হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১২
Tahrim Muntahana
ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে আফরা। অন্ধকার প্রকৃতির মায়ার সে কবেই পড়েছে। আজ খুব করে ইচ্ছে করছিল অন্ধকারে মিশে যেতে। অন্ধকারে প্রাণ ভরে শ্বাস নিবে সে। গভীর রাতের ঝড়ো হাওয়ার কার্বন ডাই অক্সাইড মিশিয়ে দিবে! বিষাক্ত গ্যাস গুলো উড়িয়ে দিবে বিষাক্ত মানুষ গুলোর দিকে। তখন কি বিষে বিষে বিষক্ষয় হবে? যন্ত্রণায় ছটফট করবে মানুষগুলো? সে প্রাণ ভরে দেখতো!
বোন কে দেখার স্বাদ জেগেছিল। তাই কোনো রকম সময় ব্যয় না করেই আফরা ছুটে গিয়েছিল গ্রামটাই। কখন রাত বেড়ে গভীর রাত হয়ে গেছে টেরই পায়নি। কত কথা জমা ছিল মনে। আঁখি মেয়েটা এতবার থাকতে বললো, আফরা’র মন সায় দিল না। তার মন পুড়ছিল অন্ধকারে হাঁটার জন্য। তবে অন্ধকার যে রহস্যের নীড়। ঠিক নিজের হিংস্রতা মেপে জখম করেছে তাকে। রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরোই পা লেগে পড়েগিয়েছিল ধুলোবালি মেশানো রাস্তায়। ছিলেও গেছে হাত, পা। জ্বলছে, তবে কষ্ট তার চোখ মুখে নেই। বরং পড়ে গিয়ে হেসেছিল সে, অন্ধকারের হিংস্রতাকে যোগ্য জবাব দিয়ে অনেকটা সময় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল রাস্তায়। আফরা’র কাজে অন্ধকারও মনে হয় লজ্জা পেয়ে হার মেনে নিয়েছে। আর কোনো বাঁধায় তো পড়তে হয়নি। দিব্বি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে।
দূর থেকে আলোর ঝিলিক আসছে। আফরা চোখ মুখ কুঁচকে নিলো এবার। অন্ধকার আবার তার সাথে বেইমানি করলো। আলো টা আস্তে আস্তে নিকটবর্তী হতেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। শব্দ করে বাইক এসে থামলো তার সামনে, ঝটপট নেমে পড়লো কেউ। আফরা মনে হয় একটু হলেও টের পেল কে হতে পারে। বিরক্তি কন্ঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ আমার ভালো থাকা সহ্য হয় না তোদের?
কথাটা বলাও শেষ আফরার গালে থাপ্পড় পড়তেও দেরী হয়নি। ভীষণ ভাবে চমকায় আফরা, তবে অন্যান্যদের মতো সামান্য চড়ে তার গালে হাত চলে যায়নি। বরং অদ্ভুত দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে দেখছে। রাগে ফুঁসছে মিরা, শরীর কাঁপছে তার, চোখ গুলো অসম্ভব লাল। আফরা এক ছুটে বুঝে নিলো মেয়েটা তার জন্য টেনশনে কেঁদেছে, একটু নয় অনেকটা সময় কেঁদেছে। তার জন্য কেউ কেঁদেছে ভাবতেও যেন শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কি কারো এত আপন হওয়ার মানুষ? মিরা নিজেকে স্বাভাবিক করলো ঠিকই তবে রাগ কমার বদলে বাড়লো যেন। চিৎকার করে বললো,
~ তোর কোনো ধারণা আছে আমার কত টেনশন হচ্ছিলো।
রাতের অন্ধকারে শব্দটা কেমন ভয়ংকর শুনালো, মনে হলো এই চিৎকার গ্রামের পথ পেরিয়ে শহরে চলে যাবে। আর সবাই টের পেয়ে যাবে আফরা’র একটা ছোট বোন আছে, যাকে দেখতেই সে রাত বিরাতে ছুটে গিয়েছিল, জখম হয়েছে। তখন কি শত্রুরা ঝাঁপিয়ে পড়বে? তার আধমরা বোনটাকে একেবারেই মেরে ফেলবে? বড়সড় ঢোক গিলে আফরা, তবুও গলা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, কথা বলা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। আফরা অবুঝের মতো এগিয়ে গিয়ে মিরার মুখ চেপে ধরে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
~ আস্তে, আস্তে! শুনতে পাবে ওরা, মেরে ফেলবে আমার বোন টাকে। বাঁচতে দিবে না। আমার শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নিবে। আস্তে কথা বল। একদম চুপিচুপি, ফিসফিস করে। আমি ছাড়া কাকপক্ষীও যেন টের না পায় এখানে কেউ আছে, অন্ধকারে মিশে ব্যক্ত করছে মনের কথা।
মিরা নিভে যায়, রাগ টা ঘায়েব হয়ে চোখ মুখে ব্যাথা ফুটে উঠে। দু হাত মেলে আগলে নেয় আফরা কে। আজ এত কান্না পাচ্ছে কেন? হারানোর মুহূর্ত গুলোই বা কেন চোখে ভাসছে? কেনই বা মনে হচ্ছে বর্তমান সুন্দর হলেও একটু পরের সেই বর্তমান কে অতিত করে পেরিয়ে যাওয়া ভবিষ্যত তাদের জন্য সুখকর হবে না। চোখের জল গুলো অনায়েসেই গাল বেয়ে পড়তে থাকে। আফরা’র শরীর মৃদু কাঁপছে। চোখে পানি নেয়, তার কান্না পাচ্ছে, খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে দিতে ইচ্ছে করছে মেয়েটির সামনে। তবে সে পারছে না। জলহীন কান্না কে তো মানুষ মিছেমিছেই লোক দেখানো কান্না বলে, তাকে আগলে রাখা মেয়েটাও কি তার আর্তনাদ কে মিছে মিছে বলবে? আফরা মিরার বুক থেকে সরে আসে। কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে দুজনই। কয়েক মুহূর্ত চলে যায় নিরবতায়। হুট করে মিরা পা ভাজ করে রাস্তায় বসে পড়ে। আফরাও খানিক পর মিরার পাশে বসে। নিরবতার সমীকরণ মেপে মিরা বলে উঠে,
~ আমাকে জানালে তোকে বাঁধা দিতাম?
~ খেয়াল ছিল না একদম।
~ কতবার ফোন দিয়েছি? ধরার প্রয়োজন মনে করিস নি। কেন?
~ ফোন দিয়েছিলি বুঝি? ইশ ফোন তো সাইলেন্ট, দেখি নি।
আফরা’র হেঁয়ালি তে রেগে গেল মিরা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ আমার সাথে হেঁয়ালি করবি না আফরা।
আফরা মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে মিরার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
~ বাড়ি চল!
মিরা চাপা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আফরা’র হাত ধরলো না। মিরার আচরণে আফরা কিটকিটিয়ে হাসলো। আর কোনো কথায় হলো না, শুধু হাঁটার শব্দ টাই অন্ধকারে বারবার বারি খেল। নাদিয়া কেও মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে মিরা। বাইকে চেপে বসতেই শব্দ করে ছুটতে শুরু করলো বাইক। আফরা’র কাছে তা শব্দ দূষণ নয় ধর্ষণ ছাড়া কিছুই নয়! অন্ধকার কি কষ্ট পাচ্ছে না?
~ বাড়ি ফিরবে কবে?
মিরার মেসেজ পেয়েই খোঁজ থামিয়ে দেয় নাদিয়া। লোকটি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলো তাকে। হঠাৎ নাদিয়ার কথায় হেসে উঠলো সে। বাড়ি? তার কোনো নিজস্ব বাড়ি আছে নাকি? হেঁয়ালি করে বললো,
~ কার বাড়ি? তোমার? বিয়ে করে ঘর জামাই রেখে দিবে নাকি?
কথাটা শোনা মাত্রই নাদিয়া দুম করে কিল বসালো লোকটির পিঠে। রেগে বললো,
~ বলেছি না? আমার সামনে নিজেকে এমন করে তুলে ধরবে না?
~ নরম হাতের স্পর্শ! খারাপ না।
তার কথার বিপরীতে এমন কথা নাদিয়া মুটেও আশা করেনি। লোকটি দিন দিন আরো বেশি অচেনা হয়ে যাচ্ছে। এমন অচেনা হলে সে বুঝবে কি করে? রেগে নিজের মতোই ফুঁসতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর লোকটি নিজে থেকেই বললো,
~ ক্রমশ শিঘ্রই!
রাগে আর নাদিয়া কথায় বললো না, এতে লোকটি অপমানিত হলো না, বরং তার হাসিটা কেমন বাড়ছিল। আহমেদ বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাইক থামতেই নাদিয়া নেমে পড়লো। কিছুক্ষণ মাস্ক পরিহিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ঘুরে হাঁটতে লাগলো। এমন সময় টের পেল লোকটি চাঁপা সুরে বলছে,
~ আমার উপরে যাওয়ার চেষ্টা করো না নাদিয়া। তুমি নিজেও জানো না আমার হাত কত লম্বা। খেলাটা আমি আস্তে আস্তে এগোচ্ছি বলে ভেবো না আমি এখন অপারগ! আফরা কেন, কেউ আমার খেলায় মুখ্য গুটি নয়। মন চাইলেই আমি খেলা থেকে তুমি, আফরা নামক গুটি সরিয়ে ফেলতে পারি। পুরো খেলাটার একছত্র নির্মাতা আমি! আমাকে টেক্কা দেওয়া মানে জীবনের মায়া ত্যাগ করা। সাবধান!
বাইক ছুটার শব্দ। কথাগুলোর সারমর্ম মস্তিষ্কে ডোরবেল বাজাতেই নাদিয়া রেগে মাটিতে লাথি বসালো। কিছুটা চেঁচিয়েই বললো,
~ তুমি খেলা নির্মাতা হলেও জানো না খেলা কখনো একজনে হয় না, বিপক্ষ দল ছাড়া যেমন খেলা অনুষ্ঠিত হয় না, তেমনি দলের খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন অনুপস্থিত থাকলে খেলা শুরু হতে পারে না। নাদিয়া আহমেদ কে চুনোপুঁটি ভেবে তুমি যে ভুল করলে এর দাম তোমাকে দিতে হবে! ক্রমশ শিঘ্রই!
ধপাধপ পা ফেলে গেইট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। মদের ছ গ্লাস ফুলফিল হয়নি বলেই মনে হয় রাগ লাগছে এত। তাকে এত রাগলে চলবে নাকি? মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে খেলা চালিয়ে যেতে হবে! ঘরে ঢুকে সোফায় বসেই মদের গ্লাস হাতে নেয়, চম্বুকের মতো টানছে যেন! ঠোঁটের কাছে নিয়ে যখনই চুমুক দিবে ঠিক তখনই নিস্তব্ধ ঘরের মাধুর্যতা নষ্ট করে বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠে। এবার সকল রাগ যেন মদের গ্লাস টার উপর পড়ে। রেগে ছুড়ে মারতে গিয়েও ফিরে আসে সে। তাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে সবচেয়ে বেশি সে কাকে ভালোবাসে! নিঃসন্দেহে কোনো রকম সময় ব্যয় না করেই সে এলকোহলের নাম বলে দিবে! এলকোহল ছাড়া সে নিঃস্ব। মদের গ্লাস টা সুন্দর ভাবে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে। ভাইয়া নামটা জ্বলজ্বল করছে স্কিনে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আবার কি হলো? সে তো এত রাতে এমন টা আশা করেনি। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
~ আধাঘণ্টার মধ্যে আমার বাংলোতে দেখতে চাই তোমাকে। ফাস্ট!
হ্যাঁ না বা কোনো রকম প্রশ্ন করার সুযোগ হয়ে উঠেনা নাদিয়ার। তার আগেই আদিল ফোন কেটে দেয়। বিরক্তি রাগে চোখ বুজে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় নাদিয়া। তাকে যেতেই হবে, এই রাতের বেলাতেও তাকে যেতে হবে। নাহলে কাল সকাল হয়তো তার জন্য সুখকর হবে না, যদিও কোনো মুহূর্তই তার সুখকর নয়! মদের গ্লাসের দিকে তাকায় নাদিয়া, পা চালিয়ে গ্লাস টা হাতে তুলে নিয়েই পেটে চালান করে দেয় সে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে, এবার শান্তি লাগছে। সব রাগ যেন হাওয়া। গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। আজ একটু অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে। বিশ মিনিটেই যেতে পারতো সে, তবে যাবে না। আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেলেই সে যাবে। সে কি হুকুমের গোলাম নাকি? ভাই কেও তো বুঝতে হবে, তারা একই রক্ত, জেদ তো একই রকম হবে!
আধা ঘন্টা পেরিয়ে গিয়ে আরো পাঁচ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর নাদিয়া এলো আদিলের বাংলোতে। সদর দরজা আগে থেকেই খোলা। হেলেদুলে ভেতরে ঢুকেই ভাই কে পাইচারি করতে দেখলো সে। চিন্তিত নাকি বুঝা গেল না, তবে গম্ভীর। নাদিয়ার উপস্থিতি টের পেতেই আদিল গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ পাঁচ মিনিট লেট!
ভয় লাগলেও নাদিয়া নির্বিকার চিত্তে বললো,
~ ঘড়ি আছে আমার হাতে!
~ বেশ কথা বলছো না? ভয় করে না আর?
~ পাঁচ মিনিট লেটের জন্য তুমি যদি আমাকে শাস্তি দিতে পারো, আমার ভয় না পাওয়া অস্বাভাবিক কি? আফটার অল একই রক্ত!
আদিল হাসলো, কিছুক্ষণ নাদিয়ার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিটা চওড়া করলো। নাদিয়া এবার ভয়ে একদম সেঁটিয়ে গেল। এই হাসি তার অপরিচিত নয়! আদিল একটু একটু করে নাদিয়ার সামনে এসে নাদিয়ার গালে ডান হাত রাখলো। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবলো। আবার হুট করেই গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
~ আমার সামনে বড় বড় কথা বলো না, রক্তের গরম আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। বিশ্বাস করো তোমার জীবন নিতে আমার একটুও কষ্ট হবে না!
নাদিয়া ব্যাথায় চোখ ছোট করলেও ছাড়ানোর কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। আদিলের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। এই যে সামনের মানুষ টা তাকে ব্যাথা দিচ্ছে অথচ তার চোখ মুখেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি দেখতে পাচ্ছে। সেটা আনন্দ নাকি ব্যাথা সে টের পেল না। তবে নরম সুরে বললো,
~ আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি নিজেকে যেভাবে দেখাচ্ছ, সেরকম তুমি নও!
গাল ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো আদিল। হেসে বললো,
~ আমি এর থেকেও হিংস্র। আমার হিংস্রতার সীমা দেখলে তোমার বাঁচার আশা মরে যাবে। নিজেকে পন্ডিত ভেবে ভুল করো না। যে কাজে ডেকেছিলাম, ফলো মি!
হাঁটতে শুরু করে আদিল। নাদিয়াও পিছু নেয়। এখন খুব কৌতুহল হচ্ছে তার। কি এমন দরকার পড়লো এই রাতে? আদিল কে একটা ঘরে ঢুকতে দেখে নিজেও ঢুকে পড়ে। কিন্তু সে হয়তো এরকম কিছু দেখবে চিন্তাও করে নি। বাকরুদ্ধ হয়ে চোখ বড় বড় করে বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে। তার শুধু মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে, তার ভাই আর যাই হোক এই দিক থেকে চরিত্রহীন নয়। তবে সে যে নিজের চোখে দেখছে, মেয়েটার শরীরে থাকা শাড়িটা এলোমেলো, পেটের অনেকাংশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। নাদিয়া একপলক ভাইকে দেখে দু’পা পিছিয়ে গেল। চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ আমি ভুল দেখছি, আমি ভুল। তুমি এরকম কিছুতেই করতে পারো না। শেষমেষ বাবার ট্রেপে পড়েই গেলে? তোমরা পুরুষ মানুষ সব চরিত্রহীন। নারী দেহ ছাড়া তোমাদের চলে না। আমি তোমাকে এতকিছুর পরেও ভালোবাসতাম ভাইয়া। কিন্তু তুমিও প্রমাণ করে দিলে রক্ত কখনো বেইমানি করে না, বাবার মতোই চরিত্রহীন হলে তুমি। আই হেইট ইউ ভাইয়া, আই হেইট ইউ!
একনাগাড়ে ভুলভাল বকে চলছে নাদিয়া। তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই কল্পনার বাইরে। নাদিয়ার কথাগুলো এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিল আদিল। তাকে দেখে তো তাই মনে হলো! নাদিয়া যখন থেমে গেল তখন ভাবালেশ কন্ঠে বললো,
~ ভাষণ শেষ তোমার? এখন আমি কিছু বলি?
নাদিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। আদিল তার দিকে না তাকিয়েই বললো,
~ এই মেয়ের জ্ঞান ফিরলে জেরা করবে! অল ডিটেলস আমার চাই। ওকে?
হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নাদিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মানে সে যা ভাবছে তা নয়! হা করে শ্বাস ফেললো নাদিয়া, বুকের উপর থেকে যেন হাজার মণ বোঝা নেমে গেল। সত্যি এটাই যে এই মানুষ টাকে এতকিছুর পরেও সে ভালোবাসে। হয়তো ছোটবেলায় হাত ধরে হাঁটতে শিখেছিল বলেই এমন মায়া। বিছানায় বসে মেয়েটির এলোমেলো শাড়ি ঠিক করে দিল নাদিয়া। তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হিসেব কষতে লাগলো। আনুমানিক ১৪-১৫ বছর হবে এই মেয়ের।
এত ছোট মেয়েকে বউদের মতো শাড়ি পড়ে থাকতে দেখে নাদিয়া’র মনে হলো এখানেও রহস্য আছে। এখন যে যুগ গ্রামের মেয়েরাও শহুরে আধুনিকতায় সজ্জিত! মেয়েটা হালকা নড়েচড়ে উঠতেই নাদিয়া নিজের ভাবনা থেকে বের হলো, মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে রাখলো। মেয়েটা যখন পুরোপুরি নিজের খেয়ালে আসলো কেমন যেন আঁতকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠে। নাদিয়া একটুও বিচলিত হলো না, সবটাই নিবিড় চোখে পর্যবেক্ষণ করে হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটার হাতে হাত রেখে বললো,
~ রিলেক্স, তোমার কিছুই হয় নি। শান্ত হও। তুমি সেইফ আছো।
মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে নাদিয়ার দিকে তাকালো। আস্তে আস্তে শান্ত হলো। নাদিয়া আরো কিছুক্ষণ সময় দিল মেয়েটা কে। তারপর বললো,
~ তোমার পরিচয়?
~ আমারে নাম আসমানী। হেই অনেক দূরের গেরামে থাকি। সৎ মাই বিয়া দিছে একটা বুইড়ার লগে, বুইড়া খালি মারে। বেইচা দিতে চাইছিল আমারে। বাপে কইলো, ‘পলাইয়া যা আসমানী , তোর জীবনডা আমি শেষ কইরা দিছি, এইবার নিজের মতন চইলা যা’। রাত্তির কইরা বারি থেইকা বাইর কইরা টেরেনে তুইলা দিল। সক্কাল হইতেই দেহি আমি আপনাগর শহরে আইসা পরছি। বাপে কয়ডা টাহা দিছিল টেরেনে থাকা কালা কাপড় পড়া ব্যাডায় নিয়া নিল। দিবার চাই নাই, কইলো টেরেন থেইকা নামাই দিব। টেরেন থামতেই ওই ব্যাডা আমারে নামাই দিল, কোনখানে যামু কিছুই তো জানি না। কয়জন বেডির পিছে নিছিলাম দেহি তাগর বারি চইলা গেল, হন্ধা হয় গেছে, একডা দোহানে বইসা আছিলাম, দোহান ডাও বন্ধ কইরা দিল, তারপর দেহি এক ব্যাডা যাইতাছে, আমি পিছে নিছি, ব্যাডায় রাইগা গেছে। তারপর তো আমি কিছু জানি না। আমারে কী বেইচা দিছে?
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামলো আসমানী। চোখ মুখ কুঁচকে কথাগুলো শ্রবণ করছে নাদিয়া। এসব আবার কেমন ভাষা। যদিও পুরোটা সে বুঝেছে। অবিশ্বাস করারও কারণ নেই। মেয়ের ভাষা, কথা বলার ভঙ্গিমা সবটাই অজপাড়া গাঁয়ের মতো। তবে নাদিয়া বুঝলো মেয়ে ভীষণ বোকা আর বাঁচাল। না হলে তার এক প্রশ্নে কেউ জীবন বিত্তান্ত তুলে ধরে? আর কথা বলার স্বাদ জাগলো না তার। মেয়েটাকে রেখেই বাইরে চলে গেল। আসমানী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ঘরটায় নজর দিল। চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল তার, এত সুন্দর ঘর! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো সে, একেকটা আসবাবপত্র হাত দিয়ে এমন ভাবে ছুঁয়ে দিল জীবনে এসব দেখেনি।
সুন্দর কারুকাজ করা শো পিস দেখে টপাটপ চুমুও খেয়েছে সে। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। কোথায় আছে, কার কাছে আছে এসব যেন মাথাতেই নেই, সে সুন্দরের মোহে পড়ে নিজের অতিত ভুলে গেছে। তার সেই বুড়ো স্বামী জানলে যে কি হবে সেটাও তার মাথায় নেই! দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই পরখ করছিলো নাদিয়া। হুটহাট যে কাউকে তো তাদের সাথে যুক্ত করতে পারে না, তারা যে একটা খেলার বৃত্তে অবস্থান করছে। এখানে প্রত্যেক টা চরিত্র তাদের প্রতিপক্ষ। তবে মেয়েটাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। দরজার আড়াল থেকে সর আদিলের ঘরে নক করলো সে। সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকতে পারলো না নাদিয়া, দরজা বন্ধ করে আদিল ই বাইরে আসলো। বললো,
~ কি জানলে?
মেয়েটার কথাগুলোই সংক্ষেপে তুলে ধরলো নাদিয়া। আদিল কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
~ মেয়ে টাকে চলে যেতে বলো।
একটুও চমকালো না নাদিয়া। সে এমন কথায় আশা করেছিল। নির্দয়, নিষ্ঠুর, বিবেকহীন মানুষ দ্বারা এসবই সম্ভব। বিবেক থাকলে কি এত রাতে একটা মেয়েকে কেউ বের করে দেয়? তারউপর মেয়েটি কিছুই চেনে না। নাদিয়াও সময় নিয়ে ভেবে বললো,
~ আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
~ কেন? অচেনা একজন কে আহমেদ বাড়িতে নেওয়ার মানেই হয় না। মেয়ের ভবিষ্যত দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়!
~ তাহলে বাড়ি পর্যন্ত এনেছো কেন?
~ আমার জানা দরকার ছিল মেয়েটার উদ্দেশ্য। তোমাকে সেসব বলতে বাধ্য নয়। মেয়েটিকে নিয়ে বিদায় হও।
এখানেও উদ্দেশ্য। নাদিয়ার বিশ্রী ভাষায় কয়েকটা গালি দিতে ইচ্ছে করলো। রাগ টাকে দমিয়ে রেখে মেয়েটির কাছে চলে গেল সে। আদিল মাহমুদের অবাধ্য হয়েই সে মেয়েটিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবে। আসমানী তখনো পুরো ঘর দৌড়াদৌড়ি করছিল। নাদিয়া গিয়েই বললো,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১১
~ আমার সাথে চলো।
আসমানীও বিনা বাক্যে নাদিয়ার পিছু নিল। যাওয়ার সময় একপলক আদিলের দিকে তাকালেও তেমন পাত্তা দিল না। তার চোখ মুখে আগের ন্যায় বিষাদ নেই বরং ঝলমলে হাসি বিরাজ করছে। সেটা হোক অদ্ভুত, কিংবা স্বচ্ছ!