স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী
গ্রীষ্মের দুপুরের তপ্ত রোদে হাঁটছে তৌসির আর নাজহা। আজ রোদের রশ্মি নিদারুণ প্রখর মনে হচ্ছে জ্বালিয়ে দেবে মুহূর্তেই জমিনের বুকের সমস্ত কিছু। এতটাই প্রখর যে রোডে যদি এখন পানি ঢালা হয় তাহলে তেলে পানি পড়ার মতো তেজ দেখাবে। এই রোদে হাঁটার কারণ নাজহার টিকা দেওয়া। নাজহা টিকা দিয়ে এলো আজ তিন নম্বরটা দেওয়ার কথা ছিল। তৌসিরদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে এটা দেওয়া হয়। তৌসির নিয়ে এসেছে ওকে, মহিলা ডাক্তারও ছিলেন তাই আর তেমন অসুবিধে হয়নি, তাড়াতাড়ি দিয়ে এসেছে। তৌসির পার্টি অফিস যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছিল, তখনই ওর বিবিজান [দাদিজান] ওকে নাজহাকে নিয়ে আসতে বললেন। অনেক জরুরি কাজ ছিল অফিসে, তারপরও নিয়ে এসেছে কি আর করবে, বউ যখন ওর কষ্ট তো ওকেই করতে হবে।
নাজহা অনেক ধীরে ধীরে হাঁটছে, ওর হাঁটা দেখে তৌসির বিরক্তির সুরে বলে,”একটু তাড়াতাড়ি হাঁটো না?”
নাজহা তৌসিরের কথায় গুনগুনিয়ে বলে,”আপনার তাড়া থাকলে আপনি যান, আমি ধীরে ধীরে হেঁটে আসবো।”
নাজহার কথা কর্ণপাত হয় তৌসিরের, কিন্তু তর্ক করে না। কারণ তৌসির এই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারছে, যাদের বুদ্ধি বিদ্যা একটু কম তারাই তর্কে বিদ্যায় পারস্য। তাই আর তৌসির কিছু বলে না। তখনই ওর চোখ পড়ে সামনে দিয়ে আসা আইসক্রিমের গাড়ি যেটা আসকির ভাই নিয়ে আসছেন। আসকির ভাই-ই তাদের গ্রামের আইসক্রিমওয়ালা। তৌসির নাজহাকে জিজ্ঞেস করে,”আইসক্রিম খাবা?”
নাজহা মনে করে হয়তো দোকান থেকে কিনে আইসক্রিম খাওয়াবে। তাই মাথা নাড়ায়। তৌসির আসকির ভাইকে ডেকে বলে,”ও আসকির ভাই, এদিকে আও তো একটু।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আসকির ভাই তৌসিরের দিকেই আসছিলেন, এখন একটু তাড়াতাড়িই ভ্যানটা চালিয়ে নিয়ে আসেন। নিয়ে এসে বলেন,”জ্বি, আইসক্রিম খাইবেন ভাই? লগে ভাবি নাকি?”
তৌসির উনার কথায় একনজর নাজহার দিকে তাকায়, তারপর আবার সামনে তাকিয়ে বলে,”হ, আইচ্ছা, পাঁচ টাকার একটা আইসক্রিম দাও তো।”
নাজহা এটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কি পরিমাণ কিপ্টা হলে এমন করতে পারে একটা মানুষ, পাঁচ টাকার আইসক্রিম? ছিঃ ছিঃ। কি ছোটলোকি কাজ! আসকির ভাই একটা পাঁচ টাকার আইসক্রিম বক্স থেকে বের করে তৌসিরকে দেন। তৌসির আইসক্রিমটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে দু’টাকা আর এক টাকার একটা সিক্কা বের করে আসকির ভাইকে দিতে দিতে বলে,”ভাই, এই তিন টাকাই নাও,। পরে দু’টাকা নিবা, নে। আইজ আর নাই।”
আসকির ভাই এই তিন টাকা নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলেন,”আচ্ছা ভাই!”
আসকির ভাই অবাক হননি এমন কাণ্ডে, কারণ এসবের উনারা অভ্যস্ত তৌসির জন্মগতই এমন হাড় কিপ্টে। আসকির ভাই চলে যান। তৌসির নাজহার হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলে,”নাও, খাও। গরম কম লাগবে।”
নাজহার মন চায় নিতে না, কিন্তু মস্তিষ্ক বলে নিয়েই নেই যাই হোক, লোকটা কিনে দিয়েছে হাড় কিপ্টামি করেও।নাজহা হাতে নিয়ে নিকাবের ভেতর দিয়ে একটু খেয়ে নেয়। তারপর ফেলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে নাক মুখ কুঁচকে বলে,”ছিঃ, এগুলো খাওয়া যায় নাকি? ফুড কালার গুলে আইসে রেখে দিয়েছে।”
এ বলে ফেলতে চায়। কিন্তু তৌসির ফেলতে দেয় না, ওর হাত থেকে নিয়ে বলে,”দাও, তুমি খাইও না, আমি খামু। তিন টাকা দিয়ে কিনছি।”
এ বলে আইসক্রিমটা খেতে থাকে। নাজহা বিরক্তির সুরে বলে,”হ্যাঁ খান। নির্লজ্জ পুরুষ কিপ্টামির একটা সীমা থাকে।”
ওর কথায় তৌসির কুটিলিয়ে হেসে ওঠে, কিন্তু কিছু বলে না। নাজহার কথাগুলো বড্ড তিতা সবসময়ই তিতা কথা বলে। কিন্তু তৌসিরের এই তিতা কথাগুলোই ভালো লাগে।নাজহা হাঁটতে হাঁটতে কাদায় পা ফেলে দেয়। কাদায় পা পড়তেই নাজহা বলে ওঠে,”দূর!”
তৌসির খানিকটা সামনেই এগিয়ে গেছে। নাজহার এ অবস্থা দেখে তৌসির ওর দিকে ফের এগিয়ে এসে নাজহার বা-হাতের বাহু ধরে ওকে একটু সরিয়ে নিতে নিতে বলে,”দেখে চলবি না, কানা বেডি?”
নাজহা নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,”ছাড়ুন তো, রাস্তার মধ্যে এভাবে হাত ধরবেন!”
তৌসির ওকে ছেড়ে দিতে দিতে বলে ওঠে,”আমার বউ তুমি আমি তোমার হাত ধরুম, ঠ্যাং ধরুম, তাতে কে কি কইবো?”
নাজহা রাগি গলায় বলে,”মুখ সামলান, খারাপ লোক।”
তৌসির ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,”চলো, সামনে পুকুরে পা ধুইয়া নিবা।”
এ বলে নাজহার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে এগোতে থাকে। নাজহাকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটা পুকুর আছে, সেখানে নামে। নাজহা নিজে পা বাড়িয়ে পা ধুতে যায়। তৌসির এটা দেখে বলে,”তুমি দাঁড়াও, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।”
এ বলে নিজের লুঙ্গি গুটিয়ে নিয়ে বসে যায়। নাজহার পা থেকে ওর জুতাটা খুলে নিয়ে পাশে রেখে দেয় জুতাটা চামড়ার, ভিজে গেলে তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যাবে তৌসির তো আবার আয়কারি মানুষ। মূলত এ কারণে ও নাজহার পা ধুয়ে দিচ্ছে নয়তো বয়ে গেছে পা ধুয়ে দিতে । তৌসির নিজ হাতে পানি দিয়ে নাজহার পা ঘষে ধুয়ে কাদা ছাড়িয়ে দেয়। নাজহা থমকে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে রয় মানুষটা টাকা-পয়সার দিকে কিপ্টা হলেও যত্নের বেলায় মহারাজা। এই যে একজন পুরুষ হয়েও ওর পা ছুঁলো একদম নিরহংকার ভাবে । নাজহা খানিকটা মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়। তৌসির ওর পা ধুয়ে জুতাটা সুন্দর করে হালকা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ওর পায়ের কাছে দিয়ে বলে,”নাও, পড়ে নাও। আর চামড়ার জুতা এমনে দৌড়ে আইসা ভিজাইতে নিও না, ছিঁড়ে যাবে সকাল।”
নাজহার পায়ে জুতা পড়িয়ে দিচ্ছে তৌসির সেই তৌসির যাকে বাঘ বলে জানে মানুষজন। এই দৃশ্য নিজ নয়নে দেখেও ঠিক যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না নাজহার মাস্টার চাচ্চু আর ওর তিন নম্বর চাচার ছোট ছেলে মুত্তাসিম নাজহার সাহেব ভাই। উনারা এসেছিলেন নাজহার টিকার কার্ড দিতে, কিন্তু এসে জানতে পারেন ওকে তৌসির স্কুলে নিয়ে গিয়েছে, কার্ডের প্রয়োজন নেই। তাই কার্ডটা ওদের কাছে দিয়ে উনারা ফিরতে নিচ্ছিলেন নিজেদের গ্রামে। তাদের গ্রাম আবার বেশ দূরেও নয়, কাছেই। যাওয়ার সময় দূর থেকে তৌসির আর নাজহাকে দেখতে পান ওরা পুকুরে নামছে। তাই নাজহাকে একটিবার দেখার জন্য এসেছেন।
মাস্টার চাচ্চু মানে নাদের তালুকদারের বড্ড আদরের নাজহা। নাজহা আর তৌসির উপরে উঠে এসে মাস্টার চাচ্চু আর সাহেব ভাইকে দেখে চমকায় সামান্যমাত্রায়। তৌসির উনাদের দেখে মোটেও খুশি হয় না শত্রুকে দেখে কেউ-বা খুশি হবে? কিন্তু তাও কিছুটা কটাক্ষের হাসি দিয়ে বলে,”সালামু আলাইকুম, শ্বশুরমশাই আর সাহেব ভাই, কেমন আছেন?”
উনাদের গায়ের চামড়া জ্বলে যায় এমন কথা শুনে, তারপরও মৃদু হেসে দু’জনে মাথা নাড়িয়ে বলেন,”ওয়ালাইকুম সালাম, আলহামদুলিল্লাহ।”
মাস্টার চাচ্চু নাজহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নির্লিপ্ত সুরে বলেন,”কেমন আছিস?”
নাজহা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়,”আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তোমরা?”
এ বলে সাহেব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”কেমন আছো সাহেব ভাই, তুমি?”
“কেমন আছো সাহেব ভাই” এ কথাটা বুকের অন্তস্তলে গিয়ে গেঁথে যায় সাহেব ভাইয়ের। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। নিজের মন চায় বলতে,”তোকে অন্যের বক্ষে দেখতে কেমন থাকতে পারি, বলতো?”
কিন্তু আফসোস, তা উনি কখনোই বলতে পারবেন না। উনার যা বলার, যা ভাবার তা শুধুই একান্ত। এই যে, ওকে ভালোবাসেন এটাও উনার একান্ত বাধ্যগত। কেউ জানে না, আল্লাহ ছাড়া কেউ না।
সাহেব ভাই অল্প হেসে বলেন,”এই তো আছি। তোর টিকার কার্ড দিতে এলাম, দিয়ে এসেছি। তোর সাথেও দেখা হয়ে গেল।”
নাজহা উনার কথায় মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বলে,”ওহ্।”
মাস্টার চাচ্চু তৌসির আর নাজহার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আচ্ছা, তাহলে আমরা যাই, বাড়িতে কাজ আছে।”
নাজহা আর তৌসির মাথা নাড়ায়। তৌসির নাজহার হাতটা নিজের হাতে মুঠোয় আলতো করে আগলে নিতে নিতে বলে,”মাঝেমধ্যে আইয়েন এমনে ভাতিজির খোঁজখবর নিতে।”
মাস্টার চাচ্চু আর সাহেব ভাই যাওয়ার জন্য উল্টো দিকে পা বাড়িয়ে বলেন,”হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো আসবই।”
মুখে এটা বললেও মনে মনে বলেন, ” তোর মত শয়তানের কাছে দিয়েছি বিয়ে আসতো হবেই সরের সর কোথাকার।”
উনারা চলতে শুরু করেন নিজেদের গন্তব্যে। আর নাজহা আর তৌসির পা বাড়ায় তাদের গন্তব্যে। সাহেব ভাই কিছুটা এগিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকান নিজের প্রাণসঞ্চারিণীকে দেখার লোভ সামলাতে পারেননি বিধায় তাকান, নয়তো তাকাতেন না। উনি দেখতে পান নাজহার হাতটা ধরে তৌসির ওকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
উনার চোখের সামনে একটু আগের সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে যখন তৌসির নাজহার পা ধুয়ে দিচ্ছিল। সাহেব ভাই পিছনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সামনে দিয়ে এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে মনে মনে বুনেন,”আমাদের যতবারই দেখা হবে, ততবারই আমাদের বিচ্ছেদ হবে। শত বিচ্ছেদের বহরেও আমি তোমায় ভালোবেসে যাবো একান্তে।”
এ বলে সামনে দিয়ে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করেন আর নিজের চুলে নিজে হাত বুলাতে বুলাতে মৃদু হেসে বলেন,”তোমায় না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মনও পুড়বে, আবার তোমায় বারংবার মনেও পড়বে।”
নাজহা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল এতক্ষণ বাড়ির মহিলাদের সাথে। ও একটু গরমেই ঘেমে একেবারে একাকার হয়ে যায়। তাই এসেছে ঘরে একটু বাতাস খাবে বলে। ঘরের ভেতর পা যখনি রাখবে তখনই ঘর থেকে বের হয় তৌসির। দু’জনে ধাক্কা খেতে খেতে গিয়েও খায় না। একে অপরের চোখের দিকে অল্প সময় তাকিয়ে থাকে। নাজহা কে আসতে দেখে ভদ্রতার খাতিরে তৌসির কিছুটা পিছনে সরে যায়। নাজহা লক্ষ্য করে তৌসিরের পড়নে কাল কাপড়ের একখানা লুঙ্গি। নাজহা এটা দেখে ভুরু কুঁচকায় সত্যি বলতে জীবনের প্রথম দেখলো কাউকে কালো লুঙ্গি পড়তে। ওর বাপ-চাচারাও লুঙ্গি পড়েন, কিন্তু এমন রঙের কখনো পড়েন না। তৌসিরের চুলগুলো এলোমেলো, কপালেও কিছুটা লুটিয়ে আছে। এর উপর তৌসির সবসময় পাঞ্জাবি পড়ে, শার্ট পড়ে না। কিন্তু আজ নাজহা দেখছে ভিন্নতা তৌসির ক্রিম কালারের একটা হাতা লম্বা শার্ট পড়েছে। বড্ড সুন্দর লাগছে চঞ্চল তৌসিরকে।
নাজহা মনে মনে ভাবে “এভাবে নায়ক সাজলেন যে, এই কিপ্টা ব্যাপারটা কী?”কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করে না। মন বা মস্তিষ্ক একবারও সংকেত দেয় না যে একটাবার জিজ্ঞেস করি কই যাবেন উনি।
নাজহাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৌসির বলে ওঠে, “শুনো তালুকদারের মাইয়া, আইজ আমি রাতে আসতে নাও পারি। তুমি সিমরানরে নিয়া ঘুমাইয়া যাইও, যদি ডরাও।”
নাজহা তৌসিরের কথায় ওর দিকে মুখ তুলে তাকায়, তারপর মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আচ্ছা।”
এ বলে তৌসিরকে পাশ কাটিয়ে বিছানার দিকে এগোতে থাকে। তৌসির একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়, মনে মনে ভাবে কত বড় শয়তান্নি জামাই চলে যাচ্ছে, অথচ ও একটাবার জিজ্ঞেসও করলো না কোথায় যাবেন?তৌসির ঘাড় ঘুরিয়ে নাজহাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,“তুমি বহুত বেয়াদব একটা মহিলা, তালুকদারের মাইয়া।”
নাজহার পা থেমে যায়। ও দাঁড়িয়ে গিয়ে তৌসিরের দিকে রুক্ষ নয়নে চেয়ে বলে,“আমি কী বেয়াদবি করলাম আপনার সাথে?”
তৌসির নাজহার কথায় কিছু বলতে চায়, কিন্তু পরক্ষণেই থেমে যায়। ওর চোখে পড়ে ওদের মধ্যে থাকা দূরত্ব বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে নাজহা। না, এত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বললে কথা বলার আকর্ষণটা ঠিক আসে না। তাই তৌসির ওর দিকে এগোনোর জন্য পা ফেলতে ফেলতে বলে, “এই যে আমি তোমার জামাই, তোমায় যাচ্ছি বললাম জিজ্ঞেস করলে না কোথায় যাচ্ছি?”
এ বলে নাজহার সামনে এসে দাঁড়ায়। নাজহা বিষাক্ত কাটা-দেওয়া নয়নে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে তিক্ত সুরে বলে,“রাতে যাচ্ছেন, তাহলে আর কোথায় যাবেন? নিশ্চয়ই অবৈধ নেশার কাজে, আর নয়তো ব্যাসসাদের বিছানায় নিজের শখ মিটাতে।”
তৌসিরের মেজাজটা এমনিতেই খুব খারাপ অবস্থায় আছে। আর এখন নাজহার এই কথা শুনে মন চাচ্ছে নাজহার গাল একটানে ধরে ফেরে নিতে অতিরিক্ত কথা বলে এই মেয়ে! তৌসির ওর দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলে, “চড় মাইরা নাক মুখ সমান কইরা ফেলমু বেয়াদ্দব মহিলা।”
তৌসিরের কথা শুনে নাজহা ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “আমি মিথ্যা কিছু বলেছি? আপনি তো এগুলোই করেন।”
তৌসির নাজহার কথায় দাঁতে দাঁত চেপে চারদিকে তাকায়। নিজের মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। রাগে মগজ গলে যাচ্ছে। নাজহার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আজ ওর শেষ দিন হতো। কিন্তু নাজহাকে ও কিছু করতে পারবে না করলেই বিপদ। তৌসির অল্প সুরে চিৎকার করে বলে “তোর এক হাত লম্বা থুতা সামলে নে, নয়তো একটানে থুতা ফাইরা আম্বরখানা নিমু।”
এ বলে আর কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এখানে থাকলে এখন খুন করতে ইচ্ছে হবে, খুন।
নাজহা তৌসিরের যাওয়ার পানে নিরলস চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “আমার নিয়তি এত নিকৃষ্ট কারোতে কিভাবে আটকে নিতে পারলো?”
নাজহা উদাস হয়ে বিছানায় বসে পড়ে। মন চায় সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যেতে নিরব কোথাও। যেখানে কেউ থাকবে না ও ছাড়া। একটু শান্তি প্রয়োজন, একটু শান্তি আর কিছু নয়। কাউকে চাই না শুধু একটু মুক্তি চাই।
রাত এখন এগারোটার কাছাকাছি। সেই অন্ধকার কারাগারে মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৌসির আর মিনহাজ মামা সাথে রুদ্র দেওয়ানও আছে। রুদ্র দেওয়ান আবার তৌসিরের বন্ধু মানুষ যেখানে তৌসির, সেখানে রুদ্রও এক আত্মা, দুই দেহ বলতে গেলে। তারা ছোটবেলা থেকে কাঁধ মিলিয়ে বড় হয়েছে যদিও রুদ্র তৌসিরের দুই-এক বছর ছোট, তবে বন্ধুত্ব কি আর বয়স দেখে? এটি তো এমনি-এমনিই হয়ে যায় যদি মনে আঁকড়ে থাকে একজন আর অপরজন।
তৌসির সেই নির্যাতিত মেয়েটির সামনে গিয়ে এক হাঁটু ঘেঁড়ে বসে। মেয়েটির নাম তৃণা। বিগত কয়েক দিন যাবৎ যার উপর চলছিল পীড়ন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট অত্যাচার মেয়েটির অবস্থা আর মানুষের মতো নয় পশুর মতো হয়ে গেছে। এখন বলতে গেলে প্রায় অর্ধমৃত সে। অবদমিত হতে হতে ওর সারা শরীর রুধিরসিক্ত হয়ে গেছে। শরীরে পঁচা ক্ষত দিয়ে পোকা বেয়ে পড়ছে সঙ্গে সাদা স্যাতস্যাতা পুঁজ, পচা রক্ত। চোখ বেয়ে পানির বদলে রক্ত পড়তে পড়তে রক্তের দাগ গালে আটকে গেছে। ময়লার সঙ্গে রক্ত মিশে গায়ে লেগে আছে বিশ্রী রূপে। চুলগুলো থেকে পোকা পড়ে যাচ্ছে। হাতের প্রতিটি আঙ্গুল দু’বার করে ভাঙা হয়েছে। এখন শুধু নামেই বেঁচে আছে । হায়াতের জোরেই হয়তো আছে টিকো।
তৌসির ওর সামনে বসে ওকে জিজ্ঞেস করে,“ডকুমেন্টসগুলো কোথায়? ওগুলো দিয়ে দে, মাগি।”
তৃণা নিঃরস হয়ে মাথা দু’দিকে নাড়ে উত্তর দেয়, “অসম্ভব। আমি তোদের মতো পশুদের এভাবে জিততে দেব না।”
তৌসির ওর কথায় চারপাশে তাকায়, তারপর আবার ঠান্ডা গলায় বলে, “ডকুমেন্টস দে বলছি!”
তৌসিরের বলার ধরণ বদলালেও মেয়েটির ক্ষেত্রে তা হয় না সে জিদ নিয়েই উত্তর দেয়,“সম্ভব নয়।”
আসলে মেয়েটি একজন সিক্রেট এজেন্ট তৌসিরের টিমে বহুরুপী হয়ে প্রবেশ করে বেশ কিছু ডকুমেন্টস কলেক্ট করেছে। তৌসিরদের ভালো মানুষের মুখোশটা খুলে দিতে। কিন্তু তার নিয়তি তার সাধ দেয়নি ওরা জেনে গিয়ে ওকে এমন অমানবিক নির্যাতন করেছে যাতে ডকুমেন্টসগুলো দিয়ে দেয়। কিন্তু তৃণার একটাই কথা মৃত্যু হলে হোক, দেশের সাথে বাটপারি করা যাবে না। অথচ প্রকৃত সত্য দেশ রক্ষীরাই দেশের খয়েরাতে লিপ্ত। তৌসির বুঝে যায় ও কোনোভাবে মানবে না। তাই কি আর করবে? হাত বাড়িয়ে শক্ত হাতে তৃণার চুল টেনে ধরে ওর কপাল বারবার দেয়ালে ঠেসে দেয়। তৃণার চোখ ভুরু কপাল ফেটে ছেঁচে যায় কিন্তু ওর মৃত্যু ওকে চায় না, তাই ও বেচে থাকে শ্বাস ফেলে। চিৎকার করার শক্তিও নেই আর থাকলেও করতো না, কারণ এই চিৎকার ওদের কানে কখনোই পৌঁছাবে না। তৌসির ওর মাথা ছেঁচে নিয়েও দেখে বেঁচে আছে। রুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “রুদ্র, কিছু দে।”
রুদ্র এদিকে ওদিকে খুঁজে নিজের লুঙ্গির কোমরে গুজা একটা কাপড়-কাটার কেচি ওর হাতে তুলে দেয়। এটা রুদ্র অবশ্য অন্য কাজে নিয়েছিল, কিন্তু এখন এই কাজে লাগছে। তৌসির তৃণার চুল আরো শক্ত করে ধরে, ওকে দেওয়ালে ঠেসে ধরে গলায়, পেটের দু’পাশে, পিঠে ইচ্ছে মতো কেচি দিয়ে কুপ দিতে থাকে। তৃণার রক্তে মাটি ভিজে যায় ওর গায়ে লেগে থাকা ময়লা রক্তের সাথে ধুয়ে পড়ে ওর শরীরটা একটু দুলে ওঠে সাথে ওর পীড়িত প্রাণটাও ঝড়ে যায় নিমেষে। ওর প্রাণটা চলে যায় তখনই, যখন তৌসির ওর গলায় কুপ মেরেছিল। তৌসির শেষ একটা কুপ মারে ওর মাঝ পিঠে। তারপর কেচি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “পানি আন। এর রক্ত আর শুয়োরের রক্তের মধ্যে তফাৎ নাই তাড়াতাড়ি হাত ধুই।”
রুদ্র বাইরে গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে আসে। তৌসির এটা দেখে ওর দিকে ভুরু কুঁচকে বলে,“কিনে নিয়েছিস সাথে, নাকি বাড়ি থেকে?”
রুদ্র হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে “আরে না, বাড়ি থেকে আনছি।”
এ বলে তৌসিরের হাতে পানি ঢালতে শুরু করে। রুদ্রের কথায় তৌসির দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে বলে, “তাইলে ভালো, টাকা দিয়ে পানি কিনে এসব মাগিদের রক্ত ধুয়ে কোনো ফায়দা নাই।”
মিনহাজ মামা এতক্ষণ সব পরখ করছিলেন চুপটি করে কোনো এক্সট্রা কথা বলেননি। কিন্তু এখন মুখ খুলেন, দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলেন, “বাপ রে, তাড়াতাড়ি চল সুনামগঞ্জ যাইতে হবে।”
তৌসির হাত ভালো মতো ধুতে ধুতে বলে, “হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওখানে আরেক মাগির পোলারে দাফন করতে হবে ওর ডানা বেশি মেইল্লা গেছে।”
রুদ্র পানির খালি বোতলটা পাশে ফেলে দিয়ে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে, “এরে, কি করবি?”
তৌসির ওর ফেলা বোতলটা হাতে নিতে নিতে বলে, “হালা, এডি ফেললি ক্যান? অন্যসময় পানি আনতে পারমু। আর এর ব্যবস্থা তন্ময় চাচা করবো ওনার এক সায়েন্টিস্ট বন্ধু মাইনষের মাংস চাইছে ওর মাংসই দিয়া দিবো নে।”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আইচ্ছা, তাইলে আমরা আমাদের কাজে যাই।”
মিনহাজ মামা কারাগার থেকে বের হতে হতে বলেন, “হ্যাঁ, যাই, চল।”
এ বলে সবাই বাইরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তৌসির ফিরে তাকায় ঐ মেয়েটার লাশের দিকে আর মনে মনে শোধ করে,“তালুকদারের মাইয়া, তোমায় এমন অবস্থায় দেখার স্বপ্ন দেখেছি আমি।”
এ বলে ঠোঁটে বিদ্রুপের কূটচালকের মতো একটা হাসি এনে হাত বাড়িয়ে লুঙ্গির প্রান্ত কুঁচকে কোমরে ঠেসে রাখতোতেই বেরিয়ে যায়। ওর পিছনে পরে রয়েছে এক নিরবে দেশপ্রেমীর ক্ষণে-ক্ষণে নির্দয় যন্ত্রণার বালী হওয়া দগ্ধ মৃতদেহ যে শুধু চেয়েছিল একটু ন্যায়, কিন্তু তা করতেই পারেনি তার আগেই মানুষরূপী এই জানুয়াররা তাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাও বিশ্রীভাবে।
রাত এখন দু’টোর কাছাকাছি। একটা ছোট নৌকায় তৌসির, রুদ্র দেওয়ান, নুহমান শাহ, কেরামত আলী সাথে দু’জন পালোয়ান নিয়ে ওরা এগোচ্ছে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর এক কিনারার দিকে। এগোচ্ছে বললে ভুল হবে, কারণ ওরা এতক্ষণে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। একটা বড় ফিশিং বোটে উঠেই ওরা একে একে সামনে এগোয়।
সামনে দেখতে পায় মাঝখানে একজন লোক চেয়ারে বসে আছে। আলতো আলো, লাইটের সাথে চাঁদের চন্দনিতে তৌসিররা স্পষ্টই ওদের দেখতে পাচ্ছে। সেই লোকের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু গুন্ডা-সন্ডা টাইপের লোক। লোকটির নাম ইজ্জত আলী।
তৌসিরকে দেখে সে বিকৃত হাসি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে,
“কি রে, তুই আইলি? তোর লাইগা আইজ না ঘুমাইয়া অপেক্ষা করছিলাম।”
তৌসির ইজ্জত আলীর কথায় মেকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের লোকদের দিকে একবার তাকায়। তারপর সামনে তাকিয়ে নিজের লুঙ্গির নিচের এক কোণ তুলা দিয়ে হাতে নিয়ে দু’কদম এগিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,“হ ভাই, আইলাম। এখন আমার মালগুলো আমায় দিয়া দেন তো, দেখি।”
ইজ্জত আলী ওর কথাটা ঠিক তেমন গায়ে মাখে না। উল্টো ভাব নিয়ে লুঙ্গির কোণ হাতে তুলে নিয়ে আসতে আসতে বলে, “আমার এলাকায় যেই মাল আয়, সেই মাল আমার হইয়া যায়। তাই ফিরত পাওয়া সম্ভব নয়।”
তৌসিরের রাগ উঠে, কিন্তু রাগ না ঝেড়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর চোখে চোখ রেখে বলে “এগারো লাখ টাকার মাল তোমার এলাকায় আইয়া আটকেছে, তাই ক্যাচাল না কইরা দিয়া দাও মালের নৌকাডা।”
ইজ্জত আলী তাচ্ছিল্যের সহিত বলে ওঠে,“তুই আমার এলাকায় ব্যাবসা করবি, আর আমারে ভাগ না দিয়া চইল্লা যাবি? এটা হইবো না। মাল নিতে হইলে ভাগ দিত হইবো।”
তৌসির ভুরু কুঁচকায়, “কত?”
ইজ্জত আলী চারপাশে একবার তাকায়। তারপর ভেবলাশহীন ভাবে বলে,“বেশি না, দুই লাখ প্রতি দশ লাখে হইবো।”
তৌসির এটা শুনে মুচকি হাসে। তারপর জিহ্বা কামড়ে শক্ত হাতে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় ইজ্জত আলীর বা গালে। এক থাপ্পড়েই ঠোঁট ফেটে পিচকারী দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে। তৌসির দাঁত চেপে বলে ওঠে, “ পয়সা বাচাইতে ছিঁড়া লুঙ্গি তালি দিয়া পড়ি, আর তুই কস বিনা কারণে তোরা দিয়া দিতাম লাখ টাকা?”
ইজ্জত আলীর লোক ওদের দিকে ত্যাড়ে আসতে নেয়। তৌসির হাত দিয়ে থামিয়ে ওদের চিৎকার করে বলে,“এই খান**নিকির পোলারা, থাম! নয়তো সব-কয়টারে কুত্তার মতো টাইন্না ছিঁড়মু।”
এমন হুংকার শুনে ওরা কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়। তৌসির ইজ্জত আলীর কলার দুই হাতে টেনে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,“তোর মতো বহুত বগারে আমি আমার জীবনে ঠিক করছি। তাই আমার লগে পাঙ্গা নিস না। নয়তো বংশের বাতি জ্বলানোর ঐটা আর লগে থাকবো না।”
ইজ্জত আলী এত বড় অপমানে চিৎকার করে বলে, “তোর এত বড় সাহস? সরের বাইচ্চা, তুই আমার ইজ্জতের উপরে কথা কস?”
তৌসির ইজ্জত আলীর কথায় তাচ্ছিল্য করে বলে, “হালা ইজ্জত হুন! তোরে আমি লুঙ্গি ছাড়া বেইজ্জত রূপে ঘুরামু সারা সিলেট বিভাগ। তুই জানস না কত বড় খবিস আমি।”
ইজ্জত আলীও খবিসের উপরে খবিস। সেও ত্যাড়ামি করে বলে, “আমি দিমু না মাল, কি ছিঁড়বি, ছিঁড়।”
তৌসিরের রাগে মগজ ফুটতে শুরু করে। কিন্তু তাও নিজেকে দমন করে নেয় কারণ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জীবন বৃথা। ও ইজ্জত আলীর কলারে আরো শক্ত হাতে টেনে ধরে তিক্ত সুরে বলে, “কাফন ছাড়া তোরে এই মাঝ নদীতে দাফন দিয়া দিমু রেএ মুনাফিকের বাচ্চা, চুপচাপ মাল দে।”
তৌসিরের কথায় ইজ্জত আলী ভয় তো পায়, কিন্তু নিজের জেদ আঁকড়ে ধরে বলে,“কি করার, কইরা নে। দিমু না, পানে দিমু না।”
স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৮
তৌসির ওর কথায় কিছু সময় ওর চোখের দিকে তাচ্ছিল্যের সহিত তাকিয়ে রয়। তারপর ডান হাতে ওর কলার চেপে ধরে, বা হাত দিয়ে নিজের কোমরে গুঁজে থাকা লোহার চাপাতি বের করে যার ধারালো ফলাটি রক্তের জন্য যেন চেয়ে আছে।
এই চকচকে চাপাতিটা ইজ্জতের গলায় ধরে বলে,
“তোর সাওয়া সহ কুচি কইরা দিমু বেশি কিছু না! ”
এ বলে চাপাতিটা শক্ত হাতে ধরে নেয়।
