হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩০+৩১
Tahrim Muntahana
~ কাল সারাদিন কোথায় ছিলে আঁখি?
গুমোট কন্ঠস্বর। আঁখির ভেতর টা ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো। যার ঝলকে পড়ে যেতে নিয়েও বিছানার চাদর খামচে ধরলো সে। দীর্ঘদিনের খরা মাটিতে যেমন ফাটল সৃষ্টি করে, আঁখি নিজের গ্রীবাদেশে তেমন ফাটল অনুভব করে। এত বার ঢুক গিলেও গলা ভেজাতে পারছে না। খরা মাটি যেমন পানি শুষে নেয়, ভয় তার মুখে মুখের লালা টাও শুষে নিচ্ছে। সাড়া শব্দ না পেয়ে আফরা আবার বললো,
~ কথা বলছো না কেন? কোথায় গিয়েছিলে? বেইমানি করছো আমার সাথে? বাঁচতে পারবে?
আঁখি খানিক পর সহজ হলো। চুপ থাকা মানে ঘাড়ে দোষ আপনাআপনিই চাপিয়ে নেওয়া। আমতা আমতা করে বললো,
~ ভুল বুঝতাছেন আপা, আমি গ্রাম দেখতে বাইর হইছিলাম।
আফরা তাচ্ছিল্য হাসলো। হাসির শব্দ আঁখির কানে পৌঁছালো না। ঠাওর ও করতে পারলো না তার সাথে ঠিক কি হতে চলছে। আফরা সহজ গলায় বললো,
~ ওকে, ভুল বুঝলাম না। তবে এমন কোনো কাজ করো না, নিজের মৃত্য নিজে ডেকে নিয়ে আসবে। আমি নারী ভয়ংকরী, সর্বগ্রাসী!
ফোন কেটে দিয়ে পাশে তাকালো আফরা। ভ্রু কুঁচকে মিরা তাকেই দেখছে। মিরা কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আফরা বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ তুই কোথা থেকে খবর পেলি?
~ আমার লোক আঁখি কে বড় রাস্তা পার হতে দেখেছে।
মিরা ভাবালেশ উত্তর। আফরা অবাক কন্ঠে বললো,
~ তোর লোক?
~ কেন? তুই কি আমাকে ঝরা পাতা মনে করছিস? মাটিতে পড়ে একাই গড়াগড়ি খাবো! আমি ডাল যুক্ত পাতা, সৈন্য ছাড়া রাজ্যের মূল্য কই?
মিরা ফোন টিপতে টিপতে আফরার থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করলো। আফরা বুঝতে পারলো মিরা তাকে এড়িয়ে চলতেই দ্রুত প্রস্থান করলো। সেও আর কিছু ভাবলো না। মেয়েটাকে অবিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! হাঁটা ধরলো আফরা। বিষাদের আকাশের ঘন কালো মেঘেদের রাজত্ব। ক্রমশ যেন প্রকট হচ্ছে। জবুথবু হয়ে আছে হাস্যজ্জ্বল অনুভূতি গুলো। আনমনে কখন নিজের ঘর পেরিয়ে গেল, টের পেল কারোর ধমকানোর শব্দে,
~ এই যে ভাবুক রানী কোথাও বসে নাহয় কোথাও দাঁড়িয়ে ভাবুন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবার সময় কার সাথে ধাক্কা লেগে যায় বলা যায় না। এমনও হতে পারে দু তালা থেকে নিচে পড়ে গেলেন। তখন আর জীবনের মায়া করতে হবে না।
ভৎসর্না। অপমানে থমথমে হয়ে যায় আফরা’র মুখশ্রী। চোখ তুলে তাকায় সে। বিরক্তি দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে আফীফ মুনতাসির। ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলো,
~ জীবনের মায়া রয়েছে, একবারো বলেছি?
অন্যকেউ হলে হয়তো এমন কথায় থতমত খেয়ে যেত। মেয়েটাকে পাগল ও ভাবতে পারতো। জীবনের প্রতি মায়া কার না আছে? তবে আফীফের মুখশ্রীতে বিরক্তি ছাড়া কিছুই ফুটে উঠে না। অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
~ বলতে হবে কেন? জীবনের মায়া সবারই আছে। নিজের জীবন না হোক, অন্যের জীবন। আপনার জীবনের মায়া না থাকলেও, আপনার কাছে নিশ্চয়ই প্রিয়জনের জীবনের মূল্য রয়েছে। রয়েছে না? প্রিয়জন আপনাকে ছাড়া ভালো থাকবে? থাকবে না। এই কারণের জন্য হলেও আপনাকে জীবনের মায়া করতে হবে।
আফরা স্তব্ধতার সহিত আফীফের কথাগুলো শ্রবণ করলো। প্রিয়জনের পাতায় হাতড়ে হাতড়ে চারটে মুখই সে খুঁজে পেল। একজন তার সাথে রয়েছে বছর দুয়েক, আরেকজন তার বোন, দুজন অত্যন্ত গোপনীয়। যাদের জীবনের মায়া সে করে। খুব করে! তবে কি সে কারো কাছে এই প্রথম ভুল টিকলো? তারও জীবনের মায়া করা উচিত? মন বলছে নিশ্চিত করা উচিত! আফরা’র গুমোট মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আফীফ। হুট করেই আফরা আনমনে প্রশ্ন করে বললো,
~ আপনার জীবনের মায়া নেই? বুলেটের সম্মুখে বুক পাততে ভয় করে না?
আফীফ যেন এই প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিল সাথের মেয়েটির থেকে। আশ-পাশ নজর ঘুরিয়ে বললো,
~ চলুন কোথাও বসা যাক।
আফরা’র না করতে ইচ্ছে করলো না। উত্তর টা শোনার কৌতুহল তাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সে হাঁটা ধরলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে আফীফ আফরা কে অনুসরণ করছে। আফরা গিয়ে বসলো রিসোর্টের সামনে। যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে পাশে বসলো আফীফ। নিরবতায় কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। আফীফ নিজে থেকে শান্ত কন্ঠে বললো,
~ নিজের জীবনের মায়া সেদিনই স্থগিত রেখেছি যেদিন আব্বুর মুখে শুনেছিলাম ,’দেশ তোমার সন্তান। মা-বাবা যেমন সন্তান কে পরম যত্নে আগলে রাখে, সন্তানের বিপদে আগ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সন্তানের ব্যাথায় বেশী কষ্ট তারা পায়; তোমাকেও দেশ কে আগলে রাখতে হবে, বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, দেশের ক্ষতিতে তোমার অন্তর ব্যথিত হবে, শত্রুদের বুক বরাবর বুলেট ছুড়তে হাত কাঁপবে না, নিজের জীবনের মায়া না করে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে!
গাম্ভীর্য পূর্ণ কথাগুলোয় আফরা’র শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। শরীর কেমন কাটা দিয়ে উঠে। কন্ঠে দেশের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া; এমন অনুভূতি লোকটা কিভাবে প্রকাশ করে? আফীফ একপলক আফরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
~ সেদিন থেকে গোটা দেশ আমার সন্তান। নিজ সাধ্য মতো আগলে রেখেছি, শত্রুর বুলেটের সামনে বুক পেতেছি, বুলেট শরীর ভেদ করে রক্ত ঝরিয়েছে; থেমে যাই নি! এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো। আমি আমার দেশের মায়া করি, জীবনের নয়। দেশের মায়ায় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি না থাকলে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বে কে? অন্য কোনো অফিসার অবশ্যই আসবে, কিন্তু সে তো আফীফ মুনতাসির নয়! না সে নুরুল আলম সিদ্দিকী’র ছেলে। আশা করি উত্তর পেয়ে গেছেন মিস আফরা ইবনাত!
আলো অন্ধকার পরিবেশে দুজন মানব-মানবি তাকিয়ে আছে অদূরের ওই পাহাড়ে। কখনো দৃষ্টি মেলে মেঘে ঢাকা আকাশ কে চোখের পাতায় এঁটে নিচ্ছে। কখনো জমিনের প্রতি অগাধ মায়া টের পাচ্ছে। কি একটা সুতো দুজন কে পাশাপাশি বসিয়ে রেখেছে কে জানে! না দুজন কথা বলছে, না কেউ প্রস্থান করে দুরত্ব সৃষ্টি করছে। অদ্ভূত উৎকণ্ঠা দুটো হৃদয়ে। মিনিট কয়েক পেরিয়ে যায়। আফরা আবার প্রশ্ন করে,
~ যদি বলা হয় নুরুল আলম সিদ্দিকী, মাতৃভূমি দুজন সম্পূর্ণ দু দিক! আপনি কোনটা বেছে নিবেন জেনারেল আফীফ মুনতাসির?
উত্তর দিতে হিমশিম খেতে হলো না আফীফের। যেন ঠোঁটের ভাজে আগ থেকে লুকানো ছিল উত্তর। প্রশ্নের অপেক্ষা মাত্র। মুচকি হেসে জবাব দিল,
~ আফীফ মুনতাসির কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না, না নুরুল আলম সিদ্দিকী শিখিয়েছেন। জীবন স্রোতধারায় ভাসতে ভাসতে যদি টের পায় যে মানুষ টা আমার মনে একটু একটু করে দেশ প্রেম জাগিয়ে তুলেছেন, লয়ালিটি শিখিয়েছেন; সেই মানুষটিই দিনশেষে অন্যায়ের নিকট হেরে গিয়েছেন; আফীফ মুনতাসিরের বুলেট অপরাধীর শরীর ভেদ করতে কন্ঠা বোধ করবে না। তবে প্রশ্ন যদি নুরুল আলম সিদ্দিকী লয়াল, তখন আফীফ মুনতাসির জেনারেল পদ এক সাক্ষরেই ছেড়ে দিবে। যে আমাকে জন্ম দিয়েছে, যার বদৌলতে দেশ কে ভালোবাসতে পেরেছি, দেশের সেবা করছি; তাকেই যদি বলিদান দিতে হয়, মায়ের মুখের হাসি কেড়ে নিতে হয় ওমন দেশ দিয়ে আমি কি করবো? কয়েকদিন দেশের লোক আফীফ মুনতাসির কে বাহবা দিবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হবে গণহারে, সম্মাননা দেওয়া হবে; কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে ভুলে যাবে সবাই। ভুলে যাবে আমার ত্যাগ কে, কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না বাবা হারিয়ে আমার অবস্থা, মায়ের সুখ কেড়ে নিয়ে আমার নত মুখের জ্বালা, বুকের ব্যাথা কেউ দেখবে না! নিজের বুকের রক্ত ঝরাতে কার্পণ্য নয়, তবে প্রিয় জনের রক্ত আফীফ মুনতাসির কে অধিক হিংস্র করে তুলে। বলাবাহুল্য হিংস্র আফীফ মুনতাসির কারোর জন্যই শুভকর নয়। সে হোক আমার সোনার বাংলা, আমার মাতৃভূমি!
আফরা’র মনে হলো উত্তর টা তার মন গ্রহণ করেছে। লোকটা যেমন অফিসার হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে তেমনি সন্তান হিসেবেও সমান যোগ্যতা রেখেছে। মানুষ এতটা পারফেক্ট হয়? কি করে? আফরা আদুরে কিশোরীর মতো প্রশ্ন করছি বসলো,
~ এতটা পারফেক্ট কি করে?
~ পারফেক্ট? আমি? উম হাম! কেউ পারফেক্ট হয় না। কোনো না কোনো খুঁত থেকেই যায়। আমি একজন অফিসার, একজন সন্তান হিসেবে যোগ্য হলেও একজন স্বামী হিসেবে সমান যোগ্যতা রাখতে পারবো না। কারণ আমার জীবনে কোনো মেয়ের প্রবেশ ঘটবে না। এটাও একটি খুঁত!
~ নারী বিদ্বেষী?
~ নাহ! দেশের প্রতি ভালোবাসা!
উঠে দাঁড়ায় আফীফ। বড় বড় পা ফেলে রিসোর্টের ভেতর ঢুকে পড়ে। গাম্ভীর্য পূর্ণ পায়ের ভাজে আফরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেশ প্রেমে আসক্ত এক সৈনিক মনকুঠিরে শ্রদ্ধার স্থান নিয়ে নিয়েছে, খুব করে টের পায় সে। দৃষ্টি ঘুরায় আফরা। অদূরের আকাশে চোখ রেখে হুট করেই হেসে উঠে। নির্ভেজাল নাকি রহস্য লুকিয়ে আছে রাতের আঁধারেই মিশে যায়। কারোর চোখেই পড়ে না। এ যেন ধোঁয়া হয়ে কুয়াশায় মিশে যাওয়া!
নতুন ভোরের আগমন। স্নিগ্ধ হাওয়া, দুলিয়ে দিচ্ছে মন। মনের উচাটনে কোনঠাসা নাদিয়া। বলে তো দিলো কয়েকদিন ঘুরবে, তবে তার এখন কেন ভয় করছে? মনে হচ্ছে সামনে এগোলেই খারাপ কিছু হবে। যা তার জন্য মুটেও সুখকর নয়। চিন্তাগ্রস্থ মন নিয়ে মদের গ্লাসে চুমুক বসায় নাদিয়া। রাতে ঘুম হয়নি, চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল মাত্র। কিছুক্ষণ পর পর কেমন শরীর কেঁপে উঠতো, চোখের পাতায় আহিশের বিরক্তিমাখা মুখশ্রী ভেসে উঠতো। যে দৃষ্টি তাকে অবজ্ঞা করছে, তার ভালোবাসা নিয়ে ভৎসর্না জারি করছে। তাকে অবহেলায় ফেলে রেখেছে মনের বাহিরে!
কথাগুলো মনে হতেই যেন নাদিয়ার মস্তিষ্ক চঞ্চল হয়ে উঠলো। পুরো এক গ্লাস এলকোহল ঢেলে দিলো গ্রিবাদেশে। ইদানিং মদ নামক অমৃতের স্বাদও জিহ্বা পায় না, মন তার বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিষ্ঠুর পুরুষ কে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। দরজা খোলার শব্দ। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দরজায়। মিরা এসেছে। নাদিয়ার হাতে মদের গ্লাস দেখে মুচকি হাসে। তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে উঠে,
~ খাস মাতাল! মহৎ কাজের জন্য নোবেল তোমারই প্রাপ্য নাদিয়া। একদম যোগ্য অধিকারী! যাই হোক, মাতাল হয়ে পড়ে থাকবে না বেরোবে? তোমার প্রেমিক পুরুষ তো চললো বউ বাচ্চা নিয়ে!
এতটাই চমকে গেল নাদিয়া, হাত থেকে মদের গ্লাস পড়ে ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে গেল। মিরা’র হাসি চওড়া হলো। তবে নাদিয়া আকস্মিক রেগে গেল দ্বিগুন হারে। বউ বাচ্চা মানে? মশকরা হচ্ছে তার সাথে? বড় পা ফেলে মিরা সামনে দাঁড়িয়েই, কাঁধ চেপে ধরলো শক্ত হাতে। মিরা’র মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ভাবালেশ ঠোঁটে মুচকি হাসি বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিয়া রাগে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ বউ বাচ্চা মানে? ফাযলামো করো আমার সাথে? ভাবী হয় ভুলে যেও না! ওই মিহি আহিশের ভাইয়ের মেয়ে! বুঝতে পেরেছো তুমি?
এক ঝটকায় নাদিয়ার হাতের মুঠো থেকে মুক্ত হয় মিরা। গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে একপলক বাইরে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
~ ভাবী, বউ হতে দেরী লাগবে না! বলেছি না? চেঁচাবে না আমার উপর! খুব খারাপ হবে। আমাকে ঠিকঠাক চিনতে পারো নি। ওয়ার্নিং দিলাম, এরপর ভুল হলে তোমাকে পাহাড়ের খাদে ফেলতে আমার দু সেকেন্ড সময় লাগবে না!
পরের কথাগুলো নাদিয়া কর্ণকুহরে আর পৌঁছালো না। সে তো ডুবে আছে ‘বউ হতে দেরী লাগবে না’ কথাটাই! তার এত বছরের ভালোবাসা কিছুই না? দুদিনের এক মেয়ে যে ভাবী ছিলো সে এসে তার ভালোবাসা কেড়ে নিবে? নাদিয়া মানতে পারছে না! মিরা কে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দেয় নাদিয়া। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে! টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। বুকের রক্তক্ষরণ বুকের মাঝেই লুকিয়ে থাকে। জ্বালাময়ী অনুভূতি গুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। একটা কথায় মনে বলে, ‘ভালোবাসা পাপ!’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিরা শব্দহীন হাসতে থাকে। কান্না গুলো তার বুকে কেমন আনন্দের জোয়ার বয়ে আনছে। গুণ গুণ করতে করতে হাঁটা ধরে,
“তোমার প্রেমের টানে না মজিলে
সেটাই হয়তো ভালা!
বুঝতে আমার হইলো দেরী
পিরিত ভীষণ জ্বালা!”
কান্নার মাঝেও মিরা’র কন্ঠস্বর কানে পৌঁছায় নাদিয়ার। গান টা যেন তাকেই তাচ্ছিল্য করে গাইছে মেয়েটি। প্রেমে তো সেই তিনবছর আগেই মজেছে, বুঝতেও দেরী করে ফেলেছে, পিরিত যে ভীষণ জ্বালা! প্রতিনিয়ত বুকে রক্তক্ষরণ হয়, অবিরাম অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। অসাড় শরীর যে জ্বালাময়ী অনুভূতির চিহ্ন! ভালোবাসা সত্যিই পাপ!
ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলছিলো আহিশ। কিছুক্ষণ পরেই তারা নীলাচল কে বিদায় জানাবে। মিরা দূর থেকে দেখে এগিয়ে এলো। আশপাশ টা ভালো করে পরখ করে কয়েক মুহূর্ত আহিশের ব্যস্ত মুখশ্রী দেখলো। হুট করেই কেশে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,
~ আপনার মেয়ে কোথায় মি. ?
আহিশ ফট করে মাথা তুললো। মিরা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো অসম্ভব। মেয়েটা কে সে আফরা’র সাথে দেখেছে। বিরক্ত হলেও স্বাভাবিকতা বজায় করে বললো,
~ রুমে রয়েছে হয়তো!
~ আপনার বউ?
বুঝতে পারে না আহিশ। মেয়েটা কি বলতে চাইছে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মিরা মুচকি হেসে বলে উঠে,
~ মিহি আপনার মেয়ে, মেয়ের মা নিশ্চয় আপনার বউ হবে! তাই নয় কি?
রাগ হলো আহিশের। মেয়েটা গায়ে পড়ে কথা বলতে আসছে কেন? মতলব কি? তীক্ষ্ম চোখে মিরা’র দিকে তাকাতেই মিরা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো! কেন যেন মনে হলো হাসিটা আহিশের বুকে লেগেছে। তীক্ষ্ম চোখের দৃষ্টি নির্মল হয়েছে। চোখে মুখে আকাঙ্ক্ষা! মিরা হেসেই বললো,
~ আপনাদের তিনজন কে একসাথে বেশ মানিয়েছে! ফ্যামিলি হলে খারাপ হবে না!
আহিশ ভীষণ ভাবে চমকালো কথাটা শুনে। ফ্যামিলি হলে খারাপ হবে না? কথাটা কোথায় যেন শুনেছিল! মেয়েটাকে তার পরিচিত ঠেকছে কেন? কে এই রমনী? ভাবতে পারলো না আহিশ। একপ্রকার ছটফটিয়েই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো। বেনী করা মেয়েটা তার দিকেই মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে। হাসিটার কত মিল! এমন মিল হতে পারে? হিসেব মেলাতে মেলাতে আহিশ অতিতে ডুব দিলো। কেউ একজন ঠিক এভাবেই বলেছিল,
~ আপনাদের দুজন কে একসাথে বেশ মানিয়েছে। ফ্যামিলি হলে খারাপ হবে না!
চোখ ভিজে আসে, কোটরের কালো মনির আশেপাশে সাদা অংশ কেমন লাল হয়ে আসে। চোখ মুখ শক্ত করে নেয় আহিশ। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ঠিক রাখার প্রয়াস চালায়। সফল হয় তবে দেরীতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে! তাচ্ছিল্য নাকি অভিযোগ?
বড়সড় ঘর! সারি সারি চেয়ার সাজানো। বড় একটি টেবিলে পানির বোতল, এলোমেলো কাগজ, একপাশে পড়ে আছে রিমোট। দেয়ালে বড় সাইজের একটি টিভি। ঘরের আসবাবপত্র বলতে এগুলোই দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আদিল। চোখে মুখে গাম্ভীর্য, অদ্ভুত রাগী ভাব। দৃষ্টি সাদা ফ্লোরে। সামনে দুজন লোক ইশারায় কথা বলে যাচ্ছে। একে অপর কে শুধাচ্ছে নিজেদের ভঙ্গিমা। দৃষ্টি নিচে থাকলেও ব্যাপারটা আদিলের অজানা হয়। সময় দিচ্ছে তাদের। মিনিট দুয়েক পেরিয়ে যেতেই গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
~ একে অপরের মতামত জানা হয়েছে? এবার আমি কিছু বলি?
চমকালো দুজনই। ধরা পড়ার ভয়ে মাথা নিচু করে চুপ রইলো। আদিল তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
~ তা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ব্যবসায় এবার দুজন একসাথে করবেন? স্বতন্ত্র? মাহমুদ দের বয়কট করবেন?
শান্ত কন্ঠস্বর। তবে যে ঝড়ের ইঙ্গিত দুটো লোক ঠাওর করতে পেরেই কাচুমাচু করতে লাগলো। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে পারছে না। আদিল মাহমুদ ‘বলুন’ না বলা পর্যন্ত যে কথা বলার অধিকার তাদের নেই! আদিল আবার বললো,
~ তা ডিলার কত টাকা বেশী দিবে বলেছে? এক হাজার ডলার? জীবনের মায়া নেই? আপনাদের সাহস দেখে আ’ম ইমপ্রেসড! বেশ ভালো লাগলো। তবে এমন সাহস যে ভুল জায়গায় দেখানো হয়েছে!
চোখ তুলে দুজন কে পরখ করলো আদিল। দুটোই কিছু বলার গড়িমসি করেও চুপ করে যাচ্ছে। এবার আর দৃষ্টি নত করলো না, দুজনের দিকেই তাকিয়ে বিজ্ঞদের মতো বললো,
~ বিড়াল ভাত পেয়ে খুশি হওয়ার বদলে যখন মাছের আশা করে ওটা তার অধিকার। মাছ ডিঙিয়ে মাংসের আশা কে কি বলবে? লোভ? উম হাম লোভ নয়, সে তো নিজ জিহ্বাকেই বিশ্বাস করতে পারেনি! ভিন্ন স্বাদের আশায় নাচতে নাচতে চলে গেছে। তবে সে কি জানতো ভিন্ন স্বাদে মেশালো বিষের কথা?
বিষের কথাটা শোনা মাত্রই একজন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আদিলের পায়ের কাছে বসে অনুরোধ কন্ঠে বলে উঠলো,
~ স্যার ভুল…
লোকটি দুটো শব্দের বেশি উচ্চারণ করতে পারলো না। তার আগেই উত্তপ্ত বুলেট কন্ঠনালী ভেদ করে থামিয়ে দিলো তাকে! পাশের লোকটি থরথর করে কাঁপলেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সাহস করেনি, না সাহস করেছে মুখ ফুটে কিছু বলার। একেতো দুজন চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য কারোর সাথে ডিল করতে যাচ্ছিলো, মাহমুদ দের নিয়ে নানান কথা কানাঘুষা করেছে; তারউপর আদিল মাহমুদের সামনে বসে তারই করা নিয়ম ভঙ্গ করে কথা বলেছে! সিংহ কি মাংসের গন্ধ পেলে চুপ করে বসে থাকবে? ঠিক হামলে পড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে! এখানেও ঠিক তাই ঘটলো। যে রাগ দমিয়ে রেখে আদিল মাহমুদ তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলো, সেই নিশপিশ করা হাতকে ভুল দ্বারা জাগিয়ে তুললো। চরম ভুল! এখন জীবন দিয়ে পস্তাতে হচ্ছে! আদিল লোকটার কাঁধ বরাবর পা রেখে দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাকালো। মুচকি হেসে ধাক্কা দিতেই লুটিয়ে পড়লো রক্তাক্ত দেহটা। সাদা ফ্লোর রক্তিম হয়ে উঠেছে কয়েক মুহূর্তেই। চুপচাপ শব্দ হীন কেটে গেল কিছু সময়। হুট করেই আদিল সহজ গলায় বললো,
~ বেরিয়ে যান, পিছু ফিরবেন না! প্রস্তুত হন, রাতের জন্য!
লোকটি সাথে সাথেই মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালো। একবারো পিছু না ফিরে সুরসুর করে হেটে বাইরে চলে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। আদিল লোকটার হাঁটার গতি দেখে হাসলো। নিচে পড়ে থাকা মৃত দেহটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
~ আদিল মাহমুদ কে চিনতে ভুল করা মানে সবচেয়ে বড় আফসোস জীবনে রাখা! আমার গুহায় থেকে আমারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! ইশ বড্ড আফসোস হচ্ছে না?
দুটো গাড়ি পরপর এসে থামলো থানচি বাজারে! গাড়ির কাজ এখানেই সমাপ্ত। এর পরের পথ ট্র্যাকিং করেই চলতে হবে।
প্রথমেই নেমে এলো আহিশ। পেছনে এসে জানালা গলিয়ে মাথা ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলবো। কোনো দিক না তাকিয়ে চলে গেল গাইড নিতে। থানচি থেকে গাইড নেওয়া বাধ্যতামুলক। তবে তার মুখে কেমন আশংকার ছাপ ছিলো। হয়তো চিন্তায় আছে এতটা পথ হাঁটতে তো?
দ্বিতীয় গাড়ি থেকে নেমে এলো জিয়াউল। বস কে অমান্য করেই এসেছে। সে থাকতে কেন তার বস নেমে গাইড খুঁজবে? গাড়ি টা অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত হাঁটতে লাগলো সে। যখন দেখলো তাকে দেখা যাবে না গাড়ি থেকে তখন পকেটের ফোন বের করে ফোন দিলো,
~ স্যার, মেম পৌঁছেছে?
নুরুল আলম সিদ্দিকী কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলেন। চাপা সুরে বললেন,
~ পৌঁছেছে মানে? আমাকে প্রশ্ন করছো তুমি? তোমরা কি পাঠিয়েছো? পৌঁছেবে কেমন করে?
থতমত খেয়ে গেল জিয়াউল। নিজ হাতে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে। বড় সড় ঢুক গিললো সে, চটপট বললো,
~ আমি নিজের হাতে গাড়িতে বসিয়েছি স্যার, পৌঁছেবে না কেন?
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নুরুল আলম সিদ্দিকী’র। যেটা ভেবেছিল সেটাই হয়েছে। গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ জলদি গাড়ি ট্র্যাক করো! আফীফ কে জানানোর প্রয়োজন নেই। চিন্তায় ভুল করে বসবে।
~ ক্ষমা করবেন স্যার। ছোট স্যার চিন্তায় ভুল করার মানুষ না। তাকেই জানাতে হবে, নাহলে গোলমাল হয়ে যাবে। আমি রাখছি স্যার।
ফোন কেটে দিয়েই দৌড়াতে শুরু করলো জিয়াউল। মাথা কাজ করছে না। তাদের লোকের কাছেই তো পাঠিয়েছিল, তাহলে এখনো পৌঁছাবে না কেন? ড্রাইভিং সিটে বসে ফোন টিপছিল আফীফ। জিয়াউলের দৌড়ে আসায় খানিক বিচলিত হয়। কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে ছেলেটাকে। প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না, তার আগেই জিয়াউল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে,
~ স্যার আন্টি তো পৌঁছায় নি এখনো। ড্রাইভার ও ফোন ধরছে না।
কিঞ্চিৎ বিচলিত হলেও নিজেকে সামলে নিতে সেকেন্ড সময় লাগলো না আফীফের। আদেশ কন্ঠে বললো,
~ সেসব তোমার ভাবতে হবে না। তুমি যে কাজে এসেছো সেটিতে মন দাও! আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে!
কিছুটা অবাক হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জিয়াউল। স্যারের চুপ থাকা মানে কামিনী বেগম সেইফ। আবার ফোনে মনোযোগ স্থাপন করলো আফীফ। হর্নের শব্দ। তীব্র বেগে ছুটে আসা বাইক হঠাৎ করেই থেমে গেল। পর পর তিনটা বাইক থামতেই শব্দ দূষণে আফীফের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। কপালে ভাজ ফেলে বাইরে দৃষ্টি ফেলতেই ভাজ আর কপালে রইলো না। মিশে গেল অবাকের আড়ালে। একপ্রকার সম্মোহনী হয়েই নেমে এলো গাড়ি থেকে। তিনজন মেয়ে বাইক রাইড করে পাহাড়ী রাস্তায় আসা কম ব্যাপার নয়।
যদিও ছেলে-মেয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য আফীফ করে না। তবে মেয়েগুলোর মধ্যে নিজের মা কে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে সে বুঝতে পারছে না। তার কি অবাক হওয়া উচিত? নাকি রাগ করা উচিত? মিনিট খানেক সময় গেল এটা ভাবতেই। তবে সমাধান সে পেল না। কামিনী বেগম এখন আর শাড়িতে আবৃত কোনো বাঙালি বউ নয়, বাইক রাইডার দের মতো পোশাক-আশাক পড়ে কেমন যুবতি হয়ে গেছে। যদিও আফীফ তার মায়ের বয়স অনুমান করতে পারে না! সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কামিনী বেগম যে স্বামীর পাল্লায় পড়েই এক্সারসাইজ করতো বা করে তা আফীফের জানা। শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা যোদ্ধা মা টাকে দেখা হয়নি। আফীফের চোখ মুখে মুদ্ধতা ছড়িয়ে গেল। তার মনে হলো, সে পাশে দাঁড়ালে কেউ ই বিশ্বাস করবে না এই মহিলার ছেলে সে। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসলো আফীফ। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার আগে গলায় ক্যামেরাটাও জড়িয়ে নিলো। কামিনী বেগম বাইক থামতেই হেলমেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে। আফীফ কে এখনো তার চোখে পড়ে নি। যখন পড়লো কিছুটা ভয় খেলে গেল তার মনে। রাগ করবে না তো? আফীফ দূর থেকে মায়ের দিকে ক্যামেরা তাক করে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ আম্মা পোজ!
কামিনী বেগম সাথে সাথেই কয়েকটা পোজ নিয়ে নিলেন। যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল। আফীফ কাছে এসেই বলে উঠলো,
~ মিসেস নুরুল আলম সিদ্দিকী দেখছি বেশ মাস্তি তে আছেন! যুবতী হওয়ার কারণ কি?
লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো কামিনী বেগমের মুখশ্রী। পাশেই আফরা, মিরা, নাদিয়া দাঁড়ানো। আফরা বাদে দুজনের মুখশ্রীতেই অবাকতা। মায়ের লজ্জারাঙা মুখ দেখে আফীফ হেসেই বললো,
~ উপস আম্মা। আমার সামনে লজ্জা না পেয়ে এমন লজ্জা আব্বুর সামনে পেও। তাহলে দেখবে মি. নুরুল আলম সিদ্দিকী ডিউটি জলাঞ্জলি দিয়ে তার মিসেস কে পাহারা দিতে শুরু করবে!
বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো আফীফ। কি প্রাণবন্ত লাগছিল তাকে। কামিনী বেগম হালকা হেসে ছেলের কাঁধে চাপড় বসালেন। মা-ছেলের খুনসুটি বেশ উপভোগ করছিল আফরা! মায়ের থেকে নজর ঘুরিয়ে আফীফ তাকায় আফরা’র দিকে। ভূমিকা হীন বলে উঠে,
~ মিস আফরা আম্মুকে পেলেন কোথায়?
~ রেডি হচ্ছিলাম উনি আসলো রুমে। প্রশ্ন করায় কোনো উত্তর আসলো না। অফার করলাম আমাদের সাথে যাবে? রাজী হয়ে গেল, ব্যাস চললাম চারজন! তবে উনি আপনার মা জানতাম না!
চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিরা। গড়গড় করে মিথ্যে বললো এই মেয়ে। অচেনা একজন কে সাথে নেওয়ার ভুল যে আফরা করবে না সে জানে। মিরা’র চাহনিতে চোরা হাসলো আফরা। মিরা বললো,
~ আপনার ছেলেকে যেহেতু পেয়েছেন এবার আমরা আসি! আপনাকে খুব ভালো লেগেছে আমাদের। রাইড খুব এনজয় করেছি!
বিরক্ত হলো আফরা। এই মেয়ে আগ বাড়িয়ে পাকনামি করতে আসছে। আফীফের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ আমাদের সাথে মিসেস কামিনী গেলে আপনার আপত্তি থাকার কথা না নিশ্চয়ই। প্রথমত আমরা উনাকে আপনার মা হিসেবে জানতাম না, দ্বিতীয়ত আমাদের না দেখা হলে আপনি জানতেও পারতেন না আপনার মা আমাদের সাথে, তৃতীয়ত আমি চাইছি জার্নিটায় মিসেস কামিনী আমাদের সাথে থাকুক তবে আপনি নয়!
আফীফ হাসলো। ঠোঁট এলিয়ে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে আফরা’র কাছাকাছি দাঁড়ালো। খানিক ঝুকে ফিসফিস করে বললো,
~ অবশ্যই আপত্তি নেই। প্রথমত উনারা কেউ না জানলেও আপনি ঠিক জানতেন মিসেস কামিনী আমার মা, দ্বিতীয়ত আমাদের না দেখা হলে আমার কানে খবর পৌঁছাতে দেরী লাগতো না, তৃতীয়ত আমিও চাইছি মিসেস কামিনী আপনার সাথে থাকুক তবে আমি নয়!
ফিসফিসানি কথাটা আর কারো কানে পৌঁছালো। আফরা বিব্রতবোধ করলো। লোকটা ধুরন্ধর! আফীফ গলা কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মুচকি হেসে বললো,
~ ওকে, আই এগ্রি! হ্যাপি জার্নি। রিকুয়েস্ট একটাই মিসেস কামিনী বেগম কেমন থাকবে জানি না, আফীফ মুনতাসিরের মা যেন ঠিক থাকেন!
আর দাঁড়ালো না আফীফ, জিয়াউল কে দেখে এগিয়ে এলো। গাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল বের করে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে একপলক পেছনে তাকালো। কামিনী বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না আফীফ তাকে অচেনা কারোর হাতে ছেড়েছে। মায়ের দৃষ্টিতে আফীফ দুর্বোধ্য হেসে আফরা কে বাই জানালো! থতমত হয়ে বাই জানাতেও ভুলে গেল আফরা। ছেলেটার ব্যবহার আজিব লাগছে! এখানে আবার রহস্য নেই তো?
থানচি বাজার থেকেই সাকাহাফং পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। মানুষের বসতি পেরিয়ে ক্রমশ পাহাড়ি ট্রেইল। পাহাড় ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই এখানে। কেবল পার হতে হবে দানবের মতো এক এক পাহাড়, অতিক্রম করতে হবে অবকতা মেশানো অনুভূতি গুলো। বসতি মনুষ্যহীন এমন জনপথে সঙ্গী কেবল পাহাড়ের কালো-সাদা মেঘ, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি, জুমের ক্ষেত, সবুজ ঘ্রাণ আর পাহাড়ি ঝিরির মিষ্টি জল! আহা দৃশ্য। কেবল ই মনে হবে হাজার বছর থেকে যাওয়া যাক প্রকৃতির কোলে! আফীফের চোখে মুখে অদ্ভুত এক দ্যুতি লক্ষ্য করছে জিয়াউল। সাকাহাফং পর্বত দেখার উত্তেজনায় নাকি অন্যকিছু টের পেলনা। হঠাৎ করে তার নজরে চাষকৃত কিছু ফসল পড়তেই অবাক হলো সে। চিনে এগুলো কে, তবে মনে পড়ছে। আফীফ আনমনেই বললো,
~ জুম চাষ! এটি পাহাড়ের গায়ে ঢালু এলাকায় জঙ্গল কেটে, পুড়িয়ে জমি তৈরি করে চাষ করা হয়। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এর প্রচলন। মানুষ জীবন ধারণের জন্য কত কিছুই না করে!
গাইড তাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। কিছুটা পথ হাঁটার পর গাইড আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লো। মোটা কন্ঠে বললো,
~ জনাব থানচি ক্যাম্পে নিজেদের নাম-ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। আসুন আমার সাথে!
আফীফ জানতো বিষয়টা তবে আনমনা ভাবনায় খেয়াল করেনি। নাম-ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করে আবার হাটতে লাগলো তারা। পায়ে ট্র্যাকিং সু থাকায় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আফীফের চোখ মুখে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য হলো। নগর সভ্যতাহীন এক অন্য কোনো জনপদের দৃশ্য তার সম্মুখে। অরণ্যের পথে পথে নানান প্রজাতির কীট পতঙ্গ! বুনো প্রজাপতি, রঙ বেরঙের প্রজাপতির ঝাঁক ছুটে চলছে মধু খুঁজতে। ক্যামেরায় বন্দি করার পর আফীফের ইচ্ছে হলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়ার। হাত বাড়িয়ে দিতেই কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে গেল হাত ছুঁয়ে। আফীফের মনে হচ্ছে এ যেন দমবন্ধ কর অনূভুতি! আফীফের রিয়েকশন দেখে গাইড মুচকি মুচকি হাসছে। এ পর্যন্ত যাদের কেই এখান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তারা এখানেই থাকার পরিকল্পনা করে বসতো। প্রজাপতি ছোঁয়ার লোভ হয়তো সামলাতে পারতো না। তবে এই ছেলেটির মাঝে মুগ্ধতা থাকলেও তেমন কোনো মনোভাব পেল না। আবার হাঁটতে শুরু করলো তারা। ক্লান্তি যেন তাদের ছুঁতে পারে না।
অচেনা পতঙ্গ গুলো কিলবিল করছে অরণ্য জুড়ে। আফীফ শান্ত চোখে দেখলো সব। তবে যখনি বিলুপ্ত প্রায় পাখির ঝাঁক উড়ে যেতে দেখলো চোখের সম্মুখে আফীফের চোখ, মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। কিছুটা চিৎকার করেই বলে উঠলো,
~ শুনেছো গো দুর্লভ পাখির ঝাঁক, খবর দিও আফীফ মুনতাসির এসে গেছে!
গাইডের মস্তিষ্কে কিছু না ঢুকলেও জিয়াউলের রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো। মুখশ্রী তে অদ্ভুত গাম্ভীর্য ফুটে উঠলো। খবর কি পৌঁছে গিয়েছে?
শুনশান বাতাসের শব্দ, নানান রকম অচেনা রহস্য, মুগ্ধতা পবর্তঘেরা পরিবেশের চিরকালীন সঙ্গী! এসব না থাকলে হয়ত এত দীর্ঘ ট্র্যাকিং একঘেয়েমি চলে আসতো। তবে সাথে যদি নিজের পরিবার থাকে দুর্গম পাহাড়ি পথটাও সরল হয়ে উঠে। মিহির হাত মুঠোয় পুরে হাটছে আহিশ। মনিরা পিছু পিছু হাঁটছে। হুট করে সালেহা বেগম যে বেঁকে বসবে কে জানতো। তার নাকি নীলাচল ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও যখন আহিশ মানছিল না পা ব্যাথার অযুহাত টা ঠিক কাজে লাগলো। থেকে গেলেন নীলাচলে। শাশুড়ির অনুপস্থিতে মনিরা যখন গড়িমসি করছিলো; আহিশ এক ধমকে বলেছিল,
~ এই মেয়ে যাবে না মানে? আমি কি একা একা ঘুরতে এসেছি? তাড়াতাড়ি রেডি হবে, সময় খুব কম!
মনিরা আর না করার সাহস পায়নি। এই ছেলেটার সামনে তার কি হয় সে বুঝতে পারে না। নতুন অভিজ্ঞতার সাথে মনিরা’র মন যে নতুন অনুভূতি তে ঠাসা হয়ে আছে মনিরা ঢের বুঝতে পারছে। সেই মনের বশীভূত হয়েই তো বারবার সামনে হাঁটা পুরুষ টির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। বাবার হাত ধরে মেয়ে হাঁটছে। মনিরা’র খুব ইচ্ছে করছে মিহির হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে শূণ্যতা টাকে পূর্ণতা দিতে। সাময়িক পূর্ণতা যে তাকে অসীম সুখ দিবে! সাহসে কুলায় না। চুপচাপ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সেই সাহস মিহি এক ছুটে করে ফেলে। পেছন ঘুরে মায়ের হাত ধরে আহিশের বরাবর দাঁড় করিয়ে দেয়। থতমত খেয়ে যায় মনিরা। আহিশ ভাবালেশ হাঁটতে থাকে। মনের কোণে পাহাড়ি বাতাসের ঢল নেমে আসে রঙিন অনুভূতি নিয়ে। মনিরা কিঞ্চিৎ সময় আহিশ কে দেখে হাঁটায় মন দেয়। ঠোঁটের ভাজে লুকানো প্রেমের ছোঁয়া শরীর যেন জ্বলে যায়!
অর্ধ পঁচা অর্ধনগ্ন লাশ! মাছি ভনভন করছে সারা শরীরে। কি এক বিশ্রী গন্ধ। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে আদিল। মুখে মাস্ক, চোখে কালো সানগ্লাস। কেউ ই মুখের ভাবাবেগ ঠাহর করতে পারছে না। লাশের আশেপাশে কয়েকজন সাদা এপ্রোন পড়া লোক বসে আছে। খুঁতিয়ে দেখছে। কপালের একপাশে কি যেন লেখা। একজন দেখেই দৌড়ে এলো আদিলের কাছে। দৃষ্টি নত। বললো,
~ লাশের কপালে কিছু লেখা আছে স্যার। আপনি দেখবেন নাকি আমিই বলবো?
আদিল উত্তর দিলো না। হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই বিশ্রী গন্ধটা নাকে মুখে ঢুকে গেল যেন। নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে বলেই হয়তো পেটে চালান হলো না। নয়তো এই গন্ধে টিকে থাকা মুশকিল হতো। কিছুটা ঝুঁকে সানগ্লাস খুলে নিলো আদিল। মাঝারি অক্ষরে কিছু লেখা। লোহা পুড়িয়ে খুদায় করেছে। মুচকি হাসলো আদিল। ঝুঁকানো মাথা শটান হতেই পিছিয়ে এলো সে। গম্ভীর কন্ঠে নির্দেশ দিলো,
~ পাহাড়ের বুকে চাপা দিয়ে চুপচাপ ক্ষনিকের স্মৃতি টুকু মুছে ফেলবেন! নচেৎ আদিল মাহমুদ মানুষ ভালো না!
শেষের কথাটা বলেই কিটকিটিয়ে হেসে প্রস্থান করলো আদিল। ঘরে ঢুকে মাস্ক খুলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। গোসল না করলে এই গন্ধ নাক থেকে সরবে না মনে হয়। গোসল সেরে সারা রুমে সুগন্ধি স্প্রে করে দিলো। ইজি চেয়ারে বসে খানিকক্ষণ চুপ থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করলো। আপন ভাবনায় ব্যস্ত থেকে ধরানোর সুযোগ পেল না। নেত্রপল্লবে ভাসছে দু লাইনের লেখা টা। আদিল বিড়বিড় করলো,
“আমি সাদা কন্যা
ভাসাই রক্তের বন্যা!”
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৮+২৯
কে হতে পারে? আদিল এক ছুটে ধরতে পারলো না। ‘কন্যা’ আছে বলেই নিমিষেই মেয়ে ধরে নেওয়া মস্তিষ্ক তার নয়! আদিলের মনে হচ্ছে, খেলাটা এবার সত্যিই জমে উঠেছে। তবে সে এখন এসব ভাবতে চায় না। আজকের রাতের যাত্রা শুরু করবে সে, কবে শেষ হবে জানে না। ফিরে এসে নাহয় ভাববে। ততক্ষণ নিজেকে সময় দেওয়া যাক! দেখা যাক ভালো কিছু নিজের মধ্যে পায় নাকি বাবার থেকেও বড় হারামি নিজেকে আবিষ্কার করে! আপন ভাবনা যে কথা কয়!