হলুদ বসন্ত পর্ব ৩৭
জাওয়াদ জামী জামী
পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো মাস। এরইমধ্যে আব্দুর রহিম মারা গেছেন। দাদুর মৃত্যুর খবর শুনে ইশরাক সবাইকে নিয়ে গ্রামে ছুটে গিয়েছিল। আজ তিনমাস পরও দাদুর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি বৃদ্ধের চার নাতি-নাতনি। ইশরার, অবনী, সাদাফ, অর্নি ওরা চারজনই দাদুকে প্রচন্ড ভালোবাসত। আজও ওরা দাদুর জন্য কাঁদে।
অর্নি বুয়েটে চান্স পেয়েছে। সাদাফের পড়াশোনা শেষ। অবনী ইন্টার্নী করছে। আর কিছুদিন পরই চাকরিতে জয়েন করবে। ইশরাকও বিসিএসএ টিকে পররাষ্ট্র ক্যাডার হয়েছে। ফাউন্ডেশন কোর্স শেষ করে এখন সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারি সচিব পদে কর্মরত। মোটকথা ওদের দু-বোন পেয়েছে পরিপূর্ণ সুখের সংসার। কারও কোন অভিযোগ নেই। এবং স্বামীদেরকে কোন অভিযোগের সুযোগও দেয়না।
সাদাফ অর্নিকে নিয়ে ঢাকার বাহিরে গেছে। দুইদিন পর ওরা ঢাকায় ফিরবে৷ বাসায় শুধু অবনী একা একা বিরক্ত হচ্ছে। কয়েকবার ইশরাককে ফোন দিয়েছিল কিন্তু সে একটা পার্টি এ্যাটেন্ড করতে গাজীপুর গিয়েছে। তার ফিরতে রাত হবে৷ অলস সময় পার করতেই ফোন দিল বড়মাকে। বড়মার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, মায়ের সাথে কথা বলল। এরপর কথা বলল দাদির সাথে। আজকাল দাদি বদলে গেছে। মেয়েদের লোভ তাকে বদলাতে বাধ্য করেছে। আব্দুর রহিমের মৃত্যুর পর সে তার মেয়েদের কাছে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মেয়েরা তাকে নিজেদের কাছে রাখেইনি উল্টো আব্দুর রহিম কোন টাকাপয়সা রেখে গেছে কিনা সেটা নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিল। এবং এক পর্যায়ে তারা বলেই ফেলে, খরচ না দিলে তারা কেউই কুলসুম বেগমকে নিজেদের কাছে রাখবেনা। এমনকি তারা আব্দুর রহিমের সকল সম্পত্তির দলিল দেখে আবারও সম্পত্তির দাবী করে বসে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অথচ আইনানুসারে তারা আর কোন সম্পত্তি পায়না। ইসহাক আজাদ সেই কথা বোনদের বুঝিয়েও কুল-কিনারা করতে পারলেননা। এক পর্যায়ে তারা ইসহাক আজাদকে হুমকিধামকি দিতে শুরু করল। বাধ্য হয়ে ইশরাককে নাক গলাতে হল। ইশরাক চেয়েছিল বাবাকে বলে সম্পত্তির কিছু অংশ ফুপুদের দিতে। কিন্তু তারা যখন ইসহাক আজাদকে মামলার ভয় দেখাল, তখন বেঁকে বসল ইশরাক। ফুপুদের অন্যায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে আইনজীবীর সহায়তা নিল। যখন আব্দুর রহিমের মেয়েরা বুঝল তারা অন্যায় আবদার করেছে, ঠিক তখনই ইসহাক আজাদ তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, বোনদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাননা তিনি। প্রথমবারের মত ইসহাক আজাদের পক্ষ নিল তার মা। সে নিজের ভুল বুঝতে পারল। এবং সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওয়াহাব আহমেদকে ছেলে হিসেবে মেনে নিল। অবনী অর্নিকে নাতিবউ হিসেবে গ্রহন করল। নিজের কয়েক ভরি গহনা ভাগ করে দিল অবনী অর্নিকে৷ এখন সে প্রতিদিনই অবনী অর্নির সাথে ফোনে কথা বলে। কথা শেষ করে অবনী রান্নাঘরে গেল। ইশরাকের পছন্দের খাবার রান্না করল। আজ ও ইশরাককে সারপ্রাইজ দিতে চায়।
রাত এগারোটায় ইশরাক বাসায় আসল। ফ্রেশ হয়ে আসলে অবনীর জোড়াজুড়িতে ক্ষুধা না থাকা স্বত্বেও খেতে হল।
” তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। বলতো কি? ” বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে ইশরাক অবনী। ইশরাক তার রমনীকে বাহুডোরে বেঁধে রেখেছে। অবনী শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে ইশরাকের ওপর।
” সারপ্রাইজই যদি হবে, তবে আমি জানবো কিভাবে! তুই-ই বলে দে সারপ্রাইজটা কি। ” অবনীর ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলল।
অবনী ইশরাকের দিকে ফিরল। ইশরাকের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর পেটে রাখল।
” তুমি মামা হতে চলেছ, ভাইয়া। ”
ইশরাক প্রথমে অবনীর কথা বুঝতে না পারলেও কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝে নিল। আর প্রায় সাথে সাথেই ওর বাম হাত উঠে গেল বুকের বা পাশে। টলে উঠল পা দুটো। শ্বাস নিচ্ছে আওয়াজ করে। কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে মুখ খুলল সে।
” বেয়াদব মেয়ে, এভাবে কেউ কাউকে সারপ্রাইজ দেয়? আরেকটু হলেই আমার প্রানটা বেরিয়ে যেত। আমারই সন্তানের মামা বানিয়ে দিয়েছিস আমাকে! ”
” তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে, তুমি তার মামা হবেনা? তুমি তার মামা, বাবা, আবার একদিক দিয়ে চাচাও হবে। বহু সম্পর্ক এক জায়গায় এসে জটলা পেকে গেছে। ”
” আল্লাহ রক্ষা কর। আবার চাচা হব কোনদিক দিয়ে? ” ইশরাক পারলে হাউমাউ করে কাঁদে।
” অর্নির দিক দিয়ে। ওর খালামনির ভাসুর, মানে ওর চাচা। ”
” তুই আসলে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাসনি, তুই চেয়েছিস আমার বারোটা বাজাতে। সব সম্পর্ক বাদ। সে শুধু আমার সন্তান। আমি তার বাবা। আর একদিন যদি এমন উল্টাপাল্টা কথা বলিস, তবে তোর কানের তিন ইঞ্চি নিচে লাল করে দেব। ” অবনীকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল ইশরাক।
” তুমি আমাকে বকছ! পুরোনো হয়ে গেছি আমি? আর ভালো লাগছেনা আমাকে? ” অবনী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
” কাঁদিসনা, বউ। তোকে আমি বকতে পারি বল? তোর দেয়া সারপ্রাইজ আরেকটু হলে আমার জান নিয়ে নিত। তাই তোর ওপর একটু বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরেছে। সরি, বউ। ”
” আমি ভুল কি বলেছি? বিয়ের আগে তুমি আমার ভাইয়া ছিলে, সেই হিসেবে যে আসছে তার মামা হও তুমি। বিয়ের পরের হিসেবে তুমি ওর বাবা৷ আবার অর্নির দিক দিয়ে, তুমি ওর চাচা। তুমি না বুঝে অযথাই আমাকে বকলে। ” ঠোঁট ফুলিয়ে বলল অবনী।
” আল্লাহ এ কে এসে জুটেছে আমার ভাগ্যে! এ নাকি দুইদিন পর ডক্টর হবে! বইন, তুই আর যাই করিস অবস্টেট্রিশিয়ান গাইনিকোলোজিষ্ট হোসনা। দেখা যাবে তোর কাছে কোন প্রসূতি আসলে তার চিকিৎসা না করে তাকে তুই সম্পর্কের সমীকরণ বোঝাতে থাকবি। শেষে পাগল উপাধি নিয়ে সাইকাইআ্যাট্রিক হসপিটালে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে তোকে। যেটা আমি কখনোই চাইবনা। ”
” ইশরাকের বাচ্চা, তুই আমাকে নিয়ে মজা করছিস? তুই ছাড় আমাকে। আজ থেকে তুই গেস্ট রুমে থাকবি। আমার আশেপাশে তোকে যেন না দেখি। ” রাগে গজগজ করছে অবনী।
” এমন নিষ্ঠুর আদেশ তুমি করোনা, বউ। তোমাকে ছাড়া একটা রাতের দশ মিনিট সময়ও আমার অন্য কোথাও কাটানো সম্ভব নয়। তুমি জানোনা, আমার অক্সিজেন তুমি? এরপর থেকে ভুলভাল কথা বলোনা। ইশরাকের বাচ্চা আমি না যে আসতে চলেছে সে হবে। আজকে থেকে নিয়ম মেনে চলতে হবে তোমাকে। নিজের খেয়ালখুশি মত কিছুই করা যাবেনা। আমি চাই আমার সন্তান নির্বিঘ্নে পৃথিবীতে আসুক। ওর পৃথিবীতে আগমনের পথ আমি মসৃণ করতে চাই। ”
ইশরাকের মুখে ‘ তুমি ‘ ডাক শুনে চোখমুখ কুঁচকে তাকায় অবনী।
” খবরদার আমাকে ‘ তুমি ‘ বলবেনা। তোমার মুখে ‘ তুই ‘ ডাক শুনতেই ভালো লাগে আমার। ”
অবনীর কথা শেষ না হতেই ইশরাক ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমে গেল। আজ ওর ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে পুরো দুনিয়াকে জানাতে। নিজের অংশ আসতে চলেছে পৃথিবীতে। খুশিতে পাগল পাগল লাগছে। কিন্তু এই পাজি মেয়ে ওর আনন্দের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে৷ তাই উচ্ছ্বাস চেপেই রাখল। মেতে উঠল অবনীতে।
ইশরাকের কাছ থেকে সুসংবাদ পেয়ে সাদাফ তখনই অর্নিকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিল। ওদের বংশে প্রথম সন্তান আসতে চলেছে। এমন খুশির দিনে সবাইকে নিয়ে একসাথে আনন্দ না করলেই নয়। নাজমা আক্তার, মিনারা খাতুনেরও একই অবস্থা। তারা খবরটা শোনামাত্রই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। মিনারা খাতুন এটাসেটা রান্না করলেন মেয়ের জন্য। নাজমা আক্তার বারবার অবনীর কাছে ফোন করে জানতে চাইছেন, ওর কি কি খেতে ইচ্ছে করছে। শ্বাশুড়ি আর মায়ের উচ্ছ্বাস ফোনের অপরপ্রান্ত থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে অবনী। ও লজ্জায় লাল হচ্ছে শুধু।
হলুদ বসন্ত পর্ব ৩৬
একদিন পরেই গ্রাম থেকে সবাই হাজির হলেন ঢাকায়। বাসায় ঢুকেই কুলসুম বেগম জড়িয়ে ধরে চুমু দিল অবনীর কপালে। ব্যাগ থেকে সোনার চেইন বের করে পরিয়ে দিল অবনীর গলায়।
” মানুষটা আইজ বাঁইচা থাকলে কত খুশি হইত। ইশু দাদু আর তুই হের খুব আদরের আছিলি। তার সেই আদরের নাতি-নাতনিগোর সন্তান আইতাছে দুনিয়ায়। হের থাইকা খুশির খবর তার কাছে আর কিছুই হইতনা। এত খুশির দিনে মানুষটা নাই গো। ” ডুকরে কেঁদে উঠল কুলসুম বেগম।
দাদির সাথে সাথে কেঁদে উঠল অবনীও। কাঁদছে সবাই। আব্দুর রহিমের শূন্যতা তারা উপলব্ধি করছে গত কয়েকমাস যাবৎ। এ শূন্যতা পূরনের নয়৷