স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২১

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২১
সানজিদা আক্তার মুন্নী

নাজহা বসা ছিল যেখানে। সে স্থান থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে সরে পড়ে তৌসিরকে দেখে চমকে। আর এটাই স্বাভাবিক, আমরা যখন কোনো বিষয়ে আশঙ্কাও করি না আর সেই পরিস্থিতিতে আমাদের পড়তে হয় তখন আমরা মানবরা কিছুটা বিচলিত হই নাজহার ক্ষেত্রেও তেমনি হয় নাজহা বিস্ময় চমকে আমতা-আমতা করে বলে ওঠে“তৌসির আপ আপনি?”

তৌসির নাজহার কথায় মুচকি হেসে ডান পায়ের ওপর তোলা বা পাটা নিচে নামাতে নামাতে মুখ দিয়ে আফসোসের চ শব্দ বের করে বলে,“তোমার সাথে সংসার ছেড়ে আমি কেমনে ওই হাজতে থাকমু কও তো? তোমার চোখের অসহায় চাহনি আর অসহায় পানি আমায় থাকতে দেয়নি তো সেখানে। তাই তোমার আঁচলের তলায় চইল্লা আসছি।”
তৌসির উঠে এসে লুঙ্গি গুটিয়ে নাজহার সামনে দু’ হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের পাতা মাটিতে সমতল রেখে বসতে বসতে ভুরু তীক্ষ্ণভাবে নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,“টুনির মা, তুমি খুশি হওনি? আমায় দেখে অখুশ হয়েছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাজহা এ শুনে মনে মনে ভাবে,“তৌসির কি সব জেনে গেলেন? নাহ, তেমন কিছু হয়তো নাহ।”নাজহা বিস্ময়ে বিস্মিত হয় তবে এখন আমতা-আমতা করলে তৌসির ঘাপলা আছে আঁচ করে নেবে তাই নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে হেসে উঠে বলে,“ত-তেমন কিছু না। হঠাৎ আপনাকে দেখে চমকে উঠলাম আরকি।
তৌসির নাজহার উত্তর শুনে ঠোঁটে ফুটে উঠে এক তাচ্ছিল্যের হাসি। তৌসির হাত বাড়িয়ে আলতো স্পর্শে আঙুলগুলো চেপে ধরে নাজহার তুলোমেঘের মতো নরম দুই গালে আর দাঁত চেপে বলে ওঠে,“ও আমার ভেত্তমিজ মাগি লো, আর কত করবি মাগিগিরি? এবার থাম, নটির নটি।”
ব্যাস নাজহার বুঝতে আর বাকি রইল না তৌসির সব বুঝে গেছে।নাজহা তৌসিরের হাত নিজের গাল থেকে সরাতে সরাতে নিচু, ম্লান কণ্ঠে বলে“আপনি আপনি সব জানতেন তৌসির?”

তৌসির এবার হাতের আঙুলের স্পর্শ আলতো থেকে কঠিন করে নেয়। শক্ত করে চেপে ধরে নাজহার গাল, আর ঠান্ডা চোখে চোখ রাখে নাজহার সবুজ নয়নায়, যে নয়নার চাহনি শুধু ছলনাই করতে চেনে। বিষমাখানো গলায় বলে ওঠে,“হ্যাঁ জানতাম তুই গাদ্দার! জানতাম। কিন্তু তুই যে এত বড় খানিকির ধারা, এইটা জানতাম না! নাজহা, আমি খুব ব্যাথা পাইলাম তোর এই গাদ্দারিতে! তোরে আমি আপন ভাবলাম। আর তুই এমনে ছুবল মারলি?”
নাজহা গালের ব্যথায় কপাল কুঁচকে নেয়। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। তৌসিরের পুরুষালি হাতের ব্যাথা বলে কথা। কষ্ট তো হবেই, দাঁতের মাড়ি ভেঙে যাচ্ছে।
নাজহা তৌসিরের হাত দুই হাতে ঝাপটে ধরে সরানোর চেষ্টা করে বলে,“কষ্ট হচ্ছে তৌসির!”

“কষ্ট হচ্ছে তৌসির?” ​নাজহার মুখ থেকে এই সামান্য দুটি শব্দ তৌসিরের বুকে তীক্ষ্ণ তীর হয়ে বিঁধে। সঙ্গে সঙ্গেই সে নাজহার গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। এই মেয়েকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার কসম খেয়েছে সে, অথচ এখন ওর সামান্যতম আর্তনাদও তার অসহ্য লাগছে! নাজহা কী জাদু করলো তার ওপর? কোনো কালো জাদু নয়তো? হয়তো এমন কিছুই নয়তো ওর কষ্টে তৌসিরের আনন্দ পাওয়ার বদলে বুকে এমন তীব্র ব্যথা লাগছে কেন?

​ওর দৃষ্টি নাজহার গালের ওপর পড়ে। অতিরিক্ত ফর্সা আর নরম হওয়ায় গালগুলিতে তার আঙ্গুলের চাপ হালকা বসে গেছে । এ দেখে তৌসিরের অসহ্য যন্ত্রণা লাগে বুকে। এ কী করল সে! এই গালগুলিতেই তো তৌসির বারবার ঠোঁট ছুঁয়েছে, গাল ঘষে মন ভরে চুমু খেয়েছে। যখন ইচ্ছে হয়েছে, তখনই নাক ডুবিয়ে দিয়েছে ভালোবাসায়। সেই গালগুলোতে আঘাত করা কি উচিত হলো তার?​না, উচিত হয়নি। একদমি উচিত হয়নি!​যেখানে নিজে দু’মুঠো সুখ কুড়িয়েছে, সেখানে আঘাত করাটা ঘোর অন্যায়। নাজহা হয়তো গাদ্দারি করেছে, কিন্তু তাই বলে তৌসির এভাবে ওকে আঘাত করবে?​তৌসির নাজহাকে কিছু না বলে নিজের বিবেকের সাথে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তৌসিরের ভেতরে একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে অসহনীয় যন্ত্রণা। ​আর নাজহা? সে মনে মনে কালেমা পড়তে শুরু করে। তার বিশ্বাস, এই মুহূর্তে, ঠিক এই মুহূর্তেই তৌসির তাকে মেরে ফেলবে। এই মুহূর্তেই!​ঠিক তখনই, তাদের এই চরম উত্তেজনাময় সময়ে, দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ান বিবিজান আর দাদাজান। দাদাজান শান্ত, অথচ ভারী কণ্ঠে তৌসিরকে পিছন থেকে ডাক দেন, ​”ও তৌসির, এদিকে আয়।”

তৌসির পিছনে ফিরে তাকায়। দাদাজান আর বিবিজানকে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে যায়।বিবিজান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বড় গলায় বলেন,“তৌসির, আমার তো মনে হয় তোর লগে যে এই কামটা করছে, এইটা তোর বউ-ই।”
নাজহা নিথরের মতো পড়ে থাকে জায়নামাজে। এবার বিবিজানও জেনে গেছেন এটা কার কাজ। নিশ্চিত এবার নাজহাকে মেরে ফেলবেন সবাই মিলে।তৌসির বিবিজানের কথায় নাজহার দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপর সামনে তাকিয়ে বলে “বিবিজান, তুমি সবসময় ক্যান আমার বউরে দোষ দিয়া কথা কও! ফারদিন আর আমি ঐটা প্রাংক করছি সবার লগে। একটু সবার রিয়াকশন বুঝার লাইগা। আমার বউ তো এইটারে হাছা মনে কইরা (নাজহাকে দেখিয়ে) “নামাজে বসে কাঁদতাছে!”

দাদাজান এটা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলেন,“সাউয়ার! সাউয়ার ছাড়ায়া দিমু একদিন বালগিরি করো! তোর মা আর আমার নাতবউ কি ভয়টা পাইছে তুই জানস ঐটা?”
তৌসির মনে মনে হাসে,“তোমার নাতবউ যে এগুলার মূল ঘটিকা এইটা কেমনে বলমু তোমারে দাদাজান।”
বিবিজান হতাশার শ্বাস ফেলে বলেন, “তৌসির, যা তোর মারে দেইখা আয়। বেহুশ হইয়া চিৎ হইয়া গেছে।”
এ বলে নাজহার দিকে তাকিয়ে বলেন,“আর নাজহা, তুই আয় রান্নাঘরে। কাম আছে।”

নাজহা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অবশেষে এই পুরো খেলার আসল চিত্রটা তার কাছে স্পষ্ট হলো। সে বুঝতে পারে, এই পুরো খেলাটা তৌসিরই সাজিয়েছে!​তৌসির নিজেই যেচে নাজহাকে ফাঁদে ফেলেছে। ফারদিন যে নতুন ওসি এবং ঘুষ নেয় না, যার সঙ্গে তৌসিরের সম্পর্ক খারাপ এই সমস্ত তথ্য নাজহা জেনেছিল তৌসিরের কাছ থেকেই। তার মানে এটা এখন জলের মতো পরিষ্কার: তৌসির সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক করেছে।​তৌসির নিজে নাজহার সামনে প্রমাণগুলো এনে দিয়েছে, আর নাজহা বোকা বনে সেই প্রমাণগুলো ফারদিনকে দিয়েছে। অথচ এখন নাজহা নিশ্চিত, ফারদিন আসলে তৌসিরেরই লোক!​কিন্তু এখন একটি প্রশ্নই নাজহাকে কুরে কুরে খাচ্ছে:
কেন? কী কারণে তৌসির তাকে বাঁচিয়ে রাখছে? কেনই বা সে সবার সামনে সত্যটা প্রকাশ করছে না? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো বড় স্বার্থ লুকিয়ে আছে।​তৌসির আর নাজহার দিকে তাকাশ না। তৌসিরের চোখ-মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তেই পাল্টে যায়। মা আগে, পরে দুনিয়া। এই চিন্তায় সে দ্রুত মাকে দেখতে চলে যায়।

তৌসির কুঠিরে এসেছে। কুঠিরের গেটের সামনে একটা টং দোকান আছে। এই টং দোকানটা তারাই দিয়েছে গ্রামের এক গরিব লোককে দোকান দিয়ে খাওয়ার জন্য। সে মাকে দেখার রুমে গিয়েছিল নিজের ইচ্ছাধারী নাগিনের সাথে হিসাব চুকাতে, কিন্তু গিয়ে আর নাযহাকে পায়নি। বিবিজান তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেছেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে তৌসির কুঠিরে চলে এসেছে।
দোকানটার ভেতরটা গ্রামের ছোট্ট এক আড্ডাখানা। এক পাশে চা-নাস্তা আর মুদি জিনিসপত্রের ব্যবস্থা চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠে, কেউ বিস্কুট চুবিয়ে খায়, কেউ আবার চিনেবাদামের ঠোঙা হাতে গল্পে মত্ত। আরেক পাশে আলাদা আলাদা টেবিল পেতে বসানো ক্যারম, লুডো, দাবা খেলার আসর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, তবু খেলোয়াড়দের ভীর কমে না।

দোকানের কোণায় রাখা আছে পুরোনো একটা বক্স টিভি স্ক্রিনে দাগ পড়েছে, তবু তাতে খবর, সিনেমা বা ক্রিকেট ম্যাচ চললেই দোকানের ভেতর ভিড় জমে যায়। কেউ গল্প করছে, কেউ আবার টিভির দিকে হেলান দিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। টিভি দেখার লোভে অনেকেই কাজ ফাঁকি দিয়ে এখানে চলে আসে।
তৌসির দোকানে ঢুকতেই কাউন্টারে বসে থাকা লাল মিয়া হেসে বলেন, “তৌসির মামা, চা দিমু নাকি এক কাপ?”
লাল মিয়ার মুখে তৌসিরের কথা শুনে সবাই এক ঝলক তাকান ওর দিকে। এখানে এক পাশে নাযেম চাচা, ফারদিন, নুহমান আর কেরামত ক্যারম খেলছিলেন। আরেক পাশে রুদ্র আর মিনহাজ মামা দাবা খেলছিলেন। টিভিতে চলছিল ‘লুসিফার’ মুভি। কাব্যরা সবাই মিলে সেটা দেখতেছে, কিন্তু তৌসির লক্ষ্য করে দেখে ধ্রুব এসবে নেই। ও এক কোণে বসে বেদনার গান শুনছে। আর শুনবেই না কেন? ওর সাথে যে যমের বিয়ে ঠিক হয়েছে!

তৌসিরের সাথেও ইকরার তর্কাতর্কি লেগে যায়। ইকরা জবর এক ‘ঝিজ’! তৌসির নাযেম চাচাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মিনহাজ মামা আর রুদ্র খেলা ছেড়ে এসে তৌসিরের পাশে দাঁড়ান। ফারদিন ক্যারম বোর্ডের স্টিক ‘ফটাস’ করে ঠুকে দিতে দিতে এক গাল হেসে বলে, “কী অবস্থা তৌসির ভাই?”
নাযেম চাচা বোর্ডে বোরিক পাউডার দিতে দিতে হেসে বলেন, “কী আর হইব? ওর বউ যে বাঁশ দিছে, তারপর কি আর ভালো থাকা যায়?”
তৌসির এটা শুনে নাযেম চাচাকে ধমকে বলে, “সরের বাচ্চা, বন্ধ কর ল্যাওড়ামি! কেউ শুনিয়া নিব, বলছি না কেউ যেন না জানে এইটা? আমার বউ ভুল করছে, আমি দেইখা নিমু। তোরা দয়া কইরা, মায়া কইরা কাউরে কইস না এইগুলো।”

ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, “ভাই, এসব বাদ দেন। আপনার বউ যে লেভেলের অভিনয়টা করলেন, আমি তো টাশকি খেয়েছিলাম! প্লাস, উনিই আপনার বউ এটা জেনে আরো বেশি খাইছি।”
তৌসিরের কেন জানি ফারদিনের কথাটা পছন্দ হয় না। ফারদিনের কথার মধ্যে একটা ‘নজর খারাপ খারাপ’ গন্ধ পায়। তারপরও কিছু বলে না। রুদ্র তৌসিরের কাঁধে হাত রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে, “এখন কী করবা? ভাবীকে কি কিছু শাস্তি-টাস্তি দিবা নাকি?”
নুহমানের হাতে স্টিক ছিল। সেটা তৌসির নিয়ে একটু ঝুঁকে বোর্ডে রেখে ঠুকা মারতে মারতে বলে, “শাস্তি আবার কী? আমার বউ আমার লগে গাদ্দারি করছে? করবে! আরো একশোবার করবে! বললাম না, একদিন বউয়ের লাইগা সব মাফ!”

মিনহাজ মামা হাসতে হাসতে বলেন, “বউয়ের প্রেমে অন্ধ হইয়া আবার কুয়াতে পইড়া মরিও না।”
ফারদিন মিনহাজ মামার কথায় কুটলি হেসে জবাব দেয়, “আরে, অন্ধ হইবেন না? যে যাই বলুক, তৌসির ভাই, আপনে কিন্তু জিতছেন। একদম খাঁটি ‘ঝিজ’ পাইয়া গেছেন! এমন একটা সুন্দরী বউ যদি আমার কপালে জুটতো, তাহলে বিছানাই ছাড়তাম না মাসের মধ্যে!”
তৌসিরের গা জ্বলে ওঠে ফারদিনের কথা শুনে। ও স্টিক রেখে ঠান্ডা চোখে ফারদিনের দিকে তাকায়। শুধু তাকায়। তারপর কিছু না বলে জোরে স্টিকে একটা ঠুকা মারে আর বলে, “ফারদিন, নজর ঠিক রাখ। আমার বউয়ের নাম আর মুখে নিস না।”

ফারদিন তৌসিরের কথায় হাসতে হাসতে বলে, “আরে, কী কন ভাই! নজর ঠিকই আছে আমার। ভাবি হিসেবে বললাম। দেবর হয়ে এতটুক মজা তো করতেই পারি।”
তৌসির এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফারদিনের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে, “হ্যাঁ, সে তো করতেই পারিস। কিন্তু তারপরও লিমিট রাখিস। আমি আবার মানুষ ভালো না।”
এ বলে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “চল মামা, পার্টি অফিসে যাই।”
রুদ্র মাথা নেড়ে বলে, “চলো।”

তৌসির আর রুদ্র বেরিয়ে যায়। আর বাকিরা আবারো খেলায় মন দেয়। ফারদিন তৌসিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে বলে, “তোমার বউকে একদিনের জন্য হলেও আমার চাই, মেয়র সাহেব।”
এ বলে শয়তানি হাসি হেসে ওঠে।
এদিকে ধ্রুব বিরহের গান শুনছিল আর গাচ্ছিল, এমন সময় ফোনে কল আসে। এই নিয়ে সাত বার কল আসলো। তারপরও ধ্রুব ধরছে না। কল-টল ধরার মুডে নাই এখন ও। কিন্তু পরপর এত কল দেখে এখন বাধ্য হয়ে ধরে। কল ধরে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে ‘ছ্যাত’ করে ওঠে একটা গলা, “এ নটির নাতি, কই থাকিস তুই? এত কল দেই, ধরিস না কেন?”
ধ্রুব বুঝে যায় এটা ওর গুণবতী শুধু গুণবতী না, মহাগুণবতী হবু বউ। ধ্রুব বিরক্তিতে তেতো গলায় বলে, “কী হয়েছে?”

ইকরা ওপাশ থেকে বলে, “আমার অফিসে একবার আসো তো।”
ধ্রুব সাফ সাফ বলে দেয়, “বিয়ে ঠিক না হতেই শুরু হয়ে গেছে তোর নাটক? আমি পারব না।”
ইকরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই আসবি নাকি আমি আসব? আমি যদি আসি, তাহলে আজ একবারে বিয়ে হয়ে তোর ঘরে উঠব। কোনটা ভালো হবে?”
“ইকরা, ভালো লাগছে না এগুলো।”
“এ মাদারচুত, তুই বাংলা কথা বুঝিস না? বলছি আসতে তো আয়! একটা প্রয়োজন আছে, এর জন্য বলতাছি। নয়তো তোর সাউয়া ধইরা টানাটানি করার ইচ্ছে আমার নাই।”
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে তীক্ষ্ণ সুর ধারণ করে বলে, “ইকরা, সুন্দর করে কথা বল। আসছি আমি।”
“আচ্ছা, তাহলে তাড়াতাড়ি আসো। খুব প্রয়োজন।”
“হুম।”
এ বলে ধ্রুব ফোন রেখে মনে মনে বলে, “জীবনটা বরই পাতা হয়ে যাবে।”

রাত এখন দশটা। ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে শহরতলীর চেনা রাস্তাগুলো। তালহা ভাই স্টুডিও থেকে বাড়ির দিকে হেঁটে ফিরছেন। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর ক্লান্তি আর একাকীত্বের সুর বাজে। গলার সুর ভালো বলেই একটা ছোট ইউটিউব চ্যানেল চালান বিভিন্ন চলচ্চিত্রের ব্যাখ্যা দেন। এই সামান্য উপার্জনেই তাঁর দিন চলে। বাবার বিপুল অর্থের প্রাচুর্য আছে, কিন্তু সেই ‘হারাম টাকার’ ছায়াও তিনি মাড়ান না। নিজের উপার্জনের সামান্য আলোতেই তিনি জীবনকে মাপেন। কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে তিনি এই দৈন্যকেই শ্রেয় মনে করেন।
​আজ বারো তারিখ। কাল তেরো তারিখ উনার জন্মদিন। গত বছর এই সময়েও তিনি এভাবে ফিরছিলেন, আর নাজহার অস্থির কলগুলো কেটে দিচ্ছিলেন। নাজহা, শুধু নাজহাই প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন মনে রাখতো। সে সবার আড়ালে তাঁকে পায়েস বানিয়েও খাওয়াতো। নাজহার হাতের রান্নার স্বাদ অমৃত, আর সেই পায়েস সে তো উনার নাজহার মতোই অতিশয় প্রিয়।

​কিন্তু আজ আর সেই পায়েস খাওয়া হবে না। বাড়ি ফিরে সেই মধুর গন্ধ আর উষ্ণ স্পর্শ আর জুটবে না। তালহা ভাই আকাশের দিকে তাকান অফুরন্ত তারার মেলা তাতে। নাজহার স্মৃতিগুলোর মতো উজ্জ্বল অথচ নাগালের বাইরে।
​দীর্ঘশ্বাসটি বুক চিরে বেরিয়ে এলো। ফিসফিস করে আফসোস ঝরে পড়ল উনান ঠোঁট থেকে,”নাজহা আমার প্রিয় নাজহা তোকে আমার ভীষণ প্রয়োজন রে! তুই আমার কেন হলি না? না, না হয়তো তুই আমার হওয়ার ছিলিই না বিধায় আমার হলি না।”

​মাথা নিচু করলেন তিনি। পথ তাঁর চোখে আর ধরা পড়ে না। কেবল অন্তরের যন্ত্রণা শোনা যায়,”সে অন্যের জেনেও তাকে আপন ভাবিতে দ্বিধা লাগে, ফের তাকে ভুলিতেও প্রাণ পুড়ে।”
​অসহ্য এক ভার চেপে ধরেছে বুক। নিজেকেই প্রশ্ন করেন তালহা “এ কেমন দ্বিধায় আমি পড়িলাম! এমন দ্বিধায় বুঝি কেবল প্রেমিককেই পুড়িতে হয়?”

​তিনি ধীরে ধীরে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করেন। মানিব্যাগের ভাঁজে রাখা নাজহার একটি ছবি। স্নিগ্ধ হাসিমাখা সেই ছবির দিকে তাকিয়ে তালহা ভাই আঙুল বুলিয়ে দেন, মনে হয় স্পর্শ করছেন এক অলীক স্বপ্নকে।
​কণ্ঠে অপার অসহায়ত্ব নিয়ে বলেন “তুমি হয়তো আজ এই মুহূর্তে তোমার স্বামীর বক্ষে মাথা রেখে আবেশে নিদ্রায় আচ্ছন্ন আর দেখো, তোমার জন্য আমি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তোমায় নিয়ে কত শত দ্বিধার আঘাতে বিহৃন। তোমায় আপন করে চাওয়াটি বুঝি মারাত্মক ভুল ছিল? তুমি আমার হওনি বলেই আজ তোমার শূন্যতায় পুড়ছি। রবি ঠাকুর তো বলেই গেছেন,আমি হয়তো তেমনি এক হতভাগা। তোমাকে পাওয়া, না পাওয়ার এক আকাশ সমান অনিশ্চয়তা… তারপরও রোজ ভাবি তুমি আমার। জানো, ‘না-পাওয়াও একধরনের পাওয়া।’ এই যে তোমাকে পেলাম না, অথচ সারাজীবন শুধু চাইতেই থাকব এটা কি ভালোবাসা নয়?”
​তিনি হাসলেন করুণ এক উপহাসের হাসি, ” বিয়ের দিন রাতে তুমি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে না? আমি আর কারো প্রেমে পড়ব কি না? শোনো, প্রাণসঞ্চারিনী। প্রাজ্ঞরা জীবনে একবারই প্রেমে পড়ে, সরলমনা বোকারা দ্বিতীয়বার, আর চরিত্রহীনরা পড়ে বারবার।”

​”আর আমি? আমি তো বোকা নই, আর সরল মনের অধিকারীও না, আর না আমি চরিত্রহীন। তাহলে বলো তো, কীভাবে পড়ব? তোমার মায়াকে ইহকালে কাটিয়ে উঠতে পারব না। মৃত্যুর আগ অবধিও হয়তো তুমি থেকে যাবে মায়া হয়ে অন্তরের অন্তস্তলে। তুমি আমার ভীষণ আপন কেউ ছিলে, আজও আছো, আর সারাজীবনই থাকবে। তোমার স্থান আমার এই হৃদয়ে তুমি ব্যতীত সবার জন্য হারাম। তোমায় না পেয়ে আমি কষ্টে আছি, খুব কষ্ট ততটা কষ্ট, যতটা প্রকাশ বা বর্ণনা দ্বারা অসম্ভব। তারপরও বলি, তোমায় আমি না পেয়েও ভালোবাসি।”

রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে এবার এলো ঘুমানোর পালা। সারাটা দিনেও তালুকদারের মাইয়ার দেখা পায়নি তৌসির। আড়ালে থেকেছে নাজহা। আর তৌসিরও বাড়িতে ছিল না, পার্টি অফিসে চলে গিয়েছিল। এই এলো এসে গোসল করে খাওয়া দাওয়া খেয়ে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ঘরের মাঝখানে তাকায় দেখে নাজহা দাঁড়িয়ে আছে খুবই শান্ত রূপে।

তৌসির নাজহাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে নাজহার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
“সারাদিন আমার কাছ থাইকা লুকাইয়া কি হইলো? শেষে তো আমার বুকেই ঘুমাইতে হইবো।”
ভয়ে নাজহার পায়ের তালু পর্যন্ত কাঁপতে থাকে তৌসিরে কথায়। এখন তৌসির নিশ্চয়ই শেষ করে দিবে ওকে।
নাজহা ভয়ে ভয়ে তৌসিরের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”আমাকে মেরে দিবেন তৌসির?”
“আমাকে মেরে দিবেন” কথাটা যতটা সহজে বললো নাজহা, ততটা সহজ হলো না তৌসিরের পক্ষে শুনাটা। কেমন করে বুকের ভেতর মুচড় দিলো, মনে হলো জ্বলন্ত কয়লার গুঁড়া তৌসিরের কানে কেউ ঢেলে দিয়েছে। নাজহা যে এই কথাটাও অভিনয় করে বলতেছে তা অবশ্য তৌসির বুঝে গেছে। অভিনয় জেনেও তৌসিরের বেশ খারাপ লাগলো তবে কেন? এই গাদ্দারের জন্য এমন লাগলো? কি জন্য লাগলো তা জানা নেই তার।

তৌসির জবাবে তিক্ত সুরে বলে ওঠে,”তুই যে লেভেলের প্রো মাগি, তারপরও কি তোরে জীবতা রাখা যায়?”
তৌসিরের মুখের এই বিশ্রী গালি শুনে নাজহা এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুঁজে নেয় অপমানে। তারপর আবার খুলে ভয়কে দূর করে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে, “তাহলে মেরে ফেলুন না।”
​তৌসির এখন আর নাজহার চোখে ভয় দেখে না, বরং দেখতে পায় মৃত্যুর অপেক্ষা। তৌসিরের মনটা বিষাদে মিশে যায়। নাজহাকে কিছুতেই ভয় দেখাতে পারছে না, বড্ড সাহসী তার বাঘিনী। তৌসির এতে ঠোঁটের কোণে কঠিন হাসি নিয়ে ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ গলায় বলে, “ডাকাইতের বাইচ্চা! তুই যে গাদ্দারিটা করলি আমার লগে, তোর তো লো মাগি, চাপাতি দিয়া আগে পিস পিস কইরা কাটমু, তারপর মারমু।”

​এ বলে বাঁ হাত দিয়ে ডান শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে নাজহার দিকে আরেক কদম আগায়। নাজহা ভয়ে কি করবে খুঁজে পায় না। ও ঢোঁক গিলে তড়িৎ গতিতে গিয়ে বিছানার বেডের নিচে রাখা ওয়ালথার পি পিস্তল বের করে দুই হাতে চেপে ধরে তৌসিরের কপাল বরাবর ঠেকায়। এটা তাকে সেদিন মাস্টার চাচ্চু সেফটির জন্য দিয়ে গেছেন। প্রথম যখন পিস্তল ধরেছিল, হাত-পা কিডনি সহ কাঁপছিল, কিন্তু এখন আর কাঁপে না। প্রতিদিন নাজহা দু’বার করে লুকিয়ে প্র্যাকটিস করত পিস্তল ধরে হুমকি দেওয়ার। নাজহা তৌসিরের কপালে ওয়ালথার পি-টি ঠেকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “গাদ্দার তো আপনি মিয়া। বরশিতে যেমন মানুষ টোপ দিয়ে পানিতে ফেলে আর মাছ তা খাওয়ার ভেবে গিলে, আপনার করা অপরাধগুলো ঐ টোপ ছিল, যেগুলো আমি মাথা মোটা বলদ প্রমাণ ভেবে ঐ জানুয়ারের বাচ্চাকে দিয়েছিলাম। আমি ভাবিনি ঐ খাকিরি পোলাটাও গাদ্দার! যদি জানতাম, তাইলে এমন মিস্টেক করতাম না। মারবেন আমাকে? খবরদার, এই চিন্তা মাথায় আনবেন! দেখতে পাচ্ছেন হাতে কি? ওয়ালথার পি নাইন-নাইন, জার্মান কোয়ালিটির। একটা ঢুকলে সোজা ওপারে।”

​নাজহার এই বাড়াবাড়ি দেখে তৌসির হতবাক। তৌসির ভুরু কোঁচকায়। তারপরের মুহূর্তেই নিজের কোমরে গোঁজা গ্লক সেভেনটিন নামে নিজের পিস্তলটা এক ঝটকায় বের করে পিস্তলের ঠান্ডা নলটা নাজহার পেটে চেপে ধরে আর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “গ্লক সেভেনটিন অস্ট্রিয়ান। কিন্তু দেই গাইথা?”

​নাজহার রুহু কেঁপে ওঠে। নাজহা ধরে আছে তৌসিরের কপালে পিস্তল আর তৌসির ধরে আছে ওর পেটে। নাজহার হাত তিরতির করে কাঁপতে থাকে। এখন ও যদি শট মারে, তাহলে তৌসিরও মারবে। নাজহার পিস্তলে তো বুলেট আছে কি না, সে তাও জানে না, শুধু আত্মরক্ষার জন্য পিস্তলটা ধরেছে। কিভাবে গুলি ছুঁড়তে হয় তাও জানা নেই সঠিক ভাবে। তৌসির নাজহাকে ভয় দেখাতে ট্রিগার টেনে ধরে। সেফটি মোডে থাকা ট্রিগার টেনে ধরে চাপ দিতে হয় বুলেট ছোড়ার জন্য। তৌসির ট্রিগার টানতেই নাজহার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। ওর হাত থেকে নিজের অজান্তেই পিস্তল ‘টাশ’ করে মাটিতে পড়ে যায়। নাজহার পিস্তল ফ্লোরে পড়তেই তৌসির বাঁ হাত বাড়িয়ে সাঁড়াশির মতো হাত ওর কোমরটাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম করে খামচে ধরে। একটা পৈশাচিক টান দেয়। সাথে সাথে নাজহা শূন্যে ভেসে গিয়ে তৌসিরের পাথরের মতো শক্ত বুকের ওপর আছড়ে পড়ে। ওর ফুসফুস থেকে সবটুকু বাতাস সশব্দে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ও দম নেওয়ার চেষ্টা করার আগেই তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটে। ওর পেটের নরম ত্বকে, ঠিক পাঁজর ঘেঁষে, একটা অসম্ভব ঠান্ডা, কঠিন, গোলাকার বস্তুর মুখ চেপে বসে— আর তা হলো পিস্তলের নল। নলটা আরও গাঢ়ভাবে ঠেসে ধরে তৌসির দাঁত চেপে বলে, “দিতাম? দিতাম চাপ!”

​এমন পরিস্থিতিতে পড়ে নাজহার নিশ্বাসটা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায়। ওর মনে হলো, ও আর কোনোদিন শ্বাস নিতে পারবে না। ওর সমস্ত রক্ত মনে পা বেয়ে নেমে গিয়ে মেঝেতে মিশে যাচ্ছে, শরীরটা অবশ, অসাড় হয়ে গেছে। এইমাত্র তৌসির শেষ করে দিবে ওকে। নাজহা আর ভয় পায় না। ভয়কে জয় করে চিৎকার করে বলে ওঠে, “দিন! আমি মরে যাই! আমি মরে যাই!”

​তৌসির ওর কোমর আরও চেপে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলে, “নাজহা, তুই আমার লগে ক্যান এমন করলি? আমি খারাপ, তুই জানিয়াই তো বিয়া বইছিলি, তারপরও ক্যান গাদ্দারি করলি আমার লগে? তুই নোবেল প্রাপ্ত গাদ্দার জানিয়াও আমি তোরে বিশ্বাস করলাম আর তুই এই প্রতিদান দিলি?​এ মাগি, যখন নাটকি করলি তাহলে আমি যাওয়ার সময় কাঁদলি ক্যান? জানস, তোর চোখের ঐ মিথ্যা পানি আমি সত্য মনে করছি। আমি মনে করছি ঐটা তোর বাপ চাচার কাজ, তোর না। তুই শুধু ওগো প্রমাণ দিছোস। কিন্তু যখন রুম আর ফোন চেক দেওয়া হয়, তখনি তোর আসল সত্য জানতে পারি।​নাজহা, তোর চোখের ঐ মিথ্যা পানি আর অসহায় চাহনি আমাকে শেষ করে দিয়েছিল রে। জানস, একটা জেন্ত মানুষের শরীর থাইকা চামড়া তুইল্লা নিলি যেমনঅনুভূতি হয়, তেমন হয়ছিল আমার। আমি তোরে আপন ভাবলাম আর তুই এভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙ্গলি?”

নাজহা তৌসিরের প্রতিটি কথাই ওর চোখে চোখ রেখে শুনে এবার কঠিনভাবে শোধায়, “আপনার সঙ্গে সংসার করব? আপনার সাথে? আপনি আমার চাচার খুনি! আপনার জন্য আমার তিন-তিনটে চাচাতো ভাই-বোন এতিম! আপনার জন্য আমার পঁচিশ বছর বয়সী চাচী বিধবা জীবন কাটাচ্ছেন! শুধুমাত্র আপনার জন্য! আপনার সাথে যা করেছি তাতে বিন্দুমাত্র ভুল নেই! আপনাকে তো কুপিয়ে মারা উচিত ছিল আমার, যেভাবে কুপিয়েছিলেন আপন আমার নূর চাচাকে।”

তৌসির দাঁতে দাঁত চেপে নাজহাকে ঝাঁকিয়ে তুলে বলে, “তোর চাচাকে আমি মারি নাই! আব্বারে কোপ মারতে আইছিলো, আমি শুধু ধাক্কা মারছি! ধাক্কা খাইয়া পইড়া শ্বাসকষ্ট উঠছিল! তারপর তোর চাচারে মারের মাঝখান থাইকা তোর বাপ আর তোর ইকবাল চাচা নিয়া যায়। পথে মইরা যাওয়ায় নিজরাই লাশরে কুপায় যাতে আমারে ফাঁসাইতে পারে। কিন্তু কোর্টে প্রমাণ হয় নাই এইটা! ফরেনসিক করে সত্যিটা প্রমাণ হওয়ায় তোর ঐ ল’ইয়ার চালাক ফুফু নিজেদের ঘাড় থেকে দোষটা নামানোর লাইগা কেস বন্ধ কইরা দেয়। তুই জানস না এগুলা?”
নাজহা তৌসিরের মুখ থেকে সত্যটা শুনে হতভম্ব হয়ে তৌসিরের মুখপানে চেয়ে থাকে। নাজহা নিজেও সত্যটা জানে, তারপরও এইটা না জানার ভান করে বলেছে যাতে তৌসির আসল উদ্দেশ্য আঁচ করতে না পারে। নাজহা নিশ্চুপ হয়ে পাথরের রূপে দাঁড়িয়ে রয়। তৌসির পিস্তলের নল দিয়ে গুঁতা মেরে জিজ্ঞেস করে, “দেই, চালিয়ে দেই?”

নাজহা তৌসিরের প্রশ্নটি শুনে স্থির হয়ে যায়। বুকের ভেতর সহস্র ডমরু বেজে ওঠে এক সাথে। ঢোঁক গিলে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। এই শ্বাস শুধু বাতাস নয়, জঠরের ভেতর জমে থাকা জমাটবাঁধা আতঙ্কের হিমশীতল বাষ্প। মৃত্যুর খুব ভয় নাজহার, মারাত্মক ভয়, এত ভয় যে শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল স্তব্ধ হয়ে যেতে চাইছে। ভেতরের সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। যতবার সে জোর করে মুখ থেকে উচ্চারণ করেছে, “মেরে দিন,” ঠিক ততবারই তার মন-প্রাণ সেই কথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠেছে। মন চায়, আরেকটু, শুধু আরেকটু থেকে যেতে এই পৃথিবীর মায়ায়। এই অপরূপ পৃথিবীতে আরও একবার রঙ দেখতে চায় সে, নিজের হাতে সেই রঙে নিজেকে সাজাতে চায়। জানে তো, এই খেলা ফুরোলে আর তো ফেরা হবে না! আর তো জন্ম হবে না! জন্ম যে একটিবারি হয়!
অসহায়ত্বে নাজহার সমস্ত শরীর এলিয়ে আসে। এই মুহূর্তে নাজহার চোখ দুটি জীবনের শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজছে। শিশুর মতো করুণ, মরণাপন্ন দৃষ্টিতে সে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বড্ড অসহায় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,

“আ… আমাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না?”
এখানে প্রশ্নে ছিল না কোনো অভিযোগ। ছিল শুধু এক আর্তি, এক আকুল মিনতি মৃত্যুর হিমশীতল দরজায় দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ উষ্ণতার জন্য এক করুণ কাকুতি। এ আকুতি শুনে তৌসির উত্তরে কঠিন গলায় বলে, “না, যায় না! তোর মতো ডাকাইতকে বাঁচানো সম্ভব না।”
“মাফ করে দিন না আমাকে, তৌসির। আমার বাঁচার খুব ইচ্ছে। এ পৃথিবীর একটুখানি সুখ অনুভব করার খুব আক্ষেপ। দিবেন প্রাণটা ভিক্ষে?”

তৌসির তো জীবনেও নাজহাকে মারবে না, শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য এমন করছে। তাই রুক্ষ গলায় বলে ওঠে, “তোর মতো নোবেল প্রাপ্ত গাদ্দারীনিরে বাঁচাইয়া রাখা আর নিজের গার্দনায় আজরাইল লইয়া ঘুরা একি কথা।”
নাজহা কাতর দৃষ্টিতে তৌসিরের চোখে চেয়ে অনুনয়ময় গলায় বলে, “আমাকে সত্যি মেরে ফেলবেন?”
তৌসির পিস্তলের নলটা আরও শক্ত করে ধরে বলে, “তুই তো মীরজাফরের প্রো ভার্সন! তাই তোরে শুধু মারমু না, মাইরা তোরে মীরজাফরের কবরের পাশে কবর দিয়া আসমু।”
নাজহা কিছু খুঁজে পায় না। আকুতি করে লাভ হবে না, তৌসির নির্দয় সে জানে। নাজহা হঠাৎই দুই হাতে তৌসিরের হাতে ধরা পিস্তলটা চেপে ধরে বলে, “গুলি ছুঁড়ুন! ছুঁড়ুন বলছি!”

নাজহার হাত থেকে তৌসির পিস্তল সরাতে চায়। ট্রিগার টানা চাপ লাগলেই গুলি চলে যাবে। তৌসির ওর হাত সরানোর চেষ্টা করে ধমকে বিষাক্ত গলায় বলে ওঠে, “এ ছিনাল ছাড়! ট্রিগার টানা চাপ লাগবো!”
নাজহা শক্তি দিয়ে পিস্তল ধরে চিৎকার করে ওঠে, “মারবেন তো মেরে দিন! মারুন বলছি!”

তৌসির ওর হাত থেকে ছাড়াতে চায়, কিন্তু নাজহা ছাড়ে না। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ‘টাশ’ করে বেজে একটা ওঠে একটা শব্দ । দুজনের হাত থেকে করে পিস্তলটা মাটিতে পড়ে যায়। তৌসিরের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, হাত-পা অবস হয়ে আসে। নাজহা আর ধরে রাখতে পারে না। অবস হাত-পা দিয়ে কি আর কোনো কিছু ধরে রাখা সম্ভব? চামড়ার নিচের স্নায়ুগুলো স্তব্ধ হয়ে যায় তৌসিরের । সারা শরীর হিমশীতল হয়ে আসে। নাজহার পেটের ডান দিকে বুলেট গেঁথে গেছে ও নিজেই নিজেকে গুলি মেরে দিয়েছে। নাজহা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, টলতে শুরু করে। পেটের ডান পাশে হঠাৎ আগুনের ফুলকি বিস্ফোরিত হয়ে গেছে। নাজহা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এক মুহূর্ত আগেও পৃথিবীটা ছিল চলমান, আর এখন সবকিছু থমকে গেছে।

বাতাসের শব্দ, এমনকি নিজের নিঃশ্বাসও মনে হচ্ছে দূরে কোথাও আটকে গেছে। গুলির দাহ শরীরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের মতো, প্রতিটি স্নায়ুতে ব্যথার অশ্রু গড়িয়ে নামছে। ও চায় চিৎকার করতে, কিন্তু গলা শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট শুধু নিঃশব্দে কাঁপছে। নাজহা টলতে থাকে আর তখনই ওর চোখে পড়ে নিজের পেটের ডান পাশে গাঢ় লাল রঙের ভেজা দাগে। সাদা ড্রেসের একাংশ রক্তে ভিজতে শুরু করেছে। রক্তটা প্রথমে ধীরে গড়িয়ে নামে, তারপর হঠাৎ ফিচফিচ শব্দে ফেটে বেরোতে লাগে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে নাজহার। নাজহা দুই হাতে পেট চেপে ধরে তৌসিরের বুক থেকে সরে যায়। সরে যেতেই ফ্লোরে ওর রক্তাক্ত শরীরটা লুটিয়ে যায়। তৌসিরের ধরে রাখার শক্তি নেই আর। নাজহা মাটিতে পড়তেই তৌসির অনেক কষ্টে শক্তি জাগিয়ে এক হাত ওর হাত টেনে ধরে অন্য হাতে ওর পেটে রক্তের ফোয়ারা যে ছুটেছে সেখানে চেপে ওর মাথার পাশে বসে হন্তদন্ত হয়ে বলে, “ও ছিনাল! তুই কি করলি এইটা! নাজহা, তুই এত সহজে মরতে পারস না! এই মন্দ লোকের ঘর তোর করতে হইবো! নাজহা, আমার লগে গাদ্দারি কইরা এমনে মরতে পারস না তুই! ক্যান গুলি করছোস!”

তৌসিরের এই আহাজারি শুনে নাজহা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। পেট থেকে হাত সরিয়ে রক্তাক্ত হাতে তৌসিরের গাল ছুঁয়ে বলে দিয়ে বলে, “জানি মরতে আমায় হবে। মেয়র সাব যদি মরে যাই, তাইলে এই গাদ্দারের লাশটা আগুনে না পুড়াইয়া কবর দিয়েন।”
তৌসির এই কথাটা শুনে চিৎকার করে ওঠে, “নাজহা! তোরে কে কইছে আমি তোরে মারমু! তুই আমার বউ, তোরে কেমনে মারমু আমি! আমার সাথে করা তোর সব দোষ মাফ! তালুকদার মাইয়া, আমার নিয়তি আমার বেলা বরাবরই বড্ড নিষ্ঠুর রে! তুইও ওমন নিষ্ঠুর হবি? তুই আমার লগে গাদ্দারি করিস, সারাজীবন করিস! তুই গাদ্দারি কইরা আমারে শুধু জেলে ক্যান, কবরেও পাঠাইয়া দিস! আমি অভিযোগ করমু না, সত্যি বলতাছি কোনো অভিযোগ করমু না! চোখ খুল কৈতরি! চোখ খুল! চোখ বন্ধ করিস না!”
এ বলেই তৌসির নাজহাকে কোলে তুলে নিতে থাকে। নাজহার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বাঁ হাত দিয়ে তৌসিরের গলা জড়িয়ে ধরে রক্তাক্ত হাতটা তৌসিরের গালে আবারো হাত রেখে মুচকি হেসে বলে, “তৌসির সাব, যদি ফিরতে পারি তাহলে আবারো বিশ্বাসঘাতকতার খেলা খেলব আপনার সাথে। ঐ খেলায় কিন্তু আমাকে রাণী বানাতে হবে।”

তৌসির আর কিছু শোনে না। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। এই মেয়ে কিভাবে বুঝবে যন্ত্রণার কথা! ও যে অনুভূতিহীন! তৌসিরের যে ভারী ব্যাথা লাগছে বুকে! প্রাণটা কেউ বোধহয় টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়েছে। এই মুহূর্তে নাজহার পেট থেকে টলটলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সাদা কামিজের ডান অংশ লাল রূপ নিয়েছে। তৌসিরের সাদা পাঞ্জাবিতে লাল দাগ লেগে গেছে। তৌসির ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ওকে শাসিয়ে বলে দেয়, “তালুকদার মাইয়া, এভাবে মৃত্যুর অজুহাতে পালিয়ে গেলে হবে না! এই মন্দ লোকের নিন্দার সংসার তোমায় করতেই হবে।”
তৌসিরের চাপা কণ্ঠস্বর নাজহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে ঠিকই, কিন্তু সেই শব্দগুলিকে মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াকরণ করার মতো সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই তার। সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ায় নাজহা ধীরে ধীরে মাথাটা তৌসিরের অভীষ্টের উষ্ণ বুকে এলিয়ে দেয়। সহসা পৃথিবীর আলো নিভে যায়, তার ক্লান্ত, ভারী পাপড়িগুলো নেমে আসে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করল চোখ খোলা রাখতে, কিন্তু সেই চেষ্টা এখন এক নিষ্ফল বিদ্রোহ মাত্র।

​নিজেকে গুলি করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না নাজহার! তবে নিয়তির কী নির্মম পরিহাস সে নিজের বোকামির কাছেই বুঝি আজ পরাস্ত হয়ে গেল। ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিল, তৌসির তাকে এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচিয়ে রাখবে না। সেই ভয়েই নাজহা তৌসিরকে আঘাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল, পিস্তল ঘুরিয়ে তৌসির কে গুল করে হত্যা করা অসম্ভব, তখন মৃত্যুভয় তাড়িত হয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে সে নিজের দিকেই বন্দুকের নল ঘুরিয়ে চালিয়ে দেয় জোর করে। কারণ ওর একমাত্র ধারণা ছিল তৌসির তাকে মারবেই, নিশ্চিতভাবে মারবেই।
​কিন্তু এখন, এই শেষ সময়ে, নাজহা গভীরতম সত্যটি প্রথমবার অনুধাবন করতে পারল তৌসির তাকে মারত না। কখনোই না। কখনোই সে এত নিষ্ঠুর হতে পারত না।

​তৌসিরের বুকের ওপর মাথা রেখে সে শুনতে পায় এক ভয়াল ধ্বনি, তৌসিরের ভেতরের হৃৎপিণ্ডটা তীব্র বেগে ‘টাশ টাশ’ শব্দে আছড়ে পড়ছে। সেই শব্দ নাজহার কানে এক ত্রাস সৃষ্টি করছে। তৌসিরের শরীর কাঁপছে, আর তার হৃদয় স্পন্দন বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে কতটা আতঙ্কিত, কতটা বিপর্যস্ত।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২০

​নাজহার নাকটা তৌসিরের শার্টের বোতামের ফাঁকে, তার বুকের উষ্ণ ত্বকে চেপে দেয়। মুহূর্তেই এক তীব্র, পরিচিত ঘ্রাণ নাজহার মস্তিষ্কের গভীরে আঘাত করে। এই ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণ নাজহার কাছে পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্যের চেয়েও দামি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুগন্ধিগুলোও এই পুরুষালি, স্বাভাবিক ঘ্রাণের কাছে তুচ্ছ, যা তৌসিরের শরীর থেকে নিঃসৃত হয় যা সে কোনো প্রসাধনী না মেখেও বহন করে।
​মুহূর্তের জন্য সমস্ত যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে, নাজহা শেষবারের মতো যতটুকু সম্ভব বুক ভরে শ্বাস টানে। এই প্রিয়তম ঘ্রাণটা সে তার অস্তিত্বে ধারণ করে নেয়।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here