হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৯
Tahrim Muntahana
~ আফরা কে আমাদের বাড়িতে থাকতে বলতে পারো না, মনিরা?
রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলো মনিরা। একটু পর যোহরের আযান পড়বে। আজ হুট করেই তার শশুড় এসেছে। এ নিয়ে অবশ্য সে চরম বিরক্ত। তবে প্রকাশ করার রাস্তা তার বন্ধ। শাশুড়ি ঘরে খিল দিয়ে বসে আছে, হয়তো দুঃখ বিলাস করছে, নয়তো ঘুমাচ্ছে! যত জ্বালা তার! এসবই মনের মধ্যে আঁকিবুঁকি করছিল, এর মধ্যে স্বামীর এমন কথায় কোনো রকম রিয়েকশন তার মাঝে দেখা যায় না। যেন এ ব্যাপারে সে আগেই বুঝতে পেরেছিল। আতিকুর কিছুক্ষণ মনিরার পাল্টা প্রশ্নের অপেক্ষা করে, না পেয়ে খানিক রেগেও যায়। কটমট করে বলে উঠে,
~ আমার কথা কানে যায় নি? চুপ থাকার স্পর্ধা কি করে হয়?
এবার ভয় পায় মনিরা। ভয় ভয় চোখে স্বামীর দিকে তাকায় সে। আতিকুর নিজেকে সংযত করে নেয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে নরম সুরে বললো,
~ দেখলাম মেয়ে টা একা থাকে, কেউ নেই! আমাদের এখান থেকে ওর ভার্সিটিও কাছে হবে, প্রতিদিন আমার সাথে যেতে পারবে, আবার মিহি’র ক্ষেত্রেও সুবিধা। ভালো একজন গাইড পাবে সবসময়ের জন্য। কি বলো?
মনিরা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। আতিকুরের মুখে হাসি ফুটে! মনিরা একপলক সেই হাসি দেখে নিজেও শব্দ করে হেসে উঠে। আতিকুরের নিকটে দাঁড়িয়ে হেঁয়ালি করে বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ আজ মনে হচ্ছে খুব খুশি। তা কেবল আফরা’র এ বাড়িতে থাকা নাকি অন্যকিছু? লাইক কোনো মেয়ের সর্বনাশ, তোমার রাতের সুখময় কিছু মুহূর্ত!
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আতিকুর। এতক্ষণ আপন মনে কল্পনা সাজাতে ব্যস্ত ছিল। মনিরার কথা বুঝতে তার কিছুটা সময় লাগে। চেঁচিয়ে বলে উঠে,
~ হোয়াট? কি বলতে চাইছো তুমি?
~ বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝতে চাইছো না?
~ তোমার সাহস দেখছি বেড়ে গেছে। এতদিন তো টু শব্দ করো নি, এখন বুলি ফুটেছে। ভয় করছে না?
সত্যিই কি মনিরা ভয় পাচ্ছে না? পাচ্ছে! খুব করে ভয় করছে তার। ভেতর টা কাঁপছে, মনে হচ্ছে এখনি বুঝি কোমরে থাকা বেল্ট খুলে পেটানো শুরু করবে। তবে আজ কেন জানি ভয় টাকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে না মনিরার। মন বলছে, আজ সে চুপ থাকলে আরো একটা পবিত্র মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। জ্বলে উঠে মনিরার চোখ। চমকায় আতিকুর। ভীষণ ভাবে চমকায় সে। এই মনিরাকে সে চিনতে পারছে না। তার সামনে মাথা নিচু করে থাকা মনিরা আর এই মনিরা আকাশ পাতাল তফাৎ। এই মনিরার চোখে মুখে বিদ্রোহ দেখতে পাচ্ছে। কেমন যেন ভয় করছে তার। উঁচু গলায় মনিরা বললো,
~ না ভয় করছে না। কি করবে? মারবে? বেল্ট দিয়ে আঘাত করবে? রক্তাক্ত করে ফেলে রাখবে? নাকি পেটে লাথি বসাবে? এসো! মারো!
এগিয়ে যাবে আতিকুর, বাবা কে দেখে থেমে যায়। যদিও এক আনা সম্মান সে করে না, তবে নিজের একটা ইমেজ আছে তো! শশুড় কে দেখে মনিরাও থেমে যায়। অসীম রাগ নিয়ে রান্নায় মন দেয়। আতিকুরের বাবা আশরাফ উদ্দিন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
~ গলা একটু বেড়েছে দেখছি। সময় থাকতে ছেঁটে ফেল, নাহলে তোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে!
মনিরা শুনেও চুপ থাকে। কথাটা শুনে যেন আতিকুরের রাগ বাড়ে। খেঁকিয়ে বলে উঠে,
~ ছোট লোকের বাচ্চা টাকে তো তুমিই বিয়ে করতে বলছিলা। টু শব্দ করবে না, যা ইচ্ছা করতে পারবো। এখন দেখছো! গলা কত বাড়ছে।
আশরাফ উদ্দিন হাসে। নয় বছর কি কম?
তিন ছেলে নিয়ে সংসার তার। আতিকুর তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। লম্বা চওড়া, সুঠাম দেহী যুবক। সুযোগ ছিল, টাকা দিয়ে পুলিশে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের স্বভাব যে ঠিক তার মতোই ছিল! মেয়ে দেখলেই শরীর যেন রসিয়ে উঠে। এতে অবশ্য তার কোনো সমস্যা ছিল না, বরং নিজের মতো হওয়ায় বাহুবা দিতেন। বিপত্তি ঘটলো তো তখন, যখন মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে গিয়ে ধরা পড়লো! চাকরী টিকিয়ে রাখা মুশকিল। বাবা হীন মেয়েটা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ে। এক দেখায় পছন্দ হয়ে যায়, নেহাত তখন জরুরি ছিল বলে নিজেই প্রস্তাব দিয়ে বসে নি। ছেলে কে বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসলো বউ করে। ছোট্ট মেয়েটা কিছুদিন স্বামীর সান্নিধ্য পেয়ে দিন দুনিয়া, ভালো, মন্দ ভুলে গিয়েছিল। সুন্দর বউ পেয়ে আতিকুর নিজেও কিছুদিন বাহিরে নজর দেয়নি। কিন্তু চরিত্র হীন পুরুষ তো! কয়েকমাস যেতে না যেতেই আবার শুরু করেছিলো। বউয়ের উপর হুকুমদারী, নির্যাতন কোনো টাই বাদ রাখেনি। নয় টা বছর তো এভাবেই চলে গেল। আজ যখন মেয়েটা একটু প্রতিবাদ করেছে তখন দোষ তার হলো?
সোফায় আয়েশ করে গলা খানিক উঁচিয়েই বললো,
~ গলা যখন বাড়ছে, গলায় দড়ি দে। মাইয়া মানুষ কেমনে টাইট দিতে হয় এখনো বলা লাগবো নাকি? তোর মায়ের গলায় দড়ি দিছি কেমনে দেখস নাই?
গর্বের সহিত হাসলো আশরাফ উদ্দিন। বুড়ো বয়সে বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করে কতটা ভালো কাজ করেছেন সেটাই যেন হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন। বাবার কথায় অভিভূত হয়ে গেল আতিকুর। সে তো এমনটাই চাইছিল। খুশি মনে বললো,
~ আফরা মেয়ে টা কেমন আব্বা? চাইছিলাম কি..
~ হইছে বুঝছি আমি। মাইয়ার দেমাগ আছে, তবে আমার আপত্তি নাই। যা করার কর!
~ রাজী হইলে তো ভালো আব্বা, না হইলে অন্য পদ্ধতি আমার জানা আছে!
মনিরা এতক্ষণ সবই শুনছিল। শেষের কথা শুনে হেসে উঠলো। বাবা-ছেলে দুজন একটু হলেও চমকালো। হুট করেই এমন পরিবর্তন তারাও মানতে পারছে না। মনিরা হেসেই বললো,
~ বাবার ছেলে! একদম খাপেখাপ। চরিত্রহীনের শিরোমণি! তবে এবার যে ভুল জায়গায় নজর পড়েছে! এই যে পুরুষত্বের বড়াই, থাকবে তো?
বাবার দিক এক পলক তাকিয়ে আতিকুর মনিরার গালে সশব্দে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আগের সেই রাগ, জেদ, শক্তি; তবে পরিবর্তন একটাই। আগে আঘাতে মনিরার চোখ বেয়ে বাঁধ ভেঙে জল পড়তো, আজ না আছে জল না আছে ব্যাথা। একদম শক্ত হয়ে চড় টা হজম করে সে। আতিকুর ও আশরাফ উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এই মুচকি হাসিতে কি ছিল কে জানে, বাবা-ছেলের অন্তর কেমন কেঁপে উঠলো!
মনিরা তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সাহস করে দু কথা তো শুনিয়ে আসলো, কি করে কি করবে সে? কোথায় গিয়ে ঠাই নিবে? কি খাবে? মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় উঠবে? মা টাও যে দুই বছর আগে ইহজীবন ত্যাগ করেছে। এসবের থেকে আফরার চিন্তাটাই তার বেশি হচ্ছে। মেয়েটা এখনি চলে আসবে, তার আগেই তাকে বারণ করতে হবে। ফোন লাগায় আফরা’র ফোনে। রিং হয়ে কেটে যায়। পর পর কয়েকবার কেটে যাওয়ার পর রিসিভ হয় ফোন। চোখ চকচক করে উঠে মনিরার। কানে ধরতেই অপাশ থেকে ভেসে আসে,
~ সদর দরজায় আপু! এসেই পড়েছি!
মনিরা চেঁচিয়ে বারণ করে। তবে আফসোস আফরা’র কানে একটা কথাও পৌঁছায় না। সে কথাটা বলেই ফোন রেখে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। মনিরার চোখ মুখে ফুটে উঠে অসম্ভব ভয়! মেয়েটা কে সে বাঁচাতে পারলো না তাহলে!
…..
নিজের ঘরে পায়চারি করছেন অনল মাহমুদ। রাগে বারবার দু’ হাত ঘঁষছেন তিনি। তাকে এই পর্যন্ত কেউ কথা শুনানোর স্পর্ধা করেনি, আজ বড় ছেলের জন্য তাকে কথা শুনতে হলো! এটা যেন মানতেই পারছেন না তিনি। রাগ গুলো যেন দলা পাকিয়ে মাথায় ঘুরছে। কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন রিসিভ হয়নি। কড়া করে কিছু কথা না শুনালেই নয়। ফোন আসার অপেক্ষায় থেকেই রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। ফোন আসার শব্দ আসতেই চটজলদি রিসিভ করে কানে তুলে নেন। কড়া করে কিছু বলবেন তার আগেই অপর পাশ থেকে নম্র কন্ঠে আদিল বলে উঠলো,
~ দুঃখিত আব্বু। মিটিংয়ে ছিলাম। এতবার ফোন দিয়েছেন, কোনো সমস্যা?
সম্মান পেয়ে রাগ টা যেন কমে আসলো। অনল মাহমুদ ও শান্ত সুরে বললেন,
~ কালকের ডিল কনফার্ম হয়নি আদি। তোমার ভুলের জন্য আমাকে কথা শুনতে হয়েছে। অন্য কেউ তোমার আব্বুকে কড়া কথা বলেছে আদি! যা আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি!
~ কষ্ট পাবেন না আব্বু। যার গলা দিয়ে কড়া কথা বের হয়েছে তার গলা টা আজ রক্তে ভেসে যাবে!
অনল মাহমুদ যেন এই কথাটিই শুনতে চেয়েছিলেন। এতক্ষণের রাগ যেন এক নিমিষেই পালিয়ে গেল। খট করে ফোন কেটে দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলেন তিন। অন্যকেউ হুট করেই হাসির শব্দে নির্ঘাত ভয় পেয়ে যেত। অনেকটা সময় হাসলেন, হুট করেই হাসি থামিয়ে মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলেন,
~ তুমিই আমার সম্পদ আদি! আব্বু তোমাকে খুব ভালোবাসে! খুব! যতক্ষণ তুমি আব্বুকে ভালোবাসো ততক্ষণ আব্বুও তোমাকে একদম বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবে!
বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন অনল মাহমুদ। দরজা থেকে সরে গেল কেউ! এলোমেলো পায়ে হেঁটে কোণার এক ঘরে ঢুকে পড়লো। এলোমেলো পায়ের একেকটা ভাজ যেন বিষাদের ইঙ্গিত দেয়! দেয় কোন ভুলে চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়ার খোঁজ! দেয় কোনো হৃদয়ের হাহাকারের খোঁজ! যাতনা গুলো আর কত দিন বয়ে নিবে? মৃত্য তো জড়িয়ে নেয় না!
~ মিহি তোমার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে আফরা, তুমি এতক্ষণে আসলে। যাও উপরে যাও!
কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়। আফরা ভেবেই নেয় দরজা টা মনিরা খুলেছে। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকবে, আতিকুর কে দেখে মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। লোকটা কেমন গাঁ জ্বালানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আফরা হালকা কেশে উঠে, আতিকুর দৃষ্টি ঘুরায়। ভেতরে যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসে, তবে সময় তার সহায় আজ হয় নি। এর আগেই দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসে মনিরা। উক্ত কথাটি বলে হাঁপাতে থাকে। আফরা এক নিমিষেই পুরো ব্যাপারটা বুঝে যায়। অজান্তেই তার ঠোঁটের ভাজে হাসিরা উঁকি দেয়। মনিরা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
~ মিহির কাছে যাবো, আগে একটু কাকার সাথে কথা বলে নিই। আরেক দিন দেখা হয়েছিল তবে কথা বলতে পারি নি!
কথাটা বলা শেষ হতেই আশরাফ উদ্দিনের থেকে কিছুটা দূরে বসে। মুখের হাসি চওড়া করে বলে উঠে,
~ ভালো আছেন কাকা?
মেয়েটাকে আশরাফ উদ্দিন দেমাগি ভেবেছিলেন, তবে সুন্দরী মেয়ের এত ভালো ব্যবহারে যেন তার ধারণা পাল্টে গেল। নিজেও গদগদ হয়ে বললেন,
~ হ্যা মা ভালো আছি, তুমি ভালো আছো?
~ আমি তো সবসময় ভালো থাকি কাকা। ছোট কাকি কেমন আছে? নিয়ে আসতেন, একটু দেখতাম।
~ তোমার ছোট কাকিও ভালো আছে। ও তো দুদিন আগে বান্ধবী দের সাথে ঘুরতে গিয়েছে, আমার কাছে দশ দিনের সময় নিয়েছে। এত করে বললো, আর না করিনি!
~ আপনাকে রেখে ঘুরতে চলে গেল? এ কেমন কথা কাকা? আপনি সাথে যেতেন!
~ গেছে ভালোয় হইছে! ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় তো।
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৮
আফরা শুধু হাসলো। দশ দিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছে? বেশ ভালো তো! ঘুরতে গিয়েছে বলে বুড়োর যেন ভালো হয়েছে, না হলে এখানে আসতো নাকি! মনে মনে কথাগুলো ভেবে উঠে দাঁড়ায়, আতিকুরের দিকে একপলক তাকিয়ে হাসি দেয়। আতিকুর নিজেও গদগদ হয়ে যায়। তবে কথা বলার সুযোগ সে পায় না। মনিরা আফরা’র হাত ধরে উপরে চলে যায়। তখন আফরা ভাবতে ব্যস্ত! হুট করেই আপন মনে বলে উঠে,
~ ১৫-১৬ বছরের গ্রামের মেয়ে বান্ধবীর সাথে দশদিনের জন্য ঘুরতে গেল। সে ঘর থেকেই বের হলো কখন, বান্ধবী টাও হলো কখন? ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে!