হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

মাটির খোলা পাত্র জুড়ে পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে একটা কালসেটে মাঝারি সাইজের মাছ। নিজের ক্ষুদ্র লেজের ক্ষমতা দেখিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে তুলছে পানিতে। কখনো পাতিলের এই প্রান্তে দেখা যাচ্ছে তো আবার ছুট দিয়ে নিমিষেই পালিয়ে যাচ্ছে অপর প্রান্তে। এই ক্ষুদ্র পরিসর ভেদ করে বৃহত্তরে গমনের জন্যই যেন তার যত কারসাজি। এর আঞ্চলিক নাম টাকি মাছ। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য পুকুর থেকেই ধরে আনা হয়েছে। আর আনা হবেই বা না কেন! নতুন বৌকে আজ এই মাছ দিয়েই যে ভবিষ্যৎ সংসার পালনের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। ধারা আনত মুখে কলের পুতুলের মতো চুপচাপ বসে আছে মাটির পাতিলটির সামনে। একটা মোটা গড়নের মহিলা তার খসখসে গলায় ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘শোন বউ, এহন এই মাছটা তোমারে হাত দিয়া ধরতে হইবো। তাও কিন্তু এক খাবায়। এক খাবাতেই যদি তুমি এই মাছরে ধরতে পারো তাইলেই বোঝা যাইবো যে তুমি সংসার খুব ভালো মতো সামলাইতে পারবা। আর যদি না পারো হের মানে হইবো তোমারে দিয়া কিছু হইবো না।
আমড়া কাঠের ঢেঁকি
পারে না কিছুই মেকি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উপস্থিত সবাই সেখানে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বিরক্তিতে খোদেজার কপাল কুঁচকে গেলো। এইসব কোন কথা! এইসব নিয়ম কানুন পালন হতো তাদের জমানায়। ভুলেও কোনটায় ব্যর্থ হলে একেকজনের কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যেত। এখন কি আর সেই সব দিন আছে। আজকাল মেয়েদের দিয়ে এসব কি না করালেই নয়! কিন্তু কে বলবে এইসব কথা? খোদেজা যদি এখন কিছু বলে সবাই বলবে খোদেজা আদিখ্যেতা করছে। তাই এখন মুখে কুলুপ এটে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। শুদ্ধ সেখানে ছিল না। এই মাত্রই একটা জরুরী কাজের জন্য বাইরে বেড়োবার প্রয়োজনে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। জোবেদা যেতে দিল না। পথ আটকালো। দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে যেতে বলল নিয়মটা। এসব কুসংস্কারের প্রতি আগ্রহ শুদ্ধ’র কোন কালেই ছিল না। তবুও দাঁড়াতে হলো মায়ের জোরাজুরিতে। ধারার তখন নার্ভাসে জমে যাবার অবস্থা। কতগুলো চোখ একসাথে বিদ্ধ হয়ে আছে তার দিকে! মহিলাটার কথাগুলো গুরুতর ভাবেই নিয়ে ফেলেছে ধারা। সত্যিই যদি মাছটা প্রথম চেষ্টাতেই ধরতে না পারে! তখন? কপালের কার্ণিশ বেঁয়ে তার এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল। ভীতিগ্রস্ত মুখেই দ্রুত পানিতে একটা থাবা দিয়েই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাতে একধরনের শীতল অস্তিত্বের অনুভূতি পেতেই চোখ খুলে দেখলো তার হাতের তালুর মধ্যেই বদ্ধ হয়ে পড়েছে মাছটা। মাছটা সবার সামনে উঁচু করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ধারা। উপস্থিত সবাইও যেন স্বস্তি পেলো। শুধু সেখানে উপস্থিত একজনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

আসমা সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে মানে যে কত শত কাজ তা গ্রামের মহিলাদের থেকে ভালো আর কে বুঝে। আজকে মেয়ে আর মেয়ের জামাই আসবে তাদের বাড়ি। রান্না বান্নার হিড়িক লেগেছে তাই। নিয়ম অনুযায়ী আজকে বৌ ভাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধারার বাবাই বলেছে শুধু শুধু অনর্থক ঝামেলা করার কোন দরকার নেই। আসল কারণ হলো তিনি চান বিয়ের এই হৈ চৈ তাড়াতাড়ি মিটে যাক। যতটুকু করার প্রয়োজন ছিল ততটুকুই তিনি করেছেন। যেগুলো না করলেও হয় সেগুলো বাদ যাক। ধারাকে আনতে যেতে শুধু কিছু লোক পাঠিয়েছেন। বিয়ের পর তো প্রথম মেয়েকে বাবাকেই আনতে যেতে হয়। সেটাও যায়নি আজিজ সাহেব। আসমার চিন্তা হয়। না জেনো ধারার শ্বশুর বাড়ির লোক খারাপ ভেবে বসে! কিন্তু এসব কথা কাউকে বোঝাবে কে? আসমার কথার কোন গুরুত্ব এই বাড়িতে নেই। এই সংসারে আসমার অবস্থান অনেকটা গাছের মতো। যে যা বলবে চুপচাপ শুধু খেটে যাবে। নিজের থেকে কোন মতামত দিবে না। আসমার ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সব কিছু এমন ভাবে তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো! ইচ্ছা হয় একটু বসে মেয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু সেই উপায় এই মুহূর্তে নেই। আসমার শ্বাশুড়ি জমিরন বিবি দাওয়ার উপরই বসে আছেন। কোন ভুল হলে তার কথা থেকে ছাড় পাওয়া মুশকিল। জমিরন বিবির বয়স প্রায় আশি’র কোঠায় পৌঁছেছে। তবুও তেজ যেন এতটুকুও কমেনি। এখনও সংসারের ব্যাপারে ছেলেদের পরে তারই একরত্তি শাসন চলে। শ্বাশুড়ির কাছে আসমা এখনও সেই নতুন বৌটির মতোই। আসমা একবার সেদিকে তাকিয়ে বটি নিয়ে কামরাঙা কাটতে বসলো। অর্ধেক কাটা হতেই সেই কামরাঙার উপর এসে হামলা চালায় ধারার ভাই রাতুল। এই বার ক্লাস সেভেনে উঠেছে সে। মেয়েদের মতো টক খাওয়ার ভীষণ পাগল। দাদীর একপ্রকার চোখের মণিই সে। রাতুল যখন একের পর এক কামরাঙার টুকরো মুখে তুলে গোগ্রাসে গিলছে তখন তাতে বাধা দেয় আসমা। বলে,

‘সব এখনই খেয়ে ফেলবি! তোর বোনের জন্য কাটতাছি এগুলা। ধারা কত পছন্দ করে! ধারা আগে আসুক। ও’র খাওয়ার পর থাকলে তারপর খাস।’
দাওয়া থেকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে শুকনো খনখনে গলায় খেঁকিয়ে উঠেন জমিরন বিবি। বলতে থাকে,
‘পোলাডা কতখন পর আইয়া একটা জিনিস খাইতে চাইতাছে হেইডাতেও তোমার আপত্তি! কেমন মা তুমি?’
আসমা বলে, ‘আম্মা, কামরাঙা আর গাছে নাই। গাছ থেকে মাত্র পাইড়া আনছি। এই চারটাই ছিল।’
‘তাতে কি হইছে? মাইয়া কি তোমার দশ বছর পরে আইতাছে? এতদিন খায় নাই। শ্বশুরবাড়ি গেলো তো মাত্র একদিন ধইরা। পোলারেই খাওয়াও। এই পোলাই পরে কামাই কইরা খাওয়াইবো। আমাগো বংশের বাতি। মাইয়া কোন কামে দিবো না। হেরা হলো পরের আমানত। বুঝছো?’
আসমা কি বুঝলো কে জানে! কারণ বোঝার আগেই ভেতর থেকে খবর এলো ধারা এসে পড়েছে। আসমা আর রাতুল দুজনেই খুশি মনে বাড়ির ভেতর ছুটে গেলো। জমিরন বিবিও প্রসন্ন মুখে ভেতর ঘরে উঁকি দিলেন। প্রকৃতপক্ষে ধারার বিয়ে হওয়ায় সবথেকে বেশি খুশি তিনিই হয়েছেন। তার মতে, মাইয়া মানুষ সেয়ানা হইলে কলঙ্ক ছায়ার মতো পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। আর একবার যদি কোন কলঙ্ক লাইগা যায় তাইলে সেই মাইয়ার বিয়ে দিতে বাপের দফা রফা অবস্থা হয়। এর জন্য মাইয়া মাইনষের বিয়ে তাড়াতাড়িই হইয়া যাওয়াই ভালো। জমিরন বিবি তো আরো কত আগের থেকেই চাচ্ছিলেন ধারার বিয়ে হয়ে যাক। তার ছেলেগুলা বেশি বোঝে বলেই এতদিন তার কথা শুনেনি। আজ অবশেষে তার প্রার্থনা কবুল হলো। সন্তুষ্টি চিত্তে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি লাঠি হাতে খটখট করতে করতে ভেতরের দিকে চললেন।

শুদ্ধদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ জল দেখলেই চক্ষু শীতল হয়। পাড় ঘেঁষে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বৃক্ষের দল। পানির মাঝখানে কিছু কচুরিপানা নিজেদের মধ্যে বেগুনী রঙের ফুল ধারণ করে হয়ে আছে স্থির ভাসমান। ঘাটের পাশেই একটা হিজল গাছ। ডালের ভারে পুকুরের উপর হেলে আছে যেন। সেই গাছের গুঁড়িতে বসেই আনমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ। তার হাতে একটা ছোট্ট তেঁতুল গাছের ডাল। বেখেয়ালি ভাবে সেই ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে ফেলছে সে। তখন সেখানে কচুরিপানার উপর দুটো সাদা বক এসে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে জোড়া বক। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাছের খোঁজ করছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। আর পাঁচটা ছেলেদের মতো বিয়ে নিয়ে তারও অনেক শখ আহ্লাদ ছিল। এই জীবনে কখনো অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়নি। এতো এতো সুযোগ পেয়েও জড়ায়নি কোন প্রেমের সম্পর্কে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা শুধু স্ত্রীর জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল বিয়ের পর নিজের বউকে প্রচুর ভালোবাসবে। কখনো কোন অভিযোগের সুযোগ দিবে না। কিন্তু এখন সব ভিন্ন। এ কারণেই ধারার উপর প্রচুর রাগ হয়েছিল তার। ধারার যদি বিয়েতে মত নাই ছিল সেটা সে তার বাবাকে খুলে বলল না কেন? ধরে বেঁধে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া এক কথা। কিন্তু ধারা তো তার বিয়ের জন্য বাবাকে কোন বারণই করেনি। দোষটা তাহলে হলো কার? শুধু ধারার একটু সাহসের অভাবের জন্যই আজ দু দুটো জীবন এলোমেলো হয়ে পড়লো।

ছেলেকে অন্যমনষ্ক হয়ে ঘাটপারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে খোদেজা। পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘কিরে মাহতাব, এই ভরদুপুর বেলা ঘাটপাড়ে বইসা আছোস কেন?’
শুদ্ধ বলল, ‘এমনিই আম্মা।’
‘বউ’র সাথে কথা হইছে?’
এই প্রশ্নের উত্তরে শুদ্ধ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি এদিকে কি করো? নামাজ পড়বে না?’
‘তা পড়বো। তুই বউ’র সাথে গেলি না কেন বল তো? বউরে একা একাই পাঠায় দিলি। কি ভাববে ঐ বাড়ির লোকজন! বললি যে তোর নাকি দরকারী কাজ আছে। বউ গেছে দু দিন হয়ে গেলো। কই তোর কোন দরকারী কাজ তো দেখতাছি না। বসেই তো আছোস।’
‘আমার ওখানে কোন প্রয়োজন নেই। তাই যাই নি।
কাজ আছে। তুমি বুঝবে না।’
খোদেজা বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ঠিকই বলছোস। তোদের ব্যাপার স্যাপার আমি আসলেই বুঝি না। কি জানি বাপু!’
খোদেজা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই পুকুরের পান্না ঘেঁষে একটা মাছ লাফিয়ে উঠলো। খোদেজাকে দেখার জন্য ডাকতে গিয়েও শুদ্ধ ডাকতে পারলো না। ও’র হঠাৎ ধারার মাছ ধরার কথা মনে পড়ে গেলো। ধারা গ্রামের মেয়ে। মাছ ধরা নিয়ে তার অপটু হবার কথা না। তবুও মাছ ধরার আগে এতোটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল কেন সে? আড়াআড়ি ভাবে বুকে দু হাত গুঁজে চিন্তামগ্ন শুদ্ধ ভাবতে লাগলো, ব্যাপারটা কি?

জমিরন বিবির প্রথম থেকেই খটকা লাগছিল। সময় যতটা গড়াতে লাগলো মনের খুতখুত ভাবটা আরো বাড়তে লাগলো তার। ধারার মতিগতি ঠিক লাগছে না তার কাছে। প্রথমে তো জামাই ছাড়া একা একাই এসে পড়লো শ্বশুড় বাড়ি থেকে। তার উপর মুখটা এই দুই দিন যাবৎ এমন ভাবে ভার করে রেখেছে যেন পৃথিবীর সব দুঃখ তার মাথার মধ্যে এসে ভর করেছে। আজকে তো জামাইয়ের নিতে আসার কথা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। কই এখনও তো আসছে না! ব্যাপারটা কি?

শেষের ব্যাপারটা শুধু জমিরনের নয় সকলের মাথাতেই এসেছে। সাঁঝ হয়ে আসছে তবুও তো তাদের মেয়েকে নিতে জামাই আসছে না। একসময় আজিজ তালুকদারকেই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে হলো। মেয়ে দুই দিন ধরে এসেছেন। এখনও পর্যন্ত কোন কথাও বলেননি তিনি মেয়ের সাথে। তার রাগ এখনও কমেনি। কিন্তু এখন কথা আর না বললেই নয়। অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে তিনি মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। বাবা ডেকে পাঠিয়েছে শুনেই ধারার ঘাম ছুটে গেলো। এই দুই দিন ধরে এই চিন্তাতেই সারা রাত ঘুম হয়নি তার। লোকটা তো বার বার করে বলেই দিয়েছে সে আসবে না। এখন এই কথাটা বাবাকে কিভাবে বলবে ধারা? তার উপর যদি কেউ শুনে যে ধারার ও বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিয়েতে রাজী না থাকার কথা বলার জন্যই এসব হচ্ছে তাহলে তো ধারা বোধহয় আজকে আস্তই থাকবে না। ভয়ে ও’র ইচ্ছা করছে কোথাও নির্জনে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। ছোট থেকেই পড়ালেখার উপরই ছিল ধারা। পড়ালেখা ছাড়া প্রেম, ভালোবাসা, ছেলে কোনকিছুতেই কখনো নজরও দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন রোমান্টিক গান খেয়াল করে শুনেছে কিনা তাতেও সন্দেহ। সব সময় শুধু জানতো ওকে পড়তে হবে, অনেক পড়তে হবে। অন্য কিছু নিয়ে ভাববার আর সময় কই! বিয়ে ব্যাপারটা সব সময়ই ছিল ও’র সমস্ত চিন্তা ভাবনার বাইরে। সাধারণত মেয়েরা চৌদ্দ পনেরো তো পড়লেই বিয়ে নিয়ে তাদের ভাবনা কাজ করে। কত রং বেরঙের স্বপ্নও সাজায়। কিন্তু এসব নিয়ে কখনোই কিছু ভেবে দেখেনি ধারা। তাই জীবনে হঠাৎ করেই এই বিয়ে নামক পরিবর্তনে ধারা ঘাবড়ে যায়। মানতে পারেনি। নেহাৎ সেকারণেই হয়তো বাসর রাতে একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিল সে। এ কারণে লোকটা এভাবে বলে দিবে সে আর ধারাকে নিতে আসবে না! ধারাকে সবটা মিটমাট করে নিতে হবে। আদৌও কি এতো ক্ষমতা আছে ধারার? সবার মতো সেও জানে যাই হয়ে যাক তার আশ্রয় এখন ঐ শ্বশুরবাড়িই। তাকে সেখানেই থাকতে হবে। কিন্তু ঐ লোকটা তো ধারাকে নিতেই আসবে না।
নত মুখে আস্তে আস্তে ধারা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গোমড়া মুখে আজিজ সাহেব প্রশ্ন করেন,

‘তোমার স্বামী এখনও আসছে না কেন? কারণ কি?’
ধারার গলা শুকিয়ে আসে। এমনিতেও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক মতো কথাও বলতে পারে না সে। আর আজকে তো…!
অনেকক্ষণ হয়ে যায় ধারা কিছু বলে না। এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে জমিরন বিবি পেছন থেকে খেঁকিয়ে উঠে,
‘আমি তোরে আগেই কইছিলাম আজিজ, কিছু একটা ঘাবলা আছে। তোর মাইয়া এমন চুপ কইরা আছে কে জিগা। জামাই আসার সময়ও আসলো না আবার এহনও আসতেছে না এর কারণডা কি?’
ধারা মাথা নিচু করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা এমনিতেও অনেক রাগী। তার উপর আজকে দাদীও আছে। কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। আসমা মাথায় ঘোমটা টেনে মেয়ের দিকে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আসলেই কি কিছু হয়েছে? ধারা এমন করছে কেন? মেয়ের জন্য মনে মনে আসমা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো। সব যেন স্বাভাবিকই থাকে। নয়তো আজ তার মেয়ের কপালে কি আছে কেউ জানে না।’

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ২

জমিরন বিবি বলেই যেতে লাগলেন, ‘আমি আগেই বুঝছি কিছু একটা হইছে। জামাই নাইলে আসবো না কেন? নিশ্চয়ই এই মাইয়াই কিছু করছে। ওরই দোষ। এমন অকর্মা মাইয়া। দুই দিনও সব ঠিক রাখতারলো না! এই ধারা কস না কেন? ঐ বাইত্তে আবার কি কান্ড কইরা আইছোস যে তোরে নিতে পর্যন্ত কেউ আসতাছে না।’
মায়ের কথায় আজিজ সাহেব খুব একটা কান দেন না। তার মায়ের স্বভাবই ছোট খাট বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা। তবে আজকের ব্যাপারটা ফেলে দেবার মতো না। তাই মাকে না থামিয়ে তিনি মেয়েকে শীতল কন্ঠে বললেন,
‘তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন আসছে না?’

ধারার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ের চোটে চোখের কার্ণিশে জলও জমতে শুরু করছে তার। গলা দিয়ে যেন কোন আওয়াজও বের হতে চাচ্ছে না। বার বার হাত দিয়ে ডান চোখের পাশ টা ঘঁষছে ধারা। আজিজ তালুকদার আগের থেকেও গম্ভীর ভাবে বললেন,
‘কি হলো বলছো না কেন?
আরো একবার কপালের কার্ণিশটা ঘষে ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে বলল,
‘বাবা! ঐ…সে…আসলে….আসবে…
ধারাকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই পেছন থেকে স্বল্প পরিচিত একটা স্পষ্ট ভরাট কণ্ঠস্বর হঠাৎ ডেকে উঠলো,
‘ধারা!’

হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব ৪