স্রোতস্বিনী পর্ব ১৪

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৪
মুগ্ধতা রাহমান মেধা

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই স্রোত নিজেকে মেহরাদের বুকে আবিষ্কার করলো।মেহরাদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে।যেনো ছেড়ে দিলেই সে উড়ে যাবে।স্রোত কোনোমতে বাঁধন ছেড়ে উঠে বসে।তার নজর যায় ঘুমন্ত মেহরাদের মুখে।কি শান্তিতে ঘুমোচ্ছে এখন।পৃথিবীর সকল শান্তি যেনো তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে।স্রোতের মনে পড়ে যায় কাল রাতের কথা।কি পা গ লামিটাই না করলো লোকটা!মুখে শুধু একটা কথাই ছিলো,

“তুমি আমার অনেক শখের স্রোত,অনেক শখের।প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত তোমার অপেক্ষায় ম রেছি।”
স্রোত ফ্রেশ হয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে যায়।তারপর আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে।পড়নে তার নীল শাড়ি,ভেজা চুলগুলো পুরো পিঠ দখল করে আছে।নিজের এই রূপ বড়ই অপরিচিত স্রোতের,নিজেকে কেমন অচেনা লাগছে,খুউউব অচেনা।গলার কাছটায় স্বামী সোহাগ স্পষ্ট। স্রোত নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে ব্যস্ত।হঠাৎ দুটো হাত তাকে বন্দি করে ফেললো,ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো।আচমকা এমন হওয়ায় স্রোত প্রথমে শিউরে উঠলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়।মেহরাদ এবার স্রোতের কাঁধে থুতনি রেখে আয়নায় দৃষ্টি ফেলে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আপনার এই রূপ অনেক ভ য়ংকর স্রোতস্বিনী, অনেক ভ য়ংকর।আমার গলা শুকিয়ে আসে,বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়।আপনাতেই আমার মরণ নিশ্চিত, স্রোতস্বিনী।”
স্রোত চেয়ে রইলো মেহরাদের প্রতিবিম্বের দিকে।নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
মেহরাদ হেঁসে স্রোতের পিছন পিছন গিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে বলে,

“গতকাল রাতে আপনি আমার নাম ধরে ডেকেছেন।আহা স্রোতস্বিনী আপনার কন্ঠে আমার নাম এতো সুন্দর লাগে, আগে জানলে তো রেকর্ড করে রাখতাম,তারপর বারবার শুনতাম।”
রাতের কথা মনে পড়তেই স্রোতের লজ্জায় মরি মরি অবস্থা।সে নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে মেঝে খুঁটছে। মেহরাদ তা দেখে বাঁকা হেঁসে বলে,

“আপনাকে লজ্জা পেলে পুরো রসগোল্লার মতো লাগে।মনে হয় এক কা মড়ে খেয়ে ফেলি।”
স্রোত মেকি রাগ দেখিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরে যায় মেহরাদ থেকে।মেহরাদ শব্দ করে হেঁসে ফেলে।তারপর স্রোতকে কোলে তুলে দিয়ে ঘুরতে থাকে,
“স্রোতস্বিনী আপনি আমার,আপনি আমার।পুরো পৃথিবী জানুক আপনি পরিপূর্ণ ভাবে মেহরাদ সাদাফের হয়ে গিয়েছেন।”

“পৃথিবী সবাইকে জানিয়ে দাও,রটিয়ে দাও আমি আমার ব্যক্তিগত স্রোতস্বিনীকে কতটা ভালোবাসি।”
স্রোত তার পা গ ল প্রেমিকপুরুষের উন্মত্ততায় অপলক চেয়ে রইলো।
আজ বিকালেই মেহরাদ চলে যাবে বিধায় স্রোতদের বাড়ির মানুষকে বউভাতের নিয়ম রক্ষা করার জন্য আজই আসতে বলেছেন বনলতা বেগম।বর বাড়িতে না থাকলে বউভাত কেমন করে হবে!তাই বাড়িজুড়ে এখন আয়োজন চলছে।স্রোত সবার সাথে টুকটাক কথা বলেছে।এই বাড়ির মানুষগুলো অনেক মজার,সবাই কত হাসি-ঠাট্টা করে।সে যে নতুন বউ,নতুন সদস্য সবার ব্যবহারে তা বুঝা যায় না। মনে হয় কত দিনের চেনা। স্রোত গিয়েছিলো রান্না ঘরে, শাশুড়ীদের সাহায্য করতে।শাশুড়ীরা তাকে ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।বলেছে,আমরা থাকতে তোমার কিছু করতে হবে না।সংসারের কাজ করার জন্য সারাজীবন পরে আছে।

বনলতা বেগম জানিয়েছেন,”খবরদার রান্না ঘরে ঢুকবে না।এতোদিন যেমন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলে তাই থাকো।আগে ক্যারিয়ার তারপর অন্যকিছু।আর আজকে আমার ছেলেটা চলে যাবে,ওকে সময় দাও।”
শেষের কথাটা শুনতেই স্রোতের মন খারাপ হয়ে যায়।সে যেনো ভুলেই বসেছিলো মেহরাদের যাওয়ার কথা।বনলতা বেগম আবার বললেন,

“সময় মতো তৈরী হয়ে নিও কেমন!সবাই চলে আসবে।”
স্রোত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলে বনলতা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যান।
মেহরাদ সকালের খাওয়াদাওয়ার কোথায় যেনো গিয়েছে, এখনো ফেরেনি। স্রোত চলে যায় বারান্দায়। বারান্দাটাই যেনো তার রাজ্য।তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রকাশ সবটাই যেনো এই বারান্দাতেই আবদ্ধ।মেহরাদ চলে যাবে ভাবনাটা মাথা থেকে যাচ্ছেই না।তার খারাপ লাগছে,কষ্ট হচ্ছে।কেনো হচ্ছে জানে না।লোকটার মায়ায় তো কবেই পড়ে গিয়েছে, ভালোও বেসে ফেললো?এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা যায়?হয়তো যায়।

তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পায় স্রোত।তার পাশেই রেলিং এ হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।স্রোত দেখলো লোকটাকে,বুঝলো তার মন খারাপ।ভণিতা না করেই জিজ্ঞাসা করলো,
“মন খারাপ কেনো আপনার?”
মেহরাদ জবাব দিলো না।স্রোত এগিয়ে গেলো মেহরাদের দিকে,নিজের দিকে ঘুরিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো,
“বলুন মন খারাপ কেনো?”

“আমি আজকে চলে যাচ্ছি স্রোত।” বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে স্রোতের দিকে তাকিয়ে বলে।
স্রোত নিজের মন খারাপ বুঝতে দিলো না, সে আগের জায়গায় চলে গেলো,হাসতে হাসতে বললো,
“এর জন্য মন খারাপ করছেন?এটা কি নতুন নাকি?দেশের দায়িত্বে আছেন আপনি।”
মেহরাদ এগিয়ে এসে পেছন থেকে স্রোতকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো অনুনয় করে বলে,
“আগে তো বউ ছিলো না,এখন বউ আছে।কই বিয়ে করলাম, বউ নিয়ে ঘুরবো-ফিরবো,সময় কাটাবো,হানিমুনে যাবো তা না।”

স্রোত হেঁসে ফেললো।পিঠ ঠেকালো মেহরাদের বুকে,মেহরাদ আরো শক্ত করে আগলে নিলো তাকে,স্রোত বাঁকা হেঁসে বললো,
“মেজর মেহরাদ সাদাফ কিনা একদিনেই বউপা গল হয়ে গেলো?”
মেহরাদ স্রোতের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে,
“অনেএএএএএএএক।”

স্রোতদের বাড়ি থেকে মানুষ চলে এসেছে।স্রোতের মামা-মামী, বাবা,মান্ধবী আর সাহেলা বেগম।স্রোতের দুঃসম্পর্কের ঐ ফুপি গতকালই বাড়িতে চলে যান।সাহেলা বেগম আসতে চান নি,বাড়ির পরিচারিকা বলে। মান্ধবী জোর করে নিয়ে এসেছে।বলেছে,আমরা তোমাকে বাড়ির সদস্যই মনে করি।স্রোতও সাহেলা বেগমকে দেখে অনেক খুশি হয়েছে।মান্ধবী স্রোতকে দেখতেই সবার সামনেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আপুউউউ মনে হচ্ছে কতবছর পর তোকে দেখলাম।এখন শান্তি লাগছে।তোকে কত সুন্দর লাগছে আপুুউউ।”
সবার সামনে এভাবে বলায় স্রোত অপ্রস্তুত হয়ে যায়।বনলতা বেগম বলেছেন মান্ধবীকে নিয়ে নিজের ঘরে যেতে।স্রোত মামা-মামীর সাথে টুকটাক কথা বলে মান্ধবীকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।স্রোতের বাবা মেয়ের পানে অনিমেষ চেয়ে রইলো।তার মেয়ের মুখে হাসি,কত সুন্দর লাগছে তার বড় মেয়েকে।মেহরাদ খেয়াল করেছে স্রোত তার বাবাকে এড়িয়ে যাওয়ায় উনি কষ্ট পেয়েছেন,উনার চেহারায় অসহায়ত্ব স্পষ্ট।তাই মেহরাদ চলে যায় শ্বশুরকে সঙ্গ দিতে।এদিকে ড্রইং রুমে রায়হানও উপস্থিত ছিলো।মান্ধবীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেও মান্ধবী একটাবারের জন্যেও তার দিকে তাকায়নি। রায়হান জানে এটা তারই কর্মফল।

মান্ধবী রুমে এসে সারাটা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে।তার বোনের পছন্দ আর মেহরাদের পছন্দ অনেকটা এক,তা ঘর সাজানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। স্রোত তখন বিছানায় বসে।তার পড়নে ন্যূড পিংক কালারের শাড়ী।মান্ধবী চোখগুলো ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করলো,

“তোকে সাজিয়ে দিলো কে?তুই তো সাজতে পারিস না।”
“রিহানা আর নয়না আপু। জোর করে সাজিয়েছে।” স্বাভাবিকভাবেই বলে স্রোত।
“ভালো করেছে।নতুন বউ না সাজলে ভালো লাগে নাকি।তুই তো নিরামিষ।”
বোনের পাশে বসতে বসতে বলে মান্ধবী।
স্রোত রাগী চোখে বোনের দিকে তাকাতেই মান্ধবীর চোখ যায় স্রোতের গলার কালসিটে জায়গাটায়।বলা বাহুল্য, সবার সামনে স্রোত ঘোমটা দিয়ে রেখেছিলো।রুমে আসতেই ঘোমটা ফেলে দিয়েছে।মান্ধবী বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“তোর এখানটায় কি হয়েছে রে?”
স্রোত লজ্জায় আমতা আমতা করে বলে,
“বিষ পিঁপড়া কামড়েছে। ”
মান্ধবী দুষ্টুমি করে বলে,
“ওওওওও বিষ পিঁপড়া!!! মেহরাদ ভাইয়াকে বলে দিবো রুমে ঔষধ দিতে।”

বলেই শব্দ করে হেঁসে ফেলে মান্ধবী।স্রোত কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমে মেহরাদের আগমন।স্রোত উঠে চলে যায় আয়নার সামনে।মেহরাদ হেঁসে জিজ্ঞাসা করে,
“শালিকা এতো হাসছো কেনো?কি হয়েছে?”
মান্ধবী মেহরাদকে দেখে চুপ করে যায়।সে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে,
“কিছু না ভাইয়া।আপনারা থাকেন আমি একটু বাহিরে যাই।”
ঘর থেকে বাহিরে যেতে যেতে আবার মেহরাদকে ডাক দেয়,

“ভাইয়াাাাাা।”
“বলো”
“আপনার রুমে অনেক বিষ পিঁপড়া হয়েছে। এদের নিধন করতে হবে বুঝলেন?” বলে দৌড়ে চলে যায় মান্ধবী।
স্রোতের লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। তার বোন এতো পাঁজি, মনে মনে বোনকে প্রচুর গা লি দিলো সে।মেহরাদ অবাক হয়ে স্রোতকে জিজ্ঞাসা করলো,
“বিষ পিঁপড়া? আমার রুমে?কি বলে গেলো?”

স্রোত লজ্জায় চুপ করে আছে।মেহরাদ আবার বললো,
“লজ্জা পাচ্ছেন কেনো?বিষ পিঁপড়ার সাথে আপনার লজ্জার কি সম্পর্ক?”
স্রোতের এবার রাগ লাগলো।দাঁত কিড়মিড়িয়ে মেহরাদের সামনে গিয়ে গলার দাগ দেখিয়ে বললো,
“এটা হচ্ছে বিষ পিঁপড়ার কাজ, বুঝেছেন?

” এটা তো আ…।বিষ পিঁপড়া?আমি?আমাকে বিষ পিঁপড়া বলে গেলো?”চোখগুলো বড় বড় করে বললো মেহরাদ।
মেহরাদের চেহারার ভঙ্গিমা দেখে স্রোত হেঁসে ফেললো।
মেহরাদ তাকে নিয়ে আয়নার সামনে দাড় করালো।পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

“শালিকা আমার জানলোই না এই বিষ পিঁপড়া আরো কত কিছু করে ফেলেছে।”
“অ সভ্য পুরুষমানুষ। ”
“আপনার কাছেই। একটু অ সভ্যতা করবো?” বাঁকা হেঁসে বলে মেহরাদ।
“ছাড়ুন তো,বাসা ভর্তি মানুষ।” ঢোক গিলে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে স্রোত।মেহরাদ ছাড়ে না।আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আপনাকে সুন্দর লাগছে অনেক।”
“জানি।”
“আর কি জানেন?”
“আমি সুন্দর,আমি জ্ঞানী,আমি গুণী”
“ভালোবাসি স্রোত।”

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৩

“ভালোবাসা সুন্দর, ভীষণ সুন্দর।”
“আমাকে ভালোবাসো না?”
“জানি না,ছাড়ুন”
মেহরাদকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় স্রোত।মেহরাদ হাসতে থাকে।বিড়বিড়িয়ে,
“এবার মিশন ” ভালোবাসি” শোনা।”

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৫