হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৬
Tahrim Muntahana
পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আরাফ পালিয়ে গেছে আপু!
কথাটা বলতে বলতেই হাঁটু তে দু হাত রেখে হাঁপাতে থাকে আফরা। মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে সে। বুকের উঠানামা একেবারে কমে এলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিল। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো। এখন না বের হলে রাত একটু বেশীই গভীর হবে। মনিরা অনেক বার থাকার কথা বলেছিল, তবে আফরা বারবার নাকোচ করে দিয়েছে। মিহির সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে গেইট পেরিয়ে কেবল বাইরে বেরিয়ে ছিল। কয়েকজন প্রতিবেশী কে আরাফের ব্যাপারে আলাপ করতে শুনে ফেলে।
আর এক মুহূর্তও দেরী না করে ছুটে আসে বাড়ির ভেতর। মিহিকে তখন খাইয়ে দিচ্ছিল মনিরা। কথাটা শোনা মাত্রই তার হাত থেমে যায়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আফরা’র দিকে তাকাতেই আফরা পরপর দু’বার মাথা নাড়ে। কানে কথাটা কেমন ঝনঝন করে বাজে, মনের মধ্যে ভয় গুলো যেন চেপে বসেছে। আরাফ রাগের বশে তাদের ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে মনিরা বুঝতে পেরেছে। তবে এখন তার কি করণীয়? তার সক্ষমতা খুব বেশি নয় তো! মানুষের সামনে গলা উঁচিয়ে, কয়েকটা ছবি দেখিয়ে, আরেকজনের হেল্প নিয়ে তো আপদ বিদায় করেছিল। কিন্তু এখন যে সেই আপদ ই তাদের জীবনে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আসবে। সামাল দিতে পারবে তো? যে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এত কঠিন পথে পা বাড়ালো সে , সেই মেয়ের ভবিষ্যত কি তার মতোই হবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভিতু মুখশ্রী টা কেমন করুণ দেখাচ্ছে। আফরা এসে পাশে বসে, কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেয়। এতটুকু ভরসায় যেন দরকার ছিল। খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নেয় মনিরা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুখটা কঠোর করে নেয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টা যেন তাকে সাহস দিচ্ছে, বারবার তাকে বলছে সে পারবে। মেয়ের জন্য হলেও তাকে পেতে হবে।
মিহির মুখটা মুছে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে আফরা কে উদ্দেশ্য করে মনিরা বলে উঠলো,
~ তোমার সাথে মিহিকে নিয়ে যাও আফরা। খুব দ্রুত, কেউ যেন দেখতে না পায়!
মায়ের কথায় ভড়কে যায় মিহি। শক্ত করে আঁচল চেপে ধরে। কিছুতেই যাবে না সে। মনিরা অসহায় দৃষ্টিতে আফরা’র দিকে তাকায়। আফরা নিজেও মনিরা’র সিদ্ধান্ত কে না মেনে বলে উঠে,
~ অসম্ভব আপু, আপনাকে ছেড়ে শুধু মিহিকে নিয়ে আমি যেতে পারবো না। গেলে তিনজনই যাবো, নাহলে আজ আমি এখানেই থাকছি!
~ তুমি বুঝতে পারছো না আফরা। তোমাদের উপর চরম রেগে আছে ও, ক্ষতি করে দিবে। আম্মা কেও সাথে নিয়ে যাবে, চরিত্রহীন বুড়ো যা কিছু করতে পারে!
~ আপনি বিষয়টা বুঝতে পারছেন না আপু। আপনাকে একা পেয়ে ও ছেড়ে দিবে? এর বদল আমরা একসাথে থাকি, দুজন কনস্ট্রেবল তো আছেই। আসলে একদম জ* বাই করবো।
মনিরা চুপচাপ কিছুক্ষণ ভেবে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ভেবেছিল এবার বুঝি একটু স্বস্থি মিলবে। তা আর হলো না। শাশুড়ির ঘরে ঢুকে শাশুড়িকে কাঁদতে দেখে মুখ বেঁকায় মনিরা। এই মহিলার আর কাজ নেই। কিছুটা রাগী কন্ঠেই বলে উঠে,
~ এত কাঁদার কিছু হয়নি আম্মা। নর*পশু টা মরে গিয়ে ভালোয় করেছে। আপনি কেঁদে কেঁদে এবার আমার মাথাটা খারাপ করবেন না দয়া করে। আমার সাথে আসুন। আপনার কুলাঙ্গার ছেলে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে।
সালেহা বেগম চমকে যায়। আকস্মিক চেঁচানো তে ভড়কেও যায় সে। আপনাআপনি কান্না থেমে যায় তার। চটজলদি কানে থাকা হাত টা নিচে নামাতে যেতেই হাতে থাকা ফোনটা ফ্লোরে পড়ে যায়। ছোট বাটন ফোনটা ঝনঝন শব্দ করে দু’ভাগ হয়ে যায়। মনিরার ভ্রু কুঁচকে আসে। একবার শাশুড়ির দিকে তাকায়, আরেকবার নিচে পড়ে থাকা ফোনের দিকে। বুঝতে পারে না ব্যাপারটা।
নিচু হয়ে ফোনটা তুলবে, তার আগেই সালেহা বেগম ফোন টা তুলে লুকিয়ে ফেলে। মনিরা’র সন্দেহ টা গাঢ় হয়। তবে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শাশুড়ির কথায় থেমে যায়,
~ চলো, কোথায় যাবে চলো।
মনিরা নড়ে না। চোখ ছোট ছোট করে সালেহা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। সালেহা বেগম ভীতু মুখশ্রী নিয়ে হাঁসফাঁস করে, এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিতে পারে না। বিছানায় বসে পড়তেই মনিরা’র চমকে যায়। পা চালিয়ে এগিয়ে যেতেই সালেহা বেগম জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললেন,
~ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না মা, আমি বলতে পারবো না এখন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই জানবে সবটা।
~ আমি অপেক্ষায় থাকবো আম্মা। আপনি হাইপার হবেন না। আমি আর কিছুই জিজ্ঞাসা করবো না। আমি আপনাকে বড্ড বিশ্বাস করি আম্মা!
সালেহা বেগম নিবিড় দৃষ্টিতে মনিরা’র দিকে তাকান। ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি আম্মা’ কথাটাই কতটা ভরসা ছিল! সালেহা বেগম শক্ত হাতে মনিরা’র হাত আঁকড়ে ধরেন। ভরসা কন্ঠে বলে উঠেন,
~ আমি তোমার বিশ্বাসের মান রাখবো মা। আমার মেয়ে আর নাতনির কোনো ক্ষতিই আমি হতে দিবো না। এমন সুন্দর একটা জীবন তোমাকে উপহার দিবো; এত দিনের কষ্ট, যন্ত্রণা, হাহাকার গুলো প্রাপ্তির কাছে মিলিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে।
মনিরা’র মনে আশার সঞ্চার হয়। ভবিষ্যত প্রাপ্তির কথা স্মরণ করেই খুশিতে দু চোখ চিকচিক করে উঠে। শাশুড়ির হাতের সাথে মিলিত হাত দুটো ভরসার বাঁধন কে আরেকটু শক্ত করে। দরজায় দাঁড়িয়ে শাশুড়ি-বউ’মার এমন মুহূর্ত দেখে আফরা’র চোখ ভিজে আসে। বুকে কেমন ব্যাথার সৃষ্টি হয়, না পাওয়ার যন্ত্রণা গুলো অশ্রু হয়ে চোখ দিয়ে প্রবাহিত হয়। খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নেয় আফরা। এ দুনিয়ায় চোখের জলের কোনো মূল্য নেই, না আছে ইমোশনের! বাঁচতে হলে লড়ে যাও। দরজায় পরপর দু’বার টোকা দেয়। সালেহা বেগম ও মনিরা দুজনই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আফরা বাইরে দাঁড়িয়েই বললো,
~ আপু, আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। আর আমার সাথে আরো একজন আসতে পারে। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না তো?
মনিরা হেসে উঠে। এই মেয়েটার সাথে কথা বললে সময়টা তার বেশ যায় তার। আফরা’র দিকে আসতে আসতে বললো,
~ শুনো, মেয়ের কথা। অসুবিধা হবে কেন? তুমি যে থাকতে রাজী হয়েছো এটাই তো আমাদের জন্য অনেক। সাবধানে যাবে কেমন?
আফরা মাথা নেড়ে চলে যায়। এত মধুর কথা যেন তার সহ্য হয় না। তার সাথে কঠিন তিক্ত কথা গুলোই মানান সই। গেইট পেরিয়ে বাইরে বের হয়েই চারপাশে নজর ঘুরায়। আজ বাইরে বেরোনোর কোনো ইচ্ছে ছিলনা, হুট করে মিরা’র ফোন এলো। কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে বাড়ির বাইরে বের হতে বললো। বিপরীতে সে কিছু বলার সুযোগ ও পেল না। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বের হতে হলো। এখন মেয়েটারই খবর নেই। ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো তার। হাতে থাকায় জলদিই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। অপর পাশ থেকে মিরা বললো,
~ এগিয়ে আয়, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
নিজে থেকেই ফোন কেটে দেয় আফরা। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর যেতেই মিরা কে দেখতে পায়। বাইকের উপর শুয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে, হয়তো গুনগুন করে গান গাইছে। বিরক্তি ফুটে উঠে আফরা’র চোখে মুখে। মেয়ে টাকে কতবার বারণ করেছে, এভাবে বাইকের উপর শুয়ে না থাকতে! তার কথা কানেই তুলে না। কাছে গিয়ে আফরা মিরা’র হাতে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কিছুটা ভয় পেয়েই উঠে বসতে গিয়ে নিচে পড়ে যায় মিরা। রেগে যায় সে, সহজ ভাষায় একটা গালি দিয়ে বলে উঠে,
~ এক থা* প্পড়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবো, বে* য়াদব! ম্যানারস শিখিস নি?
~ এক লা* থি দিবো তুই নিজে ম্যানারস শিখে যাবি। বাইকের উপর এভাবে শুয়ে থাকতে বারণ করেছিলাম? বখাটে দের মতো ব্যবহার করিস। এসব আমার চক্ষশূল, তুই জানিস! তারপরেও কেন?
~ তোর অবাধ্য হতে ভীষণ ভালো লাগে। আমি যদি বখাটেদের মতো ব্যবহার করি, তুমি কম কিসে? আদিল মাহমুদ এর সাথে কেমন আচরণ করো, জানি না আমি? আসছে সাধু সাজতে! তুই তো আরো নিম্ন মানের বখাটে!
~ প্রেম নিবেদন করলে যদি আমি বখাটে হয়ে যাই, তাহলে তো বলবো পৃথিবীর সকল প্রেমিক-প্রেমিকা বখাটে! এরকম ট্যাগ পেতে মন্দ লাগে না!
আফরা’র পাল্টা জবাবে মিরা মুখ বেঁকায়। নানা বাড়ির গল্প মামা’র কাছে করতে আসে, এমন ভাব। মুখ বেঁকিয়েই বলে উঠে,
~ তোমার প্রেম নিবেদন নাকি, ফাঁদ নিবেদন আমি জানি না? আমার সামনে ভুলভাল বকবি না! গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে ডেকেছি, সেটা বলি?
আফরা মাথা নাড়ায়, তবে তার দৃষ্টি মিরা’র দিকে নেই। সে তো ঘুরছে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো কালো গাড়িটার উপর। সারাদিনের অপেক্ষা যেন আফরা’র শেষ হলো। তার কল্পনা’র বাইরেও এই লোক চালাক। নাহলে জনসমাগমে না এসে ঠিক রাতের আঁধারে লুকিয়ে এসেছে। তবে আফরা’র প্লেন যে অন্যরকম। এই মুহূর্তে তার কাজই আদিল মাহমুদের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করা। মিরা কেবলই তার কথাটা বলতে যাচ্ছিলো, আফরা মিরা’র কথা না শুনেই দৌড় দেয়। এক দৌড়ে কালো গাড়িটার সামনে গিয়ে থামে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে কেউ নেই! আশেপাশে তাকায়,নাহ মানুষটার ছায়াও দেখতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, ফলাফল শূন্য। হুট করে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে পড়ে। চমকে দেওয়া যাক।
আফরা’র কাজ দূর থেকে দেখেই মিরা রেগে ফেটে পড়ে। তার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না? সেও এর শোধ না নিয়ে ক্ষান্ত হবে না। মেয়েটাকে অতিরিক্ত বাড়তে দিয়েছে! রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরোই লা* থি দিয়ে রাগ প্রকাশ করে মিরা। কালো গাড়িটার দিকে রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে বাইকে বসতে যাবে তার আগেই টের পায় তার পিঠে কেউ শক্ত কিছুর ঢিল ছুড়েছে। পিঠে আপনাআপনিই হাত চলে যায়। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। সময় নিয়ে ব্যাথা পাওয়া জায়গাটা হাত দিয়ে ঢলে। বাইক থেকে নেমে পেছনে ঘুরতেই, এতক্ষণের রাগের সীমাটা যেন বেড়ে যায়। এই লোকের জন্যই আফরা তাকে ইগনোর করছে! চেঁচিয়ে বলে উঠে,
~ ঢিল মারলেন কেন অ* সভ্য ছেলে?
গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে মিরা’র ঠিক দু হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে আদিল। অসভ্য বলায় রাগ হয়নি তার। মিরা’র প্রশ্নের উত্তর দিতে বলে উঠে,
~ আপনি আমাকে ঢিল মেরেছেন আমি আপনাকে ঢিল মেরেছি, শোধ বোধ অসভ্য মেয়ে!
অসভ্য বলাই দ্বিগুন ক্ষেপে যায় মিরা। সে কখন ঢিল মারলো? তেড়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
~ এই আপনি কাকে অসভ্য বলছেন? আপনার সাহস তো কম না!
~ ঢিল দেওয়ায় যদি আমি অসভ্য হয়, আপনি নিশ্চয়ই আলাদা নয়! গলা নামিয়ে কথা বলুন, আদিল মাহমুদের সাথে কেউ এমন ভাবে কথা বলার সাহস করে না। যে সাহস করে তার জীবনের বাতি নিভে যেতে সময় লাগে না!
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মিরা। আদিলের হুমকি যেন তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না। যদিও সে বুঝতে পেরেছে ভুল টা তার, রাস্তা খালি আছে নাকি না দেখেই ইট ছুড়েছে। তবে সে স্বীকার করতে নারাজ। আদিল মাহমুদের সামনে তো নিজেকে আরো দুর্বল প্রমাণ করা যাবে না। দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললো,
~ আমি নাহয় না দেখে দিয়েছি, তাই বলে আপনি জিজ্ঞেস না করেই ঢিল ছুড়বেন? বলি ঘরে মা বোন নেই। মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?
আদিল এবার রেগে যায়। আফরা ইবনাত মেয়েটার পর এই মেয়েটা তার সামনে এমন উঁচু গলায় কথা বলছে। যদিও সে এরকম টাই আশা করেছিল, আফরা’র বিশেষ বান্ধবী বলে কথা। তবে কেন জানি মেনে নিতে পারছে না। ইচ্ছে করেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। মিরা স্তব্দ হয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আদিল হাত উঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মিরা পাল্টা থাপ্পড় মারে। পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। আদিল হেসে উঠে। মিরা’র মতো গালে হাত সে দেয় নি তবে আঙুল বেঁকিয়ে গাল ঢলে দু’বার। হেসেই বলে উঠে,
~ মস্ত বড় ভুল করে ফেললেন। আপনি এবং আপনার বান্ধবী দেখছি একই ধাঁচের। তবে আদিল মাহমুদের সাথে লাগতে আসা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বয়স অল্প তো, ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। আদিল মাহমুদের কাছে ভুলের ক্ষমা নেই। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি মিস মিরা!
আদিল হাঁটা ধরে। মিরা আর কিছু বলে না। তবে মনের মধ্যে জেদ চেপে বসে। কথায় না বুঝিয়ে নিজের সাহসের গতিটা মিরা অন্য ভাবে বুঝায়। বাইকে উঠেই সর্বোচ্চ স্পিড দিয়ে আদিলের কাছ ঘেঁষে সাঁই সাঁই করে চলে যায় সে। আদিল বিচলিত হয় না, বরং ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে। মনে মনে, ‘সাংঘাতিক যুগল’ দুইটা শব্দ বিড়বিড় করে! গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েই ভাবালেশ বলে উঠে,
~ আপনি চাইলে এর থেকে দামী গাড়ি আমি আপনাকে গিফট করতে পারি। তাই বলে চুপিচুপি অন্যের গাড়িতে উঠতে হয়?
হেলান দিয়ে বসে ছিল আফরা। আদিলের কন্ঠস্বর শুনেই লাফিয়ে উঠে সে। কথাটা তেমন গ্রাহ্য করে না। আদিল যে তাকে আগেই দেখতে পেয়েছিল বুঝতে বাকি থাকে না আর। নিজেও ভাবালেশ উত্তর দিয়ে হাসে,
~ অন্যের বলছেন কেন? ভবিষ্যতে আপনার-আমার কি আলাদা হবে নাকি? সবই তো আমাদের!
আদিল গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বললো,
~ তারপর বলুন, আজ কি উদ্দেশ্য নিয়ে আসলেন?
~ আমি আপনাকে সারাদিন আজ খুজেছি ওই বাড়িটাই! অবাক হয়েছিলাম জানেন? আশরাফ উদ্দিনের ছেলের এত বড় হত্যাকাণ্ড, তারউপর আপনাদের কেনা পুলিশ অফিসারের মৃত্য আর আপনি নেই! মানতে কষ্ট না হলেও ভাবাচ্ছিল। এই দেখুন এখন ভাবাভাবি টাও চলে গেল! আপনাদের একটু হলেও মন আছে বলতে হবে! সহানুভূতি দেখাতে চলে এসেছেন, সেটা হোক চুরি করে!
জবাব আসে না, আদিল মন দিয়ে গাড়ি চালায়। আফরা’র বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়েই মুচকি হাসে, দরজা খুলে দিয়ে বলে উঠে,
~ আদিল মাহমুদের জীবনে সহানুভূতি বলে কোনো শব্দ নেই। সে নিজের লাভ, স্বার্থ ছাড়া এক পা ও বাড়ায় না! সেখানে আশরাফ উদ্দিনের মতো মানুষ কে, যে আমার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে অক্ষম তাকে নিয়ে ভেবে মস্তিষ্কের জ্বালা বাড়ানো আদিল মাহমুদের সাথে যায় না। এই যে আপনাকে রেখে গেলাম, এর মধ্যেও স্বার্থ রয়েছে। ঠিক সময় মতো টের পাবেন! আপনাকে মেরে টুকরো টুকরো করলেও যে উদ্দেশ্যের কথা আপনার মুখ থেকে বের হবে না, সেই উদ্দেশ্যে আমি আপনার সাথে থেকে বের করবো!
কথাটা বলেই আফরা’র কাঁধে হাত রাখে আদিল। আফরা শান্ত দৃষ্টিতে আদিলের চোখে চোখ রাখে। কোনো রকম ভঙ্গিমা প্রকাশ না করেই আদিল ধাক্কা দিয়ে গাড়ির বাইরে ফেলে দেয় আফরা কে। আফরা ব্যাপার টা বুঝতে বুঝতে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। ততক্ষণে সে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, জামা কাপড়ে ধুলো চিকচিক করছে। রক্তচক্ষু নিয়ে আদিলের দিকে তাকাতেই আদিল গাঁ জ্বালানো হাসি দিয়ে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,
~ আপনার স্থান ঠিক কোথায় বুঝিয়ে দিলাম! টা টা!
গাড়ি ছুটায়, আফরা তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। উন্মাদের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। পায় না, বিশ্রী একটা গালি দেওয়ার আগেই কেউ তার দিকে ইটের টুকরো বাড়িয়ে দেয়। আফরা সাথে সাথে হাতে তুলে নেয়। কিছুটা দৌড়ে গিয়ে ঢিল ছুড়ে মারে। আঁকা বাঁকা সরু রাস্তা হওয়ায় আদিল বেশী পথ যেতে পারে নি। অনায়েসেই যে কেউ দৌড়ে ধরতে পারবে। সেখানে ঢিল তো, অনেক! ঝনঝন শব্দ করে পেছনের কাঁচ ভেঙে যায়। আফরা’র ঠোঁটের ভাজে পাল্টা অপমান করতে পেরে জয়ের হাসি দেখা যায়। গাড়ি থামে, আদিল দরজা খুলে উঁকি দিতেই আফরা চিৎকার করে বলে উঠে,
~ আমার স্থানটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন? আপনাকে এভাবে ভাঙার উপস সরি আপনার ভাঙাচোরা দিল টা জোড়া লাগানোর জন্যই হয়তো আফরা ইবনাত সৃষ্টি হয়েছে ! টা টা!
আফরা ফ্লাইং কিস ছুড়ে দেয়। পাশে থাকা মিরা খিলখিল করে হেসে উঠে। দুই বান্ধবী হাতে হাত রেখে বাড়ির ভেতর চলে যায়। আদিল গাড়ি থেকে নামে না। ওভাবেই গাড়ি চালিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। বড় সড় এক পরিকল্পনাও এঁকে ফেলে! দূর থেকে যুদ্ধ আর কতদিন, এবার প্রতিপক্ষ কে সামনাসামনি, কাছাকাছি রাখা যাক! খেলাটা বেশ জমে যাবে!
রাত নয়টা। বেশ রাত হয় নি। নুরুল আলম সিদ্দিকী সবে কোয়ার্টারে ফিরেছেন। ছেলে কে ডাইনিংয়ে বসে থাকতে দেখে তিনি হাসেন। প্রিয় জনের জন্য না খেয়ে বসে থাকার দৃশ্য গুলো ভয়ংকর সুন্দর। কতটা ভালবাসা মেশানো মুহূর্ত গুলো। তিনি এগিয়ে গিয়েই ছেলের পাশে বসলেন। সে জানে এখনই ছেলে তার রাগ করবে, দুটো কথাও শুনাবে। সে তো ইচ্ছে করেই এমন করে, ছেলের বকা গুলো শুনলে মনে হয় তার অতি প্রিয় মানুষটা বুঝি আবার তার ছেলে রূপে ফিরে এসেছে। তারই তো প্রতিচ্ছবি দেখতে পান তিনি। নুরুল আলম সিদ্দিকী ‘র ভাবনা মতো কোনো কাজই করলো না আফীফ। বরং শান্ত স্বরে বললো,
~ তুমি যেটা চাইছো সেটা আজ হবে না। ছুটি মঞ্জুর হলে তবেই এসব হবে!
নুরুল আলম সিদ্দিকী উঠে পড়েন। কোনো জবাব দেন না। নিজের ঘরে চলে যান। আফীফ তাকিয়ে থাকে বাবার চলে যাওয়ার দিকে। সে জানে মানুষ টা তাদের দূরে চলে যাওয়ার কথা মনে করেই মন খারাপ করছেন। তবে আর কতদিন এমন বন্দিদশায় থাকবে? এবার একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিবে সে, মা কে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপহার দিবে। ভাবতে ভাবতেই নুরুল আলম সিদ্দিকী’র আগমন ঘটে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন,
~ তিনমাসের জন্য সম্ভব নয় আব্বু। কর্তৃপক্ষ দুইমাসের ছুটি মঞ্জুর করবে মনে হয়। তবে যেকোনো সময় ফোন, মেইল আসলে কাজে জয়েন করতে হবে। তোমাকে বলেছিলাম এ পেশা বেছে নিও না, দেশের সেবায় একবার সরকারি ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করলে নিজের পার্সোনাল সময় বলে কিছু থাকে না। দেশপ্রেম, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে প্রতিটা মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতে হয়! কখন না যুদ্ধের ডাক আসে!
বাবা’র কথা সত্য, যুক্তি আছে জেনেও আফীফ চুপ থাকে না। বরং পাল্টা যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলে উঠে,
~ আমি যদি নিজেকে ভালোবাসতে না পারি অন্য একজন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ কে কিভাবে ভালোবাসবো আব্বু? যে সরকারের কথা মতো নিজের জীবন ঝুঁকি তে রেখে এত এত মিশন কমপ্লিট করেছি সেই সরকার যদি আমার ব্যক্তিগত সময়ের জন্য কিছুটা সময় না দিতে পারে; এমন সরকার দিয়ে আমি কি করবো? এত এত পদবী, এত এত সম্মাননা দিয়ে আমার কি হবে? যদি জন্মদাত্রী মা কেই ভালো রাখতে না পারি! আপনার কাছে দেশের মানুষ সবার আগে হলেও আমার কাছে আমার পরিবার আগে! স্বার্থপর দুনিয়াই সাধারণ জনগন ও গালি দিয়ে কথা বলতে ভুলে না! আমরা কেন চুপ থাকবো?
ভাত মাখতে থাকা হাত থেমে যায় নুরুল আলম সিদ্দিকী’র। কতটা বছর সে দেশের সেবায় নিয়োজিত আছে। না নিজেকে কখনো সময় দিয়েছে, না পরিবার কে সময় দিয়েছে। কিভাবে তার ছোট ছেলেটা বড় হয়ে তার পথ অনুসরণ করলো, সময় যেন এক ছুটে চলে গেল। ছেলেটা তার আদর্শে বড় হয়েছে, তবে একটা দিকই তার সাথে ভিন্ন। দেশের জন্য সে নিজেকে, পরিবারকে কোরবান করতে রাজি। তবে তার ছেলে পরিবারের জন্য নিজেকে কোরবান করতে রাজি, দেশের প্রতি হঠাৎ এত ক্ষোভ কেন তিনি বুঝলেন না। ছেলের ভেতরের সত্তাটা নাড়িয়ে দিতে বললেন,
~ তুমিই না একসময় দেশের জন্য দেশদ্রোহীর বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলে? নিজের সেনা বন্ধুদের সেইভ রাখতে জ্ঞান থাকা পর্যন্ত লড়াই করেছো? তাহলে আজ এমন ক্ষোভের কারণ কি আব্বু? নাকি চাপা অভিমান হয়েছে বাবার প্রতি?
আফীফ জবাব দিলো না। পাতে পানি ঢেলে হনহন করে চলে গেল। নুরুল আলম সিদ্দিকী হাসলেন, তবে উঠলেন না। খাবার শেষ করে উঠলেন। কত কত মানুষ না খেয়ে থাকে, আর সে খাবার অপচয় করবে? কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ছেলের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। গলা উঁচিয়ে বললেন,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৫
~ আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো আব্বু! তুমি হয়তো জানো না, আমার কাছে তুমি খোলা বইয়ের মতো। যেহেতু গোপন রেখেছো ধরে নিলাম অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়টা। নিজে থেকে বলার অপেক্ষায় রইলাম। যাই হোক, সরকার তোমাকে তোমার চাহিদা মতোই ছুটি দিয়েছে! শুধু বলবো, এমন কোনো কাজ করো না দেশের মানুষ সেনা সদস্যদের শত্রু বলে মনে করে! আব্বু তোমাকে বিশ্বাস করে!