স্রোতস্বিনী পর্ব ৪

স্রোতস্বিনী পর্ব ৪
মুগ্ধতা রাহমান মেধা

[অতীত]
আজ শুক্রবার।সকাল নয়টা বাজতে চললো।জানালা দিয়ে সূর্যের আলো স্রোতের চোখে-মুখে পড়লে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।স্রোত সারারাত পড়াশুনো করে নামাজ পড়ে ৫ টার দিকে ঘুমিয়েছে।সাধারণত এতো দেরী করে সে ঘুম থেকে উঠে না।আজ ছুটির দিন তাই।

স্রোত উঠে বসতেই তার পুরনো কিছু কথা মনে পড়লো।আগে ঘুম কাতুরে ছিলো স্রোত,যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ঘুমাতে পারতো।সকালে তাদের মা তাদের ২ বোনকে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে যেতেন।আর এই সূর্যের আলো?সে তো কতই পড়তো,স্রোত তখন মুখের উপর বালিশ দিয়ে দিতো নাহয় চাদর টেনে দিতো,তাও তার ঘুম ভাঙ্গতো না।আর এখন কত পরিবর্তন!! সময়ের সাথে সাথে মানুষের আচার-আচরণের পরিবর্তন হয়ে যায়।সময় যায়,মানুষ বদলায়,এটাই প্রকৃতির নিয়ম। স্রোত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে চলে যায়।আজকে আবার হসপিটালে যেতে হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বনলতা বেগম বয়স্ক মহিলা,তাই ঐদিন পড়ে যাওয়ায় হাতে একটু বেশি ব্যাথা পেয়েছেন তবে ইন্টারনাল ড্যামেজ বেশি হয়নি,এক-দেড় মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। মাথার চোটটা কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে যাবে।একটু পরে তাকে রিলিজ দেওয়া হবে।আজকে হাসপাতালে মেহরাদ,নোলক সাহেব আর উনার স্ত্রী এসেছেন।মাধবী বেগম সবকিছু গোছগাছ করছেন।উনি বনলতাকে অনেক সম্মান করেন।এতোবছরে কোনোদিন বনলতা উনার সাথে বন্ধু ব্যতীত অন্যভাবে কথা বলেননি।উনারা দুইজন মাঝে মাঝে ঘুরতেও যায়।আজকে বনলতার এই অবস্থা দেখে মাধবী বেগম নিজেই হতাশ।এর মধ্যেই দরজায় নক্ করে স্রোত।মেহরাদ কেবিনে নেই।সে গিয়েছে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে।

স্রোত এসেই সবার সাথে হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করলো।তিনদিনের পরিচয়ে ওরা কত আপন হয়ে উঠেছে।
“আন্টি কেমন আছেন এখন?”বনলতা বেগমের পাশে বসে স্রোত জিজ্ঞাসা করল।
” অনেক ভালো,এই হাসপাতালের গন্ধ আমার একটুও ভালো লাগে না।”
“আজকে তো বাড়ি চলে যাবেন।আমার কথা আপনার মনে থাকবে?” অনেকটা আবেগী হয়েই প্রশ্ন করলো স্রোত।ওর নিজেরও আজকে মন খারাপ উনার সাথে আর দেখা হবে না বলে।

“মনে থাকবে না কেনো? তোমাকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসবো,বুঝছো?তুমি আমার অনেক পছন্দের,মেয়ে।”হেসে বললেন বনলতা।
স্রোত ভাবলো বনলতা মাঝেমধ্যে দেখা করার কথা বলেছেন,এতে স্রোতও খুশী, মা মা গন্ধটা পাওয়া যাবে মাঝেমাঝে। স্রোতও আহ্লাদী হয়ে মজার স্বরে বললো,
” ওমা তাই?আমি আপনার এতো পছন্দের?তাহলে আমাকে আপনার ছেলের বউ করে নিন।আমরা একসাথে থাকবো।”

স্রোত শুনেছিলো বনলতার ছেলে মেজর।সে ভেবেছিলো ঐ লোকের বউ-বাচ্চা-সংসার আছে।তাই তো মজা করে বললো।স্রোতের এই কথা শোনে বনলতা যেনো হাতে চাঁদ পেলেন,উৎফুল্ল হয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই মেহরাদ “মা” বলে ডেকে কেবিনে প্রবেশ করে।বলা বাহুল্য, সে বাহির থেকে সবই শুনেছে।মা বেফাঁস কিছু বলে না ফেলে তাই তো উনাকে থামানো।

স্রোত ভাবছে এ তো কালকের সেই অভদ্র লোকটা,এ এখানে কি করছে?আর মা বলেই বা কেনো ডাকলো?তাহলে কি এটাই আন্টির সেই ছেলে?উনি কি আমার বলা কথা শুনে ফেললেন?শুনলেও কি সে তো বিবাহিত। বেঁচে গেলাম।স্রোতের ধ্যান ভাঙ্গে বনলতায় কথায়,
“স্রোত, এই যে আমার ছেলে মেহরাদ,যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”

“এই বদলোকটা আপনার ছেলে কি করে হয় আন্টি?” বিড়বিড়িয়ে কথাটা বললো স্রোত,অন্যকেউ না শুনলেও মেহরাদ পাশে থাকায় ঠিকই শুনে ফেলেছে।স্রোত দেখলো ঐ ধূসর বর্ণের চোখগুলো এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো এখনই তুলে আছাড় মা*রবে নাহয় ধাক্কা দিয়ে এই চারতলা থেকে ফেলে দিবে।স্রোতও কম নয়,সেও ভেবে ফেলেছে তাকে কিছু বলতে আসলে সেও কথা শুনিয়ে দিবে,কালকের মতো ছাড় দিবে না,এমনিতেই রাগ কিছুটা রয়ে গেছে।তবে আন্টির সামনে কোনো গন্ডগোল নয়।
মেহরাদ বললো,

“মা চলো,সব কাজ শেষ।মামা-মামি তোমরাও এসো এই কয়দিন এখানেই থাকবে।”
ওরা সবাই একসাথে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো।গাড়ির সামনে চলে আসলে স্রোত কিছু একটা ভেবে বলে,
“আন্টি আপনার কাছে একটা আবদার করবো?”
নোলক সাহেব আর উনার স্ত্রী ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠে গেছেন।বনলতা আর মেহরাদ স্রোতের কথা শুনে দাড়িয়ে পড়লো।বনলতা হেসে বললেন,

“অবশ্যই, জিজ্ঞাসা করার কি আছে?”
“আপনার শরীরে না মা মা গন্ধ আছে।আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?” আমতা আমতা করে করুণ স্বরে বললো স্রোত।

বনলতার যেনো মায়া হলো,সে “পা গ লী মেয়ে” বলে এগিয়ে গিয়ে একহাতে স্রোতকে জড়িয়ে ধরলো।স্রোত যেনো প্রশ্রয় পেলো,সেও ঝাপটে ধরলো।উপস্থিত সবাই যেনো নিরব দর্শক হয়ে অতি সুন্দর একটা দৃশ্য অবলোকন করছে,যেনো এমন সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে খুব কমই আছে।স্রোত কঠিন মনের মেয়ে হলেও মায়ের দিক দিয়ে সে নরম,ভঙ্গুর।সে তো আগে এতো কঠিন ছিলো না।মা চলে যাওয়ার পরই তো…

বনলতা বেগম স্রোতকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।যাওয়ার সময় বলে গেলেন,
“নিজের বলা কথা কিন্তু ভুলো না,স্রোত।খুব শীগ্রই আমাদের আবার দেখা হবে।”
স্রোত কথাটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।পরিচয় যখন হয়েছে আবার দেখা হওয়া স্বাভাবিক। তাই এতো মাথা না ঘামিয়ে সেও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

পরবর্তী দুইদিন স্রোতের অন্যসব স্বাভাবিক দিনের মতো গেলেও মেহরাদের যায়নি।ঐদিন বাড়িতে ফেরার পর মা তাকে স্রোতের ব্যাপারে সবই জানিয়েছেন। হাসপাতালে থাকতেই ভাইয়ের মাধ্যমে উনি স্রোতের খুটিনাটি সব জেনে নিয়েছেন,মেয়েটাকে তার বড্ড ভালো লাগে কিনা।মেহরাদের স্রোতকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে,শুধু ভালো না অনেক বেশিই ভালো।মেহরাদ স্ট্রিক্ট মানুষ,স্ট্রিক্টলি রুটিন মেনে চলে,কিন্তু গত দু’দিন সব উলটপালট হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে না কি করবে!তার কি সময় নেওয়া উচিত!নাকি মন যা বলছে তাই করা উচিত?মন-মস্তিস্কের যুদ্ধে সে বিরক্ত।আবার,মাও বলে দিয়েছে,” যেভাবেই হোক স্রোতকে এই বাড়িডে বউ হিসেবে দেখতে চায়”।মায়ের কথা আর মনের কথা মিলে যাওয়ায় সে মস্তিষ্ককে আর পাত্তা দিলো না।

বাতাসে আযানের সুর ভেসে আসছে।পৃথিবীতে সন্ধ্যা নেমেছে।সূর্যটা যেনো আধারের ভয়ে ঐ বড় বিল্ডিংগুলোর পিছনে লুকিয়ে পড়ছে।এমন সময় বাসায় ফিরলো স্রোত।কলিংবেল বাজাতেই মান্ধবী দরজা খুলে দিলো।মান্ধবী স্রোতকে ড্রয়িং রুমের দিকে ইশারা করে।ড্রয়িংরুমে তার বাবা,বনলতা বেগম আর নোলক সাহেব বসা।স্রোত বুঝে উঠতে পারলো না ওনারা এখানে কি করছেন।স্রোতকে দেখা মাত্রই বনলতা বেগম উঠে গিয়ে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে।স্রোতের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে বলেন ফ্রেশ হয়ে আসতে।স্রোত কিছু বুঝে উঠতে না পেরে রুমে চলে যায়,মান্ধবীও ওর পিছন পিছন চলে যায়।

“ওনারা কখন এসেছে রে?আর কেনোই বা এসেছে?আমাকে তো আন্টি কিছুই জানান নি।”স্রোত মান্ধবীকে প্রশ্ন করে।
” এক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে এসেছে যে। তোমার সাথে উনার ছেলের বিয়ের কথা বলতে এসেছে।তোমার সাথে কিভাবে পরিচয় সব বললেন।”
“উনি অবিবাহিত!”মনে মনে ধাক্কা খেলো স্রোত।

“বাবা জানিয়ে দিয়েছে তুমি রাজি থাকলেই এই বিয়ে হবে নাহয় না।তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো।”
“অসম্ভব,আমি বিয়ে করবো না,কোনোদিনও না।” বলে ড্রয়িংরুমে চলে যায় স্রোত।মান্ধবী বুঝতে পারে এখন ঝড় আসতে পারে।কিন্তু এমন কিছুই হয়নি,উল্টো স্রোত ঐখানে শান্ত হয়ে বসে ওদের পারিবারিক কথা শুনছিলো।স্রোততে দেখে বনলতা তার সাথে একা কথা বলতে অন্যরুমে চলে যায়।
“আন্টি আমি বিয়ে করতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করুন।”

“কেনো পারবে না?আমার ছেলে কি খারাপ নাকি আমি খারাপ?আমাকে না তুমি ঐদিন বললে তোমাকে ছেলের বউ করে আমার কাছে নিয়ে যেতে?এখন মানা করছো কেনো?”
“আমি মজা করে বলেছিলাম, আমি তো জানতামও না আপনার ছেলে অবিবাহিত।তাছাড়া সামনে আমার পরীক্ষা, আপনার অজানা নয়।আরো অনেক কারণ যা আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না।”
“এতো বোঝা লাগবে না।মেহরাদের ছুটি কয়েকদিনের।ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হবে,আমরা-আমরাই থাকবো।আমার বাড়িতে আমি আর রিনা ছাড়া কেউ থাকে না,তোমার পড়ার কোনো সমস্যা হবে না।”

“আন্টি আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“বিয়েটা তুমি করছো।আমি তোমাকে আমার আরেকটা মেয়ে বলে মেনে নিয়েছি।আর আমি আমার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাই।সময় নাও, তবুও না করো না, অনুরোধ।” বলে বসার ঘরে চলে যান বনলতা।
স্রোত যেনো দোটানায় পড়ে গেলো।কিভাবে সে তার ভেতরের ভয়টা সবাইকে বলবে?কেউ কি আদৌ বুঝবে?
মান্ধবী এসে জানায় উনারা চলে যাচ্ছেন।নিজেকে সামলিয়ে উনাদের বিদায় দিতে যায় স্রোত।যাওয়ার আগে বনলতা বেগম স্রোতের সাথে কোনো কথা বলে নি,স্রোত বুঝতে পারে উনার মন খারাপ।
স্রোত আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঐ তারাটাকে জিজ্ঞাসা করলো,

স্রোতস্বিনী পর্ব ৩

“মা, তুমি বলে দাও আমার কি করা উচিত?আজ তুমি পাশে থাকলে হয়তো আমাকে একটা সমাধান দিতে।কি করবো আমি?আমার কাছে তো সংসার মানেই একঝুড়ি অশান্তি।”

স্রোতস্বিনী পর্ব ৫