হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১০
Tahrim Muntahana
অপরাহ্নের শেষ ভাগ। সূর্যের তেজে ধরণী অতিষ্ঠ। চারদিক যেন পানির জন্য হাহাকার করছে। ব্যস্ত মানুষ জন হাঁসফাঁস করছে। তবুও যেন জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসৎ নেই। গতানুগতিক নিয়মেই চলছে গাড়ি। পুলিশের জিপ, ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আতিকুর। পাশেই বিরক্ত নিয়ে বসে আছে আরাফ। রোদের ঝিলিক চোখ মুখে বারি খাচ্ছে। আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে তাকে। আতিকুরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হয়েছে। যদিও বউয়ের সাথে অসভ্যতা করায় তার কোনো যায় আসে নি! আরাফ কিছুক্ষণ হলো কিছু বলার জন্য চেষ্টা করছে। তবে মনে হচ্ছে বেশ ভয় পাচ্ছে। ব্যাপারটা ধরতে পেরে আতিকুর নিজেই বললো,
~ কিছু বলবি?
আরাফ চমকালো, ইতস্তত করতে লাগলো। আতিকুর যেন এক ছুটে পুরো বিষয়টা বুঝে ফেললো। হাসলো সে, নিজের বউয়ের দিকে হাত বাড়ানোর অপরাধে তার করণীয় ছিল পাশের মানুষ টাকে হাজতে পাঠানো অথচ সে কি করছে? সে বিষয়ে তার রাগ দু আনাও নেই, তার তো রাগ লেগেছিল আরাফের কুদৃষ্টি আফরা’র উপরেও ছিল। ভাইয়ের প্রতি দরদ তার খুব একটা নেই, মূলত তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোড়ালো নয়, একেবারে নেই বললেই চলে। ছোট থেকেই যে যার মতো জীবন যাপন করনে তেমন কথাও হতো না। আস্তে আস্তে তিনজন ই বড় হলো, বাইরের চাকচিক্যে হারালো, মজা মাস্তি করেই দিন গুলো চলে গেল। যেখানে বাবা-মা’র প্রতিই তাদের কোনো দায় নেই, সেখানে ভাই ভাই য়ে মিল আশ্চর্য ছাড়া কিছু নয়! আতিকুর নিজের মধ্যেই কিছু কথা আওড়ালো। ধীরে সুস্থে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ আমি আগে থেকেই জানতাম বাবার মতোই জানো* য়ার হয়েছিস, যদিও আমি জানো* য়ারের থেকে কম নয়! তবে তোর আর আমার পার্থক্য কি জানিস? তুই লোলপ দৃষ্টি দেখিয়ে ফেলিস, আর আমি তা গোপনে ভোগ করি! মজা না?
আরাফ সহজ হলো। এই প্রথম মনে হচ্ছে তার থেকেও কোনো বড় খেলোয়াড়ের সাথে সে কথা বলছে। সাহস করে বললো,
~ তোর রাগ নেই ভাবীর সাথে অসভ্যতা করেছি যে!
~ কেন থাকবে? আমার রাগ আফরা’র দিকে নজর বলে! সাবধান করে দিচ্ছি, এই মেয়ে আমার শিকার!
কথাটা কেমন শোনালো। আরাফ আর সাহস করতে পারলো না কিছু বলার। এমনিতেও বাম হাত নেই, ধরতে গেলে সে অচল। এখন ভাই কে ক্ষেপানো মানে সকল রকম বিলাসিতা পরিহার করা। যা সে চাইছে না। তাকে এখন আতিকুর কে গুনেই চলতে হবে। পরে না হয় ঝোঁপ বুঝে কোপ দিবে!
কথাগুলো ভেবেই মুচকি হাসলো সে। আতিকুর এক নজর হাসির দিকে তাকিয়ে নিজেও হাসলো। দুজনের হাসি, সম্পূর্ণ আলাদা! কে জানে এই দু হাসি আবার কার সর্বনাশ ডেকে আনে!
~ তুমি আর এসো না আফরা, মিহির টিউশনের আর কোনো দরকার নেই!
মিহিকে পড়ানো শেষ। আফরা কিছুক্ষণ গল্প করছিল মেয়েটার সাথে। মিহিও কি সুন্দর হাসছে, হেসে ঢুলে পড়ছে আফরার উপর। এভাবে হাসাতে আফরার নিজেরও ভালো লাগছে। কি বিশুদ্ধ হাসি। কই থেকে মনিরা এসে কথাটি বললো, এতক্ষণের আনন্দঘন মুহূর্তই যেন ভাটা পড়লো। মিহি অবাক হয়ে মা কে দেখছে। মেয়ের দৃষ্টিতে মনিরা’র মুখে ব্যাথার ছাপ ফুটে উঠে, সবথেকে অসহায় মা মনে হয়। যে মা নিজের সংসার বাঁচাতে সন্তানের আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে। তবে শুধুই কি সংসার? সংসারের মায়া তো সে কবেই ছেড়েছে, একটা মেয়ের সম্মান যে সবার উপরে! মনিরার কথা শুনেও আফরার তেমন ভাবাবেগ হয় না। সে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। নিজ আসন থেকে উঠে বসে, মিহির গালে হাত রাখে আদুরে ভঙ্গিমায়। মুখে হাসি টেনে বললো,
~ ম্যাম তিনদিন পর আবার আসবে! নো টেনশন বেবি!
কথা বলা শেষ করেই আফরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আসার আগে মনিরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতেও ভুলে না। হাসিটাই কি ছিল মনিরা বুঝতে পারেনি, তবে তার মনের সকল দুশ্চিন্তা গুলো কেমন এক নিমিষেই চলে গেল। মনে হলো, যা হবে ভালো হবে। আর কোনো খারাপ হবে না! আফরা নিচে নামতেই আতিকুর আরাফ কে দেখতে পায়। দুজন বসে খোশ গল্পে মজেছে। এই প্রথম হয়তো এমন দিন আফরা দেখলো। বেশ অবাকও হয়েছে। আফরা কে নিচে নামতে দেখেই আতিকুর হেসে উঠে দাঁড়ালো। সরাসরিই বললো,
~ আফরা তুমি তো একা থাকছো, কালকে আমাদের এখানে চলে এসো। তোমার, মিহির দুজনের জন্যই ভালো।
আফরা একপলক করিডরে দাঁড়ানো মনিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
~ আমি একা থাকতেই ভালোবাসি স্যার। ধন্যবাদ!
~ আহা আফরা বুঝতে পারছো না! মিহিও তোমার সাথে থাকলে আনন্দে থাকে। তোমাকে আরো পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিবো না হয়!
~ আপনি মনে হয় আমার না বোধক ইঙ্গিত টা বুঝেন নি। পুলিশ অফিসার দের এমন বোকা মাথা নিয়ে থাকতে হয় না।
অপমান টা আতিকুর বুঝতে পারে। তবে তার তেমন রাগ হয় না। মেয়েটার ঝাঁঝ দেখেই তো তার শান্তি লাগে। মনে হয় অনেক দিন পর এমন মেয়ের দেখা পেল। নিজেকে চালাক প্রমাণ করতে বললো,
~ আমার মাথায় কত কি আছে ভাবতেও পারবে না, খুঁজতে যেও না নিজেই ফেঁসে যাবে।
~ ঘুষখোর পুলিশ অফিসার বলে কথা!
এবার জ্বলে উঠে আতিকুর। অপমানে থমথমে হয়ে যায় মুখশ্রী। কথায় আছে না, ‘করলে জাত যায় না, বললে জাত যায়’! আতিকুরের হয়েছে তেমন অবস্থা। সে ঘুষ খেতে পারবে, তবে কেউ বলতে পারবে না। আর যে বলবে তার খবর আছে! দাঁতে দাঁত চেপে আতিকুর বললো,
~ অতিরিক্ত কথা বলছো আফরা। তোমাকে এত সাহস কে দিলো?
হাসলো আফরা। তাচ্ছিল্যই বটে, হাসিটা দেখে হুট করেই আতিকুরের মনে হলো এই মেয়ে তাকে ইচ্ছাকৃত রাগাতে চায়ছে। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ম চোখে আফরা কে দেখে আতিকুর নিজেই হাসলো। মেয়েটার মাঝে রহস্য আছে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে, তার আগে মেয়েটা কে একবার বাগে পেয়ে নিক! আর দাঁড়ালো না আফরা, মনিরার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো। একপলক আরাফের বাম হাতের দিকে তাকিয়ে যেন চোখ জুড়ালো। কিছু বলার ইচ্ছে পোষণ হতেই বললো,
~ দু’ভাই সাবধানে থাকবেন। একজনের বাম হাত গেছে, আরেকজনের মাথাটাই যেন না যায়!
এক মুহূর্তও দেরী না করে বেরিয়ে যায় বিলাসবহুল বাড়ি থেকে। আফরা জানে, এবার তাকে নিয়ে দু’ভাইয়ের মধ্যে বিশদ আলোচনা চলবে, আতিকুর রেগে হয়তো আজকেই কিছু ঘটানোর চেষ্টা করবে, হয়তো মনিরার জন্য তার বলা কথাগুলো কাল হবে তবে সে তো চুপ থাকতে পারে না। তার যদি সাধ্য থাকতো জনসম্মুখে এই বাড়ির চার পুরুষের বাইরের মুখোশ টা টেনে খুলে, গলায় ছু* রি চালিয়ে দিতো! ছটফট করতে করতে নির্জীব হয়ে যেত, সে চোখ মেলে দেখতো! কি যে শান্তি পেত, বলার অপেক্ষা রাখে না! আপন ভাবনায় ব্যস্ত আফরা হাঁটতে হাঁটতে কখন অর্ধেক রাস্তা পার করে ফেলেছে টের ই পায় নি! হুট করেই সামনে কারো বাইক থামতেই হুড়মুড় করে থেমে যায় আফরা। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই মিরার হাসি মুখ চোখে পড়ে। তাকে ভয় পেতে দেখে মেয়েটা আনন্দ পেয়েছে। আফরা কিছু না বলেই বাইকের পেছনে চড়ে বসলো, শব্দ করে কাঁধে হাত রাখতেই খেঁকিয়ে উঠে মিরা,
~ হাতির বাচ্চা, তুই আদও মেয়ে তো? কি শক্ত!
~ ভয় দেখানোর সময় মনে ছিল না? বাইক ছুটা পেঁচাল না পেরে। মাথা কিন্তু এমনিই গরম।
~ আবার কি হলো? কে গরম সিসা ঢেলেছে মাথায়!
~ ঘুষখোর চরিত্রহীন অফিসারের নজর পড়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে কিছু তো ঘটাবেই আতিকুর। ওর প্রাণ টাই আমি এবার নিয়ে নিবো দেখিস!
মিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আফরার দিকে। কেমন যেন ধ্বংসের আঁচ পায়, কেঁপে উঠে সে। আফরা টের পায় সেই কাঁপন, এতক্ষণের রাগ পালিয়ে গিয়ে আফরার মাঝে দুষ্টুমির ছোঁয়া দিয়ে যায়। হেসে উঠে সে, মিরা আর কিছু না বলেই বাইক ছুটায়। মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঁকি মারছে, তবে আফরা কে বলা নিষেধ! এই মেয়ে কে বলে লাভ ও নেই। বলার সময় বেশ বলে, তবে করতে গেলেই যেন কাঁপা কাঁপি। যা করার তাকেই করতে হবে। সব হারিয়ে যখন সে নিঃস্ব তখন এই মেয়েটা তাকে সঙ্গ দিয়েছিল, মনের মধ্যে বাঁচার আকুতি দিয়েছিল, তাকে বর্তমানে নিয়ে আসতে একপ্রকার যুদ্ধই করেছে! কি করে সে এই মেয়েকে কারো খারাপ পরিকল্পনার গুটি হতে দিবে? আজ তো একটা বিহিত করেই ছাড়বে। আতিকুর আরাফ নামক চ্যাপ্টার একদম ক্লোজ করে দিবে তাদের জীবন থেকে।
~ আদিলের অফিসের সামনে নামিয়ে দিবি।কতদিন দেখি না মনে হয়!
হেসে উঠলো মিরা। একদম হা হা করে, বাইকের শব্দের সাথে হাসিটাও কেমন ঝংকার তুললো। আফরা কিছুক্ষণ হাসির শব্দ টা শ্রবণ করে নিজেও হাসলো। এই হাসির অর্থ তার জানা! বাইক থেমে যেতেই নেমে পড়ে আফরা। যদিও মিরা চেয়েছিল আফরার সাথে যাবে তবে আফরা কোনো ভাবেই মিরা কে নিয়ে যাবে না। একপ্রকার রাগ করেই মিরা চলে গেছে।
বিকেলের শুরু। আফরা ধীরেই পা চালায়। এর আগে অফিসের গ্রাউন্ড টা দেখা হয় নি। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। সূর্যের তীক্ষ্মতাও তাকে কাবু করতে পারে না। বৈশাখ শুধু তোপে পোড়ায় না, গরমের এই সময় চোখ জুড়ানো সুন্দর কিছু দৃশ্য চোখে ভাসে, যদি দেখার মতো চোখ থাকে! গ্রীষ্মের ফুল বলতেই হিমঁচাপা, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, জিনিয়া, গুলাচ আর নাগবল্লী। আফরা চোখ মেলে জারুল, জিনিয়া, নাগবল্লী ফুল দেখে। হুট করেই মনের সকল দুশ্চিন্তা ভুলে ছোট বেলায় ফিরে যায় আফরা। দৌড়ে এগিয়ে যায় সারিবদ্ধ ফুল গাছের দিকে। দেশী নয়, বিদেশি ফুলের জাত। আফরা চিনতে পারে না ফুল গুলো। তবে অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করে, হাত বাড়িয়ে তিনটে ফুল ছিড়ে সাথে সাথেই কানে গুঁজে দেয়। আফরার মতে মন যা বলে তাই শুনতে হয়।
কে কি বললো, কে কি ভাবলো; সেসব দেখে কি হবে? নিজের মন শান্তি তো দুনিয়ার সব সুন্দর! পবিত্রতার রূপ ফুলের সাথে যেন আরেক ফুলের সন্ধি হয়ে যায়। নয়নতারা, পুর্তলিকা, রঙ্গন, রাধাচূড়া আরো অনেক প্রজাতির বারো মাসিক ফুল চোখে পড়ে আফরা’র। হুট করেই আফরা’র মনে হয় যার অফিসে এত সুন্দর ফুলের বিচরণ সে কি করে এতটা নির্দয় হতে পারে! আবার ভাবে সে তো রীতিমতো ফুলের সাথে সন্ধি করেও নিয়েছে, তাই বলে কি সে নির্দয় নয়? চোখ বুজে শ্বাস নেয় আফরা। বর্তমানে এসব সে ভাবতে চায় না, দমবন্ধকর পরিস্থিতি তে আর কত?
ফুলের নান্দনিকতায় আবার চোখ জুড়ায় আফরা। সূর্যের তাপকে যেন কাবু করে দিল, সাথে এনে দিল প্রচণ্ড রকম প্রশান্তি।
আফরা আরো কিছুক্ষণ থেকে অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। উপর থেকে রহস্যময়ীর আরেকটা রূপ দেখে বাকরুদ্ধ আদিল। অনেকদিন পর বদ্ধ রুমের জানালা খুলে সূর্যের তেজী রূপ দেখছিল সে। আফরা কে গেইটে দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকিয়ে ছিল। কোনো রকম ভালোলাগা, আকর্ষণ নয়, জাস্ট কৌতুহল। কৌতূহল ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এই মেয়ে নিজেকে এমন ভাবেই প্রকাশ করেছে যে কৌতুহল না চাইতেও এসে যায়। তবে আজ আবার এই মেয়ের আগমনের কারণ খুঁজে পেল না, ভয় ডর নেই নাকি? নিজ আসনে বসে, আগে থেকেই লক করা দরজা টা খুলে রাখলো। স্বাগতম জানানো যাক!
আজও কোনো রকম বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়নি আফরা’র। সরাসরি আদিলের কেবিনের দিকে চলে এসেছে। না কেউ না করেছে, না কেউ কোনো রকম প্রশ্ন করেছে। কেবিনের দরজা আগে থেকেই খোলা দেখে আফরা আর নক করে না, বরং ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। আফরা’র উপস্থিতি টের পেয়ে আদিল বিতৃষ্ণা কন্ঠে বললো,
~ ভদ্রতা আজও শিখেন নি মিস আফরা। অনুমতি নিতে হয়, জানেন নিশ্চয়?
~ অভদ্রের কাছে এসে ভদ্রতা জাহির করা মানে উলু বনে মুক্তো ছড়ানো!
কথাটা বলেই আদিলের সামনের বরাবর চেয়ার টেনে বসে পড়ে আফরা। এমন উত্তর ই হয়তো আদিল আশা করেছিল, তাই তো তার মুখে হাসি দেখা যায়। কানে গুঁজা ফুল গুলোর উপর হাত ছুঁয়ে আফরা আদিল কে উদ্দেশ্য করে আবার বললো,
~ দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে?
আদিল তাকালো না পর্যন্ত! আফরা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করলো, তবে না পেয়ে তার মধ্যে কোনো রকম অপমান, ইতস্তত, অস্বস্তি বোধের দেখা মিললো না। বরং হাসি চওড়া করে আদিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
~ আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি মি. আদিল।
~ আমার আপনাকে দেখা ছাড়াও অনেক কাজ পড়ে আছে। সো প্লিজ!
~ এই মুহূর্তে আর কোনো কাজ নেই, আমাকে দেখুন!
এবার আদিল তাকালো। এই মেয়ে নাছোড়বান্দা। একপলক তাকিয়ে নজর ঘুরিয়ে বললো,
~ কানে গুঁজা ফুলটা সুন্দর, আপনি নয়!
~ ফুল টা সুন্দর কারণ সে যার শরীরে স্থান পেয়েছে সে সুন্দর! বলে না, ফুল হাতে না গাছে সুভা পায়! আমার মতে কি জানেন, ফুল গাছের পর নারীর খোঁপায় সুভা পায়। তা দেখে যদি পুরুষ মুগ্ধ হয়, প্রশংসা করে, পবিত্র ফুল টাও তখন নারীর সৌন্দর্য টাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
কথাটা বলে আফরা মুচকি হাসে, আদিল অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের মেয়েটির দিকে। আজ এমন শান্ত কেন? কি সুন্দর কথা বলছে! চোখ ঘুরায় আদিল। প্রসঙ্গ টেনে বলে উঠে,
~ বিনা অনুমতিতে ফুল ছিঁড়ে কানে তো গুঁজেছেন। তবে ফুলের নাম জানেন?
~ আমার কাছে নাম নয়, সৌন্দর্য টাই বড় হয়েছে! এই যেমন ধরেন, আপনার তো অনেক নামডাক, আগে তো আসিনি। যখনই আপনার এটিটিউট আমার মনে ধরেছে তখনই তো ঘায়েল হলাম!
~ আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বখাটেদের দেখে প্লে গার্ল মেয়েরা যেমন পাল্টা ফ্লার্ট করে তার থেকেও লেইম ফ্লার্ট করছেন?
~ বাংলাদেশে আর কিছু আছে কি না আছে, বাঙালিদের এই এক রুখা আবেগ ঠিকই আছে। মেয়েদের ভালো ছেলে রেখে বখাটে, সিগারেট খোর দেরই পছন্দ হয়; ছ্যাকা খেয়ে দোষ দেয় পুরো পুরুষ জাতির। আবার পুরুষ মানুষের পছন্দ হয় প্লে গার্ল টাইপ মেয়েদের, একদম জান প্রাণ লাগিয়ে ভালোবাসে তারা; ছ্যাকা খেয়ে গান্জাখোর হয়ে দোষ দেয় পুরো মেয়েজাতির। অথচ আনাচে কানাচে এমন অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যারা সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য ছটফট করে!
আদিল হাসলো। মেয়েটা আজ প্ল্যান করে এসেছে। তাকে পটাতে চাইছে। তবে মেয়েটা হয়তো বুঝতে পারছে না, তার এসব কথায় কোনো প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। আফরা আবার বললো,
~ এই যে আমি সত্যি কারের ভালোবাসার কথা জানান দিচ্ছি, আপনার পছন্দ হচ্ছে না।
আদিল প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে। নাছোড়বান্দা আফরা যেন আজ পণ করেই এসেছে। এমতাবস্থায় আদিল কিছুটা চেঁচিয়েই বলে উঠে,
~ আপনি বেশি কথা বলছেন। এবার আসতে পারেন!
~ আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না। যাই হোক বলুন তো এটা কি ফুল?
আফরা চাইছে সন্ধ্যা পর্যন্ত আদিলের সাথে থাকার। এমনি এমনি তো আসেনি! বিশদ এক উদ্দেশ্য নিয়েই ঢুকেছে অফিসে। অপরদিকে আদিল ঘড়ি দেখছে বারবার। মেয়েটার উদ্দেশ্য না জানা পর্যন্ত সে কিছুই করতে পারবে না। জানাটা জরুরি। তাই আফরার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
~ যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে এই ফুল ‘লিসিয়েন্থাস’ নামে পরিচিত। সৌরভহীন হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এটি কোনো অংশেই গোলাপের চেয়ে কম নয়। ফুলের সৌরভে পোকামাকড়সহ রোগজীবাণু বিস্তারের ঝুঁকি থাকে। এবং কি ফুলদানিতে ফুলের স্থায়িত্ব কত দিন সেটিও পুষ্পপ্রেমীদের কাছে জরুরি, এক্ষেত্রে এ ফুলের স্থায়িত্ব অন্যান্য ফুলের থেকে দীর্ঘ। এই ফুলের বীজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তবে লিসিয়েন্থাস ফুল চাষের এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। একেবারে দেশি আবহাওয়ায়, দীর্ঘ শ্রম ব্যয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে পরিমিত আলো, তাপ ও পানি সরবরাহ করে সম্প্রতি সম্ভব হয়েছে লিসিয়েন্থাস ফুলের চাষ। বাংলাদেশে এই ফুলটাকে গোলাপ ফুলের উন্নত জাত হিসেবেই পরিচিতি ঘটিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নায়িকা ‘নন্দিনী’ নামে নামকরণ করা নান্দনিক ফুলটি এখন আপনার কানে সুভা পাচ্ছে মিস আফরা ইবনাত! আশা করছি সব তথ্য আপনার জানা হয়েছে। আর কোনো প্রশ্ন আশা করছি না!
খানিক মুহূর্ত আফরা আদিলের দিকে তাকিয়ে কানে গুঁজা ফুলটা হাতে তুলে নেয়। শান্ত দৃষ্টি ফেলে একটা একটা করে পাপড়ি গুলো ছিঁড়ে ফেলে। চোখে যেন অসম্ভব রাগ প্রকাশ পায়। আদিল ভ্রু কুঁচকে আফরা’র কান্ড দেখে। প্রিয় ফুলটাকে এমন ধুমডে মুচড়ে যেতে দেখেও তার খারাপ লাগে না। বরং আরেকটা কৌতুহল তাকে ঘিরে ধরে। মেয়েটার কি গোলাপ পছন্দ না? এর মধ্যেই গম্ভীর কন্ঠে আফরা বলে উঠলো,
~ আই হেইট দিস ফ্লাওয়ার!
~ বাট আই লাভ দিস ফ্লাওয়ার মিস আফরা! আপনার সাহস কি করে হলো আমার সামনে বসে আমার বাগানের আমার পছন্দের ফুল ছিঁড়ে ফেলার?
রাগ নিভে যায় আফরা’র। এই যে সামনের মানুষ টা হাইপার হচ্ছে, তার শান্তি লাগছে, আনন্দ লাগছে;
~ আপনার কষ্ট হচ্ছে মি. আদিল? তবে আমার কেন শান্তি লাগছে? আচ্ছা আমার একটা নাম দিন তো, আপনার পছন্দের ফুলের নাম!
আদিলের দৃষ্টি শান্ত। সে কখন হাইপার হলো? তার কষ্ট হয়? সে তো টের পায় না। আফরা কে ভুল প্রমাণ করতে বলে উঠে,
~ কষ্ট? আদিল মাহমুদের সাথে এটি যায়? আদিল মাহমুদ নামটাতেই ভয়; কষ্টও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়!
~ সাদা প্যাকেটের রহস্য কি মি. আদিল মাহমুদ?
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৯
কোথায় সেই ভাবালেশ মুখশ্রী? আদিলের চোখে মুখে ভয় দেখতে পাচ্ছে আফরা। উঠে দাঁড়ায় সে, তার সময় হয়ে এসেছে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। আদিল থম মেরেই বসে রয়। মেয়েটাকে সুযোগ দিয়ে সে কি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে? উদ্দেশ্য জেনে কি হবে? মানুষ টাই যদি না থাকে, তাহলে তার উদ্দেশ্য কি করে আদিল মাহমুদের জীবন পরিবর্তন ঘটাবে? শব্দ করে হাসতে থাকে আদিল, এই হাসির কারণ কারো শেষ নিঃশ্বাস, কারো ছটফটানি, কারো রক্ত! চোখ জুড়ানোর মতো মুহুর্ত!