হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩
Tahrim Muntahana

~ এখানে বসুন ভাবী, আমরা চলে যাচ্ছি, এই চল তোরা!
বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে আফরা। এটা কোন ধরনের খেলা! এরকম সম্বোধন নিয়ে কে খেলছে তার সাথে? দুটো ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরী তে এসেছিল সে। ক্লাস দুটোও ভালোভাবে করতে পারে নি, সহপাঠীরাও তাকে ভাবী ভাবী করছে! এমতাবস্থায় ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা দুঃসহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্লাস শেষ হতেই কোনোরকম গাঁ বাঁচিয়ে লাইব্রেরী তে কেবল পা রেখেছে। এর মধ্যেই জুনিয়র একজন ছেলে কথাটা বলে উঠলো। বিরক্তির সাথে আফরা রাগ টের পেল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলে-পেলে গুলোকে পরখ করে বললো,

~ এই দাঁড়ান। একদম উঠবেন না! কার নেতৃত্বে এসব হচ্ছে? কে ভাবী ডাকতে বলেছে? আর এই সরকারী ভাইয়া টাই বা কে?
ছেলে-মেয়ে গুলো এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে‌। আফরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েই র‌‌ইলো। একজন ছেলে মিনমিন করে বললো,
~ আমাদের তো কয়েকটা বড় ভাই এসে বললো, আপনাকে ভাবী ডাকতে, আর কোনো রকম সমস্যা যেন না হয় তাই দেখতে!
চোখ বুজে শ্বাস ফেললো আফরা। মস্তিষ্ক তার একটা নাম‌ই ইশারা করছে, নাদিয়া! এই মেয়ে ছাড়া এমন কেউ করবে না? কয়জন মানুষ চেনে তাকে? দৃষ্টিটা স্বাভাবিক করে বললো,
~ জাস্ট আপু বলবেন। পরিবর্তে ভাবী শুনলে একটাকেও আস্ত রাখবো না বলে রাখলাম! পড়াশোনা করতে এসেছেন, কারো হুকুম পালন করতে না!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর এক মুহূর্ত‌ও দাঁড়ায় না আফরা। যে কারণে লাইব্রেরী তে এসেছিল কাজটা সম্পন্ন করেই লাইব্রেরী ত্যাগ করে। ছেলে-মেয়ে গুলো অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েটির যাওয়ার দিক তাকিয়ে রয়। মেয়ের ঝাঁঝ অন্যরকম! এই মুহূর্তে তাদের মাঝ নদীতে সাঁতার কাটার মতো মনে হচ্ছে, এক তীরে বাঘ দাঁড়িয়ে আছে তো আরেক তীরে সিংহ! যে তীরেই যাবে না কেন, শিকার তাদের‌ই হতে হবে। কে জানে আবার কুমিরের ভয় আছে নাকি! ছেলে-মেয়ে গুলো আবার নিজেদের আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর আফরা সে তো তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলছে নাদিয়া কে। আজ একটা উচিত শিক্ষা দিবেই সে! মেয়েটির সাহস দিনদিন কেমন বেড়ে চলছে! নাদিয়া কে পেল ভার্সিটির শেষ মাথায়। এক‌ ঝটকায় বসা থেকে দাঁড় করিয়ে শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলো। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো নাদিয়া। আফরা’র মাঝে তেমন ভাবান্তর দেখা গেল না‌। শক্ত হাতের থাবা আরেকটু শক্ত করে বললো,

~ বলেছিলাম না? আমার শরীর তোমার মতো নরম নয়, খাপ খাওয়াতে পারবে না! এবার বুঝলে তো?
ব্যাথা মিশ্রিত মুখশ্রী এক নিমিষেই যেন গায়েব হয়ে গেল, নাদিয়ার ঠোঁটের‌ কোণে ফুটে উঠলো মিষ্টি এক হাসি। তবে আফরা’র কাছে সেটা বিষ ছাড়া কিছু লাগলো না। হাতের থাবা নরম হয়ে এলো। নাদিয়া নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে বললো,
~ সমস্যা কি বলো? নরম জিনিসে শক্তের প্রভাব পড়লেই তো শক্ত হয়ে উঠবে‌। আমার যে শক্ত হয়ে উঠাটা জরুরি!
~ আমিই কেন নাদিয়া? পরিবারহীন, চালচুলোহীন এক মেয়ে আমি, যার আপন বলতে কেউ নেই! তাকেই কেন তোমার ভাইয়ের জন্য পছন্দ হলো? দেশে তো মেয়ের অভাব পড়ে নি!
~ কারণ টা গোপন থাক! অন্য কোনো দিন! তবে হঠাৎ এত রাগের কারণ?
~ তুমি বুঝতে পারছো না? নাকি না বুঝার ভান করছো? সবাই কে তুমি বলেছো আমাকে ভাবী ডাকতে? নাহলে কেন ডাকবে? তোমার ভাই কে?
আফরার কথায় ভ্রু কুঁচকালো নাদিয়া। সে বলেছে? ক‌ই? অবাক হয়ে বললো,

~ আমি কাউকে বলি নি। বিশ্বাস করো, কাউকে বলিনি ভাবী ডাকতে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আবার কোন ভাইয়ের উদয় হলো। তুমি কিন্তু আমার ‌ই ভাবী হবে! নাহলে তোমার জীবনের ইতি টানতেও আমার মিনিট সময় লাগবে না!
কেঁপে উঠলো আফরা। মেয়েটা তাকে হুমকি দিচ্ছে? জীবন নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে? সে কি মৃত্যকে ভয় পায়? হৃদপিন্ডটা যেন চিৎকার করে বলছে, ‘তুই ভয় পাস আফরা, তুই সত্যিই খুব ভয় পাস মৃত্য কে। নাহলে তোর হৃদয় কাঁপবে কেন? কেন বুকে চিনচিনে ব্যাথা করবে?’ দৃষ্টি নরম হয় আফরার, নাদিয়া হেসে উঠে। হাসিটা তাচ্ছিল্য‌ই বটে। একসময় হাসির শব্দ টা বাড়তে থাকে,

~ কি ভয় পেলে আফরা? উফফ সরি ভাবী! আমি তোমার একমাত্র ননদ ভাবী, আমাকে কেন ভয় পাবে? তোমার আমার‌ সম্পর্ক তো মধুর হবে!
আফরা ছুট লাগায়, দৌড়াতেই থাকে, এক দৌড়ে ভার্সিটির গেইট দিয়ে বাইরে চলে আসে। হাত পা কাঁপছে তার। এই মুহূর্তে নাদিয়া কে তার সাইকো মনে হচ্ছে, যার পাগলামী তে তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে তো জীবন টা এভাবে শেষ করে দিতে চায় না, তার যে বৃহৎ এক ইচ্ছে আছে!
আফরার এমন দৌড়ে যাওয়া দেখে নাদিয়ার মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। উল্লাসে ফেটে পড়ে সে। এই ভয়টাই সে দেখতে চেয়েছিল। ভাবী বানাবে! তবে তার অভিভাবক নয়! মেয়েটাকে বুঝতে হতো সে কার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছে! নাদিয়া মাহমুদ ছাড়ার পাত্রী নয়! তার চোখ যে জহুরির চোখ, যা বা যাকে চোখে পড়ে এবং ভালো লেগে যায় তার নিস্তার নেই! যতক্ষণ না সে চাইবে!

অনল মাহমুদ! মস্ত বড় হার্ট স্পেশালিস্ট! ক্যারিয়ার জীবনে ছোট খাটো হুটহাট কেইস ব্যতিত আর কোনো কেইসেই অসফল তিনি হননি। এর জন্য তার অবশ্য ডিমান্ডের খামতি নেই। সুযোগটা লুফে নিতেও সময় ব্যয় করেন না তিনি। যেখানে পঞ্চাশ হাজারে কাজ হয়ে যাবে সেখানে লাখ লাখ টাকা ডিমান্ড করে আজ সে এতদূর, তার মালিকানায় আজ দেশের মস্ত বড় তিনটা হসপিটাল। অবশ্য লাখ টাকা ডিমান্ড তা কেবল টাকা ওয়ালাদের কাছেই, গরিবদের কাছে তো সে মানবতার এক অপার মাধ্যম। কপালে অনেক মানুষের দোয়া তার জুটেছে, আবার অনেক মানুষের অভিশাপ ও। সেসবে সে কান বা চোখ কোনোটাই দেন না। প্রয়োজন ই পড়ে না, দিব্যি তো জীবন চলে যাচ্ছে! নিজের কেবিনেই বসে ছিলেন তিনি, পাশেই স্ত্রী মিসেস নুরি। ব্রেক টাইম কাটাচ্ছেন দুজন। লাঞ্চ সেরেই আরামে চোখ বুজেছেন দুজন। হাতের মুঠোয় হাত, শক্ত তার বাঁধন। আহা ভালোবাসা! হসপিটালে ভালোবাসার আইকন হিসেবে বেশ আলাপও হয়। দুজন তখন মুখোমুখি হাসে, হাসিটার অর্থ সবাই আনন্দেই কাটিয়ে নেয়, বুঝার কি আছে? হুট করেই বন্ধ চোখের পাতা খুলে মিসেস নুরি বললেন,

~ ছেলেটাকে এখন বিয়ে করানো উচিত। বয়স তো কম হলো না।
অনল মাহমুদ চোখ বন্ধ করেই হাসলেন। বললেন,
~ সেসবে তোমার মন দিতে হবে না, তুমি মন দাও আমার দিকে। সবাই কে সবটা ভাবতে হয় না!
মিসেস নুরির মুখটা ছোট হলো, মলিন হলো। ভাবতে হয় না? নাকি ভাবতে মানা?
অনল মাহমুদ চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন, মিসেস নুরিও মুখে হাসি ফুটালেন। সে হোক জোর করে, হোক ইচ্ছে করে! অনল মাহমুদ বললেন,
~ তোমার একমাত্র কাজ‌ই হলো আমাকে সময় দেওয়া, আমাকে নিয়ে ভাবা, আমার সাথে সাথে থাকা। তুমি কেন ছোট খাটো বিষয়ে মন দিবে?
~ আচ্ছা বাবা, আর সেসব ভাববো না।
দুজনেই একসাথে হেসে উঠলেন। এমন ভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন টিনেজ বয়সে সদ্য প্রেমে পড়ার ফিলিংস উপভোগ করছেন দুজন।

হাতের মুঠোয় আজ দশ টাকার চিপস। মেয়েটা তাকে কাল বলে দিয়েছে চিপস নিয়ে যেতে। প্রতিদিন নাকি তার ওই পাঁচ টাকার লজেন্স খেতে ভালো লাগে না। আফরার তখন শক্ত গলায় কিছু কথা শোনাতে ইচ্ছে হয়েছিল। তবে কি বুঝে যেন চুপ থেকে সায় দিয়েছে। অগত্যা তাকে আরো পাঁচ টাকা বেশী খোয়াতে হলো। এখানেই হয়তো ধনী গরীবের তফাৎ। গরীবের কোনো ছেলে-মেয়ে কে যদি সে প্রতিদিন এমন লজেন্স দিত, হয়তো খুশিতে চিকচিক করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকতো, সাহস করে বাড়িয়ে আনার কিছু বলতো না, কারণ তাদের জানার পরিধি তো ওই পাঁচ টাকার লজেন্সেই! অথচ ধনীর দুলালি বাহারি খাবার গলাধঃকরণ করে, তাদের কি আর প্রতিদিন এই পাঁচ টাকার লজেন্স চলে? গেইট পেরিয়ে আফরা বাড়িতে ঢুকে। ভার্সিটি থেকে আগে চলে আসায় আজ একটু শপিংয়ে গিয়েছিল সে, টুকটাক বাজার করে বাড়িতে রেখে তারপর এসেছে।

তাই একটু দেরী হয়েছে। না জানি মেয়েটা আজ তাকে কেমন সময়ের জ্ঞান দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিবে, ভেতর থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। থরথর করে কেঁপে উঠে আফরা। হাত থেকে চিপসের‌ প্যাকেট পড়ে যায় মাটিতে। এলোমেলো পায়ে দৌড়ে রান্নাঘরের জানালার ধারে দাঁড়ায়। বেশ‌ বড় জানালা টা। উঁকি দিতেই ড্রয়িং রুমের দৃশ্য নয়ন যুগলে এসে বারি খায়। চোখ বুজে নেয় সে! এ কেমন বাড়ি? তার আর কি কি জানার আছে? এ বাড়ির মানুষ গুলো আদ‌ও মানুষ তো? জানালা থেকে সরে আসে। মন চাইছে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে। আবার বিবেক যেন বাঁধা দিচ্ছে। বলছে তাকে ভেতরে যেতে, হয়তো সে কলিং বেল টা চাপলেই মেয়েটা বিপদ থেকে রক্ষা পাবে! নিজেকে ঠিকঠাক করে চিপসের‌ প্যাকেট টা আবার হাতে তুলে নেয়।‌ কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেল চাপতেই ভেতরের ‘ছেড়ে দাও, কাছে এসো না’ আর্তনাদ থেমে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আফরা। দূর থেকেই আজ কোনো মেয়ে কে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে পেরে মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে আফরার। দরজা খুলার শব্দ। কারোর তীক্ষ্ম দৃষ্টি তার উপর, ইতস্তত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকে আফরা। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আরাফ বলে উঠে,

~ আজ সুন্দরীর এত দেরী হলো? টাকা কি এমনি এমনি দেওয়া হয় নাকি?
সহ্য হয় না আফরার। একজন ধর্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে এমনিতেই তার শরীর ঘিনঘিন করছে তার উপর এমন কথা। অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
~ টাকা টা নিশ্চয়ই আপনি দিচ্ছেন না! পথ থেকে সরুন।
~ সরবো না কি করবে? যাও দেখি!
গাঁ জ্বালানো হাসি দিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ায় আরাফ। রাগ হয় আফরার। মাথা উঁচু করে ড্রয়িং রুমে দৃষ্টি ফেলে। শাড়ির আঁচল আগলে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিহির মা মনিরা। তার আসতে একটু দেরি হলেই হয়তো আজ এই মেয়েটা দেবর দ্বারা ধর্ষিত হতো! এগিয়ে এসে আরাফের মুখোমুখি দাঁড়ায় আফরা। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরাফের পায়ের উপর হিল জুতোর শক্ত লাথি বসিয়ে হিসহিস করে উঠে,

~ আমি সুন্দরী, আমি রুদ্রমূর্তি! লাগতে আসিস না, রূপের তোপে পুড়ে ছাই হয়ে যাবি।
পা ধরে লাফাতে থাকে আরাফ। চোখ মুখে ব্যাথার ছড়াছড়ি। আফরা হেসে এগিয়ে যায়। মনিরার হাত ধরে উপরে চলে যায়। সে ভিতু, তবে এতটাও নয়! নিজের সম্মান কিভাবে রক্ষা করতে হয় সে জানে! মনিরা অবাক চোখে মেয়েটিকে দেখে যায়। এতদিন সে মেয়েটিকে ভিতু জানতো, পরপর কয়েকদিন সে বাঁচিয়েছে মেয়েটিকে, আজ সেই ভিতু মেয়েটি তাকে বাঁচালো! আফরা মনিরার দিকে না তাকিয়েই বুঝে যায়, নরম সুরে বলে উঠে,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২

~ মুখ বুজে সব সহ্য করলে আত্মচিৎকার গুলো ঘরের মাঝেই মিলিয়ে যাবে, শক্ত হন আপু। এমন শক্ত হন, বিপরীত মানুষটার আত্মচিৎকার যেন আপনাকে আনন্দ দেয়!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪