হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩১

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

নামাজ শেষে এক দীর্ঘ মোনাজাত দিলো ধারা। মনের সবটুকু আকুতি নিংড়ে প্রকাশ করলো সৃষ্টিকর্তার দরবারে। মোনাজাত শেষ করে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টির তেজ অনেকটাই কমে গেছে। শুধু ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। একবার আবেগ্লাপুত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধারা একটা চাদর গায়ে দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বের হলো। সকালের আলো ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করছে। মাটির রাস্তা, ফসল সব ভেজা। ধানক্ষেতের আল ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ধারা। উঁচু ভিটির উপর শুদ্ধ’র করা দীর্ঘ ফলের বাগানটার পরেই তার ধানক্ষেত, ঢাল হয়ে নিচে নেমে গেছে।

সেখানে বৃষ্টির পানি জমে গেছে অনেকটা। ফলের বাগানের শেষের মাথায় আর ধানক্ষেতের শুরুর আগে উঁচু ভিটির উপরই টিন দিয়ে বানানো একটা ছোট্ট টং ঘরের মতো। সেখানে সব প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা হয়। মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য সেখানে একটা টেবিল আর ছোট্ট চৌকি পাতা। ধারা গিয়ে দেখলো টং ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা রেখেই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা গিয়ে আস্তে করে শুদ্ধ’র পাশে দাঁড়ায়। মৃদু হেসে শুদ্ধর গায়ে হাত দিয়ে তাকে ডেকে তুলে। শুদ্ধ পিটপিট করে চোখ খুলতেই তাকে হাত বাড়িয়ে দরজা দিয়ে বাইরেটা দেখায় ধারা। ধারার ইশারা বরাবর তাকিয়ে শুদ্ধ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। বৃষ্টি শেষে সোনা রাঙা রোদ উঠতে শুরু করেছে। আকাশ পরিষ্কার। মেঘ পুরোপুরি কেটে গেছে। নয়তো আবহাওয়া যেমন দেখা যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল নিম্নচাপের মতো বৃষ্টি বোধহয় সারাদিনই থাকবে। শুদ্ধ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বাইরে বেড়িয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোদের মিষ্টি তাপ মন ভরিয়ে গায়ে মাখায়। ফসলের জমিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। তার নতুন ধানের ক্ষেতে পানি জমে গেছে। চারাগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। শুদ্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ধারা হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলে শুদ্ধ ফিরে তাকায়। একটা ভরসা মাখা হাসি দিয়ে ধারা শুদ্ধ’র মাথায় একটা লাল গামছা বেঁধে দিয়ে হাতে একটা কোদাল তুলে দেয়। তারপর আরেকটা কোদাল নিজের হাতে নিয়ে জমির পানির দিকে ইশারা করে। শুদ্ধ কোদাল হাতে ধানক্ষেতে নেমে যায়। মাটি কেটে পানি বের হবার লাইন বানিয়ে দিতে থাকে। এই শীতের মধ্যে ধারাও তার আনাড়ি হাতে যতটুকু পারে করে। শেষমেশ নিজেদের সবটুকু জমির পানি বের হয়ে যাবার ব্যবস্থা করার পর ধারা ক্লান্ত হয়ে স্বস্তি মুখে উঠে দাঁড়ায়। কাজ শেষ হয়ে গেছে ভেবে যখনই সে শুদ্ধ’র দিকে পেছনে ফিরে তাকায় দেখে শুদ্ধ থেমে নেই। নিজেদের ক্ষেতের কাজ শেষ করে এখন সে আশেপাশে অন্যদের ক্ষেতেরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যাতে তাদের ফসলেরও ক্ষতি না হয়। ধারা সেদিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।

সেদিনের বৃষ্টিতে শুদ্ধ’র সেই উদাস চেহারায় ধারা বুঝতে পারলো এই ধান শুদ্ধ’র জন্য তার ধারণার থেকেও বেশি ঠিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোন সাধারণ বোরো ধান নয়। বোরো মৌসুমে লাগানো এই বোরো ধান নিয়েই শুদ্ধ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টায় নেমেছে। বৃষ্টির পর থেকে শুদ্ধ তার পরিশ্রমের মাত্রা আরও দ্বিগুণ করে দেয়। হতাশ না হয়ে বৃষ্টিতে যতোটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার উদ্যমী মনোভাব আর পরিশ্রমে সবটা পুষিয়ে দেয়। এরপর থেকে ধারাও নিয়মিত ক্ষেতে আসা যাওয়া করতে লাগলো। শুদ্ধ’র কাজ ধান লাগানো নয়। তার হাতে আরো অনেক কাজ থাকে। এসবের জন্য সে কিছু লোক রেখেছে। শুদ্ধ’র কাজ শুধু তত্ত্বাবধায়ক করা। কিন্তু সে এখানেই থেমে থাকে না। অন্যদের সাথে সেও সমানতালে লেগে যায় ধান চাষের কাজে। এই কাজ যখন সে করে খুব উপভোগ নিয়েই করে। তার চোখে মুখে তখন এক অন্য ধরণেরই ঝিলিক ফুটে উঠে। স্বপ্ন পূরণের ঝিলিক। লক্ষে পৌঁছাবার প্রত্যাশা, অপেক্ষা…ঘিরে থাকে শুদ্ধ’র মুখশ্রীতে। প্রকৃত অর্থে পরিশ্রমী কি তা শুদ্ধকে তখন দেখলে বোঝা যায়।

ধারা খুব আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে এই দৃশ্যগুলো। শুদ্ধ’র স্বপ্ন খুব দামী। দামী তার চেষ্টাগুলোও। সেগুলো কেউ দেখলে নিজে থেকেই অনুপ্রাণিত হয়। যেমনটা হয় ধারাও। রোজ দুপুরে সে শুদ্ধ’র জন্য খাবার নিয়ে আসে। সাথে থাকে নিজেরটাও। শুদ্ধ’র সাথেই মাঠে বসে খাবার পর্ব সাড়ে ধারা। তারপর বিকেলে শুদ্ধ’র বাড়ি ফেরার সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই থেকে যায় সে। কাজ শেষে দুজনে একসাথেই বাড়ি ফেরে। খোদেজার কাছ থেকে আজকাল নকশী কাঁথা সেলাই করা শিখছে ধারা। একটা কাঁথা সেলাইয়ে হাতও দিয়েছে। খাওয়া শেষে মাঠ ভরা হলুদ সর্ষে ফুলের পাশে রোদে বসে ধারা কাঁথা সেলাই করে আর শুদ্ধ’র কাজ দেখে। কখনো কখনো ধারার হাত থেকে কাঁথা কেড়ে নিয়ে শুদ্ধ বই ধরিয়ে দেয়। ধারার আর কি করার!

শুদ্ধকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের স্বপ্নের রাস্তায় হাঁটতে তাকেও পড়তে হয় বই। আস্তে আস্তে ধানের চারা বেড়ে উঠে। উত্তরিয়া হাওয়ায় নিরন্তর দোল খেয়ে চোখের সামনে বৃদ্ধি পেতে থাকে শুদ্ধ’র পরিশ্রমের ছোঁয়া। ধারা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। কখনো নিজের ওড়না দিয়ে ক্লান্ত শুদ্ধ’র ক্লান্তি মুছে দেয়। কাজের চাপে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া শুদ্ধ’র অবশ্রান্ত দেহের উপর চাদর টেনে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আনমনে মৃদু হেসে উঠে। কখনো ছিঁলে যাওয়া শুদ্ধ’র মেহনতী হাতের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছলছল করে উঠে। সে কিছু বলে না। শুধু শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ধীরে ধীরে চারা থেকে ধান গাছ হয়। সবুজে সবুজে ছেঁয়ে যায় সমগ্র। শুদ্ধ একটা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে ধানক্ষেতের মাঝে বসায়। কাকতাড়ুয়ায় গায়ে শুদ্ধ’র একটা সাদা টিশার্ট পড়িয়ে দিয়ে ধারা সেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেয়, ‘শুদ্ধ’র থেকে সাবধান’। ধারার কান্ড দেখে শুদ্ধ শুধু হাসে। একটা ছোটখাট সংসার বসে যায় তাদের, সেই ছোট্ট টিনের টং ঘরটিতে। হিমশীতল হাওয়ার সাথে সাথে হলুদ শর্ষে ফুলের মাঠ জুড়ে বইতে থাকে তাদের প্রেমের অবাধ হাওয়াও। কখনো হলুদ রঙে ছেঁয়ে যাওয়া মাঠ জুড়ে প্রজাপতির মতো চলতে থাকে তাদের খুনসুটি মাখা নিরন্তর ছোটাছুটি।

এমনই এক দিনের ঘটনা। ধান ক্ষেতের পাশে বসে শুদ্ধ কৃষি সম্পর্কিত একটা বই পড়ছিল। ধারা তখন কিছু রাজহাঁসকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে শুদ্ধ’র সামনে নিয়ে আসলো। বই বন্ধ করে শুদ্ধ বলল,
‘কি করছো ধারা? যদি ঠোকর দেয়!’
ধারা একটা রাজহাঁস ধরে কোলে নিয়ে বলল,
‘দিবে না। এদের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে।’
‘তাই!’
‘হুম।’
হাতের রাজহাঁসটা নিজের দিকে উঁচু করে ধারা বলতে লাগলো, ‘বলো বলো হাসু বাবু, আমরা এখন ফ্রেন্ড না?’
শুদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হেসে বলল, ‘হাস্যকর!’
ধারা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ভালো। আমারটা তো তবুও হাস্যকর আর তোমারটা বিরক্তিকর।’
‘কোনটা?’
‘এই যে সারাদিন বই পড়াটা। হাসলে মানুষের হার্ট ভালো থাকে। বিরক্তি হওয়ায় কোন বেনিফিট পাওয়া যায় না। তাই তোমারটা চাইতে বেটারটা আমারই।’
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, ‘গুড লজিক! চালাক হয়ে গেছো বহুত।’
ধারা একটা ভাব নিয়ে বলল, ‘আমি জানি।’

ধারা রাজহাঁসটির সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শুদ্ধও একটা ধবধবে সাদা রাজহাঁস কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাতের রাজহাঁসকে ধারার দিকে বাড়াতেই সেটি তার লম্বা গলা বাড়িয়ে ধরলো ধারার দিকে। ধারা ভয় পেয়ে এক কদম পিছিয়ে গেলো। তা দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো শুদ্ধ। ধারা চোখ ছোট ছোট করে তার হাতের রাজহাঁসটিও শুদ্ধ’র দিকে বাড়ালো। শুদ্ধও একটু পেছালো। ধারা খিল খিল করে হেসে উঠলো। এরকম খানিক খুনসুটির পর ধারা ও’র হাতের ফোন নিয়ে ক্যামেরার টাইমার সেট করে বলল,
‘আসো রাজহাঁসগুলোকে নিয়ে ছবি তুলি। কি সুন্দর! তুমি তোমারটা ধরে রাখবা। আমি আমারটা ধরে রাখবো।’

এই বলে একটা উঁচু জায়গা দেখে ফোন রেখে দিয়ে ধারা শুদ্ধ’র পাশে রাজহাঁস নিয়ে দাঁড়ালো। একটু ভালো মতো পোজ দিয়ে যখনই ঠিক হতে যাবে তখনই শুদ্ধ হঠাৎ নিজের কাঁধ দিয়ে ধারাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। ধারাও চোখ বড় বড় করে শুদ্ধকে একইভাবে ধাক্কা দেয়। একটার পর একটা দুজনের এমন ধাক্কাধাক্কির মাঝে শুদ্ধ হঠাৎ ধারার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিজের একদম কাছে ঘেঁষে দাঁড় করায়। ধারা ভ্রু কুঁচকে শুদ্ধ’র দুষ্টুমি ভরা মুখটির দিকে তাকায়। একের পর এক এভাবেই তাদের খুনসুটি মাখা মুহুর্তগুলো ক্যামেরায় বন্দী হতে থাকে। ছবি তোলা শেষে একটা জলের ডোবার কাছে গিয়ে দুজনে হাতের রাজহাঁসগুলো উড়িয়ে ছেড়ে দিলো। রাজহাঁসগুলো তাদের শুভ্র ডানা ঝাপটে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে বেড়ালো। ধারা আগে আগে চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে দৌঁড়ে গিয়ে ধারার কাঁধে হাত তুলে দিয়ে হাঁটতে লাগলো শুদ্ধ। মাঠ ভরা চারিদিকে এখন সর্ষে ফুলের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় কিছু ফুল ছিঁড়ে শুদ্ধ ধারার কানে গুঁজে দিল। ধারা লাজুক হেসে শুদ্ধকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরাতেই আবারো ধারাকে ধরে ফেললো সে। পাশ দিয়ে খড়কুটোর স্তুপ নিয়ে যাওয়া একটা ইঞ্জিন চালিত গাড়ি দৌঁড়ে ধরে হাঁপিয়ে উঠে দুজনেই গা এলিয়ে দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। সাদা তুলোর পেজোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ানো নীল আকাশের দিকে স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলো তারা।

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩০

সময় গড়াতে লাগলো। শীত পেরিয়ে বসন্তের হাওয়ার গুঞ্জন শুরু হলো। সবুজ ধানের রং পাল্টে সোনালী রং ধারন করতে লাগলো। একসময় সেই সুদিন এসে ধরা দেয়। শুদ্ধ পেরে যায় যা সে করতে চেয়েছিল। অবশেষে একটা নতুন জাতের ধান সে উদ্ভাবন করে ফেলে। তার ক্ষেত উপচে ভরা, উচ্চ ফলনশীল ধান তারই সাক্ষ্য দেয়। সমগ্র গ্রামবাসীকে তাক লাগিয়ে দেয় সে ধান। এতো অল্প জায়গার মধ্যে এতো ঘন, এতো অধিক ফলনের ধান তারা আগে কখনো দেখেনি। অন্যন্যা ধানের শীষে যেখানে ১৫০-১৬০টি দানা থাকে সেখানে এই ধানের শীষে ৭০০-৭৫০ টির মতো দানা। মাত্র এক বিঘা জমিতেই ধান হবে ৪৩ মণের মতো। যা সাধারণ ধানের তুলনায় তিনগুণ।

তারউপরে এই গাছ অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক শক্ত ও মজবুত। যার ফলে ঝড় বৃষ্টিতেও সহজে হেলে পড়ে না। পোকামাকড়ের সংক্রমণও খুব কম। আর অধিক ফলনশীল। কৃষকদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এতো বছর ধরে তারা ধান চাষ করে আসছে। এমনটা তো কখনো দেখেনি! শুদ্ধ’র আনন্দ আর দেখে কে! পুরো বাচ্চাদের মতো মাঠ ভরে নেচে, গেয়ে, খুশিতে লাফাতে থাকে সে। বারবার ধারার কাছে এসে দেখাতে থাকে সে পেরেছে। তার এতোদিনের পরিশ্রম সার্থক। খুশিতে ধারার চোখে পানি ভরে আসে। মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শুধু শুদ্ধ’র পাগলামি দেখতে থাকে। শুদ্ধ’র উদ্ভাবিত সেই নতুন জাতের ধান তাদের জীবনের মোড় অভাবনীয় ভাবে ঘুরিয়ে দেয়।

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩২