হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৩

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

আজ রোদের তেজ বড়ই বেশি। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাও দুষ্কর। হাসুর মা ভেবেছিল ঘরে থাকা মসুরের ডালগুলো সব বের করে উঠোনে রোদ দিবে। কিন্তু সকাল থেকে বাড়ির যেই অবস্থা তার জন্য সব কিছুই যেন থেমে গেছে। তার ছেলে মনিরের বউ রোকসানা সকাল থেকেই কেঁদে যাচ্ছে। সে নাকি মনিরের ফোনে কোন মেয়ের সাথে মনিরের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেছে। মনিরকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে স্পষ্ট করে তো কিছু বলছেই না তার উপরে চেঁচামেচি, গালাগালি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। বাড়ির পরিবেশটাই যেন কেমন পাল্টে গেছে। হাসুর মা মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাসুও বাড়িতে নেই। এই সমস্যার সে কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। খোদেজা এসেছিল প্রতিবেশী হাসুর মার কাছে রান্নার জন্য কিছু সরিষা চাইতে। এসে দেখলো মনির বউয়ের সাথে কি নিয়ে যেন চেঁচামেচি করে বাইরে চলে গেলো। হাসুর মাও ঘরের সামনের খুঁটির সাথে উদাস মনে হেলান দিয়ে রয়েছে। মনিরের কথার ধরন দেখে খোদেজা ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারলো। তাই আর কিছু না ঘেঁটে চুপচাপ সেখান থেকে চলে এলো সে। নিজের দাওয়ায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলা বোঝার চেষ্টা করলো। তার ছেলে আর ছেলের বৌ গেছে শহরে। না জানি আসতে আসতে কতক্ষণ লাগে!

গ্রামের পথে আসতেই শুদ্ধ খেয়াল করলো সরকারি দপ্তর থেকে কিছু লোক এসে পাকা সড়কে কিছু ফিতা নিয়ে কি যেন মাপামাপি করছে। এই সড়কের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া অঞ্চলে মাঝে আরেকটা রাস্তা পাকা করা হবে। তারই পরিকল্পনা চলছে। শুদ্ধ উপলব্ধি করলো রূপনগর আর তাদের আশেপাশের গ্রামগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া খুব ভালো মতোই লেগেছে। গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তা ঘাট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি সবই আছে। গ্রামটি শহরের কাছ ঘেঁষে হওয়াতেই সব সুযোগ ভালো মতো পাচ্ছে তারা। এই তো বছর কয়েক আগেও তো শুদ্ধ যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিল তখনও তো এই গ্রামের অবস্থা এতোটা ভালো ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। বর্ষাকালে বৃষ্টি এলে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে হাঁটার মতো অবস্থাও থাকতো না। আজ সেখানে সবকিছু কতো সুন্দর! কিন্তু শুধু রাস্তাঘাট পাঁকা হলেই কি তাকে উন্নত বলা যায়? আসল উন্নতি তো তখন হবে যখন এই গ্রামের মানুষের চিন্তা চেতনার দুয়ার হবে বিস্তৃত, অজ্ঞতা মুক্ত ও কুসংস্কারহীন। সেই উন্নতি রূপনগরে কতটা হয়েছে তা ঠিক শুদ্ধ’র জানা নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অটো থামিয়ে অটোচালক অন্যদের সাথে কথা বলে জানতে পারলো, এই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে৷ শুদ্ধ ভীষণ বিরক্তবোধ করলো। এমনিতেই ধারাকে নিয়ে তার বন্ধুর কাছে দুই ঘন্টার মতো পড়িয়ে তারপর এসেছে। সাধারণত রোজ বিকেলেই শহরে ধারাকে নিয়ে বন্ধুর কাছে প্রাইভেট পড়াতে যায় শুদ্ধ। আজ তার বন্ধুর বিকেলে কিছু কাজ থাকায় সেই পড়া বিকেলে না পড়িয়ে সকালেই পড়িয়ে দিয়েছে। রূপনগর থেকে মূল শহর খুব বেশি দূরে নয়। অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিট। যদিও রোজ আসা যাওয়ার জন্য একটু সমস্যাই। তবুও তার বন্ধুকে রাজী করিয়ে যে দুই মাস তার কাছে ধারাকে একা পড়াতে পারছে তাই বেশি। অটোতে বসে থাকতে থাকতে গরমে ঘাম ছুটে যাচ্ছে শুদ্ধ ধারার। অটো থেকে একবার মাথা বের করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ ধারাকে বলল,
‘চলুন ধারা নেমে যাই। এখানে কতক্ষণ বসে থাকতে হয় না হয়! দেরি হয়ে যাবে। এখান থেকে আমাদের বাড়ি গ্রামের ছোট পথে গেলে খুব বেশি দূরে নয়। তবে যাওয়ার সময় একটা ছোট সাঁকো পরে। আপনি সাঁকো দিয়ে যেতে ভয় পান না তো!’

সাঁকো দিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা হলেও ধারার সাঁকো তে একেবারেই যে ভয় লাগে না তা বলা যায় না। তবুও সেই কথাটা সে শুদ্ধকে বলল না। আবার না খোঁচারাজ কোন কথায় পরে এ নিয়ে খোঁচা দিয়ে বসেন! তাই শুদ্ধ’র কথায় হেসে মাথা দুলিয়ে সে সায় দিলো। অটো থেকে নেমে পড়ে গ্রামের শর্টকাট পথ ধরলো তারা। একেকজনের বাড়ির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শুদ্ধ’র সাথে থাকা অচেনা সুন্দরী মেয়েটিকে। ধারার সংকোচ হতে লাগলো। অবশেষে সব বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যখন তারা মরা খালের কাছে চলে এলো তখনই একটু স্বস্তি হলো ধারার। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকলো না। সামনে চওড়া খাল। তার উপর দিয়ে সোজা চলে গেছে বাঁশের নড়বড়ে লম্বা সাঁকো। শুদ্ধই আগে চড়লো সাঁকো তে। তারপর ধারা।

দুজন মানুষের কদম পড়তেই সাঁকো দুলতে শুরু করে দিলো। পায়ের নিচে শুধু একটাই বাঁশ। তাকেই আশ্রয় করে যেতে হবে ওপারে। ধরে ধরে হাঁটার জন্য পাশ দিয়ে উপরে আরেকটা বাঁশকে আড়াআড়ি ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। সেটাই ভালো মতো হাত দিয়ে ধরে রেখে সাবধান সাঁকো পার হতে লাগলো তারা। সাঁকো টা কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে আছে। বোধহয় একটু আগেই কেউ ভেজা পায়ে পার হয়েছিল। ধারা খুব আস্তে আস্তে পার হতে লাগলো। বুকের মধ্যে হৃদস্পন্দন কিছুটা হলেও বেড়ে গেছে তার। যদিও খালে পানি একদম নেই বললেই চলে। পানির নিচ থেকে আঠালো মাটিও চোখে পড়ছে। খানিক শঙ্কিত মুখে সেদিকেই বারবার চোখ দিচ্ছিল ধারা। এখানে একবার কেউ যদি পড়ে একেবারে কাঁদায় নাস্তানাবুদ হয়েই উঠতে হবে তার। ভাবতে ভাবতেই পা পিছলে গেলো ধারার। সে নিজে পড়লো তো পড়লোই সাথে করে বাঁচার জন্য সামনের শুদ্ধ’র শার্ট খামছে ধরায় তাকেও নিয়ে পড়লো। ঝপ করে একপ্রকার বিকট শব্দ হলো খালের সেই কাঁদা পানিতে। খানিক নাকানিচুবানি খেয়ে দুজনেই সোজা হয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো পানিতে। কাঁদায় মাখামাখি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে তারা। শুদ্ধ বলল,

‘এটা কি হলো ধারা?’
হাত দিয়ে চুলের কাঁদা পরিষ্কার করতে করতে ধারা বলল, ‘আমি কি জানি! আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?’
‘আপনার সাঁকো তে সমস্যা হলে সেটা আমাকে আগে বলবেন না!’
‘বললে কি হতো? সেই তো আপনি আবার আমাকে পরে এটা নিয়েও ঠাট্টা করতেন। তাই বলিনি।’
‘ঠাট্টার ভয়ে কাঁদায় মাখামাখি হওয়া আপনার বেশি উপযোগী মনে হলো? কি অদ্ভুত! আচ্ছা, আপনার কি কোন পড়ে যাওয়ার রোগ আছে? এই নিয়ে আপনি আমার সামনেই ঠিক কয়বার পড়লেন বলুন তো?’
চোখে ঠাট্টার ভাব ফুটিয়েই শুদ্ধ ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধারা মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ঐ যে শুরু হয়ে গেল! খোঁচারাজ ইজ ব্যাক।’

ধারা তাড়াহুড়ো করে উঠার চেষ্টা করতেই আঠালো মাটির চুম্বকে আবার বসে পড়লো। সামনে আগানো তো দূর! এক পা তুলতে গেলে আরেক পা দেবে যায়। এ দেখি মহা সমস্যা!
খানিক এমন ভাবেই চেষ্টা মেষ্টা চালিয়ে ধারা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
‘এ মা! এ তো উঠাই যাচ্ছে না। এভাবে কি কাঁদার মধ্যেই আটকে থাকবো নাকি! এখন কি হবে?’
শুদ্ধ নির্বিকার গলায় বলল, ‘কি আর হবে? এখানেই একটা সংসার পেতে বসবো। দুই তিনটা বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করবো। তারাও এই কাঁদার মধ্যেই মনের আনন্দে লুটোপুটি খেলবে। আমাদের কাঁদায় মাখানো সুন্দর লুটোপুটি সংসার। দারুণ হবে কিন্তু! কি, দারুণ না ধারা?’

ধারা কটমট করে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে বসে রইলো শুদ্ধ। ধারা আবারো এক দমক হুটোপুটি করে উঠার চেষ্টা করলে শুদ্ধ বলল, ‘এমন ভাবে উঠলে কোনদিনও উঠতে পারবেন না ধারা।’
এই বলে শুদ্ধ খুব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। এক পা সাবধানে সামনে বাড়িয়ে আবার অনেকক্ষণ পর আরেক পা বাড়ালো। তারপর ধারার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘এভাবে উঠুন।’
শুদ্ধ’র হাত ধরে ধারা এরপর সাবধানেই খাল থেকে উঠে এলো। এরপর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যেকজনই তাদের দুজনকে দেখলো মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। এমন ভরদুপুরে দুজন কাঁদায় মাখা মানব মানবীকে দেখলে যে কারোরই অবাক হবার কথা। বাড়ির কাছে আসলে খোদেজা ওদের দুজনকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে উঠলো। তারপর সব ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
‘আগে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে নে তোরা। তারপর বাকিটা শুনবো। কি যে করিস না তোরা।’

চুলায় রান্না বসানো ছিল তার। তাই তাড়াতাড়িই সরতে হলো তাকে। খোদেজা রান্নাঘরে চলে গেলে শুদ্ধ ধারা চলে এলো পুকুর পাড়ে। সকালে শহরে যাবার আগে দুজনেই গোসল সেরে জামাকাপড় পুকুড় পাড়ে তারের উপর রোদে শুকাতে দিয়েছিল। গোসলে ঢোকার আগে তা সেখান থেকে নেবার জন্য দুজনে যখন একসাথেই হাত বাড়ালো তখন শুদ্ধ বলে উঠলো,
‘আপনি এখন জামাকাপড় নিচ্ছেন কেন? গোসলখানায় এখন আমি যাবে।’
‘ইশ! বললেই হলো। আমি আগে জামাকাপড় নিতে এসেছি তাই আমি যাবো।’
‘জ্বি না। আপনি আগে না। আমরা দুজনে একসাথেই নিয়েছি।’
‘তাহলে আপনি আগে যেতে চাচ্ছেন কেন?’

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১২

‘কারণ দোষটা আপনার। আপনি আমাকে টেনে না ধরলে তো আর আমি খালে পড়তাম না।’
‘আচ্ছা! আর আপনি যদি ঐ শর্টকাটে না আসতে চাইতেন তাহলে আমরা কেউই খালে পরতাম না। তাই মূল দোষটা আপনার।’
‘বললেই হলো! আমি তো আপনাকে আগে জিজ্ঞাসা করেই নিয়েছিলাম সাঁকোর ব্যাপারে। কিন্তু আপনিই তখন হিরো সাজার জন্য…ওপস! সরি, হিরোইন সাজার জন্য কিছু বলেননি আর আমাদেরকে খালে পড়তে হয়েছিল।’
যুক্তিতে হেরে যাবার মুখোমুখি হতেই ধারা কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘তাতে কি হয়েছে? এমনিতে তো কত বড় বড় কথা বলেন। লেডিস ফার্স্ট, এটা জানেন না? তাই আমিই আগে যাবো।’
পাশের টলমলে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময়ী হাসি ঠোঁটে চেঁপে শুদ্ধ ধারাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ধারা, আপনি সাঁতার পারেন?’

নিজের ঠাঁট বজায় রেখেই ধারা দ্রুত জবাব দিল,
‘হ্যাঁ।’
‘সিরিয়াসলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘শিওর তো?
বারবার একই প্রশ্ন করায় ধারা কপট বিরক্তের স্বরে বলল,
‘আরে হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ! এখন এইটাও কি আপনাকে করে দেখাতে হবে?’
শুদ্ধ নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
‘তাহলে তো মন্দ হয় না।’
কথার সারমর্ম বোধগম্য না হতেই এক সেকেন্ডের মধ্যেই ধারাকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে দিয়ে শুদ্ধ এক ধাক্কায় পুকুরে ফেলে দিল তাকে। তারপর নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পানিতে গিয়ে পড়লো।

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৪