স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৫

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৫
সানজিদা আক্তার মুন্নী

তৌসিররা নিজেদের বাগানের আড্ডাখানায় বসে আছে, যেখানে সবসময় আড্ডা দেওয়া হয়। সবাই সোফায় বসে আড্ডায় মেজেছে। আর তাদিরি পাশে একটা গ্লাসের কফিনের ভেতর একজন ডাক্তার প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার করছে। ডাক্তারের চিৎকার করার কারণ হচ্ছে, তাকে কফিনের ভেতর ঢুকিয়ে কতগুলো বিষাক্ত কালাচের বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছে তৌসির। সাপগুলো তার কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে মগজে চলে গেছে, পায়ে, নাভিতে, গলায়, চোখের ভেতর মারাত্মক ভাবে দংশন করতেছে। এক সময় দংশনের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ডাক্তারটি মারা যায়।

এই ডাক্তারকে মারার প্রধান কারণ হলো, সে গাদ্দারি করেছে। কী গাদ্দারি? তৌসিরের ঔষধ কোম্পানি আছে। ওর নিজের ব্যবসা বলতে দুইটি ঔষধ কোম্পানিই আছে সাথে টাউনে কয়েকটি দোকান। জীবনে যত চল-চাতুরী করেছে, তার সবকিছুর মূল মিলিয়ে কোম্পানিগুলো দাঁড় করিয়েছে। তৌসির নিজের বিজনেস এম্পায়ার ধরে রাখতে এক কৌশল নিয়েছে। এই কৌশলটা মেডিক্যাল এথিকসকে একেবারে বুড়ো আঙুল দেখায় বলা যায়। কিন্তু মার্কেটে টিকে থাকতে এটিই অলিখিত রুল।শহরের অনেক নামকরা ক্লিনিকের কিছু ডাক্তারদের সঙ্গে ওর ডিল হয়,“আপনার পেশেন্ট ভালো হোক বা খারাপ, প্রেসক্রিপশনে থাকবে শুধু আমাদের কোম্পানির মেডিসিন। রিটার্নে, প্রতিটি প্রেসক্রিপশনের জন্য আপনাদের দেওয়া হবে মোটা অঙ্কের কমিশন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডাক্তারের কাছে এটা এক্সট্রা ইনকাম, একধরনের গ্যারান্টিড বোনাস।কিন্তু এর আসল দাম চুকাতে হয় পেশেন্টকে।পেশেন্ট যখন সরল বিশ্বাসে ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকে, তখন তো সে আর জানে না তার জন্য লেখা ওষুধটা তার হেলথ কন্ডিশন অনুযায়ী নয়, বরং ডাক্তারের কমিশন টার্গেট অনুযায়ী।ফলাফল, সঠিক ডায়াগনোসিস হওয়ার পরও ভুল বা অপ্রয়োজনীয় মেডিসিন খেয়ে অনেকে রিকভারি হারিয়ে ফেলে, কেউ কেউ আরও খারাপ অবস্থায় চলে যায়।
তো, এই ডাক্তারও তৌসিরের সঙ্গে ওই চুক্তিতেই কাজ করছিল।কিন্তু গতকাল তৌসির জানতে পারে সে শুধু তার কোম্পানির মেডিসিনই প্রেসক্রাইব করেনি, বরং একই রোগের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির প্রোডাক্টও লিখে দিয়েছে!অর্থাৎ, সে এক প্রেসক্রিপশনেই দুই কোম্পানি থেকে কমিশন নেওয়ার গেম খেলছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল আরকি। তো কীভাবে তৌসির ডাক্তারের শয়তানি ধরতে পারলো? আসলে, চুক্তিবদ্ধ ডাক্তাররা আসলেই কোম্পানির মেডিসিন প্রেসক্রাইব করছে কি না, সেটা ট্র্যাক করার জন্য তৌসিরের নিজস্ব এক মনিটরিং টিম আছে একদম প্রফেশনাল সেটআপ বলতে গেলে।এই টিমের মেম্বাররা শহরের সেই সব চুক্তিবদ্ধ ক্লিনিকের ভেতর ইনফিলট্রেট করে রাখে নিজেদের।কেউ রোগী সেজে যায়, কেউ ক্লিনিকের স্টাফ সাজে।তাদের টাস্ক ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়া রোগীর প্রেসক্রিপশনটা এক ঝলক দেখে নেওয়া, বা চুপিচুপি একটা ছবি তুলে কোম্পানির সার্ভারে আপলোড করা।

গতকালও এই নজরদারি দল তাদের কাজ করছিল। দিনের শেষে যখন প্রেসক্রিপশনগুলোর ছবি তৌসিরের কাছে পৌঁছায়, তখনই ধরা পড়ে এই ডাক্তারের দ্বিমুখী শয়তানি। এ জন্য তৌসিররা ডাক্তারকে তুলে এনে এমন মৃত্যু দেয়। ডাক্তারকে মরে যেতে দেখে রুদ্র আফসোস করে বলে, “ইস! বেচারা মইরা গেল!”রুদ্রের কথায় মিনহাজ মামা মদের গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলেন, “খা***নিকির পোলারা নিজের অভ্যাসে নিজেরাই মরে।”
নাযেম চাচা চুপচাপ সিগারেট টানছিলেন। এতক্ষণ কোনো বক্তব্য রাখেননি, তবে হঠাৎ তৌসিরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখ চেয়ে বলেন, “বাবা তৌসির, তুই এগুলা বাদ দিয়া ভালো হ। তুই বিয়া করছোস, সংসার আছে তোর। আর কত দিন এই মন্দ কামে থাকবি?”

নাযেম চাচার কথায় এখানে বসে থাকা সবাই ভীমড়ি খেয়ে যান, আর খাওয়ারই তো। জিনের মুখে আয়াতুল কুরসী শুনে এমনি তো হবে! পাপের বাপ প্রায়শ্চিত্তের জ্ঞান দিচ্ছে! তৌসির নাযেম চাচার কথার তোয়াক্কা না করে তাচ্ছিল্যের সহিত উচ্চারণ করে, “মন্দ আছি, মন্দই থাকি। ভালো লোকের আবার বদনাম বেশি।”
রুদ্র তৌসিরের কথায় সায় দেয়, “হক কথা ভাই কইছো।”
নাযেম চাচা রুদ্রের কথায় মুখ বাঁকান, “এই মাদা***চুত, তুই আর ভেল্কি মারিস না।”
রুদ্র নাযেম চাচার রাগ দেখে হাসে। হেসে উদাস হয়ে গেয়ে ওঠে, “ভেল্কি মারি, ভেল্কি মারি, ছোট চাচার রাগে ফাগুনে।”

তৌসির ওদের এসব ফাউল ঝগড়ায় মন না দিয়ে নিজের জীবনের কথা চিন্তা করতে থাকে। মাঝেমধ্যে তৌসিরেরও ভবিষ্যতের চিন্তা হয়, কিন্তু এই চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ীও হয় না। সবাই হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠেছে। এরই মধ্যে তৌসির তিক্ত গলায় বলে ওঠে, “জীবনটা শেখ হাসিনার মতো হইয়া গেছি রে! যেমনিই যাই, ওমনিই বদনাম আর বিপদ।”
নুহমান তৌসিরের কথায় উচ্চ স্বরে হেসে তাল মিলিয়ে বলে, “হাসিনা আপার জীবনটা বর্তমানে মেলা কঠিন। একটাবার ভাবো তোমরা, এমনিতেই এত বিপদ। বিপদের দূর করতে যে দোয়া পড়ব, হেইডার নামও ইউনুস।”
নুহমানের বলা হঠাৎ এমন কথায় হট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। হাসির এই মুহূর্তে রুদ্র ফোন বের করে সবার চোখের সামনে একটা ভিডিও ধরে আর শক্ত সুরে বলে, “এই যে! এখন দাঁত কেলানি বন্ধ করো। গুলজার তো ভাইরাল হইয়া গেছে, এবার মেয়েরের পদ তৌসির ভাইয়ের থাইকা না নেয়।”
তৌসির রুদ্রকে এত সিরিয়াস হতে দেখে তীক্ষ্ণ চোখ চেয়ে ধারণ করে, “কী নিয়া আবার ঐ সুদানির*** পোলা ব***গা হইলো?”

রুদ্র এক্সপেইন করে, “আরে! গতকাল একটা ইন্টারভিউতে ওর বউ কথা কইছিল, তখন ঐ সময় ওর বউয়ের বুকের কিছুটা দেখা গেছিল মনে হয়। আর কোন মগা এটা ভিডিও কইরা ভাইরাল কইরা দিছে। ভাইরাল হওয়ার পর ওর বউ লাইভে ওরে লইয়া আইয়া কান্নাকাটি কইরা মানুষের নিজের পক্ষে লইয়া গেছে। এখন সবাই সমবেদনা দিতাছে। আজকের টপ সার্চ গুলজার আর ওর বউ।”
তৌসির এ কথায় মুচকি হেসে স্বল্প সময় চুপ থাকে, অতঃপর বলে ওঠে, “ঐ মাগি আর ওর জামাই নিজেদের কন্ট্রোভার্সি নিজেরাই করয়েছে। তাইলে আমিও এই খেলায় একটু শামিল হই।”
মিনহাজ মামা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কেমনে?”
তৌসির কেরামতকে ইশারা করে আর বলে, “কেরামত, ভিডিও অন কর। খালি আমারে দেখাবি আর সবাই মুখ বন্ধ রাখ।”

কেরামত কোনো প্রশ্ন না করে ভিডিও অন করে। কারণ সে জানে, তৌসির যাই করবে, সঠিকই করবে। তৌসিরের পদক্ষেপ ভুল কখনোই হয়নি আর হবেও না। কেরামত জুম করে ভিডিও শুরু করে। তৌসির রুদ্রের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে রুদ্র না বুঝেও মাথা নাড়ায়। তৌসির বলতে শুরু করে, “এগুলো আসলে বাজে জিনিস। একজন মহিলাকে এভাবে হেনস্তা করা উচিত হয়নি। আজকালকার মিডিয়ার অবস্থা তো কুকুরদের মতো হয়ে গেছে। এগুলো কেমন নীতি? মানুষ কি করে এমন সিরিয়াস কিছু নিয়েও ইস্যু ক্রিয়েট করতে পারে, জানা ছিল না। এইসব মিডিয়া বয়কট করা উচিত।”
রুদ্র মাথা ঝাঁকিয়ে দুঃখজনক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ভাই, ঠিকই বলছেন।”
কেরামত ভিডিও অফ করে দেয়। নুহমান ভুরু কোঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কী করতে চাইতাছো?”
তৌসির ঠোঁট টেনে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলে, “কেরামত, গুলজারের যেই ম্যানেজার আমাদের হইয়া কাম করে, এই ভিডিও ওরে দিয়া কবি ছলে-কৌশলে যেনো ঐ মাদারচুতরে দেখায় আর বলেমওদের ওর নিজস্ব গুপ্তচর আমার লগে আছে।”

নাযেম চাচা তৌসিরের মতলব ঠিক ধরতে পারেন না। উনি খানিকটা আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করেন, “তোর মতলবটা কী? এই ভিডিও যে ওরে যদি দেস, তাইলে ঐ সুদানির পোলা এটারে খারাপ ভাবে এডিট করে মিডিয়ায় দিব, তখন বুঝবি নে বাঁশ কেমন আর কত প্রকার।”
তৌসির নাযেম চাচার ন্যায় চপাট রাগ নিয়ে চেয়ে বলে, “এ সাউয়ার নাতি বন্ধ কর তোর বগার প্যানপ্যান। আমি যা করতাছি, তার ফল বের হইলে বুঝবি কী করছি।”
মিনহাজ মামা নাযেম চাচার দিকে তাকিয়ে বলে, “আরে তুই এত কথা কইস না। ও যা ইচ্ছা করুক। বাঁশ খাইলে আমরা লগে নাই।”
তৌসির এ শুনে তিক্ত সুরে বলে, “তোদের মতো মগা দুনিয়ায় দুইটা নাই। দেখিছ, আগামীকাল টপ সার্চে আমি থাকমু।”

রুদ্র ভুরু কোঁচকায়, “কেমনে?”
তৌসির হেসে জবাব দেয়, “শুধু দেখে যা এটা রাজনীতির খেলা এনে ব্রেনটা ইম্পর্ট্যান্ট।”
মাগরিবের পর,,,,,,
তালুকদার বাড়ির মাগরিবের পরের সময়টা মনোমুগ্ধকর। প্রতিদিনের মতোই মনের মতো আমেজে জমে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ। শতকের কাছাকাছি সদস্য সংখ্যা এই বাড়িতে, যার মধ্যে যুবক আর কিশোর ছেলেদের সংখ্যাটাই অনেক বেশি।

​মাগরিবের পর বাড়ির চারপাশের উঠোনগুলোতে আলো ঝলমলে পরিবেশ। লাইটগুলো জ্বলে ওঠায় চারদিক ফকফকা হয়ে আছে, সাথে বইছে মৃদু বাতাস। বাগানের একপাশে রয়েছে খোলামেলা রান্নাঘর। চার-পাঁচটি পিলারের ছাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা, লাকড়ির চুলা, ফ্রিজ সবকিছুর ব্যবস্থাই রয়েছে। যার যা ইচ্ছে, সে নিজেই এখানে এসে বানিয়ে নিতে পারে। এত মানুষের জন্য বাড়ির মহিলারা সবসময় চা-নাস্তা তৈরি করতে পারেন না। ঘরের রান্নাঘর থেকে শুধু মাগরিবের পর একবার আর সকালে একবার সবার জন্য চা-নাস্তা তৈরি হয়। এরপর যার যখন চা, কফি বা অন্য কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়, সে এখানে এসে নিজের হাতে বানিয়ে নেয়।

​তালুকদার বাড়ির উঠোন আর বাগান দুটোই বেশ প্রশস্ত। পাঁচতলা বাড়িটির প্রতিটি তলায় ত্রিশটিরও বেশি কক্ষ রয়েছে, আর হবেই না কেন, এত বড় বংশধর! বাড়ির এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায়। যদিও এই বাড়িটি এক যুগ আগে তৈরি, তবে এটিকে নতুন করে মর্ডান স্টাইলে মেরামত করা হয়েছে।
​আজ শুক্রবার হওয়ায় বাড়ির সব পুরুষ সদস্যই বাড়িতে উপস্থিত। এই সময় কেউ হয়তো নিজের ঘরে বসে আছে, কেউ বাড়ির ভেতরে টিভি দেখছে। আবার কয়েকজন মিলে দল বেঁধে বাগানে প্রোজেক্টর লাগিয়ে সিনেমা দেখছে। কেউ কেউ গেমিং হলে কম্পিউটারে গেম খেলায় ব্যস্ত। কেউ কেউ ব্যাডমিন্টন বা ক্রিকেট খেলায় মগ্ন। আবার কেউ কেউ চোখে কাপড় বেঁধে একজন আরেকজনকে নারকেল গাছের পাতা দিয়ে উড়াধুড়া মারার খেলায় মেতে উঠেছে। আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত তালুকদার বাড়ি। তবে এইসবেরি মধ্যে আলাদা এক সুন্দর তৈরি হয়েছে আর তা হলো বাগানের ডান দিকটায় অপার্থিব সমাবেশ। চারদিকে শিশুদের কোলাহল, পাখির কিচিরমিচির আর হালকা বাতাসে দোলছে গাছের পাতা। মাঝখানে দড়ি টেনে সাজানো হয়েছে আসন, যেখানে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছেন তালুকদার বাড়ির যারা মাদ্রাসায় পড়েন ছোট-বড় সবাই প্রায়। তাদের মুখে আগ্রহ, চোখে প্রত্যাশা।

সামনে বসে আছেন সবার প্রিয় মোল্লা চাচ্চু, কুইজ প্রতিযোগিতা হচ্ছে এখানে। আর আজকের প্রতিযোগিতার পরিচালক উনি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো লুঙ্গি , মুখে শান্ত হাসি নিয়ে প্রশ্ন করতেছেন। চলুন কিছু কুইজের প্রশ্ন আপনাদের কেও পড়াই।মোল্লা চাচ্চু প্রশ্ন করেন,
“বল তো, কোন সাহাবী দাজ্জালকে দেখেছিলেন?”
সবাই এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। ঠিক তখনই এক কণ্ঠ জোরে উঠে আসে নাম যার ইয়াহিয়া, নাজহার বড় চাচার ছোট তরফের বড় ছেলে, খালিদের সন্তান।ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “সাহাবী তামীম আদ-দারী (রাঃ) দাজ্জালকে দেখেছিলেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এক দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় একটি দ্বীপে পৌঁছে দাজ্জালের মুখোমুখি হন। পরে নবী করিম (সাঃ)-এর কাছে ফিরে এসে সব ঘটনা বর্ণনা করেন, যা হাদীসে উল্লেখ আছে।”
মোল্লা চাচ্চু হাসেন, মাথা নেড়ে বললেন

“মাশা’আল্লাহ, একদম সঠিক উত্তর!”
এরপর পরবর্তী প্রশ্ন করেন
“মুহাম্মদ (সাঃ)-এর লকব কী ছিল?”
একটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়, “আস্-সাদিকুল আমিন।”
মোল্লা চাচ্চু সন্তুষ্ট হয়ে বললেন,“জাযাকাল্লাহ! এবার বলো, কোন নারীকে রাসুল (সাঃ)-এর দ্বিতীয় মা বলা হয়?”
উপস্থিত দুজন একসাথে উত্তর দেয়,“ফাতিমা বিনতে আসাদ (রাঃ) রাসুলুল্লাহ ( সাঃ) এঁর চাচী কে।
চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে “সুবহানাল্লাহ!” সুরে।এরপর প্রশ্নের ধারা আরও গতি পায় তিনি প্রশ্ন করেন,”কোন নবী জান্নাতের হুরকে বিয়ে করেছিলেন?”
উত্তর আসে : হযরত শীস (আঃ)

উওর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চারপাশে তাকিয়ে আবারো প্রশ্ন করেন, “কোন নবী তাঁর বাবার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন?”
উওর অনেক গুলো আসে কিন্তু সঠিক মিলে না। পাশ থেকে তালহা ভাই এসে সমাবশে বসতে বসতে উওর দেন, ” হযরত উজায়ের (আঃ)-এর ছেলে বাবার চেয়ে একশো বছর বড় ছিলেন।
উওর শুনে মোল্লা চাচ্চু মুচকি হেসে আবারো প্রশ্ন ছুঁড়েন,” “নবীজির কবর কে খনন করেছিলেন?”তালহা ভাই এর সৎ ভাই তায়েব উওর দেয়,” হযরত আবু তালহা (রাঃ)।
তালহা নাম শুনে সবাই মুচকি হেসে তালহা এক নজর ভাই এর দিকে তাকান। মোল্লা চাচ্চু ফের প্রশ্ন করেন, “কোন নবীর নাম কুরআনে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ আছে?”
সবাই এক কণ্ঠে বলে ওঠে: হযরত মূসা (আঃ)!
এবার মোল্লা চাচ্চু বলেন,” চলো কুইজের মধ্যে একটু বিরতি নিয়ে পড়ি “সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী” সহীহ তিরমিযীর তিন হাজার চারশো চৌষট্টি তম হাদিসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,যে ব্যক্তি একবার সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর চারা লাগানো হবে। হাদীসটি হাসান-সহীহ-গারীব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। চলো পড়ো “সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী।’
উনার সাথে সবাই একি স্বরে পড়ে ওঠে,” সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী।”

রজনী প্রায় দ্বাদশের দ্বারপ্রান্তে নিশার প্রায় অন্তিম লগ্নে। নাজহা বেলকনিতে রাখা সোফায় বসে আছে, হাতে একটা গিটার ধরা। গতকাল যখন সবাই এসেছিলেন, তখন নাজহার প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় যা আছে সব সাত লাগেজে করে নিয়ে এসেছেন আলাদা ভ্যান দিয়ে। নাজহা দুদিন আগেই ওর ছোট চাচ্চুকে বলেছিল, “তুমি যদি পারো, তাহলে আমার সবকিছু নিয়ে এসো একদিন। আমার রুমের কাবাডে যেনো একটা সুতোও না থাকে।” নাজহার কথা মতোই উনারা নিয়ে এসেছেন। আজ নাজহাকে কয়েকদিনের সফরে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক পায়তারা করেছেন তাঁরা, কিন্তু নাজহা যায়নি। যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। কেনই বা যাবে? কি কারণেই যাবে? প্রতিটি পরিবারেই ‘ফ্যামিলি পলিটিক্স’ নামে একটা বিষয় থাকে, আর সেই ফ্যামিলি পলিটিক্সের শিকার হয় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ। নাজহা এমনই এক ইস্যুর শিকার।

সে মনে মনে পণ করেছে, যতদিন তৌসিরের অধীনস্থ রয়েছে, ততদিন তালুকদার বাড়ির ফটক পেরোবে না। ছিদ্দিক সাহেবও ফোন দিয়ে মিনতি করছেন, “আম্মা আও, ওদের সাথে চইল্লা আও। তোমার দেখিবার লাগি কলিজা শুকায়া গেছে, আম্মা আও ওগো সাথে চইল্লা আও।” এই অসহায় মিনতিও নাজহার মন গলাতে পারেনি, কারণ সে জানে যে এসব মনের কথা নয়, শুধুই বাহিরে দেখানো প্রেম। নাজহার তিনটে গিটার আছে একটা সাহেব ভাই দিয়েছেন, একটা ইকরাব আর একটা তালহা ভাই। এই মুহূর্তে নাজহার হাতে যে গিটারটি, তা তালহা ভাইয়ের দেওয়া। নাজহা গিটারের তারে হালকা আঙুল বুলাচ্ছে আর এক দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে এই ভবনময়ী বেদনার কথা ভাবছে। এই যন্ত্রণার মুহূর্তে হাজির হয় তৌসির। মুচকি হেসে সোফার সামনে রাখা ছোট্ট মোড়ায় বসতে বসতে নাজহার দিকে চোরা চোখে চেয়ে বলে, “কিতা লো আমার ডাকাইনি! তুমি গানও গাও না কিতা?”

তৌসিরের ছোঁড়া ব্যঙ্গ-বাণীতে নাজহা অতিষ্ঠতা অনুভব করে, যাকে বলে বড্ডর চেয়েও বড্ড বেশি অতিষ্ঠতা। গরম চোখে তৌসিরের দিকে তাকায়। তাকানোর উদ্দেশ্য ছিল একটা কড়া কথা বলার, কিন্তু তাকানোর পর সেই উদ্দেশ্যটা গায়েব হয়ে যায়। তৌসিরের মুখের হাসি বরাবরই সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়, একদম মন কাড়ার মতো মনোমুগ্ধকর, যাকে বলে তুলনাহীন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ। তৌসির হাসছে, ঠোঁটের কোণ বেয়ে বেখেয়ালি মতে লাল সুরুর মতো পানের পিক গড়াচ্ছে। নাজহার কঠিন চোখের চাহনি নরম চাহনিতে রূপ নেয়। তৌসিরকে পান খেতে দেখেনি, তবে জানে যে তৌসির মাঝেমধ্যে পান খায়, তাও চুন-জর্দা এগুলো ছাড়া, শুধু মাত্র পান আর সুপারি। তৌসিরের এই পান খাওয়া দেখে নাজহার ঠোঁটের কিনারায় এক চিলতি মেকি হাসি ফুটে ওঠে, তাও তার নিজের অজান্তেই। নাজহা এটা ঠিকই বুঝতে পারে যে পানের পিক পড়ছে, এ বিষয় তৌসিরের বোধগম্য হয়নি। আজ আবার তৌসিরের পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো পায়জামা একটা হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ভাব আসছে তাকে দেখে।

নাজহাকে মুচকি হাসতে দেখে তৌসির ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিতা লো, হাসো ক্যান?”
এ প্রশ্নে নাজহা কি উত্তর দিবে খুঁজে পায় না। তারপরও আলস্য ভঙ্গিতে আলতো গলায় জবাব দেয়, “বাহ, আজ তো আপনায় আলাদা আলাদা লাগতেছে।”
নাজহার বলা ‘আলাদা আলাদা’ কথাখানি বুঝতে পেরে তৌসির মনে মনে একটু খুশি হয়ে অন্তরে বুনে, ‘এই সাউয়ার মাইয়ারা থেকে তো জীবনেও নিজের প্রশংসা শোনা আমার কাম্য না, কিন্তু তারপরও আলাদা আলাদা বললো, মানে ভালোই বলতেছে। আমার মতো কাউয়ারে যে ভালো কইলো, এইডাই অনেক।’ একটু ভাব নেই, তাইলে নয়তো ইমেইজ নষ্ট হইয়া যাইব, এমনিতেও ইমেজের যে হাল। এই ভেবে তৌসির নিজের ঠোঁটের কিনারে এক তির্যক হাসি টেনে ধরে, দুই হাত উঁচিয়ে পাঞ্জাবির কাঁধের ভাঁজটা একটু টেনে তুলতে তুলতে ভাব নিয়ে রঙ্গ গলায় বুনে, “তা, হ্যান্ডসাম লাগতেছে, ঐডা কও না। আলাদা আলাদা কওয়ার কি আছে?”

তৌসিরের উচ্চারণ করা বাণী শুনে নাজহা বিরক্ত হয় নিজের ওপরই। কেন যে মুখ ফসকে বলতে গেছিলো! ধ্যাত, বেজায় বিরক্তি গ্রাস করে ওকে। বিরক্তি মেশানো শ্বাস ছেড়ে তৌসিরকে তুচ্ছতাসূচক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “জীবনে শুনছিলেন কোনো মেয়ের থেকে এই কথা যে এখন আশা করতেছেন।”
তৌসিরও জবাবে উপহাসমিশ্রিত সুরে শোধায়, “আরে, কি যে কও না আমার ডাকাইতনি! শুনছি মানে? প্রেমের প্রস্তাব পর্যন্ত দেছে অনেকে। লোক আমি মন্দ হইলেও দেখতে সুন্দর আছি বটে।”নাজহা এ শুনে মনে মনে ভাবে, ‘সে তো পাবেনি, চোখে ধরার মতো মানুষ যে।’ কিন্তু মুখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে প্রেম করেননি?”
তৌসির এ শুনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত ভাবে বলে, “আরেএ এসব ফাউল কামে আমার ইন্টারেস্ট ছিল না!”
“কেন ছিল না?”

তৌসির ক্ষীণ শ্বাস ছেড়ে শোধায়, “যুদ্ধে যাওয়া ঘোড়া কি আর বিয়াতে নাচে?”
তৌসিরের কথার মর্ম বুঝতে পেরে নাজহা পিছনে-পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর চেয়ে আফসোসের সুরে বলে, “ইসস, একটা প্রেম আপনার কপালে জুটলে আমি আপনার কপালে জুটতাম না।”
“সত্যিই আমার মতো কাউয়ার কপালে তোমার মতো রত্ন সমতুল্য ডাকাত কেমনে জুটলো, ঐটা আমি নিজেও ভাইবা পাই না।”
‘ডাকাত ডাকাত’ শুনতে শুনতে কান পচে মগজে ধরে যাচ্ছে নাজহার। আর মেনে নিতে না পেরে ক্লান্তচিত্ত হয়ে তিতো স্বরে বলে, “আমি কি ডাকাতি করলাম?”

তৌসির এবার আর প্রতি সময়ের মতো নাজহার কথায় তর্কে যায় না। উল্টো তা উপেক্ষা করে বুক চিরে মর্মের ভার নামিয়ে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে নাজহার মুখ নিরীক্ষণ করে। ইস, ওর মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেই তৌসিরের মন মোহান্ধ হয়ে যায়। তৌসির প্রায় ভুলে যায় কোথায় বসে আছে, কী তার করণীয়। নাজহার লাবণ্যে তৌসিরের আত্মা তৃপ্ততায় আচ্ছন্ন। তৌসির পলকহীন চোখে অবিরাম তৃষ্ণা নিয়ে চেয়েই থাকে নাজহার ন্যায়।

চারদিকে আলতো বাতাস বইছে, অক্টোবরের রাত বলে কথা। এরি মধ্যে চাঁদের কনকজ্যোৎস্নায় নাজহা বসে আছে। চাঁদের আলো এসে উপচে পড়ছে নাজহার মুখপানে। ওর ত্বক তুষারধবল ও স্নিগ্ধশুভ্র হওয়ায় অতি মোহময় লাগছে। এই শুভ্র লাবণ্যময়ী মুখমণ্ডলে চাঁদের আলো পড়ে এক অনুপম আভা সৃষ্টি করেছে। নাজহার চোখজোড়া তো সবসময়ই ভয়াবহ সৌন্দর্য বহন করে, এই আঁখিদ্বয় সুপ্রায় শ্যামল-মরকতমণির মতো অন্তঃসলিলা। তার-ওপর এই প্রহেলিকাময় নেত্রকোণে আজ ক্রোধের বদলে ললিত মৌনতা সঞ্চিত। নাজহার এই অবগুণ্ঠিত দৃষ্টিপাত, যাহা ক্ষণমাত্রেই তৌসিরের চিত্ত হরণ করেছে। যে এই নয়নার চাহনিতে পতিত হইবে, সে নিশ্চয়ই চিরতরে বিলীন হইবে। যে নাজহার এই সম্মোহনী দৃষ্টির ফাঁদে আবদ্ধ হবে, ধ্বংসই তার জন্য চিরন্তন রইবে।

নাজহার কেশ তরঙ্গগুলো বড্ড প্রিয় তৌসিরের। এই কেশ তরঙ্গগুচ্ছ শুধু তরঙ্গ নয়, এ তো তাম্রাভ-কৃষ্ণ কেশদাম। এই সুরঞ্জিত কেশ গুচ্ছ নাজহার কাঁধের উপর দিয়ে নেমে এসে ওর অপরাজেয় রূপকে আরও অলঙ্কৃত করে নিয়েছে। নাজহা এই মুহূর্তে সৌন্দর্যের প্রতিভূ, যার দিকে চেয়ে থেকে তৌসিরের দৃষ্টি তৃষ্ণাচ্ছন্ন এবং মোহান্ধ। তৌসিরের সত্তা নাজহার রূপে বিগলিত হয়ে গেছে। তৌসির তন্ময়চিত্তে চেয়ে রয় তো রয়-ই, আর তার এই চাহনি পলকহীন। এ চাওয়া শুধু দেখা নয়, রূপের উপাসনা। নাজহার বিহ্বলতা এতটাই তাত্ত্বিক যে তৌসিরের জ্ঞানেন্দ্রিয় নাজহার লাবণ্যের বিভায় আচ্ছন্ন। তৌসিরের মুখে কোনো বাঙ্ময়তা নেই, ও শুধু তৃষ্ণাচ্ছন্ন নয়নে এবং নিস্পন্দ দেহে নিজের নিস্তব্ধ ভাবাবেগ নাজহার রূপসুধায় ডুবে আছে।
{ কেমন হলো এই অংশটি একটু জানাবেন ভালো লাগলে এমন ভাষায় আরো লিখবো}

তৌসিরের এই চাহনিতে নাজহা মনোবিরক্তি নিয়ে বলে, “এমন গাঁজাখোরের মতো আমার দিকে তাকাবেন না!”
​তৌসির নাজহার কথার জবাবে মৃদু হেসে বলে ওঠে, “দূর ব্যাটি, গাঁজার থাইকা তোমার চোখের নেশা আরো বেশি ভয়ংকর।”

​”আমার চোখের দিকে তাকাবেন না আপনি।”
​”হাহ, না তাকিয়ে কি আর পারি? সাপের মতো সবুজ তোমার এই চোখ দুইটা মেলা সুন্দর।”
​সাপের মতো চোখ? এ কেমন তুলনা? সাপের সবুজ চোখ আছে মানল নাজহা। কিন্তু তাই বলে তৌসির ওকে এভাবে অপমান করবে? নাজহা ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলে, “আপনি আমাকে সাপ কেন বললেন?”
​তৌসির এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে উত্তর, “সাওয়ার মাইয়া, এমনে রাগ করিও না। আমি কইতাছি, সাপের মতো চোখ তোমার। সুন্দর আছে এইটাই কইলাম।”
​”আপনার বলার প্রয়োজন নেই, আপনি আমার দিকে তাকাবেনও না আর এসব বলবেনও না।”
​তৌসিরের এই সুন্দর মুহূর্তে তর্ক-বার্তা হজম হয় না, তাই কথা ঘুরাতে নমনীয় ভাষায় বলে, “হাতে গিটার যখন নিছো, একটা গান শুনাও না।”

​তার আবদার শুনে নাজহা তির্যক সুরে জবাব দেয়, “আমি পারব না।”
​তৌসির ক্ষীণ গলায় আবারো বলে, “তুমি শুনালে আমি শোনাবো। শুনাও না একটা।”
​নাজহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তৌসিরের দিকে খানিক সময় তাকায়, তারপর গিটারের তারে আঙুল বুলিয়ে স্নিগ্ধ আর কাতর সুরে গাইতে শুরু করে।

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না?
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
এ গেয়ে আকাশের দিকে চেয়ে গেয়ে ওঠে,
​মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না?​

নাজহা গান শেষ করে।​নাজহার গলায় গানটা শুনেই তৌসিরের বোধগম্য হতে দেরি হয় না এই মাইয়া তার পুরোনো প্রেমিকের প্রেমে মজছে, আর মজেই এমন বিরহের গান গাচ্ছে। তৌসির এবার নাজহাকে প্রশ্ন করে বসে, “যাকে পছন্দ করো, তার কথা মনে হলো নাকি তোমার?”
​নাজহা তৌসিরের করা প্রশ্নে মৃদু হেসে শোধরায়, “যার বাস অন্তরের অন্তস্তলেই, তাকে মনে করার প্রয়োজনই বা কি?”

​”আইচ্ছা, এখনও তারে পাওয়ার সুযোগ যদি পাও, তাইলে কি করবে?”
​তৌসিরের করা এই প্রশ্নেও নাজহা শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তৌসিরের ধারণাও নেই নাজহা কতখানি চায় তালহা ভাইকে। নাজহা নরম গলায় উত্তর দেয়, “তাকে পাওয়ার লোভ আমার পরপার অবধি থেকে যাবে।”
​নাজহার মুখের কথায় বেশ অস্বস্তি হয় তৌসিরের। কেন এই অস্বস্তি, তা তৌসিরের অজানা। তৌসির চুপ করে যায়। নাজহা আবারো বলে, “আমার ঘোলাটে মস্তিষ্ক, আমার স্থির কম্পাঙ্ক, আমার কাল্পনিক চিন্তাচিত্ত সবটাই জুড়েই সে।”
​তৌসির এবার দম বাঁধা ধীরশ্বাস ফেলে বড্ড অসহায় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, আমি কি কোথাও আছি?”
​নাজহা তৌসিরের কথায় মৃদু হেসে শোধায়, “আছেন তো, আমার বর্তমানে, আমার ভবিষ্যতে, আমার অধিনায়ক রূপে, যাকে আমার মস্তিষ্ক মেনে নিতে চাইলেও মন বারবার প্রত্যাখ্যান করে।”
​নাজহার বলা এই উক্তি তৌসিরের মনে বেশ ঝাঁকিয়ে বসে। তৌসিরের এসব বিরহের ইতি কাব্য শুনতে আর ভালো লাগে না, তাই একটু নড়েচড়ে বসে বলে, “তুমি গিটার বাজাও, আমি গাইব।”

​”কোন গানের?”
​”আমি শুরু করছি, তুমি শুইনা বাজাও।”
​এ বলে তৌসির খানিকটা ভারি কিন্তু উষ্ণ সামান্য কর্কশ গলায় শুরু করে,
“তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম,
কি দোষ দিবি তাতে?”
​এই লাইনটা তৌসির টানে দীর্ঘ করে, শব্দের মাঝে একটু কম্পন দেয়। সু-প্রায় ভেতরের কষ্টটা গলার ভাঁজে আটকে আছে। নাজহা গানটা শুনে আঁতকে ওঠে। খানিক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রয়। অতঃপর কাঁপা হাতে গিটারের তারে সুর তোলে। তৌসির যখন দেখে নাজহা সুন্দর মতো টান টেনেছে গিটারে, ও আবারো একই গলায় গেয়ে ওঠে,

​”বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই
সকাল, দুপুর, রাতে।”
তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম,
কি দোষ দিবি তাতে?”
বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই
সকাল, দুপুর, রাতে।”
এ গেয়ে আক্ষেপী গলায় একটু আওয়াজ দিয়ে গেয়ে ওঠে,
“আগুন জ্বেলেও পুড়লাম আমি,
দিলাম তাতে ঝাঁপ।
তোর আমার প্রেম ছিল রে বন্ধু,
ছিল পুরোটাই পা,,,,,প।
আগুন জ্বেলেও পুড়লাম আমি,
দিলাম তাতে ঝাঁপ।
তোর আমার প্রেম ছিল রে বন্ধু,
ছিল পুরোটাই পা,,,,,প।

একপর্যায়ে তৌসির গান শেষ করে।​তৌসিরের গাওয়ার ধরনটা ছিল একদমই বিষাক্ত, যেমনটা গায়কের গলায় লেগেছে শুনতে। একদম নিখুঁত রূপে ধারণ করেছে প্রতিটি লাইন গানের। কিন্তু নাজহার বুকে ভয় ঢুকেছে এতে। আচ্ছা, তৌসির কেন এই গান তারই সামনে গাইল? তৌসির কি জেনে গেল সব? নাহ, কীভাবে জানবে? নাজহার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। যদি তৌসির ঐ সব বিষয় অবগত হয়, তাহলে আজই নাজহার শেষ রাত। তৌসির কুকুরের মতো মারতে মারতে নাজহাকে মেরে ফেলবে। সব শেষ হয়ে যাবে, সব। নাজহা এগুলো ভেবে হাঁসফাঁস করতে থাকে। ভয়ে, আতঙ্কে ভেতর খুইয়ে যেতে থাকে। হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়ায় নিজের হাতে ধরা গিটারটি পাশে রেখে দেয়।

​এমনই মুহূর্তে তৌসিরের মনে পড়ে একটা কথা, তাই ফট করে বলে ওঠে, “তালুকদারের মাইয়া, একটা জিনিস আনছি তোমার লাইগা!”
​নাজহা ভয়ে ভয়ে ভুরু কোঁচকায়। এই কিপটে আর কীই আনবে ওর জন্য? সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী?”
​তৌসির মৃদু হেসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা আধা শুকনো নিমের ডাল বের করে নাজহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “মিসওয়াকের কথা যে বলছিলা, নাও।”
​নাজহা শান্তির শ্বাস ফেলে। যাক, ওমন কিছু না। হাত বাড়িয়ে মিসওয়াকটা হাতে নেয়। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি এটা নিমের ডাল, তবে হাতে নিয়ে বুঝতে পারে এটা নিমের ডাল, তৌসির এটাকে মিসওয়াকের শেপ দিয়ে নিয়ে এসেছে। নাজহা দাঁতে দাঁত চেপে তৌসিরের দিকে স্বল্প ক্রোধ নিয়ে চেয়ে বলে, “নিমের ডাল কেন?”
​তৌসির সহজ-সরল ভাবে উত্তর দেয়, “মিসওয়াক একটা ত্রিশ টাকা। তাই নিমের ডাল দিয়াই কইরা নেও, দাঁতের মাড়িও ভালো থাকবো।”

​নাজহা রাগ করে নিমের ডালটা ফেলতে নিয়ে বলে, “লাগবে না আপনার আমায় এনে দেওয়ার। আমার সবকিছু এনে দিয়েছে আমার পরিবার।”
​এই বলে ডালটা ফেলতে যায়, কিন্তু এতে নাজহা ব্যর্থ হয়। তৌসির ঝাঁপটি মেরে তার হাত থেকে ডালটা নিয়ে বলে, “ও, আমার চ্যাটের বাল, তোমার না লাগলে ফেলে দিও না, আমার লাগবো।”
​এ বলে ডালটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। নাজহা আর কোনো বাক্য ব্যয় করে না, চুপচাপ উঠে রুমে চলে যায়। নাজহাকে চুপচাপ যেতে দেখে তৌসির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধরায়, “রংধনুর কাছেও ওত রঙ নাই। যত রঙের রূপ আমার বউ ধারণ করে।”

এখন অতন্দ্র প্রহর, রাত্রি তিমিরের ঘন আবরণে ঢেকে রেখেছে চরাচর। সব নিস্তরঙ্গ হয়ে আছে নিস্তব্ধতার রাজত্বে।​নিদ্রাচ্ছন্ন তৌসিরকে আচমকাই ওর বিবিজান ফোন করে বাড়ির পশ্চাৎভাগে ডেকেছেন। এই স্থাণু নিশীথ প্রহরে এমন অপ্রত্যাশিত আহ্বানে তৌসিরে কৌতুহল আর বিস্ময় নিয়ে নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে এসেছে। তৌসির বেশ অবাক হয়েই পদক্ষেপ ফেলছে, কারণ বাড়ির পেছনে কোনো বসতি বা কার্যক্ষেত্র নেই ওটা একেবারেই জনমানবহীন এক শূশান জায়গা। এই নিবিড় অন্ধকারে এমন রহস্যময় আহ্বান কেন? এই প্রশ্নই ওর মনে কৌতূহলের ঢেউ তুলছে বারংবারি।​এসব আওড়াডে আওড়াতে বাড়ির পিছনে আসে।

বাড়ির পেছনের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে এসে দাঁড়াতেই তৌসির চমকে ওঠে। সেখানে টর্চলাইট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন নাযেম চাচা আর রুদ্র। তাদের সামনে, একেবারে কেন্দ্রে, তার বিবিজানও দাঁড়িয়ে আছেন উনার হাতে ধরা একটা রক্তাক্ত লোহার কুঠার । কুঠার থেকে টুপ টুপ করে রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়তেছে, এ দেখে তৌসির থমকে মনে মনে ভাবে,” এই বুড়ি আবার কারে উপরে পাঠাইলো?”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৪

​হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তৌসির চারদিকে চোখ ঘোরায়। আর তখনই ওর দৃষ্টিতে আসে একজন অর্ধবয়স্ক মহিলার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে ! মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একপাশে পড়ে আছে, আর দেহখানি পড়ে আছে অন্যখানে।​এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তৌসিরের শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। ও কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে “এ কী বিপত্তি ঘটিয়েছো বিবিজান তুমি? এ কী কাণ্ড!”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here