হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৫+৬৬

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৫+৬৬
Tahrim Muntahana

ভোরের সোনালী সূর্য জেগে উঠেছে। প্রকৃতি তে নেমে এসেছে সোনালী আভা। মাঠ ঘাট আজ স্নিগ্ধ, মনোরম। নির্মল হাওয়া গাঁয়ে দোলা দিয়ে যায়। শহরের ভারিক্কি ভাব ছাড়িয়ে গ্রামের কাঁচা মাটির রাস্তা শরীরে নির্মল উষ্ণতা এনে দিচ্ছে। মাটির গন্ধ মনের দুঃখ লুকাতে তৎপর। সাঁকো পাড় হয়ে সরু রাস্তায় পা দিয়ে আহিশ চারপাশ দেখে নেয়। দুটো রাস্তা দুদিক চলে গেছে। সে ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে গেলে নিজের অচেনা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে ধরতে পারছে না।

একটু পরে হয়তো এই কোলাহলহীন স্থান থাকবে না; কৃষক হাত মুখ ধৌত করে পান্তা ভাত বা রুটি গান্ডে পিন্ডে গিলে তাড়াহুড়ো তে চলে আসবে নিজের জমিতে। হাঁকডাক করে শুরু হবে আয়োজন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও আহিশ কাউকে খুঁজে পেল না সাহায্য করার। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে এগিয়ে গেল কাঁচা মাটির সেই টিনের চালের বাড়ির দিকে। মোরগ ডেকে চলছে ঘুম ভাঙাতে। বৌ ঝি দের টুকটাক সুখ দুঃখের আলাপ ভেসে আসছে আহিশের কানে। সাহস করে এগিয়ে যায়। এত ভোরে অচেনা এক যুবক কে নিজ বাড়ির উঠোনে থেকে আঁতকে উঠেন মহিলা। এগিয়ে আসেন ক্ষীণ মেজাজে। মহিলা কিছু বলার আগেই আহিশ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
~ রমিজ.. না এই গ্রামের রমিজদা’র বাড়ি কোন দিকে বলতে পারবেন? বা সালাউদ্দিন মাষ্টারের বাড়িটা?
মহিলার ক্ষীণ মেজাজ আর ক্ষীণ থাকে না‌। অবাকতার নিকট হেরে গিয়ে প্রশ্ন করেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ তুমি কেডা? ক‌ই থিকা আইছো?
~ আমাকে চিনবেন না, আমি শহর থেকে
এসেছি। ঠিকানা টা বললে উপকার হতো।
আহিশের গম্ভীর কন্ঠস্বর। মহিলা খানিক ভড়কে গেলেন।‌ কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বাড়ির ছোট্ট সদস্যকে ডেকে বলে উঠলেন,
~ বাবু, উনারে একটু মাষ্টারের বারি দেখাই দিয়া আয়।
ডাক শোনা মাত্র ছুটে আসে ছেলেটি। পড়তে বসেছিল, ঠিক মন বসছিল না।বাহানা খুঁজে চলছিল সে, সুযোগ তার এমনি এমনি নিকটে চলে এলো‌। খুশি যেন ধরে না। আহিশ মহিলাদের কিছুই বললো না। ছেলেটার পিছুপিছু হাঁটতে শুরু করলো‌। অর্ধেক পথ গিয়ে বললো,

~ রমিজ আংকেলের বাড়ি কোথায়? আগে সেখানে নিয়ে যাও বাবু।
ছেলেটা আড়চোখে তাকালো। কথা বললো না। গাঁ ছাড়া এক ভাব নিয়ে হাঁটতে লাগলো। ঘাস, পাতা, আবর্জনায় ভরপুর বাড়িটা। অনুভূতি হীন এগিয়ে গেল আহিশ। ছেলেটা চোখে মুখে কেমন উৎফুল্ল ভাব ফুটে উঠেছে‌। আহিশ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললো,
~ রমিজদা কে আপনি চেনেন? আব্বায় বলতো তারা যখন ছোট ছিল, রমিজদা তাদের খুব প্রিয় ছিল। সারাদিন নাকি ট‌ইট‌ই করে ঘুরতো, এখানে সেখানে আসর জমাতো। লজেন্স কিনে রাখতো বাচ্চা দের জন্য। যেদিন রমিজদা মরলো সেদিন নাকি পুরা গ্রাম কাঁদছিল। আমি তখন থাকলে লজেন্স আমিও পেতাম না?
বাচ্চা দের যেমন টা আবদার থাকে। আহিশ মুচকি হাসলো। এগিয়ে গেল ভাঙাচোরা ঘরটাই। দরজায় অনেক পুরোনো তালা ঝুলে আছে। তার পাশেই সুন্দর এক নেমপ্লেট! বিস্মিত হলো আহিশ, এমন বাড়িতে এত সুন্দর নেমপ্লেট! চোখ রাখলো ভালো করে। লেখা ছিল,

“রমিজদা ও তার সালুর ভালোবাসা’র সংসার”
পুরুষ তো খুব সহজে ভেঙে পড়ে না, তাহলে আহিশের কি হয়েছে? চোখ তার ছলছল করছে কেন? ছেলেটা আহিশের দৃষ্টি অনুসরণ করে বললে,
~ এটা পাড়ার ক্লাব থেকে লাগিয়েছে। তারা নাকি প্রেম করে বিয়ে করেছিল!
ছেলেটা কথাটা শেষ করেই মুখে হাত চেপে হাসলো। তাদের কাছে শব্দ টা হাস্যকর বটেই। কেমন লজ্জা পায়। আহিশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
~ ক্লাব থেকে কেন লাগিয়েছে?
~ যেদিন এটা টানালো সেদিন আমাদের ক্লাবের নতুন মেয়ে এসেছিল। সে বলেছে, সেসময় গ্রামের মেয়ে গুলো বাড়িতেই থাকতো, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বের হতো না। প্রেমে পড়া নাকি গ্রামের মানুষ খারাপ চোখে দেখতো। সে সময় রমিজদা আর সালুর প্রেম করে বিয়ে করে। তাদের সংসার সবাই দেখতো, এমন কি আব্বা রা যখন একত্র হয়, তখন‌ও রমিজদার কথায় আলোচনা করে। কত আফসোস করে। ওই মহিলা বলছে, তাদের এই ভালোবাসার সংসার কে সম্মান জানিয়ে এটা করেছে। আমিও ছিলাম, কয়েক জন মহিলা কেমন কাঁদলো। আমার তো মজা লাগে।

আরেকবার তাকালো আহিশ নেমপ্লেটের দিকে। ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নিল। গ্রাম যে আর পিছিয়ে নেই এটাও তার প্রমাণ। বহুদিনের ঝরে পড়া ভালোবাসা কে এরা কি সুন্দর জিইয়ে রেখেছে। ডান হাত হুট করেই বুকের বাম পাশে চলে গেল। ঢলে নিল বুকটা। চিনচিনে ব্যাথাটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেকে ঠিক করে আহিশ বললো,
~ তোমার বয়স কত?
~ বারো বছর!
~ তোমাদের রমিজ’দার কবর টা কোথায়?
~ ওই যে!
আঙুল উঁচিয়ে সামনে দেখালো ছেলেটি। আহিশ ফট করেই তাকাতে পারলো না। ধীর গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। বাঁশ দিয়ে বেড়া দেওয়া কবরটার গাঁয়ে জন্মেছে অনেক ঘাস। কেমন আড়াল করে রেখেছে মাটি গুলোকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল আহিশ। উবু হয়ে বসে ছুঁয়ে দিল কবর। সর্বাঙ্গে কেমন কাঁপুনি বয়ে গেল। ছেলে টি অদ্ভুত চোখে আহিশ কে দেখছে। ঠিক বুঝতে পারছে না এমন কেন করছে। আহিশ কিছুক্ষণ বসে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
~ মাষ্টারের বাড়ি চলো।

মাথা নাড়িয়ে ছেলে টি আবার হাঁটা ধরলো। পাল্টে গেছে গ্রাম। টিনের চাল খুব একটা দেখা যায় না। বিল্ডিং গড়ে তুলেছে। বড় স্কুল হয়েছে, কলেজ হয়েছে, ক্লাব হয়েছে। বড় রাস্তার কাজ চলছে, হয়তো রাস্তার কাজ শেষ হলে বাস স্ট্যান্ড ও হয়ে যাবে। কত উন্নত! ছেলেটি গিয়ে থামলো পুরোনো এক বাড়ির সামনে। গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই হাঁক ছেড়ে বলে উঠলো,
~ স্যার বাড়ি আছেন? শহর থেকে একজন দেখা করতে আসছে।
দু একবার ডাকার পর যুবতি এক মেয়ে বেরিয়ে এলো। পড়নে শাড়ি, কোমরে আঁচল গুঁজে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে বললো,

~ কে আসছে? ও মারুফ তুমি? কে উনি?
ছেলেটি কিছু পারলো না। পূর্বেই আহিশ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
~ রমিজদা ও তার সালুর ছেলে!
দুজন মানুষ স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে র‌ইলো শহুরে ছেলেটির দিকে। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না হয়তো! যুবতি স্তব্দতা কাটিয়ে হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ আপনি আমাদের সালুর ছেলে? রমিজ দার ছেলে? কি নাম রাখছিল মনে হয়, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, আহিশ তাইনা?
পরক্ষণেই বাড়ির লোকজন কে ডেকে উঠলো যুবতি,
~ ক‌ই গো কে আছো এদিকে আসো। দেখে যাও কে আসছে। আমাদের রমিজদা, সালুর ছেলে আসছে গো। তাড়াতাড়ি আসো, দেখে যাও।

যতটুকু বিস্মিত হ‌ওয়ার আহিশ পূর্বেই হয়ে নিয়েছে। এখন আর নতুন করে কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। তার বাবা -মার নামের চর্চা যে প্রাপ্তির পরেও অপ্রাপ্তির সংসারের ফলেই হয়; বেশ বুঝতে পারছে। মুহুর্তেই খবর টা বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে গেল পুরো গ্রাম। বিস্ময় হতবাক গ্রাম বাসী দলে দলে চলে এলো দেখতে। যাদের তেমন আগ্রহ‌ও নেই তারা জমকালো খবরের সামিল হতে চলে এসেছে। এরকম তো আর প্রতিদিন হয় না! সালেহা বেগমের চাচাতো ভাই এসে আহিশ কে ঘরে নিয়ে যান। মন কে দমাতে না পেরে বলে উঠেন,

~ তুমি আসলেই আমাগোর সালেহার ছেলে? ছোট্ট আহিশ? সেবার যখন বাড়ি আসলা মায়ের কোলে করে। তোমার মা আমারে দেখাইয়া বললো, ওইটা তোমার মামা হয়! তোমার মনে আছে? এই দেখ আমি কি সব বলতাছি! তুমি তো তখন ছোট ছিলা, মনে থাকবো কি করে?
আকস্মিক উত্তেজনায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। আহিশ এরকম ঝামেলায় জড়াতে চাইলো না। শুধু নিম্ন স্বরে বললো,

~ আমি একটু জামাকাপড় ছাড়বো! ব্যবস্থা করা যাবে?
~ করা যাবো না মানে? আরে আসো আসো! তোমার নানা বাড়ি এইডা‌‌। কোনো সংকোচ করবা না।
তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ঘরের দিকে যেতে যেতে কাউকে ডেকে বলে উঠলেন,
~ ক‌ইরে শিল্পী চাচারে খবর দে। তার নাতি আসছে।‌
ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে আহিশ বের হয়। সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে আজ, নতুনত্ব ফিরে এসেছে যেন। বের হয়েই বসার ঘরে বৃদ্ধ একজন কে দেখে বুঝে নেয় এটা তার মায়ের বাবা। তার নানা! এগিয়ে যায়, নিম্ন কন্ঠে সালাম জানাতেই বৃদ্ধ চশমাটা ভালো করে পড়ে নেন। তাকিয়ে থাকেন অপলক। একসময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন আহিশের হাত ধরে। কতশত আহাজারি। অভিমানী মেয়ে তার মুখ যে ফিরিয়ে নিয়েছে, আর এদিক পা মাডায় নি। আহিশ জানে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই, চুপ করে আছে সে। সালাউদ্দিন মাষ্টার অনেকটা সময় মনের কথা ব্যক্ত করেন, নিশ্চুপ শ্রোতার মতো আহিশ শুনে যায়। তার ঔষধ খাওয়ার সময় হতেই যুবতি মেয়েটি তাকে ঘরে নিয়ে যায়। এই সুযোগে আহিশ উঠে দাঁড়ায়। ঘর থেকে বের হয়, কিন্তু বেশী দূর এগোতে পারেনা। আকস্মিক এতজন মানুষ দেখে খানিক কেঁপে উঠে সে। তাকে দেখা মাত্রই চাপা চিৎকার শোনা যায়। তারা বলাবলি করছে,
~ এইডাই রমিজের ছেলে, এইডায় সালেহার ছেলে? কত্ত বড় হ‌ইয়া গেছে দেখছো? এত বছর পর আইলো। কি সুন্দর পোলাডা।

আহিশের বেশ হাসি পায়। শহরে এর ছিটেফোঁটা দেখতে পাওয়া যেত না। পাশের ফ্ল্যাটে কি হয় তা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না শহরের মানুষ। অথচ গ্রামে কতটা ভিন্নতা। সেই কতবছরের একটা স্মৃতি কে তারা এখনো মনের মধ্যে ধারণ করে আছে। ছুটে এসেছে প্রিয় সেই মানুষের অংশ কে দেখতে। আহিশ কে দেখে কয়েকজন যুবক তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসে। তিন যুবতিও দৃশ্যমান। সরাসরি প্রশ্ন করে,
~ আপনি কি সত্যিই উনাদের ছেলে?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভড়কে যায় আহিশ। ভ্রু কুঁচকে উল্টো প্রশ্ন করে,
~ বিশ্বাস না করার কারণ?
এগিয়ে আসে এক মেয়ে। কন্ঠে আন্তরিকতা ধরে রেখে বলে,

~ আপনি কিছু মনে করবেন না। এই গ্রামে কিছু দিন ধরে গন্ডগোল হচ্ছে পাশের গ্রামের সাথে। বড় রাস্তার কাজ চলছে তাই নিয়ে। ব্যাপারটা অনেক বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে‌। আর আমাদের গ্রামে দু বছরের শিশুও মনে হয় রমিজদা সালু নামটার সম্পর্কে পরিচিত। তারা সেসময় যে উদাহরণ রেখেছে। পড়াশোনা না জানা, কুচকুচে কালো গাঁয়ের রঙ ধারী রমিজ দা কে সালু যেভাবে ভালোবেসেছিল; রমিজদা সালুর জন্য যা পাগলামি করেছে আমরা আমাদের বাবা, মা, দাদা, দাদি থেকেই শুনেছি। প্রথম দিকে তারাও হাসাহাসি করতো। এক পর্যায়ে সালুকে পড়াশোনা করানোর জন্য ভবঘুরে রমিজদা যখন কাজের পেছনে ছুটে চলে তখন গ্রামের সবাই আপ্লুত হয়। সংসার দেখে তৃপ্তি পায়। রমিজ দা মারা যাওয়ার পর সালুর যুদ্ধটাও বাঁধিয়ে রাখার মতো। আমরা আমাদের ক্লাবের মাধ্যমে এসব সহ বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে মেয়েদের পড়াশোনার দিকে অগ্রসর হ‌ওয়ার সাহস দিই।

বিয়ের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় সালু যদি পরীক্ষা দিতে পারে, এই সময়ের আধুনিক মেয়েরা কেন পারবে না? আমরা এখনের মেয়েদের এটাও শিক্ষা দিই অশিক্ষিত বলে সে আপনজন হ‌ওয়ার যোগ্য নয়, মনুষ্যত্ব বোধ তার কম এমন ভাবা ভুল। একজন ভালো জীবন সঙ্গী নির্বাচন তার প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা দিয়ে হয় না। বাবা-মা দের ও আমরা এই বিষয়ে সতর্ক করে দিই। আমাদের মাষ্টার যেমন মেয়ের ইচ্ছে কে গুরত্ব দিয়েছিল তারাও যেন ছেলে মেয়েদের ইচ্ছে কে গুরুত্ব দেয়। সত্যি বলতে রমিজ দা গ্রামের মানুষদের খুব প্রিয় ছিল‌। আসর বসলেই তার কথা আলোচনা হতো। আমরা এই দুর্বল পয়েন্টটাকেই ব্যবহার করে শক্ত ভীত গড়ে তুলেছি! তাই আমাদের ধারণা হতেই পারে যে কেউ আমাদের এই দুর্বল পয়েন্টটাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষতি করতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি ছিলেন তখন দুধের শিশু, আজ তাগড়া যুবক! আমাদের সেইফটির জন্য‌ই আপনার কাছে প্রমাণ চাওয়া!

আপ্লুত আহিশ। গ্রামের ছেলে মেয়েরা যে এমন একটি সুন্দর উদ্যোগ নিয়েছে আহিশ খুব আনন্দিত। তার প্রেমপিয়াসীর যে খুব ইচ্ছে ছিল তার গ্রামের ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার। তা আর হলো কই। চাপা শ্বাস ফেলে আফীফ নিজের ফোন বের করলো। অনেকগুলো ছবি আছে কিন্তু সে সরাসরি মা কে ভিডিও কল দিলো। শাশুড়ি ব‌উমা মিলে গল্প করছিল। ছেলের ভিডিও কল পেয়ে অনেকটা অবাক হোন সালেহা বেগম। রিসিভ করে ধরতেই আকস্মিক দাঁড়িয়ে যান তিনি। শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কিছুটা সময় যে বাড়িতে পার করলো সে বাড়ি চিনতে তাঁর ভুল হবে কি করে? আহিশ মুচকি হেসে সেলফি ক্যামেরা অন করে। বলে,
~ আম্মু, রমিজদা আর সালুর সন্তান দেখতে এসেছে তারা!

কেটে দিলেন ফোন। আহিশ নিশব্দে হাসলো। পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে উঠলো যেন। নিজ ঘরে গিয়ে দরজা দিলেন সালেহা বেগম। বন্ধ দরজার ভেতর ঠিক কি বয়ে যাচ্ছে খোঁজ পেল না মনিরা। নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় নিজ হৃদয়ের ধুকধুকানি উপভোগ করতে লাগলো।
ফোন পকেটে ঢুকিয়ে যুবক গুলোর দিকে তাকালো আহিশ। নিম্ন স্বরে বললো,
~ তোমাদের রমিজদার কবর জিয়ারত করবো, একটু জায়গা করে দাও!
যুবক গুলো সবাইকে সরিয়ে দিল। আহিশ চলে গেল রমিজদার কবরের সামনে। একাগ্রচিত্তে কবর জিয়ারত করে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। আবার‌ও ছুঁয়ে দেয় হাত দিয়ে। শিশুকাল থেকে সে বাবাহীন। আশরাফ উদ্দিনের সাথে তার দুরত্ব ছিল আকাশ ছোঁয়া। তিনি কখনোই আহিশ কে কাছে টেনে নেয় নি। না আহিশ কখনো যাওয়ার চেষ্টা করেছে‌। এই দুরত্ব থেকেই তার জীবন চলে গেল বাবার ভালোবাসা হীন। অথচ কয়েক দিন আগে সে জানলো তার কপালেও বাবার ভালোবাসা জুটেছে। মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা তাকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে, বুকে রেখে ঘুমিয়েছে, চুমু খেয়েছে। বুকটা ভার হয়ে আসে, চোখে জল আসতে। ঘোরের মাঝেই বিড়বিড় করে বলে উঠে,
আমার বাবা, বাবা, বাবা, বাবা, বাবা!

যুবক গুলো এসেছিল আহিশের পিছু। তাদের‌ও চোখ কেমন ছলছল করে উঠে। আহিশ উঠে দাঁড়িয়ে তাদের জানায়,
~ আমার ব্যাগটা এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? তোমাদের সাথে কিছু কথা ছিল।
যুবক যেন হুকুম পালনের জন্য‌ই দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নেড়ে ছুটে যায় ব্যাগ আনতে। অল্প সময় পর ফিরে আসে। আহিশ ব্যাগ থেকে কয়েকটা নোট বের করে যুবকদের দিকে বাড়িয়ে বলে,
~ তোমাদের ক্লাবের জন্য। আমি সময় মতো ফোন করে নিবো। প্রতি মাস সামান্য হলেও কিছু সম্মানি দিয়ে সাহায্য করবো। যাই হোক, আমি এবার আসবো। খুব শীঘ্রই তোমাদের সালু কে নিয়ে আবার আসবো।
~ সাঁকো পর্যন্ত একসাথে যাই?

মাথা নাড়িয়ে হাঁটতে থাকে আহিশ। বাকি পথ তাকে একা একাই চলতে হবে। মাঝে যদি কেউ নিজের তৃপ্তির জন্য সাথ দিতে চায় ক্ষতি কি? অনেকটা পথ যাওয়ার পর এক যুবক প্রশ্ন করে,
~ শুধু সালু কেন আপনার পরিবারের সবাই কেই নিয়ে আসবেন! আমরা অপেক্ষা করবো।
হাসে আহিশ। পরিবার বলতে কি বুঝিয়েছে? স্ত্রী? সাঁকো এসে গেছে। আহিশ একটু খানি দাঁড়ায়। সমবয়সী এক যুবকের সাথে হাত মিলিয়ে বলে উঠে,
~ তোমাদের রমিজদা ও সালুর সন্তানের কপালটা ও ঠিক তাদের মতো! শুধু পার্থক্য কি জানো? এখানে রমিজদা মরেছে রোগের কবলে, সেখানে সালু মরেছে কারো হিংস্র থাবায়! ভালো থেকো আসছি!
সাঁকো পেরিয়ে আহিশ মিলিয়ে যায়। যুবক গুলো অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয় কোলাহল হীন রোদে চিকচিক করা রাস্তার দিকে। প্রকৃতি যেন খাঁ খাঁ করে উঠে। এক চাপা শ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। হয়তো এমন শতশত রমিজ দা ও সালু এখনো পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মানুষের হৃদয়ের খবর জানে কয়জনা?

চারপাশ রোদে খাঁ খাঁ করলেও থেমে নেই সৈন্যরা। চলছে খুব জোর কাজ। দায়িত্ব প্রাপ্ত সৈন্যরা ব্যস্ত পায়ে কাজের হুকুম দিচ্ছে, আরেক দল তা করতে তৎপর হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষ। জেনারেল আকা খবর পাঠিয়েছেন শুনেই নুরুল আলম সিদ্দিকী এগিয়ে যান। ধীর গতিতে তারা কি আলোচনা করেন পাশের জনের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। কথার সমাপ্তি টেনে নুরুল আলম সিদ্দিকী নিজ আসনে বসেন। জেনারেল আকা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশ একনজর দেখে নেন। নিজ নেতৃত্বে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম গুলো শেষ করে তিনি বলেন,

~ আজ আমরা আমাদের বীরসেনা শেখ মেহরাব মুনতাসির ও বীর সেনা জিয়াউলের জন্য একত্র হয়েছি। তাদের এই ত্যাগ আমাদের দেশ কে এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। করেছে অপরাধ জগতের বিনাশ। শিখিয়েছে আমরা যে শপথ নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করেছি, সেই শপথ রক্ষা করতে প্রয়োজনে জীবন দিবো; তবুও দেশদ্রোহীর নিকট আপোষহীন থাকবো। আজ এত কথা বলছি না, কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ মেহরাব মুনতাসিরের একমাত্র কন্যা ও জিয়াউল আহমেদের বাবা-মা উপস্থিত হবেন। আমরা তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো।
জিয়াউলের বাবা-মা অনেক পূর্বেই উপস্থিত ছিলেন। তারা এগিয়ে যেতেই এওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয়। তারা মলিন মুখে গ্রহন করেন। যেখানে নাড়ি ছেঁড়া ধন বেঁচে নেই এসব পুরস্কার, সম্মান দিয়ে আর কি হবে? চেয়ারে বসেন তারা। জেনারেল আকা আবার ঘোষণা দেন,

~ শেখ আফরা মুনতাসির আপনাকে মঞ্চে আসার অনুরোধ করা হচ্ছে।
আফরা নেই। কিছুটা বিব্রত হোন নুরুল আলম সিদ্দিকী। আফীফ শান্ত হয়ে বসে আছে। সে জানে আজ এখানে কিছু না কিছু হবে। সবকিছুর জন্য প্রস্তুত সে। আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে আফরা আসে হেলতে দুলতে। এসে সরাসরি এগিয়ে যায় মঞ্চে। জেনারেল আকা আফরার হাতে শেখ মেহরাব মুনতাসিরের সকল সম্মাননা তুলে দেন। তারপর এক্সট্রা মেডেল প্রদান করতেই আফরা নিজের চেয়ারে বসে। পায়ের উপর পা তুলে বসে গলা থেকে মেডেল খুলে রাখে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে। জেনারেল আকা আফরা কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করতেই যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনি মেডেল টা নিজের পায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে ফোন বের করে কিছু ছবি তুলে নেয় আফরা। আকস্মিক এমন কাজে স্তব্দ হয়ে পড়ে সকলে। এরকম একটি সম্মননা কে পায়ে পেঁচিয়ে রাখার দুঃসাহস করে আফরা হাসছে। মেয়েটার হাসি অত্যন্ত ভয়ংকর লাগছে আফীফের নিকট। একটু পরের সময় টা তার জন্য আদৌ ভালো হবে তো?

~ কি করছেন আফরা? এভাবে আমাদের অসম্মান করার কারণ কি?
কর্নেল নূরুল আলম সিদ্দিকী’র মাঝে কোনো রাগান্বিত মনোভাব নেই। শুধু মাত্র দায়িত্বের ভারেই তিনি প্রশ্ন করেছেন। তবে এরকম একটি সম্মননা কে পায়ে ফেলার দিকটা সে কোনো ভাবেই সমর্থন করেন না‌। একজন সৈনিক এরকম সম্মাননা প্রাপ্তির জন্য বছরের পর বছর সংগ্রাম করে যায়, তাদের কাছে এটি একটি দায়িত্বশীল আবেগ। সেখানে কি না মেয়েটা সর্ব সম্মুখে এমন কাজ করেছে? আফরা ফোন থেকে চোখ তুলে না, ফোনে চোখ রেখেই বলে,
~ জেনারেল আকা পুরস্কার টি আমার হাতে দিয়েছে মানে পুরস্কার টি এখন কার?
নুরুল আলম সিদ্দিকী প্রশ্নের উত্তর দেন না। পেছন থেকে একজন ক্যাপ্টেন বলে,

~ আপনার!
~ তাহলে আমার জিনিস আমি মাথায় তুলে রাখি নাকি পায়ে ফেলে রাখি; আপনাদের কি? আপনাদের সে রাইট রয়েছে?
থতমত খেয়ে যায় ক্যাপ্টেন। কেন যেন নুরুল আলম সিদ্দিকী’র বেশ হাসি পায়। হাসিটা চেপে তিনি নিজের আসনে বসেন। মেয়েটা তার ধারণার বাইরে ভয়ংকর। আফরা এবার ফোন রেখে মেডেল টি পা থেকে খুলে, মাথায় পেঁচিয়ে জেনারেল আকা’র দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে ভয়াবহতা। জেনারেল আকা খানিক কেঁপে উঠেন। মেয়েটা ঠিক কি করতে চাইছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। কিছু বলে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার সুযোগ ও তিনি পেলেন না। শক্ত কন্ঠে আফরা বলে উঠলো,

~ আমি পর পর দু’বার আপনার যোগ্যতার দিকে আঙুল তুলছি জেনারেল আকা। আপনি আদৌ সেনাবাহিনী’র প্রধান হওয়ার যোগ্য? কয়েক বছর আগে আপনি যে ভুল টা করেছেন তদন্ত না করে আজ আপনি এক‌ই ভুল করেছেন। একটা মেয়ে এসে বললো সে বীরসেনার মেয়ে আর আপনি বিশ্বাস করে নিলেন? কোনো খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। আরে আপনি তো এটাও জানেন না শেখ মেহরাব মুনতাসিরের একমাত্র কন্যার নাম শেখ মাহনূর মুনতাসির নট শেখ আফরা মুনতাসির!
মেয়েটা খানিক অতিরিক্ত করছে। একজন সৈনিক হয়ে আফীফ কিছুতেই এটি হতে দিতে পারে না। উঠে দাঁড়ালো সে। গম্ভীর নম্র কন্ঠে বললো,

~ আপনার জানার বাইরেও অনেক কিছু রয়েছে মিস মাহনূর মুনতাসির। স্যার আপনার পরিচয় সম্পর্কে অবগত। এমনকি খোঁজ খবর ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। আমরা আপনার মতামত কে প্রাধান্য দিয়েই আপনাকে ওই নামেই সবার নিকট তুলে ধরেছি। কয়েকবছর পূর্বে যে ভুল টার কথা আপনি বলছেন তা শুধু মাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’র অপরাগতা নয়। শেখ মেহরাব মুনতাসির কখনোই তার পরিবার কে জনসমক্ষে তুলে ধরেনি। আইন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন আইনের প্রতীক হিসেবে যে মূর্তি টা আদালতে রয়েছে তার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। আইন অন্ধ, আপনি তাকে যেদিকে পারেন সেদিকেই নিয়ে যেতে পারবেন। ওই সময় টাই অপরাধী ওরফে অনল মাহমুদ আইনের অন্ধ চোখের দুর্বলতা টাই ব্যবহার করেছে। চারপাশ তার এত এত লোক ছিল, মুখোশের আড়ালে কোনটি তার লোক আর কোনটি আপনাদের প্রতিবেশী ধরা সহজ হয়নি। তারাই তদন্ত কারী অফিসার দের জানিয়েছিল ভেতর থেকে একজন মহিলা ও একজন বাচ্চার চিৎকার শুনতে পেয়েছে। আগুন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল তারা উদ্ধার কাজে যেতে পারে নি। ফারায় সার্ভিস পৌঁছানোর পূর্বেই দুটো দেহ পুড়ে ছাই। শেখ মেহরাব মুনতাসিরের বিরুদ্ধে যে প্রমাণ ও সাক্ষ্য গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা তাকে নিশ্চিত করে দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু আমরা এত বছর পর জানলাম সবকিছুর মূলে রয়েছে অনল মাহমুদ। এতটা বছর আমরা ভুলের সাগরে বসবাস করছিলাম।

লম্বা শ্বাস টানলো আফীফ। জেনারেল আকা’র দিকে একপলক তাকিয়ে আবার বললো,
~ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’র নিকট একজন বীরসেনা হারানো, এত বছর মিথ্যের উপর ভেসে থাকা, এতবছর মিথ্যে কলঙ্ক নিয়ে থাকা কতটা লজ্জার তা আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না। এমন‌ও সময় গিয়েছে কোথাও মিশনে যাওয়ার পর জনতা আঙুল তুলে বলেছে, ‘একজন বীরসেনা যখন দেশদ্রোহী বের হলো, দেখ গিয়ে এদের মধ্যেও এমন কালপ্রিট রয়েছে।’ আমরা শ্রবণ করেছি, হাঁসফাঁস করেছি কিন্তু উত্তর দিতে পারিনি। কয়জনের মুখ বন্ধ করবো, আড়ালে তারা শতশত! আমি সেসময়ের কিছু চিত্র তুলে ধরলাম। জানার বাইরে অনেক কিছু থাকে মিস মাহনূর। তাই এরকম একটি মঞ্চে নিজের ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশ না করলে ভালো হয়। আপনাকে কৈফিয়ত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। কিন্তু বীরসেনা শেখ মেহরাব মুনতাসিরের ত্যাগের স্মরণেই আমরা আপনাকে কৈফিয়ত দিচ্ছি।আশা করছি তার অন্য ফায়দা তুলবেন না।

নিজ আসনে বসে পড়লো আফীফ। জেনারেল আকা’র ঠোঁটের কোণে হাসি। নুরুল আলম সিদ্দিকী একবার ছেলে কে দেখলেন, আরেকবার ভাগ্নী কে দেখে দিলেন। তার মন বলছে আফরা’র নিশ্চুপতা ঝড়ের পূর্বাভাস! আফরা কে শক্ত মুখশ্রীতে দাঁড়াতে দেখে তিনি নড়েচড়ে বসলেন। আফরা সরাসরি মাইকের সামনে দাঁড়ালো। আপন ভঙ্গিমায় হেসে দিল শূণ্যে তাকিয়ে। বিষাদেরা দৌড়ঝাঁপ করে ঘুরছে সেই দৃষ্টি। আফরা মাইকে আঙুল দিয়ে দু বার টোকা দিয়ে বলে উঠলো,

~ ‘সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে’- এ মূলমন্ত্র ধারণ করেই তো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হচ্ছে? আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই নীতিবাক্যটির পূর্ণ বাস্তবায়ণ পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ উপলব্ধি করছে বান্দরবানের সর্বস্তরের জনসাধারণ।সমরে আমরা অর্থাৎ যুদ্ধে আমরা। যুদ্ধ করেই আজ সেনাবাহিনীর সফলতা।বাক্যটির দ্বিতীয় তে রয়েছে শান্তিতে আমরা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বলা হয় শান্তির পায়রা। বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধ্বংসকারী সন্ত্রাসী-দেশদ্রোহী দের দমন করে বান্দরবানে আজ শান্তি প্রতিষ্ঠার মহা গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সর্বশেষে রয়েছে ‘সর্বত্র আমরা দেশের তরে’। শান্তি, শৃংঙ্খলা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সর্বত্র আমরা দেখি দেশের তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অস্ত্র হাতে ধরতে, আইন শূংঙ্খলায় জীবন বাজি রেখে লড়তে, শান্তি প্রিয় মানুষের পাশে গিয়ে দাড়াতে, দূর্গতদের পাশে গিয়ে হাত বাড়াতে, শান্তিরক্ষা মিশনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে দেশের সম্মান রক্ষার্থে, দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা জাগ্রত থাকতে, নিজের প্রাণ বলিদান দিয়ে দেশদ্রোহী দের রুখতে, বান্দরবানের উপজাতিদের দেশদ্রোহীদের থেকে রক্ষা করতে, যুবসমাজ কে মাদকাসক্ত হ‌ওয়া থেকে বাঁচাতে, নারী ও শিশুদের নরক যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আজ একাংশ‌ই তারা সফল।

থেমে গেল আফরা। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে
সকল সৈনিক। মেয়েটি হঠাৎ তাদের সফলতার বুলি আওড়াচ্ছে কেন বুঝে উঠতে পারছে না। আফরা কিছুক্ষণ চুপ র‌ইলো। মুচকি হেসে আবার বললো,

~ স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল। লড়াই টা সহজ ছিল না। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। জন্মলগ্ন থেকেই অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি দক্ষ ও চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ একটি অতি পরিচিত ও গর্বিত নাম। সামরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ যে কোন অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা সকল ক্ষেত্রে অসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। দেশের মানুষের সুবিধার্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাও ফিরতে পারে, এক বুলেট কপাল ভেদ করে, বুক ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে; তবুও তারা পিছু হটে না। নিজ পরিবার থেকে তারা দূরে অবস্থান করে। পরিবার, পরিজন, নিজের থেকে তাদের কাছে দেশ, দেশের মানুষ, নিজেদের শপথ বড় হয়।..
.
কি যেন বলতে গিয়েও আফরা চুপ মেরে যায়। মাইক ছেড়ে নিজের বসার জায়গায় দাঁড়ায়। ব্যাগ হাতড়ে একটি খাম বের করে আবার ফিরে আসে মাইকের সামনে। ধীর গতিতে খাম খুলে কয়েক টা ছবি বের করে। কিটকিটিয়ে হেসে উঠে সে। হাসিটা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বারংবার। ছবি গুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখশ্রী করে নেয় কঠোর। অগ্নি চোখে জেনারেল আকা’র দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

~ আপনার নীতিবাক্য যদি সর্বত্র আমরা দেশের তরে বলে, আপনার মূলমন্ত্র যদি দেশের উপরে কেউ নেই বোঝায়, আপনার শপথ যদি পরিজন ভুলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেয়। তাহলে আপনি কেন সেদিন নিজের পরিবারের কথা ভাবলেন বিগ্রেডিয়ার আকা? আপনি কেন নিজের মেয়ে কে বলিদান দিতে পারলেন না? আপনি কেন পরিবারের জন্য একজন দেশদ্রোহীর সাথ দিলেন? আপনি কেন নির্দোষ জানা সত্ত্বেও একজন বীর সেনা কে ফাঁসিকাঠে ঝুলালেন। বর্তমান আপনার কাছে উত্তর আছে জেনারেল আকা? আপনি নিজের বিগ্রেডিয়ার পদ কে ব্যবহার করেছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কে লজ্জিত করেছেন। শুধু মাত্র নিজের মেয়ের জন্য। আপনি কোন মুখে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল আকা? এত বড় বড় ভাষণ আপনি কোন মুখে দিচ্ছেন? এখন আমি যদি বলি আপনি যে মেয়ের জন্য আমার জন্মদাতা কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন , সেই মেয়ের হৃদপিন্ড এক থাবায় বের করে আনবো? তার রক্তে পা ভেজাবো? তার ছটফটানি দেখে হাসবো? আমি কিন্তু শেখ মেহরাব মুনতাসির নয়! শেখ মাহনূর মুনতাসির আমি! এমন কোনো কাজ নেই করতে পারে না, সে হোক মানুষের হৃদপিন্ডে ছুরি ঢুকানো। এই মেডেল দিয়ে আমি কি করবো? পারবেন আমার শৈশব ফিরিয়ে দিতে? পারবেন আমার বাবা-মা কে ফিরিয়ে দিতে? আপনার নিকট এই সস্তা সম্মান কে চেয়েছে?

গমগমে কন্ঠস্বর। আকস্মিক কথার তীরে সকল সৈনিক দাঁড়িয়ে পড়েছে। জেনারেল আকা বুকে হাত দিয়ে বসেন। এতটা বছর যে আত্মগ্লানি তে তিনি ভোগছেন, বুকের উপর যে বোঝাটা তাকে ঘুমাতে দেয় না, অপরাধ বোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খায়; সেই অপরাধ আজ সর্ব সম্মুখে। কি উত্তর দিবে সে? মেয়েটির একটি কথাও ভুল নয়। আফরা ছবি গুলো এগিয়ে দেন বিগ্রেডিয়ার অনিমেষ মির্জা’র দিকে। অনিমেষ মির্জা দেখেন, আবছা আলো অন্ধকারে চেয়ারে বসে আছে একটি যুবতি মেয়ে, তার পাশেই বিগ্রেডিয়ার আকা, যার সম্মুখে বসে আছেন অনল মাহমুদ। সালটাও স্পষ্ট ২০০৪! আর কিছু বলার থাকে না। নুরুল আলম সিদ্দিকী কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তবে নিজের দায়িত্ব ভুলে যান না।

বিগ্রেডিয়ার অনিমেষ মির্জা এগিয়ে গিয়ে জেনারেল আকা’র সামনে দাঁড়ান। জেনারেল আকা নিশ্চুপে নিজের টুপি খুলে টেবিলের উপর রাখেন। একে একে পাওয়া সম্মান গুলো খুলে রাখেন পর পর। নিজের পদ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন। এক মুহুর্ত‌ও অপেক্ষা করেন না তিনি। ইউনিফর্ম খুলে ফেলতে চাইলেও নুরুল আলম সিদ্দিকী বাধা দেন। জেনারেল আকা তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করেন। সবার বাঁকা দৃষ্টি তিনি নিতে পারছিলেন না। ঘামছেন তিনি, বুকের ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে‌। গাড়িতে অবস্থান করার পূর্বেই ঢুলে পড়েন তিনি। খবর টা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। নুরুল আলম সিদ্দিকী, আফীফ কেউ ই এগিয়ে আসে না। অনিমেষ মির্জা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে চলে যান নিজের রুমে। পরিস্থিতি টা ক্রমশ জটিল হয়ে আসে। সৈনিক রা অনুমতি না পেয়ে সেভাবেই বসে থাকেন। কি এক বিতৃষ্ণা অন্তর জুড়ে। আফরা এলোমেলো পায়ে মঞ্চ থেকে নেমে যায়। আফীফের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,

~ জানার বাইরে অনেক কিছু থাকে ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির!
ঠোঁট বেঁকিয়ে কিছু একটা ইশারা করে আফরা, সব ভুলে থতমত খেয়ে যায় আফীফ। মেয়েটা তাকে চুমু দেখালো? লাজুক হাসে মাথা চুলকে। নুরুল আলম সিদ্দিকী মুখে হাত চেপে ফিক করে হেসে দেয়। প্রেমে পড়বে না পড়বে না করে ছেলে তার ঠিক প্রেমে পড়েছে। তা আবার কোনো সাধারণ মেয়ের প্রেমে পড়লে ব্যাপারটা ঠিক ছিলো, একজন আগুন আরেকজন আগুন নেভানোর গ্যাস। তা না করে এমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে দুজন একসাথে হলেই বিস্ফোরণ! বাবার হাসিতে আফীফ ভ্রু কুঁচকায়, তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে? দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো,

~ বাড়ি যাও, আজ না ঘুরতে যাওয়ার কথা দিয়েছিলে? মনে আছে? না হলে আজ গেইটে তালা ঝুলে থাকবে!
শুকনো ঢোক গিলে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। উদ্দেশ্য বাড়ি যাওয়া নয়, ছেলের কথার হাত থেকে বাঁচা। আফীফ বুঝতে পেরে হেসে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। আফরা কে খুঁজতে খুঁজতে বাইরের দিকে চলে আসে। অন্যদিকে আফরা পাপার রুম থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে। কাউকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন করছে। দু বার রিং হয়ে কে’টে যাওয়ার পর রিসিভ হয়। আফরা ঝটপট বলে উঠে,

~ সব ঠিক আছে? ক্যামেরা?
~ আধাঘণ্টার জন্য সব অফ!
অপর পাশ থেকে নোমানের কথা ভেসে আসে। আফরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে,
~ সে ক‌ই?
~ পাশেই। কথা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছে।
হাসে আফরা। বলে,
~ ফোন টা দিন তাকে।
নোমান ফোন দেয়। আফরা কিছু বলার সুযোগ পায় না। পূর্বেই অস্থির কন্ঠে মিরা বলে,
~ কোথায় তুই? আমি আসছি, তুই একা যাবি না। এমনিই দুদিন দেখা হয়নি তোর সাথে, তার‌উপর সেখানে চরম রিস্ক। একা যাবি না আফরু, আমি দু মিনিটেই আসছি।
এক নাগাড়ে এত গুলো কথা বলে হাঁপিয়ে যায় নি মিরা। তৎক্ষণাৎ ছুটতে শুরু করে। আফরা বুঝতে পেরে নিষেধ করে বলে উঠে,

~ একদম না, এক পা ও নড়বি না। তুই এই চত্বরের মধ্যেই থাকবি না। আদিল মাহমুদ কে একটা তালা দিয়ে আটকে রাখা যায় না, সেটা তুই ভুলে গেছিস। আটকা তাকে, এদিকেই আসছে। তোর ভাই আছে তো, সব সামলে নিবো আমরা। কথার খেলাপ হয় না যেন। বাই।
ফোন কেটে দেয় আফরা। মিরা পড়ে যায় অথৈ সাগরে। একদিকে বন্ধুত্ব আরেকদিকে ভালোবাসা! সে কোন দিকে যাবে? দোটানা থেকে বের করে নোমান। জোর করে বের করে দেয় চত্বর থেকে। মিরা ছুটে চলে অজানা শঙ্কা নিয়ে। মানুষ টা ঠিক আছে তো?

অনিমেষ মির্জা নিজ কেবিনে বসে ছিলেন। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে মলিন মুখে কিছু ভাবছিলেন। এমন সময় দরজায় নকের শব্দ। গলায় ক্ষীণ আওয়াজ তুলে অনুমতি দেন তিনি। আফরা ঢুকে, দরজা ঠেসে দিয়ে অনিমেষ মির্জার নিকট বসে। অনিমেষ মির্জা মলিন হাসেন। আফরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
~ পাপার তুমি ছাড়া কেউ নেই মাম্মাম। পরিবার পেয়ে ফিরে যাবে না তো?
আফরার চোখ এই টুকু কথাতেই ছলছল করে উঠে। অনিমেষ মির্জার একদম কাছে চেয়ার টেনে বসে বুকে মাথা রাখে। অতি নিম্ন কন্ঠে বলে,

~ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি পাপা। সেই শৈশব থেকে কৈশোর, যৌবন পার হচ্ছে; আগলে রেখেছো তুমি। এক ফোঁটা আঁচ আসতে দাও নি। কিন্তু যে তোমাকে মরতে হবে পাপা। আ’ম সরি পাপা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!
অনিমেষ মির্জা বিস্মিত কন্ঠে কিছু বলবেন, পূর্বেই বুকের বাম পাশে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় আফরা। পর পর কয়েকবার বুক ছুরির আঘাতে জর্জরিত হয়‌। ধারালো ছোট অস্ত্র টি চামড়া ভেদ করে হৃদপিন্ডে আঘাত করে। অনিমেষ মির্জার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। আফরা’র চোখ আজ বাঁধ ভেঙেছে, নিয়ম ভেঙেছে, পুরো আফরা কেই আজ ভেঙে দিয়েছে। আফরা এখনো অনিমেষ মির্জার বুকে মাথা রেখে বসে আছে‌। হাত বাড়িয়ে অনিমেষ মির্জার কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল টা মুছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

~ কষ্ট হচ্ছে পাপা? আমারো খুব কষ্ট হয়েছে জানো? যেদিন শুনলাম তুমি সেই অনল মাহমুদের জীবন ধ্বংসকারী সহ শতশত জীবন ধ্বংসকারী, আমার বাবা-মা’র হত্যাকারী অনিমেষ মাহমুদ; বিশ্বাস করো পাপা এর থেকে হাজার গুণ কষ্ট আমার হয়েছে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, বাবা-মা’র খুনীকে পাপা ডেকে এসেছি, পাপা ডাকছি ভেবেই মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। তুমি ভাবলে কি করে পাপা? যে মাহমুদ বংশের সাথে মাত্র পাঁচ টাকার জন্য সম্পর্ক রেখেছে আমি তাকেও খোঁজে বের করেছি, অথচ অনল মাহমুদের ভাই কে জানতে পারবো না?
আফরা বুক থেকে মাথা উঠালো। অপলক তাকিয়ে র‌ইলো অনিমেষ মির্জা’র ব্যাথামিশ্রিত মুখশ্রীর দিকে। উঁচু হয়ে কপালে অধর স্পর্শ করে বললো,

~ আমি জানি অনল মাহমুদ যেমন তোমার শিকার হয়েছে, তুমিও তোমার বাবার শিকার হয়েছো। কিন্তু অপরাধ তো অপরাধ পাপা। তোমার জীবনের সবচেয়ে ভুল কি ছিলো জানো? আট বছরের ছোট্ট শিশুটাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করা। যদিও তুমি আমাকে ব্যবহার করতেই নিয়ে গিয়েছিলে। তবে কখন সেই মেয়েটার প্রতি তোমার অগাধ ভালোবাসা জন্মালো নিজেও বুঝতে পারো নি। তারপর দুই সন্তান হারিয়ে তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলে। তাইতো অনল মাহমুদের সব তথ্য আমার হাতে তুলে দিলে! তারপর ছেলের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আদিল কেও অনল মাহমুদের সাথে যুক্ত করেছো। যদিও সে অপরাধি, সমান ভাগীদার শাস্তির কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না পাপা। আদিল মাহমুদ বন্দী হয়নি পাপা, তোমার পরিকল্পনা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা ঠিক বাঁচিয়ে নিয়েছি। আজ আমার শেষ খুন, তোমাকে আমি আইনের হাতে তুলে দিতে পারতাম। ফাঁসি হতো তোমার, কিন্তু মেয়ের হাতে রক্তাক্ত হয়ে মৃত্যুর আগে যে ক্ষতটা তোমার বুকে রয়ে গেল; এর বাইরে আমি কিছুই চাইনি পাপা। আজ শেখ মাহনূর মুনতাসির শান্তিতে ঘুমোবে।

উঠে দাঁড়ায় আফরা। শান্তিতে ঘুমাবে? আদৌ সেই শান্তি তার জীবনে আসবে? এই যে বুকে ব্যাথা হচ্ছে, চোখ যন্ত্রণার কবলে পড়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। তা তো হ‌ওয়ার কথা ছিল না। কেন হচ্ছে? তার তো খুশি হ‌ওয়ার কথা ছিল। বাবা-মার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পেরে তার তো উল্লাস করার কথা ছিল তবে পারছে না কেন? কেন জোর করেও হাসি ফুটাতে পারছে না? অনিমেষ মির্জা নিভু নিভু চোখে আফরা কে দেখে যায়। দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যেতে চায়, জোর করে যেন ধরে রাখেন তিনি। অস্পষ্ট কাঁপা কন্ঠে বলেন,

~ তোমার জীবনে আমি নায়কের মতো এসেছিলাম, আজ আমি খলনায়ক হয়ে বিদায় নিচ্ছি। তুমি একটু উদার হলেও পারতে মা! ছুরিটা লুকিয়ে ফেল, চলে যাও এখান থেকে। পাপা তোমাকে খুব ভালোবা..
অসমাপ্ত বাক্য হয়ে পড়ে র‌ইলো। অনিমেষ মির্জা চোখ বুজলেন, নিঃশ্বাস থেমে গেছে, হৃদযন্ত্র স্পন্দন নিতে ভুলে গেছে। আফরা চোখ বুজে সেভাবেই দাঁড়িয়ে র‌ইলো। হাতে রক্তাক্ত অস্ত্র, পরনের সাদা কামিজ লালরঙা হয়ে অদ্ভুত আকর্ষণ প্রদান করেছে। বুকের ধুকধুকানি নিয়ে আফরা বসে পড়লো ফ্লোরে‌। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুরি থেকে রক্ত ঝরছে। কি অদ্ভুত নিয়তি, নিয়তির লীলা খেলা।

অনিমেষ মির্জার কেবিন থেকে খানিক দু
দূরে অস্থির চিত্তে পাইচারি করছিল নোমান। বার বার ঘড়ি দেখছে। আধাঘণ্টা হতে আরো কয়েকমিনিট বাকি। মিনিট কয়েক পর ক্যামেরা গুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে‌‌। ঘেমে চুপচুপে অবস্থা তার। পরনের টিশার্ট ভিজে একাকার। এরমধ্যে ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির সহ তিনজন সৈনিক কে এদিকে আসতে দেখেই পিলে চমকে উঠে তার। একবার ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রাখে, আরেকবার আফীফের দিকে, ফের ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অনিমেষ মির্জার কেবিনে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হৃদপিন্ড দ্রুত গতিতে লাফাতে শুরু করে। আফীফ তাকে দেখার পূর্বেই কোনো কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়ে অনিমেষ মির্জার কেবিনে। ফ্লোরে বসা আফরা কে দেখে পা থেমে যায় তার। শক্তপোক্ত কঠোর মেয়েটার কি দশা! শক্ত বুটের আওয়াজ খুব নিকটে।

নোমান তড়িঘড়ি করে আফরার হাতের ছুরিটা কেড়ে নেয়। পাশে রাখা ব্যাগে ঢুকিয়ে চেইন বন্ধ করে দেয়। তৎক্ষণাৎ কোমর থেকে দামী ছোট ছুরিটা বের করে চলে যায় অনিমেষ মির্জার নিকট। চোখ বুঝে ঘা বসিয়ে দেয় ফের, আরেক অস্ত্র রক্তাক্ত হয় অনিমেষ মির্জার রক্তে‌। আফরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই নোমান চোখ রাঙিয়ে তাকায়। চুপ হয়ে যায় আফরা‌। নোমান দুরে যাওয়ার সময় পায় না, দরজা খুলে আফীফ ঢুকে পড়ে কেবিনে। হাতে শোভা পায় বন্দুক, চোখে মুখে অবাকতা। নোমানের এমন কান্ডে সে কতটা বিস্মিত হয়েছে তা আফরা কে এখনো ভালো করে না দেখায় বুঝে নোমান। হাসে, দু পা এগিয়ে এসে ছুরি সহ দু হাত উপরে তুলে বলে উঠে,
~ আমি মেরেছি!

ব’জ্র’ক’ন্ঠের কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র দু পা পিছিয়ে যায় আফরা। ঢলে পড়তে নিতেই আগলে ধরে আফীফ। দৃশ‌্যমান হয় সাদা কাপড়ে রক্তের ফোঁটা। খবর টা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে। নুরুল আলম সিদ্দিকী সহ সাংবাদিক গুলো উড়ে আসার মতো উপস্থিত হয়। তৎক্ষণাৎ হাত কড়া পড়িয়ে বন্দী করা হয় নোমান কে। নুরুল আলম সিদ্দিকী শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
~ ইন্সপেক্টর নোমান! একজন আইনের লোক হয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন আপনি। সেনা চত্বরে ঢুকে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কে হত্যা করেছেন‌। এর পরিণতি কি হবে জানেন?
~ বড়জোর ফাঁসি হবে!
গাঁ ছাড়া ভাব নোমানের। নুরুল আলম সিদ্দিকী চাপা শ্বাস ফেললেন। আফরা’র নিকট এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। নিম্ন কন্ঠে বললেন,

~ শক্ত হ‌ও আম্মা। কাছের মানুষ ই বেইমান হয় দেখেছো?
আফরা মাথা নাড়ে, কন্ঠরোধ হয়ে গেছে তার। আঙুল উঁচিয়ে অনেক চেষ্টার পর বলে,
~ বেইমান উনি নয়, বেইমান ওই যে অনিমেষ মাহমুদ! অনল মাহমুদের ভাই!
চৌকস সেনাদের খোলাসা করে বলতে হয়না। বিস্ফোরিত ভাব কাটিয়ে আফীফ আফরা’র নিকট এগিয়ে আসে। মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। নুরুল আলম সিদ্দিকী কে ইশারা করলো আফরা কে নিয়ে যাওয়ার। আফরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে না করলো, মুখ ফুটে কিছু বলার পূর্বেই নোমান গমগম কন্ঠে বলে উঠলো,
~ শেষ মুহূর্তের কাজটি তোমার নিকট আমাকে নায়ক করে তুলবে প্রাণভোমরা। তুমি যে খলনায়কের আসনে আমাকে বসাতে চেয়েছিলে, আমি পাসা উল্টে দিলাম। নোমান শিকদার শেখ মাহনূর মুনতাসিরের জীবনে না থেকেও কোথাও একটা থেকে যাবে আমৃত্যু। তুমি খলনায়কের ভূমিকা দিতে চেয়েছিলে, আমি নায়কের ভূমিকা পালন করে গেলাম। একটা চাপা শ্বাস অন্তত আমার নামে ফেল।

আর কিছু শোনার ভাগ্য আফরার হলো না। চোখ বুজে নিয়েই শরীরের সকল ভার ছেড়ে দিল নুরুল আলম সিদ্দিকী’র উপর। নোমান মুচকি হেসে, কিছুক্ষণ অপলক ওই মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। হৃদয়ের কোথাও একটা ব্যাথা করছে কিন্তু আফসোস হচ্ছে না। আফীফ অদ্ভুত চোখে নোমানের যাওয়া দেখলো। ছেলেটা তার ভালোবাসা প্রমাণ করে গেল? কিভাবে? কিছুদূর যাওয়ার পর নোমান ফের ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। বিড় বিড় করে বলে উঠে,
~ প্রাণভোমরা বিহীন মানুষ বাঁচে? আমি কি করে বাঁচব? নোমান শিকদার সবার নিকট খলনায়ক হলেও তোমার নিকট নায়ক হয়ে থাকবে। এটাই তোমরা শাস্তি প্রাণভোমরা আমাকে না ভালোবাসার জন্য। ভালোবাসি!

নিজ গন্তব্যে এসে স্তব্দ মিরা। ঘরের দরজায় মস্ত বড় তালা ঝুলানো। যা তার দেওয়া তালা নয়। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে মিরার, ক্রমশ ভয় তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দরজার নিচে পেয়ে চায় চাবি। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে, কেউ নেই। খাঁ খাঁ করছে ঘর। দরজা চেপে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায়, এটা তো কথা ছিল না। বিছানায় বসে ঝিম ধরে। ফোন বের করে ডায়াল করে আদিলের নম্বরে। মেয়েলি কন্ঠের এক‌ই কথা বারংবার ফিরে আসে। “এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু পর আবার ডায়াল করুন।” খানিক রাগ‌ও হয় মিরার। লোকটা তার কর্মের শোধ নিতেই এমন করেছে, সে ঢের বুঝতে পারছে। মনের মধ্যে জেদ কাজ করে। যে কোনো ভাবেই হোক খুঁজে বের করবে। ঠিক তখনি টেবিলের উপর নিজের ডায়েরীটা দৃশ্যমান হয় চোখে। ভ্রু কুঁচকে আসে মিরা’র। এটি তো তার ব্যাগে ছিল। চট করে ধরে ফেলে সে, এগিয়ে গিয়ে ডায়েরীটা হাতে তুলে নেয়। তার‌ই অনুভূতি তে ঠাসা ডায়েরীটা। কলম দিয়ে মার্ক করা পাতাটা উল্টোতেই মিরার চোখে পড়ে ছোট ছোট কিছু অক্ষর,

“সম্বোধনে কি যায় আসে! করছি না। আপনার ভালোবাসা ভয়াবহ হলে আমার ভালোবাসা ভয়ংকর রাজনন্দিনী। আদিল মাহমুদ কে একটি তালা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ভয় নেই, এগোচ্ছি না সেদিকে। ক্লান্ত হয়ে গেছি, অস্ত্র হাতে তুলতে ইচ্ছে করে না। আপনারা তিনটে মেয়ে আমার অতি কাছের। বোন; যে আমার রক্তের কেউ না, প্রকাশ না করেও তাকে ভালোবেসেছি। রাজনন্দিনী, শাহজাদী; আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন ভালোবাসতে। আদিল মাহমুদের নিষ্ঠুর মন কে ভেঙে প্রেমের ফুল ফুটিয়েছিলেন। আরেকজন আফরা! মেয়েটা আমার খুব পছন্দের।

ভালোবাসা আর পছন্দ এক নয়। পছন্দ যে কাউকে যে কোনো কারণেই হতে পারে। আমার জীবনে দ্বিতীয় নারী সে যে আপনার পর আমার কাছে আসার চেষ্টা করে গেছে ভয়হীন। তার কাজ, ব্যবহার, কঠোরতা, বুদ্ধি আমার মনে তার প্রতি আলাদা এক ধারণা সৃষ্টি করেছে। নাহলে আফরা ইবনাত মেয়েটি কবেই হারিয়ে যেত। যাই হোক, চলে যাচ্ছি বহুদূর। আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি যে আমাকে গ্রহণ করবেন না, জানি। মেনে নিয়েছি। নিষ্ঠুর আদিল মাহমুদ কে আপনি ভাঙতে পেরেছেন রাজনন্দিনী। আমি চাই না ভবিষ্যত আরো আদিল মাহমুদ জন্মাক। এদের রক্ত বেইমানের রক্ত, খু*নীর রক্ত। তবে ধর্ষকের নয়। আমার আব্বু ধর্ষক নয় রাজনন্দিনী। জানার বাইরে অনেক কিছু রয়েছে। অপারেশন থিয়েটারে যে হিংস্রতা হয়েছে তা সম্মুখে হলেও উনি সাথে ছিলেন না‌। আমার মতোই ছটফট করে গেছেন। মিসেস নুরি আপনাকে চিনতো জানেন? খুব আশা করেছিলেন আপনাকে নিয়ে। অনেক কথা বলে ফেললাম। শুধু প্রার্থনা পৃথিবীতে দ্বিতীয় আদিল মাহমুদ কোথাও না জন্মাক!

আমি আপনার বহুদূর হলেও, আপনি আমার অতি নিকটে‌ রাজনন্দিনী। আপনার জীবনে নায়ক ও আমি, খলনায়ক ও আমি। সর্বত্র শুধুই আমি‌। আদিল মাহমুদ এখনো পাল্টে যায় নি। প্রয়োজন ভেদে নিশ্চুপতা থেকে খলনায়কের রোল প্লে করতে সময় নিবে না। সাবধানে থাকবেন। ভালোবাসি রাজনন্দিনী!
ইতি
ডাক্তার!”

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৩+৬৪

দু তিন বার পড়লো মিরা। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। পরক্ষণেই চোখের জল মুছে পাতাটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লো। উন্মাদের মতো চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ আপনাকে আমি জিততে দিবো না ডাক্তার!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক শেষ পর্ব