হলুদ বসন্ত পর্ব ২৬

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৬
জাওয়াদ জামী জামী

” মা, এত বছর পর আবার কিসের অনুষ্ঠান বলতো? মানুষজন কি বলবে? ”
” তুই চুপ থাক। মানুষজন যা বলে বলুক। তোদের বিয়ে হুট করেই হয়েছিল। আমার ইচ্ছে ছিল তোদের বিয়েতে বিশাল আয়োজন করব। গ্রামের প্রতিটা মানুষকে দাওয়াত করব। কিন্তু পরিস্থিতির কারনে সেটা হয়ে ওঠেনি। এবার যখন সুযোগ এসেছে, তখন আমি অনুষ্ঠান করবই। এবং সেটা ইশু ঢাকা যাওয়ার আগেই। তুই লিষ্ট কর কাকে কাকে দাওয়াত করবি। আর আজ বিকেলেই তোরা চারজন মিলে শহরে যাবি। বিয়ের কেনাকাটা করবি। ”
নাজমা আক্তারের ধমক খেয়ে অবনী চুপ করে গেল। ও বুঝতে পারছে বড়মা যখন বলেছে অনুষ্ঠান করবে, তখন তাকে আর থামানো যাবেনা।

” অবনী, তুই এখানে কি করছিস, মা? বাহিরে গিয়ে দেখ লিষ্ট অনুযায়ী সব বাজারগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। তবে তার আগে আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যা। যা গরম পরেছে। সেদ্ধ হয়ে গেলাম গরমে। ” ইসহাক আজাদ গরমে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তিনি সোফায় বসলেন।
” আরও যাও বাজারে। তোমাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছনা। শখ কম নয় তোমাদের। টাকাগুলো এভাবে খরচ না করে মাকে গহনা বানিয়ে দিতে পারতে। কিংবা জমি কিনতে পারতে। কিন্তু না তোমরা ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, তা-ও আবার বিয়ের চার বছর পর। ”
” তোকে চুপ থাকতে বলেছিনা? চুপচাপ যা যা করতে বলেছি কর। যা তোর চাচাকে পানি এনে দে। ফাজিল মেয়ে, খালি অনুষ্ঠান বন্ধের বাহানা খোঁজে। ” আবারও ধমকে উঠলেন নাজমা আক্তার। বড়মার ধমকে সুড়সুড় করে পানি আনতে গেল অবনী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” নাজমা, তোমার বাবার বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত দেবেনা? এদিকে প্রায় সবাইকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে। শুধু আমার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত দেয়া বাকি আছে। ”
” দিতে হবেনা। ওদের বদলে তুমি অন্য কাউকে দাওয়াত দাও। ”
” এটা কি বললে তুমি? তোমার আব্বা এখনও বেঁচে আছে। তোমার ভাইবোন আছে। তাদের রেখে নিজের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে তুমি? এটা কিন্তু ঠিক নয়। তারা শুনলে কি ভাববে? ”

” যা ভাবার ভাবুক। যাদেরকে তুমি আমার ভাইবোন বলছ, তারা আমার সৎ ভাইবোন। আর আব্বা সে তো অনেক বছর আগে থেকেই আমার কাছে মৃত। যে পিতা তার মাতৃহীনা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে, তাকে আর যাইহোক পিতা বলা যায়না। বিয়ের পর সে কখনো আমার খোঁজ নিয়েছে? তার সম্পত্তি কিংবা টাকাপয়সার প্রয়োজন ছিলনা আমার। আমাকে নায়র নিতেও বলিনি কখনো। আমি শুধু চেয়েছিলাম, আব্বা নিয়মিত আমার খোঁজ নিক। কিন্তু সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে, নাজমা নামের তার একটা মেয়ে ছিল, সেটা ভুলে গেছে। সেই মানুষকে আমি অযথা কেন দাওয়াত করতে যাব? আবার তার ছেলেমেয়েরাও আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। প্রথমদিকে আমিই দরদ দেখিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে গেছি। কিন্তু তারাও তাদের পিতার মত আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। তাই তাদেরও দাওয়াত করার প্রয়োজনিয়তা দেখছিনা। ”
” আমার বাড়িতে এসে কিন্তু তুমি কম কষ্ট সহ্য করোনি। আমার মা-বোনেরা কম অপমান-অসম্মান করেনি তোমাকে। কিন্তু তারপরও তুমি তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করোনি। আমার মায়ের সেবাযত্ন করছ, আমার বোনদের বছরে দুই-চারবার নায়র নিয়ে আসছ। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সর্বপ্রথম তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছ। আমার বোনদের প্রতি যদি এত দ্বায়িত্ব পালন করতে পার, তবে নিজের আব্বা আর ভাইবোনদের প্রতি কেন এই অবিচার? ”

” কারন জানতে চাইছ? তোমার মা, তোমার বোন ওরা তোমার আপনজন। আমিতো তাদের কাছে বাহিরের মেয়ে। অন্য বাড়ির মেয়ে। তাই তারা আমাকে হাজার অপমান, অসম্মান করতেই পারে। তারা অপমান, অসম্মান করলে ততটাও আঘাত লাগেনা, যতটা নিজের মানুষ করলে লাগে। আমার আব্বা? সে-তো আমার জন্মদাতা? সে কিভাবে পারল, তারই ঔরসজাত সন্তানকে পর করে দিতে? তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র সন্তানরাই তার কাছে আপন। আমি কেউ নই। বিয়ের দিন সেই যে এই বাড়িতে আসলাম, তারপর এক দিনের জন্যও আমার খোঁজ নিলনা, আমাকে দেখতে আসলনা। আমিই কতদিন একে-তাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। কিন্তু সে আসেনি। সে যদি বাবা হয়ে আমাকে ত্যাগ করতে পারে, তবে মেয়ে হয়ে আমি কেন পারবনা? যে বা যারা আমার দুঃখের দিনে আমার পাশে ছিলনা, তাদেরকে আমার সুখের দিনে আমার পাশে চাইনা। তোমার মা-বোনেরা আমাকে হাজার অপমান করলেও আমি খবর দেয়ার সাথে সাথে ওরা ছুটে এসেছে। ওদেরকে আমি কি়ভাবে ফেলি বল? এসব নিয়ে আর কোন কথা হবেনা। ”

অবনী চাচার হাতে পানির গ্লাস দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। বড়মার চোখে পানি দেখে ওর কান্না পাচ্ছে। ও ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই বড়মার বাবার বাড়ির কাউকে দেখেনি কিংবা কখনো বড়মাকে বাবার বাড়িতে যেতে দেখেনি। ও যখনই বড়মাকে জিজ্ঞেস করত তখনই বড়মা বলত, আমার কেউ নেই। তখন বড়মার কষ্ট না বুঝলেও আজ অবনী ঠিকই বড়মার কষ্ট বুঝতে পারে। এই মানুষটা হাসির আড়ালে কতশত কষ্ট গোপন করে রেখেছে, তা কেবল সে-ই জানে। গুটিগুটি পায়ে অবনী গেল বড়মার কাছে। হাত দিয়ে মুছে দিল বড়মার চোখের পানি। ভাঙ্গা গলায় বলল,

” তুমি কাঁদবেনা বলে দিচ্ছি। তুমি জানোনা, তোমার চোখে পানি দেখলে আমারও কান্না পায়? কাদের জন্য কাঁদছ তুমি? যারা ভয়ে তোমার দ্বায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেছে? যারা ভেবেছিল, তোমার সাথে সম্পর্ক রাখলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। তাদের জন্য কিসের এত কান্না তোমার? ওরা তোমাকে যতটা আঘাত দিয়েছ, তুমিও এবার সেই আঘাতের শোধ নাও। এবার সেই সময় এসেছে। তুমি তাদের দেখিয়ে দাও, তারা তোমাকে ত্যাগ করলেও বড় চাচা তোমাকে ত্যাগ করেনি। তোমার ছেলেরা তোমাকে ত্যাগ করেনি। তাদের থেকে তুমি বেশি সুখী। তোমার ছেলেরাও অযোগ্য নয়। তোমার সুখ তাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে, তোমার এত বছরের আঘাতের শোধ নাও তুমি। তাদেরকে বুঝতে হবে, তারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে। তারা একরকম তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই তুমিই এখন তাদের থেকে শতগুনে ভালো আছ। তোমাকে রিকুয়েষ্ট করছি, মা। তুমি তাদের ইনভাইট কর। এই সুযোগে আমরাও দেখতে পাব তোমার আব্বা আর তোমার ভাইবোনদের। তোমার সৎমাকেও দেখার ইচ্ছে হয়। একটা মানুষের কতটা ঝাঁঝ থাকলে বাবা আর মেয়েকে আলাদা করতে পারে, সেই মানুষকে দেখতে ইচ্ছে করে। প্লিজ, মা, আমার রিকুয়েষ্ট রাখ। ”

” তুই আবারও কথা বলছিস? কতবার তোকে বলেছি, বড়দের ভেতর কথা বলবিনা। কথাটা কি তোর মনে থাকেনা? ”
” চার বছর আগে থেকেই আমি বিবাহিতা, মেডিকেলে পড়ছি। এখনো যদি আমাকে তোমার ছোট মনে হয়, তবে এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। শোন, সংসার জীবনের পুরোটা না বুঝলেও কিছু কিছু বিষয় আমি খুব ভালো বুঝি। তাই এখন থেকে মাঝেমধ্যে আমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। তুমি ঠকবেনা এই গ্যারান্টি না দিলেও ঝকমারি একটা সিন ক্রিয়েট হবে এটার নিশ্চয়তা দিতে পারি। আর মাঝেমধ্যে কিছু কিছু সিন ক্রিয়েট হওয়া দরকার। এটা শরীরের জন্য উপকারী, তাইনা বড় চাচা? একমত হলে, ‘ হ্যাঁ ‘ বল, দ্বিমত থাকলেও, ‘ হ্যাঁ ‘ বল। এই ‘ হ্যাঁ ‘ আবার তোমার শরীরের জন্য উপকারী। ”
” আমি তোর সাথে একমত। অবনী ভুল কিছু বলেনি, নাজমা। তুমি রাজি হয়ে যাও। আমি তোমার বাপের বাড়ির লোকজনদের দেখিয়ে দিতে চাই, আমার পুত্রবধূটি একটা রত্ন। তোমার বাপের গোষ্ঠীতে কয়টা ডক্টর আছে সেটাও দেখতে চাই। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি , শালা-শালীকে দেখাতে চাই আমার ছেলেরা একেকটা খাঁটি রত্ন। ঠিক বলেছি তো, মা? ”

” একটা বিষয় বাদ গেছে চাচা, তাদেরকে আরও দেখাতে হবে তোমার পুত্রবধূ এই এলাকার সেরা সুন্দরী। সে মেডিকেলে না পড়লেও, তার রূপে আশেপাশের দশ গ্রাম আলোকিত হয়ে থাকত। পুরো জেলার ছেলেদের হার্টথ্রব তোমার পুত্রবধূ। তাকে না দেখলে তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের একজনকে দেখতে পাওয়া হবেনা। তারা এই বিরল সৌন্দর্য মিস করবে। ঠিক বলেছিনা, বাবা? ”
” একশোবার ঠিক বলেছিস, হাজারবার ঠিক বলেছিস। রাজি হয়ে যাও, নাজমা। ”
” একটু সংশোধন করতে হবে, বাবা। তোমার মনে রাখতে হবে, তোমার ছেলের বউ আর পাঁচজন বউদের মত নয়। সে একজন ভবিষ্যৎ ডক্টর এবং সেই সাথে সেরা সুন্দরীদের একজন। তাই তার ক্ষেত্রে একশোবার, হাজারবার কথাটা বলা ভুল। বলতে হবে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন। এবার সঠিকভাবে বল। ”
” বলছি, বলছি। তুই মিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, বিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, ট্রিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, মা। রাজি হয়ে যাও নাজমা। ”
নাজমা আক্তার দু’জনের অভিনয় দেখে হেসে ফেললেন।

” ওরে ঢংগী মেয়ে, এবার থাম। এত ঢং তুই জানিস? ”
” আমি কি ভুল কিছু বলেছি, শ্বাশুড়িমা? মনে কর তোমার বজ্জাত বাপ অসুস্থ হয়ে গেল, তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে গেল। আমি তখন ডিউটিতে আছি। বেডে কাতরানো নানা শ্বশুরকে দেখামাত্র চিনে ফেললাম। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলাম। এর ফলেই তোমার বাপ সুস্থ হয়ে গেল। সুস্থ হয়েই তোমার বাপ মনে কর ফল মিষ্টি নিয়ে তোমার বাড়িতে আসল। ইচ্ছে হলে সম্পত্তিও লিখে দিল। বিষয়টা ভালো হবেনা বলো? সেই সাথে আমারও সুনাম হল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হও, মা জননী। ”

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৫

হাসতে হাসতে শ্বাস বন্ধ হওয়ার দশা নাজমা আক্তারের। তিনি অনেক কষ্টে হাসি থামালেন।
” অনেক হয়েছে, এবার থাম। তোর চাচাকে বল তার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত করতে। পারলে যেন তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে দাওয়াত করে। ”
” চৌদ্দ গোষ্ঠী নয় মা, বল আঠারো গোষ্ঠীকে দাওয়াত করতে। বড় চাচা, রেডি হয়ে যাও। তোমার শ্বশুরকে ফোন লাগাও। ”
ইশরাক এতক্ষণ ড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। সেই পুরোনো অবনীকে যেন দেখতে পেল সে। একটু দুষ্টু, পুরোটাই মিষ্টি সেই অবনী। যে অবনী দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। আনমনেই হেসে উঠল ইশরাক।

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৭