স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৩

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৩
সানজিদা আক্তার মুন্নী

তৌসির বসে আছে বাগানে রাখা মিটিং-মাটিং করার সোফায়। ওর সাথে নাযেম চাচাও বসে আছেন।তৌসিরদের সামনে এক সুন্দরী কম বয়সী রমণী দাঁড়িয়ে আছে, ছোট্ট একটা খোলামেলা পোশাক পরা অবস্থায়। তৌসির মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,”তা কুমারী তো? সত্যি তো?”
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্ব জ্বি!”
তৌসির মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ঘৃণার চোখেই বলে,”তা এই পথে ক্যান? দেখলে তো ভালো ঘরেরই মনে হইতাছে!”

মেয়েটি এটা শুনে নাক কুঁচকে বলে,”কেনো আবার? নিজেকে কাজে লাগিয়ে নিজেই বড় হওয়া!”
তৌসির এটা শুনে হেসে বলে,”ভালোই কথা বলতে পারো দেখি।”
নাযেম চাচা বলেন,”তৌসির, যখন কুমারী, তাইলে এরে আলমের ভাতিজা তন্ময়ের কাছে পাড়াইয়া দে। ও কুমারী মাইয়া বেশ পছন্দ করে, রেটও দিবো ভালো, সাথে কমিশনও!”
তৌসির নাযেম চাচার কথা শুনে মেয়েটির দিকে তাকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে,”এক রাইত তন্ময়ের লগে থাকবা, রেট দিবো সত্তর হাজার হইবো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেয়েটি এটা শুনে খুশিতে নেচে উঠে বলে,”হবে!”
তৌসির এটা শুনে ওকে যাওয়ার জন্য ইশারা দিয়ে বলে,”ওকে, তাইলে এই থাইকা এখন ভাগো, কখন কোথায় যাইবা বইলা দিমু কাইল।”
কিন্তু মেয়েটি যায় না। মেয়েটি তৌসিরের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,”কিন্তু আমি যে নিজের সবটুকু আগে আপনাকে দিতে চাই, নেতা সাহেব!”
এ বলেই মেয়েটি তৌসিরের দিকে নিজের হাত ছোঁয়ার জন্য বাড়ায়।তৌসিরের মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। তৌসির ছিটকে সরে গিয়ে রুক্ষ গলায় বলে,”দূর মাগি, ছুইস না আমারে! আমি বিবাহিত!”

তৌসিরের এই গালি শুনে মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তারপরও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তৌসিরের পাশে সাহস করে বসে ওর ওপর হেলে পড়তে নেয়। এতে তৌসির বেশ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেজাজ ধীরে ধীরে খুনি হয়ে উঠছে এই ছেঁছড়ামি আচরণে।তৌসির উঠে গিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,”দেখ, তুই দেহ-ব্যবসা করবি কর, কিন্তু এইগুলা আমার লগে না। আমার নির্ধারণ করা লোকের লগে। যা এন থাইকা ভাগ, মাগি।”

মেয়েটি এতে প্রচণ্ড রেগে যায়। এমন অপমান সহ্য করার মতো তো আর নয়।মেয়েটি তৌসিরের পাঞ্জাবি ধরে আলতো টেনে ইনিবিনিয়ে বলে,”কি হইছে বিবাহিত? আমার সমস্যা নাই। আপনি আমাতে মিশতে পারেন!”
এই উক্ত বিষয়গুলো নাজহা ওপর থেকে দেখছে, সব শুনছেও, তবে অবাক হচ্ছে না, কারণ এদের নোংরামি সম্পর্কে নাজহার যথেষ্ট ধারণা আছেই। আসলে এরা বিভিন্ন ভালো, কুমারী, অল্প বয়সী মেয়েদের এসবের কুবুদ্ধি, কুমন্ত্রণা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেহ-ব্যবসায় নিয়োজিত করে, তারপর নিজেদের দেশি-বিদেশি ক্লায়েন্টদের উপহার দিয়ে কাঁচা ডলার হাতিয়ে নেয়। আর এগুলোর মূল শেকড় তৌসিরের বিবিজান নূরজাহান হাতুন। এক খবিস মহিলা নাজহার চোখে উনি।

তৌসির মেয়েটির এমন ছেঁছড়ামি দেখে কিছু সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রয়, তারপর এক ঝটকায় কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে টাশ করে মেয়েটির কপাল বরাবর একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়। টাশ করে উঠে পুরো বাড়ির উঠোন, তারপর আবারো নীরব হয়ে যায়।মেয়েটির মাথা থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। মেয়েটি টাশ করে লুটিয়ে পড়ে।তৌসিরের এই কাণ্ড দেখে নাযেম চাচা বিরক্ত হয়ে বলেন,”সাউয়ার, রাগ সামলাইতে পারস না? এখন এই মাগি রে মাইরা ফেললি! এখন ঐ খানকির পোলারে কি দিবি?”
তৌসির পিস্তল সোফায় ছুঁড়ে মারতে মারতে তিক্ত সুরে বলে,”লাশই দিয়া দাও। ওর তো দেহ দরকার জিতা আর মরা দিয়া কি করবো? তাজা আছে লাশ।”

এ বলেই লুঙ্গি টাখনু দিয়ে বারি মেরে তুলে দুই হাতে তুলে ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পাঞ্জাবিতে রক্ত লেগেছে। রক্তের দিকে তাকিয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলে,”সাউয়ার, এক জীবন মাইরি যেইদিকে যাই, ঐদিকেই গাদ্দারি!”
তৌসির এই নারীর ঝামেলায় বেশি থাকে না। এগুলো ওর বিবিজান আর নাযেম চাচা, মিনহাজ মামাই সামলান। তবে মাঝেমধ্যে দু-একজনকে ধরে ক্লায়েন্টের হাতে তুলে দেয়।

নাজহা এক দৃষ্টিতে মেয়েটির পড়ে যাওয়া লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা অমানুষ এরা!আজ নাজহার বাড়ির লোক কেউ আসেনি, আগামীকাল আসবে নাকি নাজহার মন বলে, না এলেই ভালো।আর নিজের বাপ-চাচার মুখ দেখতে ইচ্ছে হয় না ওর। আজ তাদের স্বার্থপরতার নীড়ে ওর শ্যামপুরুষকে ও হারিয়েছে। চায় না আর ওদের মুখোমুখি হতে।নিজের শ্যামপুরুষকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নাজহা যতটা পুড়েছে, ততটাই পুড়ুক তারা। ততটাই কষ্টে জর্জরিত হোক তারা।নাজহা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এসব আওড়াচ্ছে।
এ সময় তৌসির রুমে আসে। এসে নাজহা না দেখে বুঝে নেয় নাজহা বেলকনিতে আছে। তাই আর এদিক-ওদিক না তাকিয়ে নিজের পাঞ্জাবিটা বদলিয়ে বিছানায় রাখে।
আর বিরক্ত গলায় গালি দিয়ে বলে,

“এই বালের মাইয়া, সারাক্ষণ বেলকনিতে পইড়া থাকে।”
এ বলতে বলতে তৌসির ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। মেজাজ ভালো না, খারাপ। খারাপ মেজাজটা। খুন টুন করলেও হাত চুলকায়, আবার না করলেও অশান্তি অশান্তি করে ভেতরে। এ মনে হচ্ছে মহান এক যন্ত্রণা। তৌসির বেলকনিতে পা রাখাতেই ওর নজর বন্দী হয় মোহান্ধ এক বিমূর্ত-সুন্দর চিত্ররূপ নাজহা দাঁড়িয়ে আছে। কোমরের নিচ অবধি কোঁকড়ানো বাদামী কেশতরঙ্গ, চুলগুলো ছিটিয়ে আছে ওর পিঠে, হালকা বাতাসে উড়ছে। নাজহা আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে। তৌসির পেছন থেকে নাজহার চুলের দিকে খানিক মুহূর্ত চৈতন্যবিভোর হয়ে চেয়ে রয়। তারপর কিছু সময় পর বলে ওঠপ,” তালুকদারের মাইয়া, রাইত বিরাইতে এমনে দাঁড়াইও না বেলকনিতে আইয়া। পরে জ্বিনের বালগুলো তোমার রূপের আগুনে জ্বইল্লা তোমার পিছনে যাইবো কুত্তার মতো পইড়া।”

নাজহা তৌসিরের কথা শুনে খানিকটা ভরকে যায় তারপর ধীরে ধীরে পিছন ফিরে তাকায়। একবার তাকিয়ে চোখ অন্য দিকে সরিয়ে নেয়। তৌসিরের পরনে চেকের লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি। স্যান্ডু গেঞ্জি পরায় তৌসিরের বলিষ্ঠ জিম করা নিখুঁত পুরুষালি শরীরটা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ফর্সা গায়ের রঙের জন্য আরো বেশি নিখুঁত লাগছে। তৌসির নাজহাকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে বলে, “শুনো, এমনে নাক ছিটকাইও না, আমি তোমার জামাই, বাইরের কেউ না!”

নাজহা তৌসিরের কথায় অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, “আমি এই বিয়ে মানি না। আমি আপনাকে স্বামী মানি না!”
নাজহার কথা শুনে তৌসির নাজহার দিকে একটু এগিয়ে এসে কপাট গলায় বলে, “জামাই মানস না তাইলে এনে কী করস? যা দৌড় দে নিজের বাড়িতে। আমার তো তোর মতো বউ লাগবো না।”
নাজহা তৌসিরের কথায় তৌসিরের দিকে কটমট চোখে তাকায়। রাগে গা ঝা ঝা করছে এত বড় অপমান! নাজহা নিজের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে, “চলে যেতে পারলে থাকতাম না এখানে!”
তৌসির এতে হেসে বলে, “জানি তো, যাইতে পারবা না কারণ তোমার বাপ চাচা সবগুলোই তো ইতর হালার হালারা। তুমি চইলা গেলেও আবার আমার কাছেই দিয়া যাইবো।”
নাজহা তৌসিরের কথা শুনে কিছু সময় চুপ করে রয়। সত্যি তো তৌসির তো ভুল কিছু বলেনি। নাজহা কে চুপ করতে দেখে তৌসির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আচ্ছা বাদ দাও, যাও আমার পাঞ্জাবিটা ধুইয়া দাও, কাইল সকালে পরতে হইবো!”

নাজহা তৌসিরের কথায় মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “একটা অসহায় মেয়েকে মেরে গায়ে তার রক্ত মেখে সেই রক্ত মাখা পাঞ্জাবি আমায় ধুতে বলতেছেন? আমাকেও পাপের অংশীদার বানাতে চান?”
তৌসির এটা শুনে অল্প তিড়িক করে রেগে বলে, “ঐ মাগি! তোমার জামাইরে বিছানায় টানতাছিল, আর ওরে তুমি অসহায় কইতাছো?”
নাজহা এই গালি শুনে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় কি গালি! নাজহা দাঁত চেপে বলে, “মানুষের বিছানায় পাঠাতে পারেন, অথচ নিজে যেতে পারেন না?”

নাজহার এমন ঘাড়ত্যাড়ামি কথা তৌসিরের গায়ে মেখে যায় তেলের মতো। মনে হয় কেউ গরম তেলের ছিটা উপচে পড়লো। তৌসির দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিজের থুতা সামলে নে, সাউয়ার মাইয়া, নয়তো থুতা আস্থা রাখমু না!”
নাজহা ভয় পায় না তৌসিরের কথায়, উল্টো নিজের কালচে সবুজ চোখের কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে তৌসিরের চোখে, এবং রুক্ষ গলায় বলে, “আমার থুতা ঠিকই আছে। নিজেকে সামলান। পাপে তো ঘা হয়ে যাচ্ছে অন্তর আপনার।”

তৌসির নাজহার সাহস দেখে থমকায়। বেশ সাহস বেড়ে গেছে এই ছোট্ট মেয়ের বয়স হয়নি এক চিলতে আর এত বড় বড় কথা! তৌসির নাজহার চোখে চোখ রেখে হুমকি দিয়ে বলে, “আমি পাপি, আর আমার পাপে আমারে ক্ষয় করবো, তাতে তোমার কি?”
“আর আপনি তো পাপি না, আপনি একটা জানোয়ার। পাপি বললে পাপিকেও অপমান করা হবে। নিকৃষ্টের চেয়েও নিচু আপনি।”
“আমি যেই সাউয়ারই হই না ক্যান, তাতে তোমার কি?”
নাজহা এই ‘তোমার কি, তোমার কি’ আর গালি শুনে দ্বিগুণ রেগে ওর দিকে এগিয়ে বলে, “নিকৃষ্টদের একটাই অস্ত্র আর তা হলো অশ্লীল বাক্য!”

“বেশি মুখ লম্বা করো না, নয়তো……
তৌসির আর কিছু বলতে পারে না। হঠাৎ নাজহা ওর থেকে কথা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে ওর দিকে ধমকিয়ে তাকিয়ে বলে, “নয়তো কি? মারবেন? খুন করবেন? নাকি নিজেরা ব্যাবসায় বেচে দিবেন? কি করবেন? এগুলোই তো করতে পারেন, আর কোনো বাল পারেন করতে? পাপ ছাড়া কখনো জীবনে কিছু করেছেন? নিন, করুন, আপনার জন্য আমার জীবনের সব চিত্রল হারিয়েছে এবার জীবনটাও নিয়ে নিন। তাহলে শান্ত হবেন!”
নাজহার হঠাৎ এমন রাগ দেখে তৌসির চোখ বড় বড় করে নাজহার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভেবে নেয় এর লগে সত্যি জ্বিন ট্বিন লাগলো না তো? তৌসির নাজহাকে ভয় দেখাতে হুংকার দিয়ে বলে, “এই চুপ! এত কথা বলবি না, যা গিয়া মরণের ঘুম ঘুমা। আমার লগে ফ্যাত ফ্যাতি করলে জীবন্ত কবর দিয়া দিমু!”

তবে নাজহা কি ওর ধমকে ভয় পাওয়ার মেয়ে? নাজহা আরো বেশি চিৎকার করে বলে, “তো দিয়ে দিন!”
তৌসির নাজহার কথায় মারাত্মক রাগ ওঠে। তৌসির নিজের লুঙ্গির নিচের কোণ তুলে হাতে নিয়ে কোমরে গুঁজে নিতে নিতে বলে, “কুত্তার বাইচ্চা! তুই আমারে তোর সাউয়ার রাগ দেখাস? আমার লগে ফ্যাত ফ্যাতি করস? আইজ তোর সাউয়াগিরি আমি বের কইরা দিমু!”
এ বলেই তৌসির সাপের মতো ফুঁস ফুঁস করে নাজহার দিকে এগিয়ে যায়।
খানিকক্ষণ পর………………

নাজহা চিৎকার করছে, চিৎকার করে কান্না করে বলছে, “আম……. আমায় উঠান……… জানোয়ারের মতো কাজ করবেন না! উঠান আমায়!”
এ বলে নাজহা দুই হাতে মাটি আঁকড়ে ধরে পিছতে থাকে। তৌসির ওর এমন অসহায় চিৎকার দেখে দাঁত কেলিয়ে বলে, “কই গেলো এত ঝাঁজ? আর দেখাবে ঝাঁজ?”

নাজহা ঢোক গিলে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে, “ন…. ন…..আর এমন করবো না আমায় তুলুন এখান থেকে।”
এ বলে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। আসলে নাজহাকে তৌসির কবরের ভেতর বসিয়ে রেখেছে সেই মেয়েটির লাশ কবর দেওয়ার জন্য যে কবর খোড়া হয়েছে বাড়ির পেছনে। তৌসির নাজহাকে রাগে এই কবরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, কারণ ও মুখে মুখে তর্ক করছিলো। কবরে ফেলেছিলো তো, কিন্তু তাও নাজহা ভয় না পেয়ে উল্টো তৌসিরকে গালাগালি করছিল, তাচ্ছিল্য করছিল। তাই তৌসির ওকে ভয় পাওয়াতে এখন কয়েকটা বিচ্ছু ছেড়ে দিয়েছে কবরে। আর নাজহা ভয়ে মরছে। তৌসির কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বুকে হাত গুঁজে নিতে নিতে বলে, “তালুকদারের মাইয়া, তোমার সাউয়ার রাগ তোমার কাছেই রাইখো, নয়তো নেক্সটে এমন কিছু হইলে সাপঝুলাই দিমু গলায় !”

নাযেম চাচা আর মিনহাজ মামা তৌসিরকে গালি দিয়ে বলেন, “থাপ্পড়ি দাঁত ফালাইয়া দিমু! ওরে তাড়াতাড়ি তোল! বউরা রাগ ঝাপ করবেই, এগুলো সহ্য করতে হয়। এমন করলে সংসার করবি কেমনে?”
তৌসির বুক ভরে শ্বাস নিয়ে এক লাফে কবরে নামতে নামতে বলে, “আর সংসার! যেই লেদা বাইচ্চা ঝুলাইছো গলায়, এরে লগে সংসার করার বদলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করন লাগবো আমার।”
এ বলে গ্লাভস হাতে বিচ্ছুগুলো হাতে নিয়ে উপরে অন্যদিকে ছুড়ে মারে। নাজহা এখন ভয়ে সিটিয়ে আছে। মিনহাজ মামা বলেন, “তুই বউমারে নিয়া আয়, আমরা গেলাম।”

এ বলে নাযেম চাচা আর মিনহাজ মামা চলে যেতে থাকেন। তৌসির মুচকি হেসে নাজহার দিকে তাকায়, তবে হাসিটা মুচকি না, তাচ্ছিল্যের বললে ঠিক হবে। নাজহার দিকে তাকায় তৌসির, একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চায়, কিন্তু বর সাধ্য হয় না ফিরিয়ে নেওয়ার। নাজহার ফর্সা গালে অল্প মাটি লেগে আছে। নাজহার কুয়াশা মাখানো কালচে পান্নার মতো সবুজ চোখে তৌসির স্পষ্ট ছুঁয়ে যাওয়া ঘেন্নার চাহনি দেখতে পাচ্ছে। নাজহার তপ্ত কুসুমরাঙা রক্তিম অধর খানা রাগে কাঁপছে। মনে হচ্ছে অধরদ্বয় জোড়া গোলাপকুসুমের খাঁচা। তৌসির নিজের নজর কে সামলাতে চোখ বুঁজে কিছু সময় বুক ভরে শ্বাস নেয় তারপর চোখ খোলে নাজহার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,” চলো উডো!

কিন্তু নাজহা ওর হাত ধরে না নিজেই ধীরে ধীরে উঠে দাড়ায়। উঠে দাড়িয়ে তৌসিরের দিকে রুক্ষ চোখে কিছু মুহুর্ত চেয়ে থেকে বলে,” উপরে উঠুন যান তারপর আমি উঠবো! ”
তৌসির নাজহার কথায় কিছু বলে না চুপচাপ কবেরর পাড়ে উঠে এক হাঁটু ঘিরে বসে নাজহার দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু নাজহা আবারো আগের মতো কাজ করে নিজেই নিজের কষ্ট করে পাড়ে উঠে পড়ে। তৌসির নাজহার এমন জেদ দেখে দাঁত চেপে বলে, ” জেদ দেখাইতাছো? ! ”
কিন্তু নাজহা কোনো উওর দেয় না চুপচাপ নিজের ওড়নাটা মাথায় টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়! নাজহার এমন উগ্র স্বাভাব দেখে তৌসির তপ্ত শ্বাস ফেলে আসমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” তুমি এই কেমন ঝাল মরিচ আমার কপালে জুটাইলা আল্লাহ।

ঘড়ির কাঁটা তিনটায় এসে থেমেছে।
চারপাশ একদম স্তব্ধ নিস্তব্ধত, কেবল মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে পেছনের ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু সুর। এমন সময় নাজহা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পেছনের সেই কবেরের কাছে। এত রাতে এখানে আসার একটাই কারণ আর তা কি? তা হলো প্রতিশোধ। তৌসিরের কাছে তার ভাঙা আত্মসম্মানের, যন্ত্রণা আর অসহায়ের প্রতিশোধ নেওয়া।
ওর হাতে পড়া আছে তৌসিরের ফেলে রাখা ঐ গ্লাভস যা পড়ে তৌসির কবরে বিচ্ছু ছেড়েছিল। নাজহা কবেরের চারপাশে নিঃশব্দে ঘুরে ঘুরে কিছু একটা খুঁজছে।অবশেষে ওর চোখ পড়ে এক কালচে রঙের বিচ্ছুর উপর। সেই বিচ্ছুগুলোর মধ্যে একটা যেগুলো দিয়ে তৌসির ওকে ভয় দেখিয়েছে।

তখনকার অপমানে রাগে রাতে ঘুম হয়নি ওর তাইতো এসেছে এখানে। রাগে শরীরের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়তো চিৎকার করে পালাতো ও। কিন্তু এখন ভয় পায় না উল্টো নিঃশব্দে গ্লাভস পরা হাতে বিচ্ছুটিকে তুলে নেয়। নিজের হাতে নিজের ন্যায়ের অস্ত্র তুলে নিচ্ছে আরকি।তারপর চোরের মতো নিঃশব্দে বাড়ির ভেতর ঢোকে আবারো। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় নিজেদের ঘরের দিকে। রুমে এসে দেখে বিছানায় তৌসির নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, চিৎ হয়ে।নাজহা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে। তারপর ধীরে ধীরে বিছানার পাশে গিয়ে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“আমায় ভয় দেখাও? এবার দেখো আমার খেলা।” এ বলে পা টিপে টিপে আরেকটু এগিয়ে তৌসিরের পায়ের কাছে ঝুকে পড়ে। খুব সাবধানে ওর লুঙ্গির অল্প একটু অংশ টেনে তুলে আনে টাখনুর কাছ থেকে। তারপর সেই বিচ্ছুটিকে ছেড়ে দেয় সেখানে।তৌসিরের ঘুম এখনও ভাঙেনি।নাজহার বিচ্ছুটি ছেড়ে দিয়ে মনে মনে বলে, “একটুখানি হলেও আমি শান্তি পাবো।”

কেউ একজন এই গভীর রাত্রিতে নিঃশব্দে বসে আছে তালুকদার বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে। পড়নে তার কালো রঙের শার্ট, সঙ্গে রঙছাটা একটি প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঠোঁটের কোণে কালচে আভা চোখজোড়া লাল, শার্টের বোতামগুলো খোলা পুরোটা ছন্নছাড়া এক অবয়ব।চারপাশে কেবল এখন পেঁচা আর কুকুরের ডাক। প্রকৃতিও হয়তো থমকে গেছে তার বিষণ্ণতায়।সে এক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীটা শূন্য হয়ে গেছে।ভেতরটা এক্কেবারে ফাঁকা লাগছে।নিজের সবটুকু শূন্য শূন্য লাগছে। মনে চাচ্ছে, ইকরাব যেভাবে নাজহাকে না-পেয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল, ওভাবেই কাঁদতে। কিন্তু তা যে অসম্ভব। ওর অনুভূতিগুলো যে লুকায়িত। ও চাইলেও পারবে না। ও যে শুধুই নাজহার বিরহে ছাই হয়ে যাবে, তাও ভেতরে ভেতরে।বুকটা ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, দম নাকের কাছে এসে আটকে গেছে। আর আসবে নয়, হয়তো চলেই এসেছে।সে পানির দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটে টেনে ধরে বলে,
“রুদ্ররাগিণী এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে এমন তো ছিল না আমাদের গল্প।তবে তুমি কেনো আজ তলিয়ে গেলে অন্য কারো নীড়ে, বলো?”

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, নিজের চোখ দুটো মুছে নিতে নিতে বিধ্বস্ত গলায় বলে,
“ও মন, সে তো অন্য কারো! তবে তুমি তার জন্য কেনো এতটা পুড়ো?”
এবার মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। বুক ধড়ফড় করছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। ও যন্ত্রণায় নিজের বুকে হাত চেপে ধরে চোখের পানিগুলো টুপটাপ করে সিঁড়িতে পড়তে থাকে। নিজেই নিজেকে বলে,
“আমি মানতে পারছি না, তুমি আমার হয়েও কেনো আমার হলে না? নাকি তুমি আমার হবারই ছিলে না?
ফুপিয়ে শ্বাস নিয়ে আবারো বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আফসোস করে বলে,
“তোমায় আমি বলতে পারিনি, আমার না-পাওয়া স্নিগ্ধপদ্ম, কতখানি ভালোবাসি তোমায় আমি।
এ বলে মাথা তুলে চারদিকে তাকায়। তারপর চোখের পানি মুছে, পাশে রাখা নিজের গিটারটা হাতে তুলে নেয়। আঙুলগুলো গিটারের তারে ছড়িয়ে দেয়, টুংটাং আওয়াজের তালে কান্না ভাঙা গলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ গলায় গেয়ে উঠে,

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২

বিধাতা আমাকে বলো
কোথায় গেলে তাকে পাবো
যন্ত্রণা গুলো আমাকে
ভেতরে পোড়ায় হুম…
ভাবতে ভাবতে তারে আমি
চোখ বুজিয়া জড়ায় ধরি
চোখ মেলিয়া দেখি আমি
সে যে বুকে নাই।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here