স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৮

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৮
সানজিদা আক্তার মুন্নী

তৌসির কেরামত আলীর বুকে কুপ মারতেই কোচের আগায় ঝুলে যায় একটা কাক। আসলে এটা কেরামত আলী না, এটি ছিল একটা খবিস জ্বিন। এই জ্বিনটা এই বিলেরই কারণ এই বিলটা বড্ড দোষী। এই জ্বীন গুলো মানুষের রুপ নিয়ে মজা করে কোনো সময় আবার মেরেও ফেলে। তৌসির কেরামত আলীকে চুপচাপ থাকাতে দেখেই বুঝে গেছিল এটি জ্বিন। সাথে পানির কলকলে শব্দও ওর কানে বেজেছে। তাই সাথে সাথে জ্বীনকেই উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেরমত আলী পানিতে পড়ে আছে খানিকটা পিছনে। তৌসির কাকটা কে কোচের আগায় নিয়ে গিয়ে ওকে এক হাতে টেনে তুলতে তুলতে অন্য হাতে কোচের আগায় সেঁটে থাকা মরা কাকের দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বলে,

“এই দেখ মাগির পোলা জ্বিনও আমাদের কাছে রেহাই পেলো না।”
কেরামত পানি থেকে উঠতে উঠতে বলে, “খবিসের বাইচ্চা যাইত্তা ধরছিল ভাই, আমি তো কই এই শেষ জীবন।”
তৌসির কাকটা পানিতে ফেলে দিতে দিতে বলে, “আমাদেরে মারার ধান্দা করতে গিয়া নিজেই দয়ালের দরবারে গেলো গা।”
এ বলে সামনে আগাতে থাকে। এই যে জ্বিন মারা এগুলো প্রথম না কিন্তু। তৌসিদেরর জীবনে আরো অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটেছে বিধায় তৌসিরদের ভয় নেই অন্তরে। ওরা দুজনে এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। মাছ যখন ধরতে এসেছে, মাছ ধরেই যাবে। কেরামত আলী নিজের ভিজা লুঙ্গি কোমরে গুঁজতে গুঁজতে বলে, “ভাইজান আর ধরবেন নাকি আইজ চইল্লা যাইবেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“না না ধরমু, চইল্লা যামু ক্যান? জ্বীনের সাউয়া-টাউয়া ডরাইয়া লাভ আছে?”
“আইচ্ছা চলেন!”
“বুঝলি কেরামত, মাছের যেই দাম বাজারে, একটা মাছ এখন মাইরা খাইতে পারলে তিন-চারশো টাকা বাইচা যাইব।”
কেরামত আলী থমকায়। এদের এত টাকা-কুড়ি থাকার পরও এত কিপ্টামি করে! কেরামত হাবলার মতো হেসে বলে, “হ ভাই, হক কথা।”

কথা বলতে বলতে হাঁটু পানি অবধি ওরা আগায়। আরেকটুখানি সামনে আগাতেই পানিতে নড়ে উঠে একটা বড় দেখে গজার। তৌসির ওর দেখা পেয়েই সাথে সাথে কোচ দিয়ে কুপ মেরে সেটি কোচের মাথায় নিয়ে নেয়। মাছের পেট ফুঁড় হয়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায় কোচের লোহার কাটাগুলো। তৌসির কোচটা খাড়া করে পানি থেকে উঠতে উঠতে বলে, “চল, আইজ তোর ভাবিরে দিয়া এইডা রান্ধামু।”
কেরামত এটা শুনে মুখ বাকিয়ে বলে, “রান্না করবো ভাবিজান এত রাইতে?”
তৌসির পাড়ে উঠতে উঠতে বলে, “রানব রানব, আমি জামাই ওর, সব করব আমার কথায়।”
“করলেই হইলো।”

এদিকে নাজহা তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে নিজের চুল বাঁধা দেখে নিদারুণ অবাক হয়েছিল, কারণ ওর সম্পূর্ণ মনে আছে যে ও চুল খোলে ঘুমিয়েছিল। এর মধ্যে তৌসিরও ঘরে নেই। অনেক ভেবে ভেবে ওযু করে নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়েছে কারণ সময় পার হয়ে যাচ্ছিল তাহাজ্জুদের। ওর বিড়ালগুলো ঘুমিয়ে আছে এখনও, নাজহা আজ আর ওদের তুলেনি।
আট রাকাআত পড়ে মোনাজাত শেষ করে বসে বসে দরুদ পড়ছিল। তখনই তৌসির ঘরে আসে, এসে দেখে নাজহা নামাজের পাটিতে নীরবে বসে আছে। নাজহা কে নামাজ পড়তে দেখে মনে মনে বলে ওঠে,” আমার মতো এমন পাপির কপালে এমন হেকমতকারি রাণী কেমনে জুটলো? এসব আজেবাজে চিন্তা মনে নিয়ে কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর নাজহাকে ডাক দিয়ে বলে,”নাজহা শুনছো?”
তৌসিরের ডাক শুনে নাজহা পিছনে তাকায় না, চুপচাপ নামাজের পাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থেকে উত্তর দেয়,”না শুনছি না আমি, কালা।”

তৌসির ওর কথায় বুক ঝেড়ে শ্বাস ফেলে সামনে এগোতে এগোতে বলে, “এক মুখ মাইরে সাউয়ার!”
এ বলে নাজহার পাশে এসে দাঁড়ায় দুই হাত কোমরে রেখে একটু ত্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “রান্নাঘরে যাও, ওখানে বড় মাছ একটা ধইরা আনছি, ঐটা বানাও, কাম করো গিয়া।”
নাজহা তৌসিরের আদেশ শুনে কিন্তু তাও তৌসিরের দিকে তাকায় না, চুপচাপ পাঠির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “আমি এসব কাজকর্ম পারি না করতে।”
তৌসির নাজহার উত্তরে প্রতিবারের মতোই বিরক্ত হয়ে যায়। বিরক্তি গলায় বলে, “কামকাজ যখন পারিস না, তাইলে হাঙ্গা বইলি ক্যান? বাপের ঘরে লাউ-কদুর বিছ হইয়া থাকতি।”

নাজহা তৌসিরের কথায় মাথা নিচু করে রয় কিছু সময়। তারপর কি একটা ফন্দি এঁটে তৌসিরের দিকে নরম চোখে -মুখ তুলে তাকায়। নাজহার কালচে সবুজ চোখের এই নিরীহ হরিণির মতো চাহনিতে তৌসিরের মনমাঝি গলে পড়তে শুরু করে। ইসস, কতই না সুন্দর এই চাহনি! কি নরম কতটা আবেশি। এই চোখ জুড়াই যথেষ্ট তৌসর কে আচ্ছা মতো ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। তৌসির ভেতরখানা ধড়ফড় করতে থাকে এই চাহনি দেখে। তৌসির ঠোঁটে হাত দিয়ে কি একটা ভাবতে ভাবতে মুগ্ধ চোখে নাজহার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তখনই নাজহা নরম গলায় বলে ওঠে, “এভাবে বলছেন কেন? আপনি করে নিন না, আমি তো পারি না!”

নাজহার এই নরম গলার কথায় তৌসিরের চোখ উল্টে যায়। ও চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নাজহার দিকে তাকায়। আর তাকাবেই না কেন? এত সুন্দর কথা! নাজহার মুখে এমন সুন্দর কথা আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া সমান ব্যাপার তৌসিরের কাছে। তৌসির নাজহার দিকে একটু ঝুঁকে নাজহার থুতনিতে আলতো করে নিজের হাত রেখে বাচ্চাদের মতো মুখ করে আলতো সুরে বলে, “এমন নাটক করে লাভ নাই, আমি তোমার এমন কথায় গলবো না গো বউ। কাম তোমারি করা লাগব।”
নাজহা তৌসিরের কথায় রাগে ফেটে উঠে, তৌসিরের হাত নিজের থেকে ঝাড়ি মেরে সরিয়ে উঠতে উঠতে বলে, “রাত-দুপুরেও নাটক করতে হয়।”

এ বলে রুমে নামাজের হিজাবটা খোলে পাটিতে রেখে বিছানা থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বলে, “চলুন আমার সাথে, আমি একা ভয় পাই।”
তৌসির ওর কথায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঠিঠকারি মেরে বলে, “ও আল্লাহ! তুমি ভয়ও পাও?”
নাজহা তৌসিরের কথায় ওর দিকে শুধু কঠোর চোখে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। চুপচাপ রুম হতে বেরিয়ে যায়। তৌসিরও ওর পিছনে পিছনে যায়, কি আর করবে, বউটা ওর বাচ্চা টাইপের ভয়-ডর পেতেই পারে। বউ কে সেইভ রাখা প্রয়োজন। এত সুন্দর বউ পেয়েছে কপাল কম ভালো নাকি?

নাজহা রান্নাঘরে এসে দেখে ফ্লোরে একটা মাছ রাখা আছে বউলে { প্লাস্টিকের গামলা}। নাজহা বড় একটা বটি নিয়ে বসে পড়ে মাছ কাটতে। এসব ও পারে ভালোই, বড় পরিবার জন্ম হয়েছে বলে এসব টুকটাক কাজ নাজহা পারে। তৌসির একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে এসে বসে। নাজহা একটা চামচ নিয়ে চামচ দিয়ে মাছের আস ছাড়াতে থাকে। মাছের আস ছাড়াতে ছাড়াতে এক সময় একটা মাছের আস উঠে উড়ে এসে নাজহার নাকে লেগে যায়। এটা দেখে তৌসিরের খারাপি লাগে একটু তাই ভালোবাসো দেখাতে হাত বাড়িয়ে নাজহার নাক থেকে আসটা তুলে নেয়। তৌসির একটু কেয়ারিং হওয়ার চেষ্টা করছে আরকি। কিন্তু ওর বউয়ের তো এসগ আবার হজমি হয় না। নাজহা চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস নেয়, তারপর রুক্ষ গলায় বলে, “হাত কেটে যাক আমার, তাহলে আপনি শান্ত হবেন।”
তৌসির নাজহার রুক্ষ গলার এই বাণী শুনে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বলে, “মাইনষের বালা করতে নাই এই জগতে। তুমি করবা ভালা, কিন্তু তোমার পাছায় লাইগা যাইব মন্দের আটা।”

তৌসিরের কথা শুনে নাজহা কিড়মিড় করে বলে, “আমার ভালা করা লাগবে না আপনার।”
তৌসির নাজহার কথায় নাক-মুখ ছিটকিয়ে বলে, “না না ম্যাডাম, আফনার ভালা আমার মতো খারাপ কেমনে করব কন তো? এইডাও কি সম্ভব?”
নাজহা মাছটার মাথা কাটতে কাটতে তৌসিরের দিকে চেয়ে বলে, “না সম্ভব না। শয়তানে মানুষের ভালো কখনও করে না, আর আপনি খারাপ না, আপনি একটা নিকৃষ্ট, বুঝলেন?”
তৌসির খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসিই হেসে বলে ওঠে, “হ হ, দুনিয়ায় যত খারাপ আর যত নিকৃষ্ট সবি তো আমি। তুমি আর তোমার বাপ-চাচারা তো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা।”

নাজহা মাছের পেট কাটতে কাটতে তৌসিরের কথার প্রতিত্তোরে শোধায়, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার বাপ-চাচা ধোয়া তুলসী পাতা, তা আমি জানি। আপনার মনে করিয়ে দিতে হবে না। কথায় কথায় আমার বাপ-চাচার ঠ্যাং টানা লাগে।”
“তোমার বাপ-চাচার ঠ্যাং বেশি লাম্বা, এর লাইগা টানি।”
নাজহা এবার বড্ড বিরক্তই হয় তৌসিরের কথায়, তাই এবার ধমকে বলে, “চুপ করুন তো, বড্ড বেশি কথা বলেন আপনি।”
তৌসির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “তোমার লগে একটু কথাও কইতে পারি না। না পারি কইতে মিঠা কথা, আর না পারি কইতে তিতা কথা।”

নাজহা এবার তৌসিরের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ওঠে যায় তারপর মাছের আস যে বউলে রেখেছে তা বেসিনের নিচে রেখে বটিটা ধুয়ে নেয়। তারপর কেটে রাখা মাছ বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে ধুতে ধুতে ঘাড় ফিরিয়ে তৌসিরের দিকে তাকায়। তৌসির সেই ছেঁড়া পাঞ্জাবিটাই পরে আছে, এটা দেখে নাজহা নাক-মুখ কুচকায় তারপর বলে, “কি করব এই মাছ? ফ্রিজে রেখে দেই?”
তৌসির চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলে, “হ্যাঁ রাখো। আর দু-টুকরো এখন ভাজা করে দাও, আমি আর কেরামত খামু।”

নাজহা রান্নার কথা শুনে ছ্যাত করে ওঠে, বলে, “আমি রান্না করতে পারি না!”
তৌসির নাজহার কথা শুনে মেকি হেসে ওর দিকে পা ফেলে এগিয়ে এসে বলে, “চেষ্টা করো!”
তৌসিরের এত সুন্দর বাণীর প্রতিত্তোরেও নাজহা ত্যাড়ামি করে বলে, “আমি রান্না করতে পারব, বলছি তো পারব না। আপনি পারলে করুন!”
তৌসিরের মেজাজ এবার বিগড়ে যায়, তাই টাশ করে বলে ওঠে, “সাউয়ার-সাউয়ার কথা তইয়া চুপচাপ রান। আমার লগে হাঙ্গা যখন তোর হইছে, রান্না তোর করাই লাগবো।”

নাজহা ধমক খেয়ে কেঁপে ওঠে। হঠাৎ এমন ধমক দিবে আশা করেনি। তাই এমন কেঁপে উঠলো, নয়তো তৌসিরের ধমকে কেঁপে ওঠার মতো মেয়ে নাজহা নয়। নাজহা ধমক শুনে আর কিছু বলে না। তিন পিস মাছ রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে দেয় একটা বাটিতে। তিন পিস মাছ দেখে তৌসির নাজহাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমিও খাইবা নাকি?”
নাজহা মসলা নিতে নিতে তিতা সুরে বলে, “হ্যাঁ খাব। আমার তো আপনাদের মতো রাত-বিরাইতে খাওয়া লাগে।”
তৌসির নাজহার কথায় বুঝে যায়, ও খাবে না। তাই তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে এক পিস মাছ প্লেট থেকে নিয়ে নেয়। এটা দেখে নাজহা হতবাক হয়ে ওর দিকে কটমট করে তাকায়। তৌসির নাজহার চাওয়া দেখে বলে ওঠে, “আমরা দুজন দুই পিসি খামু, এক পিস একস্ট্রা লাগবো না। মাছের বহুত দাম বাজারে এক পিস বাচলেও বাচবো।

এ বলে ফ্রিজে মাছের পিসটা রেখে দেয়। নাজহা দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নেয় মনে মনে ভাবে ছিঃ কতটা ছোট লোক ছিঃ ছিঃ।নাজহা দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে চুপচাপ ওই দু পিস মাছেই পরিমাণ মসলা নেয়। তৌসির মাছের পিস রেখে এসে ওর পিছনে দাঁড়ায়। নাজহার বিরক্তি আর শেষ নেই। চার রাকআত নামাজ পড়তে পারেনি। রান্না করতে এসেছে কিন্তু এখানে তৌসির হাড় কিপ্টামি করছে ঐ যে কথায় আছে না সময় দেখলে ব্যাঙেও ঠ্যাং মেলে তো নাজহার হালাও এমন হয় এখন। খোলে যায় ওর চুলের খোপা। খোপা ধীরে ধীরে খোলে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় নাজহার পিঠে। নাজহা এখন কি করবে বুঝে পায় না। মসলায় মাখানো হাত। কিছুটা দিশেহারা বোধ করে তাই কোনো কিছু না ভেবে পিছনে ঘুরে তৌসিরের পাঞ্জাবির বুকের অংশে নিজের মসলাযুক্ত হাত দিয়ে মুছে নেয়। সাথে সাথে ওর হাতে লেগে থাকা সব মসলা তৌসিরের পাঞ্জাবিতে গিয়ে লাগে। হাত মুছে নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের অবাধ্য কেশতরঙ্গ গুটায় নাজহা।

তৌসিরের জান তো বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কি করলো এটা নাজহা? পাঞ্জাবি ছিঁড়ায় ভেবেছিলো নাজহাকে দিয়ে সেলাই করিয়ে পড়বে কিন্তু এখন তো নাজহা পাঞ্জাবিতে দাগ লাগিয়ে দিল। এখন কি হবে? বারোশো টাকা দিয়ে গত ঈদে কিনেছিল তিন মাসও হয়নি নষ্ট হয়ে গেলো, লস হয়ে গেলো এবার বড্ড। না লস হওয়া যেতে দেওয়া যাবে না। এমনিতেই জীবন মানেই লস আর লস। তাই লস হতে দেওয়া যাবে না।
তৌসির নাজহার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথা হালকা কাত করে ওর দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলে, “কি করলা এডি?”

নাজহা তৌসিরের কথার তোয়াক্কা না করে বলে, “কি করলাম আবার করে দেখাই?”
তৌসির দাঁত চেপে বলে, “সাউয়ার সাউয়ার ছাড়ায়া দিমু চুপচাপ ধুয়া দিও।”
“আমিই তো ধুয়ে দেই। আপনি ধুয়েছেন বিয়ের পর থেকে আপনার কাপড়?”
এ বলে নাজহা গ্যাসে তাওয়া বসাতে নেয়। হাড় কিপ্টে তৌসিরের কলিজায় ধরে যায় এটা দেখে। তৌসির তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “গ্যাসের চুলায় ক্যান লাকড়ির চুলায় বসাও। গ্যাস সিলিন্ডারের দাম চৌদ্দশ টাকায় উঠছে গিয়া।”
নাজহা এটা শুনে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে তৌসিরের দিকে দগ্ধ চোখ চেয়ে বলে, “এমন কেন করছেন? এই রাত্তিরে আমি কিভাবে আগুন ধরাবো? খুব কষ্ট হবে, করে নেই আজ গ্যাসে?”
তৌসিরের মন নাজহার এই আদুরে কথাটা শুনে একটু হলেও গলে কিন্তু তারপরও এদিকে ওদিকে এক পলক তাকিয়ে বলে, “আমাদের বাড়িতে গ্যাসে চা ছাড়া অন্য কিছু করা হয় না তাই লাকড়ির চুলায় আগুন ধরাও।”
এটা বললো কারণ আজকের অভ্যাসে আগামিকালকের অভ্যাস। আজ যদি ও রান্না করতে দেয় তাহলে আগামীতেও নাজহা রান্না করবে। আর বউ কে বেশি লাই দেওয়ার মতো মানুষ তৌসির নয় তাই কষ্ট হলেও নাজহা কে লাকরির চুলায়-ই করতে হবে রান্না।

তৌসিরের কথা শিনে নাজহা কঠোর চোখে এক নজর তৌসিরের দিকে তাকিয়ে তারপর চোখ ফিরিয়ে লাকড়ির চুলায় আগুন ধরানোর জন্য লাকরি দিতে দিতে মনে মনে বলে, “এক খবিস কিপ্টার সাথে সংসার করতে হবে ছিঃ ছিঃ এত ছোটলোকি কারবার মানুষ কিভাবে করে? এত ছোটলোক মানুষ কিভাবে হতে পারে? ওয়াক থু। সামান্য গ্যাসের জন্য এত কথা, না জানি কত কি দেখতে হয় আর শুনতে হয়।”
তৌসির নাজহাকে নিজের কাজ করতে দেখে এবার নিজে দুটো প্লেট ধুয়ে পরিমাণ মতো ভাত নিয়ে নেয়। সাথে ফ্রিজ থেকে দু টুকরো লেবু আর দুটো কাঁচা মরিচ নিয়ে নেয়। এগুলো মরেও গেলে তৌসির করতো না, রান্নাঘরেই তো আসে না। কিন্তু কি করবে এখন? বউ তো। বউকে বেশি কষ্ট দিলে আবার কলিজা খুতখুত করে তাই নিজেই করে নিচ্ছে যতটুকু পারছে।

নাজহা মাছ ভাজতে দিয়ে একটা পেঁয়াজ আর যা যা লাগে কেটে নেয়। তারপর মাছ দু পিস ভেজে ভাত নিয়ে রাখা দু প্লেটে রেখে দেয়। ঘেমে একেবারে ওর অবস্থা খারাপ। একটা এসি ফ্যান কিছুই নেই। নাজহা নিজের ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে, “নিন নিয়ে যান।”

তৌসির এক নজর ঘেমে লাল হয়ে যাওয়া নাজহার দিকে তাকায়। ভেবেছিল একবারই তাকাবে তারপর চোখ ফিরিয়ে নেবে কিন্তু তা আর হলো না। চোখ সেই ঠেকেই গেলো নাজহার মুখ পানে আর ঠেকেই বা না কেন? এত সুন্দর যে এই মেয়েটা। গরমে ঘেমে ওর সমস্ত মুখখানি রক্তাভ হয়ে উঠেছে ঠিক সূর্যোদয় আকাশের জ্বলে ওঠা আগুনরঙা আভার মতো। গাল দুটো লাল হয়ে গেছে, পূর্ণ পলাশফুলের ন্যায় তপ্ত, কিন্তু মোহনীয়। ঘামে ভেজা রক্তিম ঠোঁট জোড়া শিশিরসিক্ত জবা ফুলের মতো লালিমায় ভরপুর হয়ে গেছে । বড্ড কোমল ও আকর্ষণীয় লাগছে এই অধর জোড়া। হেমন্তের ঘন পান্নাখচিত রত্নখানি ওড নয়নদুটি। নাজহার এই পান্না-নয়নায় ক্লান্তি থাকলেও ঝরে পড়ছে অসীম মায়া। ওর শোভন নাসিকা ঘামে ভেজে একদম বেহাল ওর নাসারন্ধ্র দেখে মনে হচ্ছে শিশিরে ধোয়া পাহাড়চূড়া এর উপর কপালে উপচে পড়েছে ছোট ছোট চুল। তৌসির নাজহার এই লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে ফিসফিসিয়ে বলে, “কাম করে নাই একটুও, আর দেইখা মনে হইতাছে কাম কইরা দুনিয়া উল্টাইয়া নিছে।”

নাজহা গরমের তালে কিছু শুনে না, চুপচাপ বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে। জান পালাও পালাও বলছে, শুধু জীবনটাই তেজপাতা আর কিছু না। এত গরম এত গরম।
তৌসির নাজহাকে যেতে দেখে আর কিছু বলে না। প্লেটগুলো খাওয়ার রুমে নিয়ে যায়। ওখানে কেরামত আলী পাটি বিছিয়ে বসে আছে। ওদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিল এসব নেই, সবাই নিচে বসেই খান, পাটি বিছিয়ে খাওয়ার রুমে। তৌসির প্লেটগুলো পাটিতে রাখতে রাখতে বলে, “যা কেরামত, হাত ধুইয়া ফ্রিজ থাইকা ঠান্ডা পানি আর গ্লাস লইয়া আয়।”

কেরামত আলী উঠতে উঠতে বলে, “যাইতাছি ভাই। ভাবির হাতের খাওন বইল্লা কথা, আইজ ইচ্ছা মতো খামু।”
তৌসির মেকি হেসে বলে, “দেখি কোন সাউয়া রানছে তোর সাউয়ার ভাবি।”
নাজহা রুমে এসে ওয়াশরুমে যায়। ঘামে ভিজে গেছে একেবারে, তাই গোসল করে নেয়। গোসল করতে করতে ফজরের আযানও পড়ে যায় তাই ওযু করে একেবারে বের হয়।
বের হয়ে কাবাড থেকে নিজের তেলের বোতল নেয়, হাতে পায়ে মাখবে বলে। নাজহা এক্সট্রা কিছু মাখে না, লোশন আর অলিভ অয়েল তেল ছাড়া। তেল বের করে দেখে তেলের বোতল শেষের দিকে। তাড়াহুড়োর বিয়ে বিধায় কিছুই কেনা হয়নি। যা ছিল তখন, আপাতত তা নিয়েই এসেছে। একফোঁটা তেল হাতের তালুতে নিয়ে মেখে নেয় মুখে আর হাতে। তখনই তৌসির ঢেকুর দিতে দিতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “রান্না তো ভালোই মজা হইছে। তালুকদারের মাইয়া পেট ভইরা খাইলাম ভাত।”

নাজহা তৌসিরের কথায় ওর দিকে তাকায়। ছেঁড়া, মসলার দাগযুক্ত সাদা পাঞ্জাবি পড়া। লুঙ্গি গোঁজা হাঁটুর উপর অবধি। এত অগোছালোর মধ্যেও বেশ সুন্দরই লাগছে ওকে। কিন্তু নাজহার চোখে সুন্দর লাগছে না। নাজহা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কাবাডে তেলের বোতলটা রাখতে রাখতে বলে, “এই যে শুনছেন।”
তৌসির ওর কথায় উত্তর দেয়, “জ্বী শুনছি।”
নাজহা পিছনে ঘুরে ওর মুখপানে নিরলস চোখে তাকিয়ে বলে, “আমার ব্যবহার করার তেল শেষ হয়ে গেছে, এনে দিবেন?”
তৌসির ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, “কি তেল মাখো?”

“আমি অলিভ অয়েল তেল মাখি, এনে দিবেন।”
তৌসির অলিভ অয়েলের কথা শুনে নাক মুখ ছিটকিয়ে বলে, “নবাবের বেটি, বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম, সরিষার তেলই গায়ে মাখো অলিভ অয়েল আর মারাইও না।”
তৌসিরের এই সীমাহীন কিপ্টামি দেখে নাজহা আর চুপ থাকতে পারে না। মন চায় উষ্টা মারতে ওকে। কিন্তু এই মনের চাওয়া পূরণ হবে না। নিজেকে দমিয়ে নাজহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “এত কিপ্টামি করেন কেন আপনি? টাকা পয়সা কি কবরে নিয়ে যাবেন?”
তৌসির ফাজলামি করে মাথা নাড়িয়ে বলে, “কবরের পাশে রাইখা দিমু।”
নাজহার গা জ্বলে যায়। রাগে টাশ করে বলে ওঠে, “দেইখেন, আপনার এই কিপ্টামির কারণেই আপনি মরবেন। ছিঃ কত ছোটলোক আপনি।”

তৌসির নিজের লুঙ্গির বাজ কোমর থেকে ছুটাতে ছুটাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, “তোমার সাউয়ার লগে তোমার মুখও ফারতে হইবো দেখতাছি, নয়তো তোমারে দমাইতে পারতাম না।”
নাজহার গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে। এমন নিকৃষ্ট কথা শুনে নাজহা শরীরে ঝাঁকিয়ে উঠে বলে, “ছিঃ কত নোংরা আপনি।”
“হ, আমি নোংরা। আমি ড্রেনের পানির থাইকাও নোংরা, তাতে তোর কি?”
এ বলতে বলতে নাজহার সামনে এসে দাঁড়ায়। তৌসিরকে নিজের সামনে আসতে দেখে নাজহা পিছনে ঘুরতে ঘুরতে বলে, “আমারই তো সব, আপনার মতো নোংরার সাথে সংসার করতে হবে যে আমার।”
এ বলে নাজহা সামনে দিকে এগোতে থাকে। তৌসির পিছনে থেকে ওকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে নাজহার চুলগুলো খোলে দিয়ে নাজহার গলায় নাক মুখ ঠেসে ধরে। নাজহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। গা ঘিন্নায় গুড়িয়ে যাচ্ছে। অন্তর ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তৌসির ওকে এভাবে ছুঁচ্ছে, না জানি কি আবদার এঁটে বসে এভাবে কেন আবদ্ধ করছে তৌসির ওকে হঠাৎ? নাজহার মন খুটখুট করতে শুরু করেছে।

নাজহা দুই হাত দিয়ে তৌসিরকে ঠেলে দিতে নেয় কিন্তু তৌসির সরে না। উল্টো নাজহার দুই হাত ধরে শক্ত করে ওর পেটের সাথে চেপে ধরে। নাজহার দম বেরিয়ে আসতে নেয় এতে। নাজহার শরীর ঝাঁকিয়ে কেঁপে ওঠে। তৌসির নাজহার কাঁধে নিজের ঠোঁট ছুঁইতে ছুঁইতে নাজহার গলার দিকে হাত বাড়ায় নাজহা এটা দেখে কিড়মিড় করে চোখ বুঁজে নেয়। তৌসির নাজহার গলায় নিজের ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুল বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “গলায় বেশি ব্যথা পেয়েছিলে? এখনও রাগ ফুঁসতাছে মনে মনে?”
নাজহা দাঁত চেপে তৌসিরের হাত নিজের গলা থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে, “না রাগ করবো কেন? আপনার উপর রাগ করার কোনো অধিকার আছে? আপনি বিয়ে করছেন কিনে নিয়েছেন। এখন মারলেও ভালো, আর কাটলেও। আমার রাগ আপনার উপর কি আদৌ খাটে?”

তৌসিরের শান্ত নরম মেজাজটা নাজহার কথায় বড্ড গরম হয়ে যায়। নাজহাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাজহার গাঁড়ে থুঁতনি চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। তৌসিরের ক্লিন শেভ করা মুখে এখন নতুন করে ছোট ছোট খুচা খুচা দাঁড়ি উঠছে। এই দাঁড়িগুলো বেশ ধার বলতে গেলে। আর এখন এগুলো নাজহার গাঁড় কাঁধের ত্বকে বিঁধছে, আবার গাঁড় কাঁধে উপচে পড়ছে তৌসিরের উষ্ণ শ্বাস। নাজহার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রাণ মাঝি উড়াল দিবে নিজ গন্তব্যে।
তৌসির কিরিমিরি খেয়ে বলে, “একটু রোমান্টিক মুডে আইলাম, ওমনি তোমার সাউয়ার সাউয়ার কথা শুরু হইয়া গেলো। দূর বাল!”

নাজহা এখন আর নড়ে না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উত্তর দেয়, “এখন এসবের সময় নয়, ফজরের নামাজ পড়তে হবে, ছাড়ুন।”
তৌসির ছাড়ে না, তৌসির ওকে একইভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর নরম সুরে বলে, “তোমারে জড়ায়া ধরলে ক্যান জানি মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ আমার হইয়া গেছে।”
তৌসিরের কথায় নাজহা আলতো সুরে বলে, “আর কত সময়! আযান হয়ে গেছে, নামাজ শেষে ধরবেন, এখন ছেড়ে দিন।”

তৌসির নাজহার গালে আবারও নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়। গভীরভাবে নাজহা কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে তৌসির ওকে বলে, “না আর ধরমু না, আমার আবার সবসময় মুড আয় না এসব প্রেম-ভালোবাসার।”
এ বলে নাজহাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে নাজহা ছিটকে দূরে সরে যায় তৌসিরের থেকে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে, “রাক্ষসের মতো শরীর দিয়া জড়িয়ে ধরেন!”
এ বলে এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে খেতে শুরু করে। এই ফাঁকে তৌসির নিজের পাঞ্জাবিটা খোলে নাজহার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে, “এইডা ভালো করে ধইয়া সেলাই কইরা দিও। বারোশো টাকা দিয়া কিনিয়া বারো মাসও পড়তে পারি নাই।”

এ হুমুক ঝেড়ে তৌসির কাবাড থেকে আরেকটি লুঙ্গি নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়। নাজহা পানি খেয়ে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। না জানি কি হয় আজ না কাল, তৌসির নিশ্চিত নিজের অধিকার নিয়ে নিবে, তখন নাজহার কাছে নিজের বলতে কিছুই রইবে না। নাজহা তো নিজের এই ইজ্জতকে বুঝ হবার পর থেকে তালহা ভাইয়ের ভেবে এসেছে, তবে আজ কেন এত নিষ্ঠুর সমাপ্তি হচ্ছে এই ভাবনার? কেন হচ্ছে এমন?
তৌসির শাওয়ারের নিচে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিরের মন খাবলাচ্ছে, নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয় বড্ড। কি করবে বুঝে পায় না। চারদিকেই মরণ, যেদিকে যায় সেদিকেই যন্ত্রণা। আগামীকাল সমাবেশ তন্ময় চাচার। সাকালে গিয়ে সব চেক দেওয়াতে হবে নিজে থেকে, নয়তো বোমা-টোমা থেকে যেতে পারে। শত্রুদের তো আবার অভাব নেই। যে যেমনে পারে ওমনে ধরে যাইত্তা।

জন্ম মৃত্যুর আবর্তনে
পুনর্জন্ম হবে
তোমার আবার দেখা পাব
কখন কে জানে জন্ম মৃত্যুর আবর্তনে
পুনর্জন্ম হবে
তোমার আবার দেখা পাব
কখন কে জানে
দূরে যাও সরে যাও রেখে যাও
কিছু স্মৃতি তোমার আমার
জানি আবার একটি জন্ম
আমার কভু হবে না।
জানি আবার এমন করে
তোমার দেখা পাবো না জানি
আবার একটি জন্ম আমার
কভু হবে না।
জানি আবার এমন করে
তোমার দেখা পাবো না…

গানটা বাজছে স্লো বিটে স্পিকারে। নিজের বারান্দায় বসে আছে ইকরাব বসে বসে এই গান শুনছে। দেশে আসার পর থেকে ঘুমের ইনজেকশন নিতে নিতে শরীরের অবস্থা ধ্বংসপ্রায় কেল্লার মতো। ফজরের আযান হয়েছে একটু আগে, সূর্য উদয় হচ্ছে ধীরস্থিরে। ঘুম নেই চোখে, আজ ঘুমের ইনজেকশন দেয়নি ওকে ওর স্বার্থপর বাপ-চাচারা। তাই আজ একটুখানি বিরহে পুড়তে পারছে। ইস! কি ভাগ্য ওর, কত নিষ্ঠুর ভাগ্য! নিজের প্রিয়তমাকে পেলো না তো পেলোই না, সাথে তাকে না পাওয়ার বিরহেও একটু একটুখানি পুড়তে পারছে না। সিগারেট টানছে, চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে, নীলচে চোখ দুটো লাল বর্ণের ধরন ধারণ করেছে। নিয়তির নিষ্ঠুরতার ছাপে আজ তলিয়ে গেলো ওর নিষ্পাপ চাওয়াখানি। ও পেলোই না আর ওর আপন প্রিয়তমাকে। বুকের ভেতরটা চিৎকার করতে করতে গলা অবধি এসে আঁটকে গেছে। ইকরাব লালচে চোখে বুক ভরে শ্বাস ফেলে। হাতে ফোনের স্ক্রিনে একটা ফটো যা নাজহার পান্না-নয়নার। ইকরাব নাজহার আঁখিদ্বয় জুম করে করে দেখতে থাকে অসহায় চোখে এই নয়ন শুধু নয়ন নয়, তা এক অব্যক্ত প্রেম। ইকরাবের না পাওয়া আকাঙ্ক্ষা। এমন সময় গানের একটা লাইন এসে কানে বাজে

“জানি আবার একটি জন্ম
আমার কভু হবে না।”
এই লাইনটা শুনেই নাজহার মায়াময়ী মুখখানা ইকরাবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাথে সাথে ইকরাব আহত সুরে বলে ওঠে,
“তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কোনো লালসা ছিল না, বরং ছিল এক নিরুপায় চাওয়া। এই জন্ম যদি ব্যর্থ হয়, পুনর্জন্ম তো কেবল কল্পনা।”
মাথা নিচু করে নেয় এই বলেই। চোখ বেয়ে টুপটাপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, কর্ণপাত হয় আবারও দু’খানা খণ্ডলাইন,
“জানি আবার এমন করে
তোমার দেখা পাবো না জানি
আবার একটি জন্ম আমার
কভু হবে না।”
সাথে সাথে ইকরাব আফসোসের সুরে বলে,
“তোমায় আপন করার তীব্রতা আমার ফেলা শেষ শ্বাসটুকুর আর্তি!”
এ বলে হাতে উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিতে নিতে নিজেকে বুঝায়,
“জানি পূর্ণতা দূরের স্বপ্ন, তাও এই জন্মেই তোমায় আমার বলার যে ব্যাকুলতা, তা জন্মান্তরেরও ঊর্ধ্বে, যে প্রিয়তমা।”

একটা অন্ধকার, পুরোনো, স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে আছে সাতাশ বছরের এক রমণী। তার চোখ-মুখের অবস্থা ভয়াবহ চোখদুটো লাল হয়ে আছে , কোটর থেকে মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসতে চায় মণিদ্বয়, ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে। মাথার চুলগুলো কাদায় মাখা, শুকিয়ে গিয়ে বিশ্রী জট বেঁধে আছে। পড়নের কাপড় ছেঁড়া, শরীরে অল্প অল্প কাপড়ের টুকরো লেগে আছে ধুলো, ময়লা আর অজানা দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন পুরোটা শরীর তার।
চারদিন ধরে খাবার জোটেনি। অভুক্ত দেহ নাভি পর্যন্ত শুকিয়ে ভেতরে গুটিয়ে গেছে। জ্বিভ হাতখানেক লম্বা হয়ে তৃষ্ণায় বেরিয়ে আছে, অথচ আশেপাশে কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই। চারপাশে অন্ধকার, কেবল একটি দরজা সেটিও বাইরে থেকে শক্ত করে আটকানো। দেয়ালের ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে আসা ম্লান আলো ছাড়া আর কিছুই নেই এই কারাগারে।

তার সামনে রাখা আছে এখন শুকনো, বাসি দু’টো রুটি আর এক গ্লাস ঘোলাটে পানি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মেয়েটি সেই বাসি রুটিগুলো কুকুরের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে। প্রথম রুটি শেষ করতে না করতেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে গলায় রুটি আটকে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে হাত বাড়িয়ে গ্লাসের পানি তুলে নেয়। তীব্র তৃষ্ণায় এক কুলি গিলে ফেলে, আরেক কুলি মুখে দেয় কিন্তু গলা দিয়ে আর নামতে পারে না।সেই পানিটা ছিল ড্রেনের পচা পানি। সাথে সাথে মনে হলো গলার ভেতর বড় কোনো মাছের কাঁটা বিধে গেছে। মেয়েটি বুক ফেটে কাশতে থাকে। চোখ দিয়ে পানি নয় এবার লাল রক্ত ঝরতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই রক্ত চোখ থেকে গড়িয়ে মুখ দিয়েও বেরোতে থাকে।যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি গলা চেপে ধরে ছটফট করতে থাকে।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৭

একসময়ে গলা ফেটে ধপধপ করে রক্ত ঝরতে শুরু করে। মাথাটা টাশ করে লুটিয়ে পড়ে ওর স্যাঁতস্যাঁতে, পোকায় ভরা মাটির উপর। আধমরা মাছের মতো শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে ছটফট করতে থাকে তার প্রতিটি শ্বাস মনে হচ্ছে মৃত্যুর করাল থাবার সাথে শেষ লড়াই। পোকাগুলো ওর কান চুলের বাজে ঢুকে গিয়ে কামড়াতে থাকে এতে মেয়েটি জান সপে চিৎকার করতে চায় কিন্তু পারে না গলায় কাটা আটকে যাওয়ার জন্য। ওকে এমন কাতরাতে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি পিশাচের মতো হেসে বলে,” দেখ মাগি কেমন লাগে মাগিগিরি করলে। আমাগো সাথে করতে নিছিলি এবার বুঝ ঠেলা।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here