স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৯

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী

কনফারেন্স থেকে সোজা কুঠিরে চলে এসেছে সবাই, কেউ আর বাড়ির পথ মাড়ানি। বিবিজানও কুঠিরে আছেন। আড্ডা দেওয়ার জন্য যে আলাদা কক্ষটা রাখা, সেখানেই আসর বসেছে। তৌসির তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে বসে আছে।
তৌসিরের এই মাইন্ড গেমে রুদ্র, কেরমত, নুহমানরা তো খুশিতে নেচে নেচে কোমর ভেঙে ফেলছে। কিন্তু যার জন্য এতকিছু, সেই তৌসিরই চুপচাপ বসে আছে। তার মুখে কোনো হাসি নেই।
মিনহাজ মামা এগিয়ে এসে তৌসিরকে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে, একটু তো নাচ! তোর লাগিই তো এত উল্লাস।”
তৌসির মিনহাজ মামার দিকে চেয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলে, “এই ছিঁচকে গুলজাররে কুপোকাত করতে আমার কতগুলো পয়সা যে খরচ হইলো!”

মিনহাজ মামা হো হো করে হেসে উঠেন। তৌসিরের কাঁধে হাত রাখতে রাখতে বলেন, “আরে ব্যাটা, চিন্তা করিস না। একশো পয়সার লাভে দশ পয়সা তো ফেলতেই হয়। ওসব বাদ দে।”
নাযেম চাচাও তৌসিরকে বোঝান, “জীবনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকা ফেলতে হয়, নয়তো জেতা যায় না।”
তাদের কথায় তৌসিরের মনটা যেন একটু সতেজ হলো। নাযেম চাচা নুহমানের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন, “নুহমান, লাগা তো একটা ঝাক্কাস গান। আজ পার্টি হইবো!”
রুদ্র নাচ থামিয়ে এক লাফে নাযেম চাচার সামনে এসে দাঁড়ালো, “তাইলে গুলজারের জন্য সমবেদনার একটা গান চালাই!”
তৌসির রুদ্রের বুক পকেটে ঝুলে থাকা কালো সানগ্লাসটা বের করে স্টাইল করে চোখে পরতে পরতে বললো, “লাগা মামা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কেরমত স্পিকারে গান চালু করলো। গানের সুর কানে আসতেই তৌসির গুলজারের বদলে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বুকের ওপর হাত রেখে গানের তালে তালে গেয়ে উঠে
“আহা, কেমনে রাখি বাঁধিয়া,
বাঁধিয়া… বাঁধিয়া।
এই মনের পাখি বাঁধিয়া,
বাঁধিয়া… বাঁধিয়া।”
রুদ্র লুঙ্গির দুই কোণ দুই হাতে ধরে নাচতে নাচতে স্পিকারের গানের সাথে তাল মেলায়

“আহা, কেমনে রাখি বাঁধিয়া,
এই মনের পাখি বাঁধিয়া।
তুমি কাছে, তবু যে দূরে,
কত যে দূরে ওরে বঁধূয়া! আ আ আ আ
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে।”
গানের তালে তৌসির এক লাফে সোফার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে, বুকে হাত দিয়ে আবারও গেয়ে উঠে,
“পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে,
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে।”

রাত নয়টার কাছাকাছি “!
ঘরের দিকে আসছে তৌসির। শরীর চলছে একরকম, মন পড়ে আছে আরেক জায়গায়।​কেমন একটা বিস্বাদ লাগছে সব। সারাটা দিন কেটে গেছে অথচ নিজের ডাকাইতনি কে একবারও ঠিকমতো দেখা হলো না। তার পরিচিত ছোঁয়া, খুনসুটিতে মেতে ওঠা, বা অকারণ ফাইজলামি করে ওকে রাগিয়ে দেওয়া আজ তার কিছুই হয়নি।​এমন যান্ত্রিক দিন কি আর মনকে স্বস্তি দেয়?

​তৌসির টের পাচ্ছে, ‘নাজহা’ তৌসিরের অভ্যাসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে না, সে নিজেই একটা তীব্র, মারাত্মক অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। এমন একটা অভ্যাস, যা পূরণ না হলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসে।​শুধু এক পলক। এক পলক দেখলেই তৌসিরের মনে হয়, গোটা মহাবিশ্বের সমস্ত সুখ, সমস্ত প্রশান্তি সে যেন নিজের বক্ষে ধারণ করে নিয়েছে। এই অনুভূতিটা, এই টানটা দিনদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
​বিশেষ করে নাজহার সবুজ ওই চোখ দুটো। নাজহার ওই আখি জোড়া তৌসিরকে এক অদ্ভুত মায়ায় টানে। যে টান এখন এক মারাত্মক ‘তৃষ্ণা’য় রূপ নিয়েছে। এক পলক দেখার, শুধু এক মুহূর্ত দেখার কী তীব্র, কী সর্বগ্রাসী লোভ!​অথচ তৌসির তো এমন নয়। সে মোটেও লোভী প্রকৃতির মানুষ নয়। খুব অল্পতেই যে ছেলেটা দুনিয়া-উজাড়-করা খুশিতে মেতে উঠতে জানে, সেই তৌসির আজ এক অদ্ভুত লোভে আচ্ছন্ন। নাজহাকে দেখার লোভ। এই একটা লোভ সে কিছুতেই সামলে উঠতে পারছে না।

​ঘরের দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলো নাজহাকে এই ক্ষণিকের পলকে দেখিবার যে তৃষ্ণা, যে বুকচাপা আক্ষেপ, তা বোধহয় তৌসিরের এই জীবনে অন্য আর কোনো কিছুর জন্য কখনো হবে না।
তৌসির ঘরের দরজার সামনে খাঁড়া হয় আর খাড়া হতেই না হতেই নাজহার চিৎকার করে ওঠে। তৌসির হতভম্ব হয়ে নাজহার দিকে তাকায়। নাজহার সামনে কোল্ড স্টোরেজ অরগ্যান ট্রান্সপোর্ট বক্স পড়ে আছে আর ও ছিটকে সরে গিয়ে থরথর করে কাঁপতেছে। কোল্ড স্টোরেজ অরগ্যান ট্রান্সপোর্ট বক্সে তৌসির দুটো কিডনি রেখেছিল সকালে। বক্সটা কোথাও না নিয়ে খাটের নিচেই রেখে দিয়েছিল। তৌসির তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে পড়ে থাকা বক্সের মুখটা লাগিয়ে আবারো খাটের নিচে রাখে। নাজহার সারা শরীরে ছিকানি ধরে গেছে। নামাজ শেষে জায়নামাজ গুটিয়ে নিয়ে ওঠার সময় ওর চোখ পড়ে বক্সটা, তাই কৌতুহলবশত হাতে নেয়। নিয়ে যখন অনেক কষ্ট করে লকটা খোলে, লক খুলেই তো নাজহা তব্দা খেয়ে যায়। ভিতরে দুটো মাংসের মতো অংশ! এ দেখে সারা শরীর কাঁপতে থাকে, দেহের রগে রগে ছিকানি ধরে যায়। তৌসির বক্সটা সযত্নে রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বলে, “সব সাউয়া তোমার লাড়তে হইবো ক্যান?”

তৌসিরের দেওয়া গালিতে নাজহা এখন আর রাগ করে না উল্টো দু কদম এগিয়ে এসে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে , “এগুলো কি?”
তৌসির নাজহার থেকে কিছু লোকাতে চায় না, কারণ সে তো জানে নাজহা ওর কুকর্ম সম্পর্কে কিছু না হলেও জানে, তাই এত লুকালুকির কিছু নেইডিরেক্ট বলে দেয়, “এইটা এক খান**কির পোলা লয়ারের কিডনি।
নাজহা এ শুনে ধিক্কারের সহিত বলে ওঠে, “ছিঃ! কতটা অমানুষ আর নিকৃষ্ট মানব আপনি!”
তৌসির আর নাজহার কথায় ভুরুক্ষেপ না করে বিছানায় বসতে বসতে বলে, “নিকৃষ্ট জানাইয়াই তো হাঙ্গা বইছোছ, তাইলে এখন ভেল্কাছ কির লাইগ্যা?”

নাজহা তৌসিরের কথায় এবার চ্যাঁতে যায়, চ্যাঁতে গিয়ে ছ্যাঁত করে ওঠে, “এতটা শয়তান আপনি জানা ছিল না।”
তৌসির বিরক্তি প্রকাশ করে বুনে ওঠে, “এসব ছাড় ব্যাটি ব্যাঙ, আমার পায়ের টাখুনেতে ব্যাথা করতেছে, একটু বিক্স লাগাইয়া পা টা টিপ্পা দে তো।”
নাজহা এ শুনে বড় বড় চোখে তৌসিরের দিকে তাকায়। কী শখ! পা টিপবে নাজহা? নাজহা নাখোশ হয়ে বলে, “আমি পারব না।”
তৌসির হাই দিতে দিতে ঘাড় গর্দান মুড়ামুড়ি করতে তিক্ত সুরে বলে ওঠে, “দাও না একটু পা টা টিইপ্পা আমার সবুজ বাঘিনী ।”
সবুজ বাঘিনী শুনে নাজহার রাগ হয় সবসময় তৌসির ওকে ফালতু ফালতু নামে ডাকে এখন ডাকতে ডাকতে সবুজ বাঘিনী। সবুজ বাঘ হয় নাকী? নাজহা তৌসিরের অনুরোধে দাঁত চেপে বলে, “পায়ের বদলে গলা টা টিপে দেই, হবে?”

তৌসির সটান হয়ে হেলেদুলে শুতে যাচ্ছিল, কিন্তু তা হলো না। নাজহার এমন কঠোর কথায় এক লাফে উঠে বসে বিতৃষ্ণায় ধমকে ওঠলো, “ধুর বৈজ্জতনি! ঠাডা পড়ুক তোর, এই ঠাডা পড়া জবানে জামাইরে এসব কস!”
এ বলে আবারো সটান হয়ে শুয়ে যায়। নাজহার মন চায় না তৌসিরের পা ছুঁতে, কিন্তু মন না চাইলেও মস্তিষ্ক বারংবার মনে করিয়ে দেয় গতকাল তৌসির নিজের বুকে নাজহার পা রেখেছিল, নাজহার পায়ে চুমু অবধি খেয়েছিল। নাহ, এখন তৌসিরের সাথে বেবিচার হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছে না থাকতেও ওয়ারড্রবের ওপর থেকে মালিশের কৌটা নিয়ে তৌসিরের পায়ের কাছে এসে বসে। তৌসির নাজহাকে নিজের পায়ের কাছে দেখে ভুরু কোঁচকায়, আপন মনে ভাবে, ‘সত্যি আমার ডাকাইতনি আমার সেবা করব? সত্যি করব? সবি দয়ালের দয়া! আহা, কি সুখ আমার।’
নাজহা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, “কোন পায়ে?”

তৌসির সুন্দর করে উওর দেয়, “ডান পায়ে গো।”
নাজহা তৌসিরের এমন মিষ্টি কথায় ভেংচি দিয়ে তৌসিরের দিকে তাকায় আর বলে, “এ্যাহ! কি নাটক।”
তৌসির নাজহার এই বাচ্চামি দেখে মুচকি হেসে ওঠে। এই প্রথম ম্যাচিউরিটির সীমানা পার করে কোনো কিছু বললো নাজহা। নাজহা তৌসিরের পায়ে বাম লাগিয়ে আলতো হাতে মালিশ করতে থাকে। তৌসির আবেশে চোখ বুঁজে নিতে নিতে নাজহাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, “তোমার এই আলতো ছোঁয়া বৃষ্টির ফোঁটার চেয়ে নরম গো টুনির মা।”
নাজহা তৌসিরের কথায় মুচকি হাসে। তৌসিরের পায়ের দিকে ওর চোখ পড়ে। এক হাতে মালিশ করতে করতে অন্য হাত বাড়ায় তৌসিরের টাখনুর উপরের তৌসিরের ফর্সা পায়ে। কালো কুচকুচে লোমগুলো বড্ড আকর্ষণীয়। নাজহা তৌসিরের পায়ে আঙুল দিয়ে রেস কাটতে কাটতে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কাতুকুতু আছে আপনার?”

তৌসির এবার কিভাবে বুঝাবে তার কাতুকুতু নেই, কিন্তু যখন নাজহা তাকে ছুঁয়ে দেয় শরীর জীম ধরে যায়, দেহের প্রতিটি স্নায়ু তড়তড় করে কাঁপতে শুরু করে পুরুষালি লজ্জায়। তৌসির নিজের অনুভূতিকে সামলিয়ে আলতো হেসে ধারণ করে, “না, কাতুকুতু লাগে না। কিন্তু যখন তোমার ছোঁয়া শরীরে লাগে, তখন দেহের প্রতিটা কোষ কাঁপতে থাকে।”
নাজহা এ শুনে ভেলাসভাবে বলে, “এ্যাহ! আমি মনে হয় কারেন্ট যে আমার ছোঁয়ায় আপনার শরীরে কাঁপবে!”

“বললাম না, তোমার ছোঁয়া বৃষ্টির ফোঁটার চেয়েও নরম, আবার তার প্রভাব বিদ্যুৎের ঝটকার ন্যায় তীক্ষ্ণ।”
নাজহা তৌসিরের কথায় আর কিছু বলে না। তৌসিরের পায়ে মালিশ করা শেষে তার পায়ের আঙুল গুলোও টেনে দিতে থাকে। পায়ের আঙুল টেনে দিতে দিতে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আপনার পা প্রথমবার ছুঁয়েছি, দিন এবার আমায় সালামি দিন।”
তৌসির এ শুনে বুক পকেট থেকে একটা দু টাকার সিকি বের করে নাজহার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, “নাও, এই লজেন্স কিনে খেয়ে নিও।”

তৌসিরের দেওয়া কয়েনটা নাজহা হাত বাড়িয়ে হাতে নিয়ে দেখে যখন দেখে দু টাকা! মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। সিকিটা ফের তৌসিরের বুকের উপর ছুঁড়ে মেরে বলে, “থাক, প্রয়োজন নেই, ছোটলোক কোথাকার!”
তৌসির সিকিটা আবারো পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে, “প্রয়োজন না থাকাই ভালো, ঘরের বউ তুমি। তোমার হাতে টাকা থেকে কি হইবো!”
নাজহা তৌসিরের সাথে আর তর্কে জড়ায় না, কারণ তৌসিরের সাথে তর্কে ও কেন, ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ পারবে না। তৌসির এবার নিজের পা সরিয়ে নিতে নিতে বলে, “যাও, হাত ধুয়ে আসো, আর লাগতো না।”
নাজহা চুপচাপ উঠে মালিশের কৌটোটা জায়গা মতো রেখে দেয়। অতঃপর ওয়াশরুমে প্রবেশ করে হাত ধুয়ে, ওযু করে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে হাত-মুখ মুছে হাতে-পায়ে-মুখে অলিভ অয়েল তেল মেখে রুমের লাইটটা অফ করে আলগোছে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ে। তৌসির ওকে এত সকালে শুয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “এই, তুমি ঘুমাইয়া যাইতাছো ক্যান? ভাত খাইবা না?”
নাজহা কাঁথা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে ওঠে, “না, খাব না।”

“ক্যান খাইবা না?”
“আমি ইফতার করে নিছি, তাই খাবো না।”
“রোজা ছিলা?”
“হ্যাঁ।”
“কিসের রোজা?”
“এমনি রেখেছি, ইচ্ছে হয়েছে তাই।”

ব্যাস! এরপর দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। কিছু মুহূর্ত নীরবতায় কেটে যায়। তথাপি, তৌসিরের কি আর নীরবতা পছন্দ? সে চঞ্চল মানুষ, তার ক্ষণে ক্ষণে চঞ্চলির অভ্যাস। তৌসির হাত বাড়িয়ে নাজহাকে এক টানে নিজের বক্ষের উপর নিয়ে আসে। নাজহা অবাক হয় না, কারণ সে জানে তৌসিরের এটা অভ্যাস নাজহাকে বুকের ভেতর না নিয়ে বিয়ের পর অবধি না ঘুমায়নি। তৌসির নাজহাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। নাজহার দম বন্ধ হয়ে আসছে, তাই বিরক্ত হয়ে বলে, “ছাড়ুন তো, একটু ফস করে ধরুন।”

তৌসির নাজহার বিরক্তি প্রকাশে নাজহাকে ছেড়ে দেয়, কিন্তু একেবারে ছাড়ে না। নাজহার মাথাটা নিজের বালিশে রেখে নিজেই নাজহার গলায় মুখ গুঁজে দিতে দিতে নাজহাকে জিজ্ঞেস করে, “আমার ছোঁয়া পছন্দ না বুঝি?”
তৌসিরের করা প্রশ্নে নাজহা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে রয়, তারপর শোধায়, “পছন্দ না, ভারী অপছন্দ। কিন্তু আপনার ছোঁয়ায় এখন আর গা গুলায় না, অশান্তি অনুভব হয় না, বরং এক আবেশ উপলব্ধি হয়।”

নাজহার বলা এই কথাখানি তৌসিরের অন্তরের অন্তস্তলে গেঁথে যায়। যাক, সেদিনের মতো শুনতে হয়নি, ‘আপনার ছোঁয়া ঘেন্না লাগে’। তৌসির সন্তুষ্ট হয়ে নাজহার গলায় বারকয়েক বার আলতোভাবে দাঁত বসায়। তৌসিরের এই কান্ডে নাজহা কেঁপে ওঠে। ওর দুই কাঁধের শার্ট খাবলে ধরে অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক গলায় উচ্চারণ করে, “তৌসির, এমন করবেন না, কষ্ট হয়। আপনার দাঁড়িগুলো আমার শরীরে চামড়া ঝলসে দেয়, তারওপর আপনি কামড় দিচ্ছেন।”
তৌসির নাজহার এই অনুরোধ রাখে, ফের দাঁত বসায় না। নীরবে শুধু একের পর এক প্রগাঢ় চুমু আঁটতে থাকে নাজহার গলায়। নাজহা তৌসিরকে বাঁধা দেয় না। তৌসির নিজের মন ভরিয়ে নেয়। একপর্যায়ে নাজহা ওকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি খাবার খাবেন না?”

তৌসির ফিসফিসিয়ে উওর দেয়, “খাবো একটুপর।”
“যান গিয়ে সবার সাথে খেয়ে নিন। আপনি না খেলে আম্মা আপনার জন্য অপেক্ষা করবেন, নিজেও খাবেন না, সারারাত পড়ে আছে এসবের জন্য।”
“বাহ, আমার আম্মার জন্য তোমার এত মায়া?”
নাজহা এ প্রশ্নে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে শোধায়, “এই বাড়িতে সবাই আমায় একটু অন্য চোখে দেখেন, ছিটফিটি করেন। শুধু আপনার আম্মা আর সিমরান, সিমরানের আম্মা ছাড়া। তাই একটু মায়া তো তাদের প্রতি আমার আছেই!”
তৌসির নাজহার কথায় মুখ তুলে ওর চোখে মোহাবিষ্ট চোখে চোখ রেখে এবার জিজ্ঞেস করে, “তোমার লগে কেউ খারাপ আচরণ করে? কে করে? কও আমারে?”

নাজহা আবারো দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে বলে ওঠে, “না, তেমন কিছু না। আমি চুপচাপ থাকি তো, তাই হয়তো তারাও আমার সাথে অত বেশি মেশার চেষ্টা করে না, ব্যাস এতুটুকুই।”
তৌসির নাজহার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর নরম হাতের পাতায় চুমু খেতে খেতে বলে, “তোমারে কিছু কইলে আমারে কইও, আমি দেইখা নিব। তুমি অযথা তর্কে জড়াইয়ো না, কারণ তুমি তর্কে জড়ালে খারাপ তুমিই হইবা। নতুন বউ তুমি, তর্কে তোমায় মানায় না। ছয়-সাত মাস যাক, তারপর তুমি রাজত্ব করিও, সমস্যা নাই।”

নাজহা এক দৃষ্টিতে তৌসিরের কথাগুলো শোনে। কথাগুলো শুনে মৃদু হেসে বলে, “আমার কারো সাথে চুলোচুলি করার শখ নাই।”
তৌসির নাজহার এই কথায় আর অন্যকিছু শোধায় না। আলতো হাতে নাজহার ডান গালে হাত ছুঁয়ে বাম গালে মন ভরে একটা চুমু খায়। তৌসিরের ঠোঁটের ছোঁয়ায় নাজহা চোখ বুঁজে নেয় আবেশে, কিন্তু তারপরও বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “উমম, সরুন তো, দরজা খোলা, কেউ এসে যাবে।”
তৌসির ওর গালে আরো জোরে চুমু খেতে খেতে ফিসফিসিয়ে বলে, “কে আসবে? আমি এখন বিয়াইত্তা, তাই কেউ আমার ঘরে অনুমতি না নিয়া ঢুকবো না।”
“আর কেউ না আসলে, আপনার বিবিজান ঠিকই চলে আসবেন। ছিঃ, লজ্জা নেই উনার! সেদিন কীভাবে ঘরে ঢুকে পড়লেন?”

“আরে ব্যাটি সাউয়া, সেদিন তো জরুরি দরকার আছিলো তাই ঢুকছেন।”
“প্রয়োজন ছিল বলে এভাবে বিবাহিত নাতির ঘরে ঢুকে পড়বেন? আমরা কত আপত্তিকর অবস্থায় ছিলাম! ছিঃ!”
“আরে, তুমি এসব নিয়া ভাইবো না। এমন সিন বিবিজান প্রতিদিন দেখেন, তাই উনার লজ্জা লাগতো না।”
“হ্যাঁ, জানি ওরা পতিতা, কিন্তু আমি তা নই। তাই আমার লজ্জা লাগবে, সাথে রাগও হবে। উনি ভুল করেছেন।”
তৌসির নাজহার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “ভুল তো তোমার। তুমি দরজার ছিটকিনি ক্যান খুইলা রাখছিলা?”
নাজহা তৌসিরের এই দোষারোপ দেওয়া দেখে বলে, “এখন দোষ আমার হয়ে গেল? ভুল আমি করিনি! আপনার বিবিজান করেছেন।”

তৌসির নাজহার মুখ বন্ধ করতে আর তর্কে জড়ায় না। চুপচাপ নাজহার পদ্মধর অধর জড়োয় নিজের ঠোঁট ঠেসে ধরে। আজ এই প্রথমবারের মতো নাজহার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়েছে তৌসির। নাজহার ঠোঁটের স্বাদ নিতে থাকে সে মন ভরে। ক্ষণিকের আবেশে হারিয়ে ফেলে তৌসির নিজেকে। নাজহাও আর বাঁধা দেয় না। বাঁধা দেওয়ার অধিকার যে তার নেই, এটা তৌসিরের চাওয়া, তৌসিরের পাওনা। নাজহা চোখ বুঁজে নিয়ে দুই হাতে তৌসিরের শার্টের কলার খামচে ধরে। কিছু মুহূর্ত পর তৌসির নাজহার ঠোঁট ছেড়ে দেয়। নাজহাকে ছেড়ে দিয়ে স্বল্প ভয় নিয়ে নাজহার চোখের দিকে তাকায়। বেহুশির তালে এই আকাম তো করে নিলো, এখন যদি নাজহা ওকে দোষারোপ করে? তাহলে তৌসিরের তো মান-ইজ্জত রইবে না। যতই বউ হোক, তার সাথে এমন জোরাজোরি করা উচিত না। নাজহা যদি এখন এর জন্য কেঁদে বসে? তাহলে কী হবে? তৌসির কি একটু বেশি করে নিলো? নাজহা তো সময় নিয়েছে, তাহলে এত তাড়াহুড়োর কী ছিল? অন্যদিনের তুলনায় নাজহাকে আজ বেশি জ্বালিয়ে ফেললো না তো সে? নাজহা কি এবার রাগ করবে? তথাচ তৌসিরের এই ভাবনায় ব্যঘাত ঘটিয়ে নাজহা আশ্চর্য এক বাণী শোনায়, “ভয় পাবেন না! আজ থেকে আপনার অধিকার আপনার। আমি বাঁধা দিব না। আমি অতটা কমবয়সী নই যে নিজের স্বামীকে তার অধিকার তাকে দিতে পারব না।”

নাজহার কথায় তৌসির বাকরুদ্ধ হয়ে নাজহার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, ‘কোনো গাদ্দারির প্ল্যান করতাছে না তো আমার ডাকাইতনি?’ কিন্তু মুখে নাজহাকে শোধায়, “তুমি সত্যি বলতাছো তো?”
নাজহা হ্যা-বোধক মাথা নাড়িয়ে উওর দেয়, “হুম, আমি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি।”
তৌসির এ শুনে মৃদু হেসে বলে, “তাহলে আজ
নাজহা তৌসিরের কথায় না-বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, আজ না, আগামীকাল।”
“ক্যান, আগামীকাল ক্যান?”

নাজহা মুচকি হেসে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে বলে, “আজ যে কোনো প্রস্তুতি নেই, তাই আগামীকাল। আগামীকাল রাতে আপনি সব কাজ ফেলে একটু আগেভাগেই ঘরে ফিরবেন। আমি ততক্ষণে এশার নামাজ শেষ করে প্রস্তুত হয়ে নিব। পরনে জড়াবো আমার একটা সাদা শাড়ি, যার পাড় সোনালী আভায় জড়ানো আছে। দু’চোখে কাজলের একটি সূক্ষ্ম রেখা টেনে নেব। আর হ্যাঁ, আমার পায়ে থাকবে একটা রুপোর নূপুর। এ নূপুর জোড়া আব্বার দেওয়া দু’বছর আগের। নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ অপেক্ষায় গুনবে আপনার আগমনী সুর। আপনার কাজ শুধু এটুকুই আসার সময় এক হাতে নিয়ে আসবেন একগুচ্ছ নীলকাঞ্চন, আর অন্য হাতে এক গুচ্ছ মাধবীলতা। আর নিয়ে এসে আমার দুই হাতের মুঠোয় অঞ্জলি ভরে সেই ফুল তুলে দিবেন, সাথে আপনি এই পুরো ঘরটা ভরিয়ে দেবেন স্নিগ্ধ কাঠগোলাপের সৌরভে পারবেন তো?”

নাজহার এই আবদার শুনে তৌসির স্তব্ধ হয়ে নাজহার দিকে চেয়ে থাকে। এই আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তৌসিরের নেই। তারপরও হিসাব-নিকাশের একটা বিষয় আছে না? তৌসির মনে মনে হিসেব করে নেয় শাড়ী, নূপুর সবই তো নাজহার। ওর শুধু ফুল নিয়ে আসতে হবে। ফুলগুলো কিনতে টাকা দিতে হবে না, কুঠিরের বাগানে ফুল আছে, সেখান থেকে নিয়ে আসবে। তৌসির হিসেব মিলিয়ে দেখে এতে ওর এক পয়সাও খরচ হওয়ার নয়, তাই স্নিগ্ধ গলায় বলে, “পারব! তুমি সত্যি আমার হবে তো?”

নাজহা এ প্রশ্নে সামান্য রাগ নিয়ে বলে, “তো এতক্ষণ কি আমি মিথ্যা বললাম? এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন!”
তৌসির এতে বলে ওঠে, “ও আমার সাউয়া, এমনে ছ্যাঁত করে ওঠো ক্যান? আমি কনফার্ম হচ্ছিলাম।”
নাজহা তৌসিরকে আর কিছু বলতে যাবে, তখনি বাইরে থেকে নাযেম চাচার আওয়াজ আসে, “মা নাজহা, আমার ভাতিজা কি এখানে আছে? একটু পাঠাবে ওকে?”

তৌসির নাযেম চাচার ডাকে বড্ড বিরক্ত হয়। বিয়ের এতদিন পর বউয়ের সাথে একটু ভালো সময় কাটানোর ভাগ্য কপালে জুটেছিল, কিন্তু তা আর হলোই না। তৌসির আওয়াজ দিয়ে তেঁতো গলায় বলে ওঠে, “ধুর হালার হালা বিশ্ব বদমাশ! দেখতাছোছ লাইট অফ করা, তারপরও ডিস্টার্ব মারাইতাছোছ? তোরে সান্ডার তেল খাওয়াইয়া মারা উচিত।”
নাযেম চাচা তৌসিরের গালি শুনে নিজের মুখও খারাপ করে বলে ওঠেন, “এ,! তোরে সাউয়া মারাবার ইচ্ছে আমার নাই, তাড়াতাড়ি আয়, দরকার আছে।”

তৌসির আর কী করবে? এত জরুরি তলবে তো যেতেই হয়, তাই আর কথা না এগিয়ে নাজহার ঠোঁটের কিনারায় একটা হালকা চুমু খেয়ে উঠে যায়। রুম থেকে বেরিয়ে এসে নাযেম চাচার সামনে দাঁড়ায় আর জিজ্ঞেস করে, “কিতা রে মাঙ্গের নাতি, কিতা হইছে তোর?”
নাযেম চাচা দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, “লুঙ্গির গিট খুল তো।”
তৌসির হঠাৎ এ শুনে হালকা রাগ দেখিয়ে বলে, “ধুর হালার হালা বদমাশ! লুঙ্গি খুলতাম ক্যান?”
নাযেম চাচা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে ওর লুঙ্গির গিট খুলতে খুলতে বলেন, “আমার জাইঙ্গা তুই পড়সোস না? দে তাড়াতাড়ি খুইল্যা দে।”
তৌসির নাযেম চাচার হাত সরিয়ে দিয়ে লুঙ্গি ঠিক করতে করতে মৃদু বিষণ্ণ বিরক্তি নিয়ে বলে, “হালা ছোটলোক, তোর লজ্জা করে না ভাতিজার লুঙ্গি ধইরা টানাটানি করতে?”
নাযেম চাচা উগ্র গলায় বলেন, “তো তোর লজ্জা করে না চাচার জাইঙ্গা চুরি করে পইড়া নিতে? হালা কিপ্টা, কিনছ না ক্যান একটা?”

তৌসির নাযেম চাচার কথায় বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি চুরি করে পড়ি নাই। সকালে ছাদে মেলা পাইছি তাই কনফারেন্সে যাওয়া লাইগ্যা পইড়া নিছি।”
“এখন খুইল্যা দে, আমার মাত্র দুইটাই। একটা আমার পড়নে, এখন আমি গোসল কইরা আরেকখানে যামু।”
“সাউয়ার সাউয়ার কথা মারাইস না। কাইল গোসল কইরা ধুইয়া দিমু নে।”
“না, ধোয়া লাগত। এক্ষুনি দে।”
তৌসির নাযেম চাচার এমন জেদ দেখে এবার ধমক দিয়ে বলে, “ও আমার চ্যাটের বাল! কইলাম তো কাইল দিমুনে। এখন এমনি পইড়া নে, আমিও তো সবসময় খালিই থাকি।”
নাযেম চাচা ওরে উল্টো ধমক দিয়ে বলেন, “তোর মতো বেহায়া না আমি যে টাকার লাইগা জাইঙ্গা পড়মু না। তাড়াতাড়ি খুইল্যা দে।”

তাদের এই বিতর্কের মাঝে ধ্রুব পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। কানে ওর ইয়ারফোন গোঁজা, গান শুনছে আরকি। তৌসির ওকে দেখে ডাক দেয়, “এ ধ্রুব, এমনে আয় তো।”
ধ্রুব এ শুনে থেমে যায়। ভুরু কুঁচকে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিতা?”
তৌসির জবাবে বুনে, “তোর কাছে আছেনি এক্সট্রা লুঙ্গির নিচে পড়ার লাইগা?”
ধ্রুব হ্যা-বোধক মাথা নাড়িয়ে উওর দেয়, “আছে!”
তৌসির ‘আছে’ শুনে ধ্রুবকে বলে, “তাইলে আজকের লাইগা ছোট বদমাশরে একটা দে তো। আমি ওর টা পড়ছি বলে এখন পড়নে থাইকা খুলে নিতাছে।”
ধ্রুব এ শুনে তীক্ষ্ণ চোখে নাযেম চাচার দিকে তাকায় আর বলে, “ক্যান, আমারগুলোই তো ছোট চাচা পড়ে। তার নিজের আছে নাকি?”

তৌসির এ শুনে আড় চোখে নাযেম চাচার দিকে তাকায়। ধ্রুব নিজের মতো চলে যায়। নাযেম চাচা তৌসিরের তাকানো দেখে এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকেন। তৌসির এবার তেতো হয়ে বলে, “নিজে মাইনষের জিনিস পড়ছ, আর আমারে আইসা ডায়লগ মারস! বিশ্ব বেঈমান! তোরে সান্ডা খাওয়াইয়া মারা উচিত।”
তাদের এই কথাবার্তার মাঝেই হাজির হোন মিনহাজ মামা আর রুদ্র। রুদ্র তাদের এভাবে তর্ক করতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কিতা অইছে? এমনে তর্কাতর্কি কির লাইগা করো?”
তৌসির রুদ্রের কথায় উওর দেয়, “আরে আর কি কমু! ছোট চাচা নিজে মাইনষের জাইঙ্গা আনিয়া পড়ে, আর সেই জিনিস আমি পড়লেই আমার পড়নে থাইকা টাইনা নেয়।”

মিনহাজ মামা নাযেম চাচার পক্ষ ধরে বলেন, “হ্যাঁ, তো নিত না? তুই সারাটাজীবনি তো এমন কইরা কাটাইলি। বিয়ে-শাদি করছোস, এবার একটু কিপ্টামি টা ছাড়।”
তৌসির মিনহাজ মামার এই পক্ষটানা দেখে কপাল কুঁচকে বলে, “এত চপ্পার-চপ্পার করিস না রে মাঙ্গের পোলা, যে লুঙ্গিটা পইড়া আছো ঐটাও আমার।”
রুদ্র এবার বলে ওঠে, “আচ্ছা, এগুলা বাদ দাও। বিবিজান ডাকতাছে খাইতে, চলো। আর ছোট চাচা, তোমার যা ভাই পড়ছে ঐডা আমার থাইকা নিয়া নিও।”
নাযেম চাচা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলেন, “হ, চল। খাইয়া আবার কুঠির যাইতে হইবো। আইজ তো ঝাক্কাস গরম পার্টি আছে।”

এ বলে তৌসিরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, “আইজ তুইও আয়। আমি আর মিনহাজ যামু। ওখানে আম্মা বিদেশী পার্টির লাইগা নয়া নয়া নর্তকী আনছে। একটু মজা করবিনে, আয়।”
তৌসির সামনে পা ফেলতে ফেলতে নাযেম চাচার দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে, “তোমাদের মতো অত কুঁয়া ভরা উত্তেজনা আমার নাই যে ঘরে চাঁদ রাইখা পাদের পিছনে দৌড়ামু। আমার লাইগা আমার বউই যথেষ্ট।”
মিনহাজ মামা এ শুনে অসহায় ভঙ্গির ভান করে বলেন, “তোর তো ব্যাটা ঘরে চাঁদ আছে, কিন্তু আমাগো নাই দেইখাই পাদের পিছনে পইড়া থাকি।”
রুদ্র জবাবে বলে, “তো আনো না ক্যান ঘরে চাঁদ? বুড়া হইয়া যাইতাছো কিন্তু বিয়া করতাছো না। তোমরা বিয়া-শাদি করলে আমার পথটা একটু ক্লিয়ার হয়।”

নাযেম চাচা রুদ্রের কথায় ওর দিকে আড় চোখে চেয়ে বলেন, “তোর তো লাইন ক্লিয়ারই আছে ব্যাটা। আম্মা হ্যাঁ বললেই সিমরান তোর। কিন্তু আমাগো কে বউ দিব? না আছে সুন্দর একটা চেহারা, আর না আছে সুন্দর একটা চরিত্র তোগো দুইটার। আর যাই হোক, একটা সুন্দর চরিত্র আছে, আমাগো তো ঐটাও নাই।”
তৌসির বিরক্ত প্রকাশ করে, “বিয়া কইরা নেও, তাইলে দেখবা বউয়ের আসক্তিতে অন্য নারীর ভূত মাথা থেকে এমনি ঝইড়া যাইব।”

বেলকনিতে অন্ধকারের মধ্যে সোফায় চুপটি করে বসে আছে নাজহা, আকাশ পানে চেয়ে।
​দিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই, কিন্তু রাতটা কেমন ভেজা চাদরের মতো জড়িয়ে আছে চারপাশকে। বেলকনির গ্রিল বেয়ে এখনও ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে, বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ এঁটে আছে । এই ভেজা, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারের মধ্যেই সোফায় গুটিয়ে বসে আছে নাজহা।
​ওর কোলে পড়ে আছে ওর প্রিয় গিটারটি। আঙুলগুলো আলতো করে তারের ওপর রাখা, কিন্তু কোনো সুর তৈরি হচ্ছে না। নিস্তব্ধতা ভাঙার কোনো ইচ্ছেই যেনো নাজহার নেই।

​মাঝে মাঝে একটা দমকা বাতাস এসে নাজহার খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। নাজহারের সেদিকে খেয়াল নেই। ওর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে। এই নিকষ কালো ক্যানভাসে সে কী খুঁজছে, তা কেবল সে-ই জানে। চারপাশের এই শীতল, ভেজা নিস্তব্ধতার সাথে ওর ভেতরের জগতটার অদ্ভুত এক মিল। শুধু গিটারটাই যা বেসুরো, বোবা হয়ে পড়ে আছে।
​তৌসির বেরিয়ে যাওয়ার পর নাজহারের ফোনে কল আসে ওর ভাই নাজহারের। বেশ কিছু সময় তার সাথে কথা বলে। এই পৃথিবীতে বর্তমানে একমাত্র ‘আপন’ বলতে যদি কেউ থাকে, তবে সে তার ভাই নাজহার। মায়ের সাথে কথা হয় না, কিন্তু নাজহারের সাথে দিনে অন্তত তিন-চারবার কথা না হলে চলে না। এই একটা মানুষের সাথে কথা বললেই কেবল নাজহা একটুখানি শান্তির খোঁজ পায়।

​ওর ভাইটা বড্ড বুঝদার। এই বয়সেই সারাদিন পড়াশোনা আর নিজের ছোটখাটো আবিষ্কার নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মহাবিশ্ব, নক্ষত্র এসব নিয়ে ওর আগ্রহের শেষ নেই। ওদের মায়ের মতো নয় সে।
​মা তো দ্বিতীয়বার বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। সেই সংসারে আরও তিনটি সন্তান। যদিও সেই ভদ্রলোকও আর বেঁচে নেই, তবু সেই নতুন ভাইবোনদের সাথে নাজহার কোনোকালেই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। সে কারো সাথেই তেমন মেশে না।
​নাজহারের জগতটা খুব গোছানো। নিজের পড়াশোনা, তার ছোট্ট টেলিস্কোপটা দিয়ে রাতের আকাশ দেখা, নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা এই নিয়েই সে মগ্ন। আর এই সবকিছুর ফাঁকে, রুটিন করে দিনে কয়েকবার সে তার এই বোনটির খোঁজ নেয়। ব্যাস, এতটুকুই তার জীবনের রুটিন।
​নাজহা এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবার গিটারের তারে হাত বুলিয়ে সুর তোলে:

কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে,
যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে,
চোখ ভাঙ্গা ঘুমে তুমি, খুঁজো না আমায়;
আশেপাশে আমি আর নেই!
আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ,
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ।
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি,
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরবো না, না, না,
না, না, না, না, না, না, না, না…
এই জাহাজ মাস্তুল ছারখার,
তবু গল্প লিখেছি বাঁচবার
আমি রাখতে চাই না আর তার
কোনো রাত-দুপুরের আবদার।
তাই চেষ্টা করছি বার-বার,
সাঁতরে পাড় খোঁজার…!!
না-না-না-না-না-না-না-না-না-না।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৮

তৌসির খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে এসেছিল নাজহাকে একটু জ্বালাবে বলে, কিন্তু বেলকনির দরজায় পা রেখে যখন নাজহাকে এত নীরবে গান গাইতে দেখে, তখন আর জাউরামি করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় না বিধায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মুগ্ধ হয়ে নাজহারের গলায় গানটা শুনে আর মনে মনে বলে, ” আমার ছিনালের গলাটা চোখ আর চুলের মতেই মারাত্মক সুন্দর।”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here