হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৮

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সেদিনের মতো আজ ভরা পূর্ণিমা না হলেও আকাশে মেঘের লুকোচুরির আড়ালে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে অর্ধচন্দ্রটি। পুকুরের ওপাশে একরাশ অন্ধকার। ঝোপের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে একঝাঁক জোনাকির দল। তাদের মৃদুমন্দ আলোতে সৃষ্টি করেছে নজরকাড়া পরিবেশ। শুদ্ধ বসে আছে পুকুরপাড়ে বানানো বাঁশের মাচায়। পাশে ধারাও। ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ আছে। তবুও ইচ্ছে করেই ধারাকে নিয়ে বাইরে এসেছে শুদ্ধ। ধারা আজ দুপুরে খাবার পর থেকে একটানা পড়েছে। পরীক্ষা নিকটে। বলাবাহুল্য পড়ার চাপ একটু বেশিই। তাই পড়তে পড়তে ধারার একঘেয়েমি দূর করতেই তাকে নিয়ে বাইরে আসা। অল্প সময়ের হাওয়া বদল মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে। বসে থাকতে থাকতে শুদ্ধ ধারাকে বলল,

‘ধারা, আমি এখন ফোন দেখে দেখে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। এগুলো পূর্ব বছরের প্রশ্নব্যাংক। দেখি আপনি কতগুলো পারেন। এটাই প্রমাণ করবে আপনার প্রিপারেশন কেমন?’
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে সাধারণ জ্ঞানের অংশ থেকে প্রথম প্রশ্নটি করলো। ধারা সঠিক উত্তরটাই দিলো। এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করলেও ধারা বলতে পারলো। মাঝের একটা আইকিউ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। আরেকটা ভুল বলল। এরপর আরেকটা প্রশ্ন করলে ধারা কিছু বলছে না দেখে শুদ্ধ অপশন চারটি বলল। ধারা একটা উত্তর বলে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে শুদ্ধর প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ মাথা নেড়ে ইতিবাচক ইশারা দিয়ে মুচকি করে হাসলো। ধারা আনন্দিত হয়ে উঠলো। তার থেকেও বেশি খুশি হলো শুদ্ধ। পনেরো টা প্রশ্নের মধ্যে বারোটারই সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে ধারা। যেখানে বেছে বেছে শুদ্ধ কঠিন প্রশ্নগুলোই করেছিল। খুশির জোরে হঠাৎ করে ওরা দুজন একটা হাই ফাইভও করে ফেললো। শুদ্ধ উৎফুল্ল হয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ধারা, আপনি খুব ভালো করছেন। আমার মনে হয় আপনি পারবেন।’
ধারা মৃদু হেসে মাথা নিচু করলো। শুদ্ধ বলল,
‘আপনার পরীক্ষার সময় তো আপনাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে৷ তারপর দুইদিন থেকে আবার ফেরত চলে আসবো। এর জন্য আমার কাজগুলো আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে হবে। একবার চান্স পেয়ে গেলে তো আবারো যেতে হবে তারপর তো একেবারে ভর্তি করে আপনাকে হলে রাখার ব্যবস্থা করেই আসতে হবে।’
কথাটা বলতে বলতেই শুদ্ধ’র গলার আওয়াজ হঠাৎ কমে এলো। ধারা উদ্গ্রীব হয়ে বলল,
‘রেখে আসতে হবে মানে?’
শুদ্ধ জোর করে একটু হেসে বলল, ‘ঢাকায় থেকেই তো আপনাকে পড়তে হবে। রোজ রোজ তো আর আপনি গ্রাম থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবেন না। ইউনিভার্সিটির কাছেই হলে থাকবেন। মন দিয়ে পড়ালেখা করবেন।’
ধারার কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেলো। কি বলবে না বলবে সে ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘আচ্ছা, আপনিও তো দূরে থেকে পড়ালেখা করেছেন। এভাবে দূরে থাকতে আপনার খারাপ লাগেনি?’

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুদ্ধ মুখে হাসি টেনে সামনে দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘কখনো কখনো বড় কিছু অর্জনের জন্য ছোট ছোট এই অনুভূতিগুলোকে আড়াল করতে হয় ধারা। আপনি সেখানে গিয়ে পড়বেন, খুব বড় হয়ে একদিন ফিরে আসবেন। ফিরে তো আসবেনই। এই যে আমিও তো এসেছি। সেই দিন পর্যন্ত থেকে যায় শুধু আপনজনদের নিরন্তর অপেক্ষা।’
এরপর ধারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে শুদ্ধ বলল, ‘এখন কোন ধরণের দূর্বল অনুভূতিকে মনে জায়গা দিবেন না। আপনার সামনে এখন সফলতার দরজা খোলা। কঠিন হলেও আপনাকে সেই পথে যেতে হবে৷ আপনাকে আমি একজন সফল মানুস হিসেবে দেখতে চাই ধারা। তার জন্য যা করা দরকার আমি করবো৷ আপনি শুধু মনে সাহস রাখবেন। ভেঙে না পড়ে নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। নিজের জন্য, আমার জন্য এই চেষ্টাটা আপনি করবেন তো ধারা?’
আনত দৃষ্টি তুলে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো ধারা। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আশ্বাসের সাথে চোখের পলক ফেলে সে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। শুদ্ধও খুশি হলো। ধারা বলল,

‘আমার রেস্ট নেওয়া হয়ে গেছে। চলুন ভেতরে গিয়ে পড়তে বসি। আপনিই তো বলেছেন, পরীক্ষা এসে পড়েছে, সময় নষ্ট করা এখন একদমই উচিত হবে না।’
ধারার আগ্রহ দেখে শুদ্ধ’র ভালো লাগলো। হেসে বলল, ‘চলুন।’
ধারা মাচা থেকে নেমে আগে আগেই যেতে যেতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যদি পারি আপনি আমাকে কি দিবেন?’
শুদ্ধ মাচার ওপরে আরও আয়েশ করে বসে আড়চোখে চেয়ে বলল,
‘আন্ধার রাইতে আইসো কন্যা একলা দীঘির পাড়,
তোমায় আমি দিমু একখান নীল জ্যোৎস্নার হার।’
ধারা নিজের লজ্জা আড়াল করে পেছনে ফিরে মৃদু হেসে বলল, ‘বাহ! আপনি তো ভালোই ছন্দ বানাতে পারেন।’
শুদ্ধও ঠোঁট চেঁপে খানিক হাসলো। তারপর মাচা থেকে নেমে ধারার পাশে এসে কথা কাটিয়ে ব্যগ্র দিয়ে বলল,
‘চলুন, চলুন, পড়তে বসবেন না! চলুন।’

ঠোঁট ফুলিয়ে ধারা শুদ্ধ’র সাথে সাথে গেলো। রুমে গিয়ে বিছানায় বই নিয়ে বসলো ধারা। রাত গভীর হতে লাগলো। ধারা মনোযোগী হয়ে পড়লো বইয়ে। পড়তে পড়তে একসময় বই থেকে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো শুদ্ধ ধারার একটা বই কোলে নিয়ে হাতে কলম ধরেই বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরে একটা ক্লান্তির ছাপ। ধারার ভীষণ মায়া লাগলো। ধারার এই এডমিশনের চক্করে শুদ্ধ এতোটাই খাটছে যে ধারার মাঝে মাঝে মনে হয় পরীক্ষাটা তার না, আসলে শুদ্ধ’র। প্রতিদিন সাথে করে ধারাকে শহরে নিয়ে যাওয়া, যতক্ষণ ধারা পড়বে ততক্ষণ ধারার সাথে বসে থাকা, এমনকি ধারা ঘুমিয়ে গেলেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ধারার জন্য মনে রাখায় সহজ করে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরমালা তৈরি করা, রাত বিরাতে ধারার জন্য ঘন ঘন নিচ থেকে চা বানিয়ে নিয়ে আসা সবই তো লোকটা বিনা ক্লান্তিতে, বিনা বিরক্তিতে করে আসছে। এর সাথে তার নিজের কাজ তো আছেই। সব অর্থেই ধারার চেয়ে যেন দ্বিগুণ খাটছে শুদ্ধ। ধারার এক মামাতো বোনের বিয়ের পর ধারা দেখেছিল কিভাবে এতো ভালো ছাত্রী হওয়ার পরও তার স্বামী তাকে পড়তে দেয়নি। বাড়ির বউয়ের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা তারা পছন্দ করে না বলে। তারপর পাশের বাসার রেশমি আপুর সময়ও তো দেখলো, তার স্বামী অবশ্য নিষেধাজ্ঞা করেনি তবে পড়ালেখার জন্য সময় ব্যয় করায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতোটাই খিটখিট করতো যে শেষমেশ আপুটা সংসারের শান্তির জন্য নিজের পড়ালেখা ছেড়ে দিল। তার স্বামীও তখন ছিল নিশ্চুপ। আর এতো এতো উদাহরণের মধ্যে শুদ্ধ যা করছে তা সত্যিই ধারণার অতীত।
ধারা বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ’র কাছে গিয়ে তার কোল থেকে বই সরিয়ে, হাত থেকে কলম ছাড়িয়ে ঠিক করে রাখলো। তারপর গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুদ্ধ’র ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধার সাথে মৃদু হাসলো।

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৭

ধারার পরীক্ষার মাত্র দুইদিন আগে ফাহিম অসময়ে শুদ্ধকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠালে শুদ্ধ ভাবলো হয়তো ধারার পরীক্ষা বিষয়ক কোন আলাপ করতেই ডেকেছে। কিন্তু গিয়ে দেখলো ব্যাপারটা ভিন্ন। ফাহিম খুবই উশখুশ করে কথাটা বলল, ‘দোস্ত, কথাটা কিভাবে বলবো আমি বুঝতে পারছি না।’
শুদ্ধ বলল, ‘তুই এতো ভাবছিস কেন? কি বলবি বল!’
ফাহিম গড়িমসি করে বলল,
‘খুব প্রয়োজন না হলে তোকে বলতাম না রে। আমার খুব আর্জেন্ট এখন টাকার প্রয়োজন। তুই যদি তোর টাকাটা আমাকে এখন দিতে পারতি তাহলে খুব ভালো হতো।’
টাকার কথা শুনে শুদ্ধ’র মুখ শুকিয়ে গেলো। ফাহিম বলতে লাগলো, ‘তোর সাথে তো আমার আট হাজার টাকার ডিল হয়েছিল ধারার পড়া নিয়ে। তুই না হয় সাত হাজারই দিস৷ কিন্তু টাকাটা আমার এখনই প্রয়োজন রে শুদ্ধ। বিশ্বাস কর, দরকার বলেই এভাবে চাইছি। নয়তো এমন হঠাৎ তোকে তাড়া দিতাম না।’
শুদ্ধ একটা হাসি টেনে বলল, ‘আরে দূর! তুই এতো সংকোচ করছিস কেন? আমরা আমরাই তো। তোকে আমি তোর ফুল টাকাটাই দিবো। কম কেন দিবো? তুইও তো ধারার পেছনে কম কষ্ট করোস নাই। এতো ব্যস্ত থাকার পরেও সময় বের করেছিস। আমি তোকে দিয়ে দেবো। টেনশন নিস না।’

শুদ্ধ’র থেকে আশ্বাস পেয়ে ফাহিম স্বস্তির হাসি দিয়ে চলে গেলো। ফাহিম যেতেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো শুদ্ধ’র কপালে। ফাহিমকে শুদ্ধ কিছু মাস পর সমস্ত টাকা দিবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু টাকাটা তো ফাহিমের এখনই প্রয়োজন। হঠাৎ করে এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা শুদ্ধ কিভাবে করবে বুঝতে পারলো না। ইতিমধ্যেই সব টাকা সে তার প্রজেক্টে লাগিয়ে দিয়েছে। তার উপর বিয়েতেও কম টাকা খরচ হয়নি। মাসের মধ্যবর্তী সময় চলছে। হাতে এখন একপ্রকার টাকা নেই বললেই চলে। ধারাকে নিয়ে ঢাকায় আসা যাওয়া করতেও তো কতো টাকা লাগবে! শুদ্ধ কি করবে কিছু খুঁজে পেলো না। এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা হঠাৎ কোথা থেকে করবে? হঠাৎ ই তার নজর পড়ে হাতের ফোনটির দিকে। এই আড়াই মাস আগেই টাকা জমিয়ে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে শখ করে ফোনটা কিনেছিল৷ ফোনটার স্ক্রিনে একবার মায়ার সাথে হাত বুলালো শুদ্ধ। পরক্ষনেই তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধারাকে তার এখন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেছনে ফিরে তাকাবার এতো সময় কই! ফোন তো এর কাছে অতি সামান্যই।

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ১৯