স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২
সানজিদা আক্তার মুন্নী

নাজহা চিৎকার করে উঠে বসে। ঘুমের মধ্যে পায়ে ব্যথা পেয়ে নাজহা থতমত খেয়ে উঠে আর চট পাওয়া চিৎকার করে উঠে । তৌসির ছিটকে সরে গিয়ে জিভে কামড় দিয়ে বলে, “হায় রে ডাকাতি করে ফেলছি রে, তালুকদারের মাইয়ার ঠ্যাং মনে হয় শেষ রে।”
এ বলে তাড়াতাড়ি গিয়ে রুমের লাইট অন করে তাড়াতাড়ি নাজহার কাছে এসে বসে।নাজহা আর চিৎকার করে না হুসে থাকলে এমন সামান্য ব্যাথায় চিৎকার করতো না কিন্তু ঘুমের মধ্যে ছিলো তাই করেছে। অল্প ব্যাথায় ন্যাকামি করার মেয়ে সিদ্দিয়া নয় বটে। নাজহা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে নাক-মুখ কুচকে ব্যথা সহ্য করে নেয়। তবে মনে মনে ভেবেই নেয়, “এই লোক বিয়ের দিন রাতেই ল্যাংড়া করে দিয়েছে, না জানি এ জীবন না কবে নিয়ে নিবে?”
তৌসির এক ঝলক নাজহার পায়ের দিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি ওয়্যারড্রোবের উপর থেকে বাম নিয়ে এসে নাজহার সামনে বসে।হাত বাড়িয়ে নাজহার পায়ে হাত দিতে যায় কিন্তু নাজহা পা সরিয়ে নিয়ে বলে, “থাক থাক থাক, আমি লাগিয়ে নিচ্ছি!”

নাজহাকে ‘থাক থাক’ করতে দেখে তৌসির বিঘ্ন স্বরে বলে, “তোমার পা সালামি নেওয়ার লাইগা ধরছি না, তাই থাক থাক মারাইও না।”
নাজহা কথাখানি শুনে খানিকটা রেগেই তৌসিরের হাত থেকে চিলের মতো টান দিয়ে বামটা নিয়ে বলে, “আমি লাগিয়ে নিচ্ছি!”
এ বলে নাজহা বামের মুখ খোলে, অল্প একটু নিজের বা পায়ের টাখনুতে লাগিয়ে দেয়।তৌসিরের এটা মোটেই সহ্য হয় না।তৌসির হাত বাড়িয়ে নাজহার পায়ে বারকয়েক হাত বুলিয়ে নাজহার গোড়ালি ধরে শক্ত করে টান দিয়ে ধরে এতে পা যদি মুচকে যায় তবে ঠিক হয়ে যাবে।একে পায়ে তো পেয়েছে ব্যথা, এর মধ্যে তৌসির এভাবে টেনে ধরেছে, তার ওপর তৌসির ওকে স্পর্শ করেছে।নাজহা দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে নিয়ে তৌসিরের হাত থেকে ঝাড়ি মেরে নিজের পা সরিয়ে নিতে নিতে বলে,”আর কখনো আমার শরীর স্পর্শ করবেন না, এটা প্রথম, তাই কিছু বললাম না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তৌসির এটা শুনে ঠোঁট হেলিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে,”ভাগ্য ভালো বেডি তোর, যে তৌসির শিকদার তোর পা ছুঁইছে! আর এত ফ্যাত ফ্যাত করিস না, আমি তোর জামাই, ছুইলে খারাপ কিছু হইতো না।”
এ বলেই তৌসির উঠে দাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় আর নাজহা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।তৌসির ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে নাজহা একইভাবে বসে আছে।নাজহাকে বসে থাকতে দেখে তৌসির ওর দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকিয়ে বিছানায় উঠে বলে,”কি হইলো? ঘুমাও না ক্যান?”
নাজহা এর কোনো উত্তর দেয় না, চুপচাপ বসে রয়।তৌসির এটা দেখে চিৎ হয়ে শুতে শুতে বলে,”সবসময় শুনতাম বিয়ের দিন রাইতে বউরা লাল শাড়ি পড়ে, কিন্তু তুমি কাফনের কাপড়ের মতো সাদা কাপড় ক্যান পড়ছো?”
নাজহা এটা শুনে দাঁত চেপে বলে,”কারণ আমায় দাফন করা হইছে, তাই কাফন পড়েছি!”
তৌসির নাজহার এই ঝাঁঝ ধরা কথা শুনে বলে,”ঝাঁঝ আমার লগে দেখাইও না, পরে কবে মাইরা টাইরা ফেলমু, আর বউ মেরে ফেলার কলঙ্কিণী বইনা যাইমু।”

নাজহা তৌসিরের কথায় কোনো উত্তর দেয় না, নিঃশব্দে ধীরে ধীরে উঠে যায়।তৌসির ওর টাখনু যে ভাঙেনি, এটাই অনেক।নাজহা উঠে যায়, উদ্দেশ্য তাহাজ্জুদ পড়া।ও সবসময় ফজরের এক ঘণ্টা আগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে, ফজর পড়ে, তেলাওয়াত করে, ইশরাকের নামাজ পড়ে একেবারে জায়নামাজ থেকে ওঠে।নাজহা নিজের ব্যাগ খোলে, মিসওয়াক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওজু করে বেরিয়ে আসে।নাজহা ভালো করেই জানে এখানে জায়নামাজ পাবে না, কারণ ও যে পাটিতে ঘুমিয়েছে, সেটাই নামাজের, তাই চুপচাপ ব্যাগ থেকে নামাজের হিজাব বের করে পাটিতে বসে কাঁথা সরিয়ে নামাজে।
তখনই মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। ইশরাকের নামাজের সময় কিভাবে দেখবে তা!কারণ একেকদিন একেক সময় থাকে আর নাজহা সূর্য দেখে বুঝে না ওয়াক্ত, তাই ফোনে নামাজের সময়সূচি নামক একটা অ্যাপে সময় দেখে নেয়।কিন্তু এখন তো মোবাইল নেই।
নাজহা ধীরে ধীরে উঠে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে,”এরে হুনরানি {এই যে শুনছেন}!”

তৌসির নাজহার ডাক শুনে চোখ না খুলেই বলে,”জ্বি হুনরাম {জ্বি শুনছি}।”
নাজহা ইতস্তত বোধ নিয়ে বলে,”আপনার ফোনটা দিবেন? আমি টাইম দেখবো নামাজের!”
তৌসির এটা শুনে চোখ খোলে, বালিশের পাশ থেকে একটা ফোন বের করে দেয়।নাজহা ফোন দেখেই আঁতকে উঠে ফোনের যে করুন অবস্থা! এটা দেখেই নাজহার কান্না চলে আসার উপক্রম।Samsung Galaxy S8 ফোন, সেই ২০১৭ সালের মডেলে ফোন। এর মধ্যে টাচ ফাটা, ভয়াবহ ভাবে ফাটা-ছেঁড়া!মনে হচ্ছে কেউ নিজের যত ক্ষোভ আছে সব ঢেলে দিয়েছে এই ফোনে!এই ফোন কিভাবে তৌসির ইউজ করে নাজহা খুঁজে পায় না।
নাজহা বিস্ময়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তৌসির বলে,”কি হইলো? নাও!”
নাজহা ফোনটি হাতে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,”এই ফোনে কি প্লে স্টোর আছে?”
তৌসির নাজহার প্রশ্নে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,”ঐডা আবার কোন বাল?”

এটা শুনেই নাজহার মেজাজ তিক্ত হয়ে যায় লোকটা এমনি কেনো? সবসময় গালি দেয়?নাজহা তৌসিরের ফোন তৌসিরের পাঁজরের ওপর রেখে বলে,”থাক, লাগবে না আমার!”
এ বলেই নামাজে এসে দাঁড়ায়।তৌসির নাজহার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে মোবাইলটা পাশে রাখতে রাখতে বলে,”কি এক অদ্ভুত চিজ জুটাইলে দয়াল তুমি আমার কপালে!”
এ বলেই বা পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।তবে কিছুক্ষণ পর পর চোখ আপনাআপনি খোলে, নাজহার দিকে চলে যায়।এতে বেশ বিরক্ত হয় তৌসির, নিজের চোখের উপর মন শোধায়,”তালুকদারের মাইয়া কালা জাদু-টাদু করলো না তো আবার?”

তালুকদাররা পড়েছেন আজ অনেক বড় বিপদে, যদিও এই বিপদের সূচনাদাতা উনারাই।আসলে নাজহার বড় দাদীর চার নম্বর ছেলে, মানে নাজহার চার নম্বর চাচার বড় ছেলে ইকরাবের পছন্দ নাজহা কে। নাজহার যখন বয়স ১১, তখনই ও নাজহা কে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।পরিবার অবস্থা বেগতিক দেখে ইকরাবকে সবাই বুঝিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য। ওর নানাবাড়ির মানুষও আছেন ওখানে, সেই সুবাদে। তবে কথা দেন, নাজহা ইন্টার শেষ করলেই ওর সঙ্গে ওকে বিয়ে দেবেন।
আজ আগস্টের দু তারিখ।

ওর চাচা নোমান আর সাফা বিয়ে এবং নাজহা-তৌসিরের বিয়ের এক তারিখে হয়েছিল।কিন্তু ও জানত শুধু চাচার বিয়ে, তাই সারপ্রাইজ দিতে সবাইকে না জানিয়ে বিয়ের দিন আসতে চেয়েছিল, কিন্তু কিছু ইস্যুর জন্য বিয়ের পরদিন আসে।ওকে হঠাৎ দেখে তালুকদার বাড়ির সবার অবস্থা যায় যায়, কারণ ও নাজহার জন্য পাগল ওর মরণ হয়ে যাবে সত্যটা জানলে।কিন্তু সত্যটা চাপানোও সম্ভব না।
ইকরাবকে বলে দেওয়া হয় সত্যটা।ওর মাস্টার চাচ্চু নাদির এই কথাটি ওকে বলেন, কারণ আর কারও মুখ দিয়ে আসছিল না এই ভয়াবহ বাণী। উনি সাহস নিয়েই বলেন।যেই মুহূর্তে ইকরাবের কর্ণপাত হয়,“ইকরাব আসলে নাজহার তৌসির শিকদারের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।”

সেই সময়ই ইকরাব কিছু মুহূর্ত সবার দিকে এক দৃষ্টিতে চোখ বড় করে স্থবির চোখে তাকিয়ে রয়, আর তারপরই জোর শ্বাস টেনে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে।ওর মন এই ভার আর সহ্য করতে পারেনি, তাই এভাবে লুটিয়ে পড়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, সব মিথ্যা মনে হচ্ছিল।
বর্তমানে তালুকদাররা নিজেদের বাড়ির উপরের করিডরের সোফায় ওকে নিয়ে শুইয়েছেন, ওর জ্ঞান ফেরানো হয়।জ্ঞান ফেরতেই ইকরাব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে নাজহা কে খুঁজতে খুঁজতে বলে,“আমার ফুল কোথায়? আমার ফুলকে তোমরা কী করলে?ওকে আমার সামনে আনো!ওকে আমার দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।অনেক বছর ওর চাঁদমুখখানা পরখ করি না।”

এটা শুনে নাজহার বাবা ছিদ্দিক তালুকদার এগিয়ে এসে বলেন,“বাবারে, ওর বিয়ে হয়ে গেছে।”
এটা শুনে ঠিকই ইকরাব, কিন্তু বিশ্বাস করে না একটুও। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,“কেনো, মজা করছেন চাচা?আপনার মেয়ে তো আমার স্ত্রী হবে, ওর অন্য কারও সাথে কেনো বিয়ে হবে?”
ওর মোল্লা চাচ্চু নাহিদ সাহেব এসে এগিয়ে বলেন,“ইকরাব, এটাই সত্য।সাহেবকে বিয়ে করানোর জন্য এমনটা করতে হয়েছে।মেয়ের বদলে মেয়ে দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সামনে নির্বাচন।”
ইকরাব এটা শুনে স্তব্ধ চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রয়।
ওর ফুল আর ওর নেই?মন বারবার শোধায়,“ওহে, তোমার অন্তরের ফুল আজ কারো ঘরফুল হয়ে গেছে তুমি শূন্য আজ, তুমি শূন্য।”

ইকরাব পেছনে ঘুরে চিৎকার করে বলে,“আমার অন্তরের ফুল যখন অন্যকারো ঘরফুল হয়ে গেলো, তাহলে আমি বেঁচে থেকে কী করবো?”
এ বলেই ইকরাব করিডরের রেলিংয়ের দিকে ছুটে যায়, উদ্দেশ্য লাফ দেওয়া।কিন্তু এর আগেই ওকে ওর চাচা ধরে পিছনে নিয়ে আসেন।ওরা ওকে বোঝান,“এমন করিস না, এটাই নিয়তি।”
ইকরাব সবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাটিতে দুই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে আবারো মাটিতে লুটিয়ে মাছের মতো ছটফট করতে শুরু করে।
একটা পাখির গায়ে তীর বিঁধলে যেমন সে মাটিতে পড়ে ছটফট করে, ইকরাব নিজের সব বিশ্বাস হারিয়ে এভাবেই ছটফট করতে করতে চিৎকার করে বলে,“তোমরা আমায় নিঃস্ব করে দিলে!তোমরা আমার সবটুকু শেষ করে দিলে!
তোমরা আমার সবটুকু বিশ্বাস ভেঙে দিলে!আমায় মৃত লাশ বানিয়ে দিলে!কী করে তোমরা এমনটা করতে পারলে?আমার ফুলকে… তোমরা… তোমরা…..।

এ বলেই ইকরাব চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।পুরুষরা বুঝি আবার কাঁদে? হ্যাঁ কাদে। এই যে কাঁদছে ইকরাব। নিজের সবটুকু ভরসা হারিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে ওর কিশোর বয়সের আবেগ আর যুবক বয়সের ভালোবাসা আজ অন্য কারো।ওর সবটুকু শেষ হয়ে গেছে সব। দম বন্ধ হয়ে আসছে।বর্তমানে প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস বিষের মতো তীব্র যন্ত্রণার লাগছে।ইকরাব ওর আব্বার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আব্বা, ওর বিয়ের জন্য লাল শাড়ি যখন কিনলে, তখন তোমার আমার জন্য কাফনের কাপড় কেনো কিনলে না?
তোমরা মানুষ নয় তোমরা সবাই রক্তচোষক।তোমরা আমার সব শেষ করে দিয়েছো!
ইকরাব চিৎকার করে বুক ফাটিয়ে বলে,

“ওকে এই মুহূর্তে এনে দাও, নয়তো আমায় জীবন্ত দাফন করে নাও!”
সবাই স্তব্ধ হয়ে ওর এমন ছটফটানি দেখছেন।
ইকরাব চিৎকার করে কেঁদে বলে,“আমার অন্তরের ফুলকে কী করে তোমরা অন্যের ঘরের ফুল বানিয়ে দিলে?তোমরা এতটা নিকৃষ্ট কীভাবে হতে পারো?তোমরাই তো কথা দিয়েছিলে, যে আমার ফুল শুধু আমার।তাহলে আজ ও অন্যকারো কী করে হয়?আমি ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসি।
আমি ভীষণ ভালোবাসি।আমি ভীষণ ভালোবাসি।
আমার পক্ষে ওকে ছাড়া থাকা সম্ভব নয়!”
ইকরাব পাগলের মতো বলে,

“ওর বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে?তালাক দিয়ে নিয়ে আসো, তারপরও ওকে আমার করে দাও।আমি শুধু আমার ফুলকে চাই শুধু ওকে চাই।”
এ বলেই ইকরাব হাঁপাতে থাকে, হাঁচি দিতে থাকে।সাথে সাথে ওর নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে শুরু করে।রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া অতিরিক্ত আবেগ, কান্না বা মানসিক চাপের কারণে হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেলে নাকের ভিতরের রক্তনালিগুলো ফেটে রক্ত বের হয় আর এমন ইকরাবের সাথেও হলো।
ইকরাবের বাবা নাহিদ সাহেবকে বলেন এটা দেখে,
“নাহিয়েইদ, যা তাড়াতাড়ি ঘুমের ইনজেকশন লইয়া আয়!”
নাহিদ তাড়াতাড়ি নিজের রুমের দিকে যান।ইকরাব এটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,“ও আব্বা আমায় চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে ফেলো আমি আর বেঁচে থেকেই কী করব?”

ইকরাবের বাবা ইকবাল সাহেব ওকে কিছু বলতে যাবেন, তখন আরও রক্ত গড়িয়ে পড়ে।ইকরাব ঢোক গিলে বলে,“আব্বা হয়তো আমার বুকে আমার ফুলকে এনে দাও নয়তো আমায় কাফনে মুড়ায়ও।
নাহিদ চাচা ইনজেকশন নিয়ে আসেন।আর সাথে সাথে তিন চারজন ইকরাব কে চেপে ধরে।ইনজেকশন দিয়ে দেন।ইকরাবের মাথা তিরতির করে ভারী হয়ে আসতে থাকে।ইকরাবের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে।ইকরাব ঘোলাটে নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,

“এই ঘুম আর না ভাঙুক এই ঘুমই চিরন্তন হয়ে রোক!”
দৃষ্টি লেগে আসবে তখন আবারো বলে ওঠে,
“যে ফুল আমার হয়নি, সে ফুল আর কারো না হোক।”
এ বলে ইকরাব বুক চেপে ধরে, বুকে প্রচুর ব্যথা করছে।
বুক খাবলে ধরেই ইকরাব চোখ বুঁজে নিদ্রায় ডুব দেয়।
ওর এতটা বছরের ভালোবাসা আজ বৃথা।

নাজহা দাঁড়িয়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। এই ড্রেসিং টেবিলটা একটু আগেই ওর দাদাশ্বশুর এনে দিয়েছেন কয়েকজনকে দিয়ে, যাতে ওর অসুবিধা না হয়। এখন বেলা বারোটা বাজে। নাজহা গোসল করে নিয়েছে, ওকে তড়িঘড়ি করেই গোসল করানো হয়েছে। একটু পর ওর বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসবেন বাপ চাচারা। আর এখন এই বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন।নাজহা একটা সাদা গোল ড্রেস আর কালো সালোয়ার পরেছে। ভিজে চুল, তাই খোলাই রেখেছে। নাজহাকে চুড়ি পড়ার জন্য বলা হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাজহা আপন মনে আস্তে আস্তে চুড়িগুলো হাতে পরছে।

এদিকে তৌসিরও রুমে রেডি হচ্ছে। তৌসির পরেছে সাদা লুঙ্গি। এমনিতে তো চেকের পরে, কিন্তু সাদা বেশিই পরে। সাদা পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট, পায়ে লেদারের জুতো এই জুতো আবার ডার্বি জুতো এই জুতোখানা তৌসির কে ওর মেঝো চাচা গিফট দিয়েছিলেন। গত সাপ্তাহে ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছেন কারণ ইংল্যান্ড এই জুতো সেরা ক্লাসিক ও হ্যান্ডক্রাফটেড পাওয়া যায়। এর মধ্যে শত বছরের পুরনো গুডইয়ার ওয়েল্টেড লেদার জুতো, হাতে তৈরি। দাম আটশ’ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক ৮৮,০০০ হবেই।তৌসির নিজের কোট ঠিক করতে করতে আয়নার দিকে তাকায় এক নজর। তাকিয়ে কিছু সময় তাকিয়েই রয়।নাজহা নিজের মতো চুড়ি পরছে।তৌসির নাজহার বাদামি কোমরের নিচ অবধি চুল দেখে অপলক নয়নে সেই চুলের পানেই তাকিয়ে রয়।বেশ আকর্ষণীয় বটে এই কেশতরঙ্গগুলো। ঢেউ খেলানো চুলগুলো বেশ সুন্দর সুন্দর লাগে তৌসিরের চোখে।নাজহার পড়নে গোল ড্রেস, ওর খোলা ঢেউখেলানো বাদামি চুলগুলো তৌসিরের চোখ বারবারই আটকে নেয়।তৌসির মনে মনে বলে ওঠে,“ছিদ্দিক তালুকদার কোনো বাল পারুক আর না পারুক, এক চিজ জন্ম দিছে মারাত্মক, মাইরি!”

নাজহা চুড়িগুলো হাতে পরছে আর মনে মনে বলছে,
“কতটা দুর্ভাগ্য আমার! আজ আপনার নামের চুড়ির পড়া হাতদ্বয় এক দানবের নামে পড়তে হচ্ছে। আপনায় আর আমার পাওয়া হলো না মশাই।বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু আমার চোখ আপনাকেই খুঁজছিল। এতটা পাষাণ কেনো আপনি? কেনো আমার নজরের বাইরে চলে গেলেন? শেষবারের মতো আমায় দেখা দিলে কি এমন ক্ষতি হতো?কেনো দেখা দিবেন? পারবেন না তো অন্যকারো হতে আমায় দেখতে, তাই বোধহয় সরে গিয়েছিলেন!”
নাজহাকে বিরবির করতে দেখে তৌসির কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,
“কি লো তালুকদারের মাইয়া, কি বিরবিরাও?”

নাজহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলে আয়নায় তাকায়। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে।লোকটাকে বেশ সুন্দর-ই লাগে জিম করা বডি, নেতা-নেতা একখানা ভাব, অবশ্য নেতাই তো!
ধুতি স্টাইলের মতো লুঙ্গি পরা,পরনে সাদা পাঞ্জাবি, তার উপর গুছিয়ে পরা কালো মুজিব কোট যেটাকে অনেকে নেহেরু কোটও বলেন।মুখে দাড়ি অল্প, এই অল্প দাড়ি বলে দিচ্ছে, এই হয়তো কিছু দিন আগেই মুখ শেভ করা হয়েছে।চুলগুলো আলতো এলোমেলো, ফর্সা, সুন্দর। মুখের গঠনও বড্ড সুন্দর।কিন্তু এইসব সৌন্দর্য পানসে নাজহার চোখে।কারণ ওর চোখ যে এক শ্যাম পুরুষের স্নিগ্ধতায় বিভোর।নাজহা নিজের মনে মনেই শোধায়,“পৃথিবীর সব পুরুষের সৌন্দর্য তুচ্ছ আমার ভালো লাগা মহাশয়ের নীড়ে।”

নাজহা কিছু সময় ধ্যানে থেকে মাথা নাড়িয়ে না-বোধকভাবে বলে,“না, কিছু না।”
তৌসির নাজহার দিকে আয়নায় আড়চোখে তাকিয়ে বলে,“তোমার আবার কোনো লাং টাং ছিলো না তো বিয়ের আগে? তার বিরহে মরতাছো না তো আবার?”
‘লাং’ শব্দটা শুনে নাজহার মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়।
তিক্ত সুরে পিছনে ঘুরে তৌসিরের পানে কটমট করে তাকিয়ে বলে,“চরিত্রহীনের তমকা দিবেন না!”
তৌসির নাজহাকে রেগে যেতে দেখে বলে,“ও আমার সাউয়া রাইগা যাও ক্যান? ভালো কথাই তো জিগাইলাম।”
নাজহা তৌসিরের কথায় দ্বিগুণ রেগে গিয়ে বলে,“নিজের মুখের ভাষাটা ঠিক করুন!”

“দুঃখিত, মুখের ভাষা ঠিক করা সম্ভব নয়।”
নাজহা এটা শুনে কিছু বলে না। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়, কারণ তৌসিরের সামনে দাঁড়ালেই রাগে গা জ্বলবে!নাজহা যেতে নেয়, তৌসির তখন বলে ওঠে,
“শুনো তালুকদারের মাইয়া, এমন সাপের মতো ফ্যাত ফ্যাত কইরো না, পরে সাপের মতো পাড়া দিয়া মাইরা ফেলমু।”
নাজহা এটা শুনে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে,“রাতে তো মেরেই ফেলেছিলেন!”
“মাইরা ফেলার ইচ্ছা থাকলে পায়ে না দিয়া গলায় পাড়াটা বসাইতাম।”
নাজহা এ বাণী শুনে উত্তর দেয়,“তো বসাইলেন না ক্যান?”
তৌসির হেসে বলে,“তোমারে মাইরা ফেললে আমি বউ পামু কই? এমনেই সাত কপালের দৌড়ে তোমার মতো চানমুখি পাইছি।”

নাজহা আর কোনো উত্তর দেয় না।চুপচাপ বিছানায় বসে পড়ে। ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে কষ্টে।নিজের পেয়েও না পাওয়া তীব্র যন্ত্রণায়।
কিছু মুহুর্ত পর,,,
তৌসির, তৌসিরের ছোট চাচা নাযেম আর ছোট মামা মিনহাজ বসে আছেন শিকদার মহলের ছাদের এক কোণে সোফায়। নাযেম চাচা মদ গিলছেন এক হাতে, অন্য হাতে সিগারেট টানছেন। উনার মুখোমুখি সোফায় তৌসির বসে আছে, আর পাশেরটায় মিনহাজ মামা বসে আছেন। মিনহাজ মামা একটা সিগারেট তৌসিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, “নে, টান দে।”

তৌসির সিগারেট হাতে নিয়ে অন্যদিকে ছুঁড়ে মারে আর নাক-মুখ কুঁচকে বলে, “দূর! তুমি তো জানো, এসব বাল-চাল ছাইপাঁশ আমি গিলি না। এগুলো গিললে বুকে জ্বালা ধরে যায়, পরে আর কিছু মুখে নিতে পারি না।”
নাযেম চাচা ওর কথা শুনে হেসে বলেন, “নেশার ব্যবসা করিস, আর নেশা করিস না তাইলে আসল নেশার স্বাদ পাইবি কেমনে?”
মিনহাজ মামা বলে ওঠেন, “আমি খুঁইজা পাই না, ও নেশার এই তীব্র স্বাদ ক্যান নেয় না?”
তৌসির বিরক্তি নিয়ে বলে, “দূর! এইসব খাইলে মাথা-টাথা ঠিক থাকে না। তোমরাই গিলো, আমি এগুলোর মধ্যে নাই।”

নাযেম চাচা বলে ওঠেন, “আচ্ছা, বাদ দে এগুলা। আগে ক বউ পছন্দ হইছে?”
তৌসির উনার কথায় উত্তর দেয়, “হ, চাচা। বউ তো মারাত্মক পছন্দ হইছে, কিন্তু সংসার করবার যোগ্য হইছে না।”
মিনহাজ মামা ওর কথায় ভুরু কুঁচকে বলেন, “ক্যান? যোগ্য না ক্যান?”
তৌসির বিরক্তি সুরে বলে, “আরে সংসার কেমনে করমু? ওর বয়স আর আমার বয়স দেখছো? কত ছোট ও! এই জীবনে আর সংসার অইতো না। আচ্ছা, এইগুলা বাদ। তোমরা কও, তোমরা বিয়া করবা কবে? আমি তো কাম সাইরা নিলাম।”

মিনহাজ মামা ঠাস করে টি টেবিলের উপর হাতা থাকা গ্লাস রাখেন। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে উনার। অতিরিক্ত সুন্দর বিধায় একটু খেলেই এমন লাল-নীল হয়ে যান মামা। মিনহাজ মামা আবার মারাত্মক সুন্দর, তবে আজ পর্যন্ত কোনো রমণী উনি পাঠাতে পারেননি। উনি ব্যর্থ, উনার অভ্যাসেই। মেয়েদের সাথে কথা বলার স্টাইলটাও জানা নেই। দু-একখানে পাত্রী দেখা হয়েছিল, কিন্তু পাত্রী সাথে কথা বলতে গিয়ে বলবেন বাপের নাম, বলেছেন দাদার নাম।তাই আর বিয়ে করা হয়নি। উনিও আর করতে চান না। কিন্তু বয়স ত্রিশের উপরের দিকে দৌড় দিচ্ছে। মিনহাজ মামা আবার তৌসিরের ছোট। আর নাযেম চাচা তৌসিরের এক বছরের বড়। উনি নেতা মানুষ। উনার রাজনীতি আর দুর্নীতিই সব। সংসার, বউ, বাচ্চা এগুলোতে তিনি রাজি নন। তাই আর কি করা উনি আছেন উনার মতই।
নাযেম চাচা তৌসিরকে বলেন, “শুন, দুইটা বাটিয়ালি থাইকা আইছে। এখন কি করমু ওগো?”

তৌসির সন্দেহভরা চোখে বলে, “ওরা নিজের ইচ্ছায় আইছে তো? কন্ট্রাক্ট সাইন করছে তো?”
“হ, ওরা নিজেই আইছে। আমরা কাউরে ধইরা আনি নাই।”
“তাইলে ওগো রে আলমের ফার্ম হাউসে পাঠাইয়া দাও। আলম পাঁচ লাখ দিছে আমারে। এর মধ্যে ওদের দুইজনের দুই দিয়া দিও।”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১

মিনহাজ মামা বলেন, “এগুলো বাদ দে ভাই বাবারা। ল্যাবের কি হইলো? দাঁতের টায় কোনো কাম হইছে নাকি?”
তৌসির তিক্ত সুরে বলে, “ল্যাবের কথা আর কইও না। ওগুলো ডাক্তার না সবগুলা উলুর বদল। সাউয়াগুলা কোনো কামের না।”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here