হামিংবার্ড পর্ব ১
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
” আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে না, মিস অরা? ওহ সরি! মিসেস অরা! আজ তোমাকে বোঝাব, তেজরিন খান আরিশের দিকে আঙুল তোলার শাস্তি কতটা ভয়ানক হতে পারে। ”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত বরের মুখে এমন কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল অরা, পুরো নাম অরা মেহরিন। আরিশ পাঞ্জাবির বোতাম খুলে বিছানার দিকে এগোতে লাগলো দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা।
” প্লিজ এমন করবেন না। সম্পর্কে আপনি আমার খালাতো ভাই হোন। ”
” খালাতো ভাই! হুহ্? এসব বাজে কথা বাদ দাও। আমার কোনো বোন নেই, মা নেই, খালা নেই—কেউ নেই! এসব সম্পর্কের ফালতু তকমা দিও না আমাকে। নাউ ইউ আর মাই ওয়াইফ। এটা ভালোবেসে বিয়ে নয়, এটা তোমার দেওয়া অপমানের শাস্তি! গট ইট?”
আরিশের কথায় কেঁপে উঠল অরা। ছোটো থেকে আরিশের সাথে কখনো তেমন দেখা হয়নি। মায়ের মুখে শুধু শুনেছিল, তার একজন খালাতো ভাই আছে এতটুকুই। কিন্তু সেই মানুষটাকে যে স্বামী হিসেবে আজ এভাবে দেখতে হবে ভুলেও কল্পনা করেনি সে।
” আমার ভুল হয়েছে ভাইয়া। কতবার ক্ষমা চাইলে বিষয়টা ভুলে যাবেন? ”
” ভরা মজলিসে আমার পুরুষত্ব নেই ঠান্ডা করার সময় এই কথা মনে ছিলো না? এই তেজরিন খান আরিশকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার পরিমাণ তোমাকে ভুগতে হবে মেয়ে। ”
” না, আরবান ভাইয়া প্লিজ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এই নামে কেন ডাকলে আমাকে? তোমার সাহস হয় কীভাবে! তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে। ”
অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। হুট করে নামটা না বললেও পারতো সে। লোকটাকে এমনিতেই কেমন হিংস্র লাগছিল, তারমধ্য এই নামে ডাকার ফলে আরো ভয়ানক হয়ে উঠল । আরিশ অরার সাথে জোরাজোরি শুরু করেছে। একেবারে হিংস্র পশুর মতো আচরণ করছে। অরার ছোটো দেহখানি ধীরে ধীরে আরিশের সুঠাম দেহের নিচে চাপা পড়তে লাগলো। অরা গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছে কেবল। আরিশের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আরিশের চোখে কোনো মায়া দয়া নেই, আছে কেবল ক্রোধের অনল।
গভীর রাত। বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বিধ্বস্ত অরা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে, চোখের কাজল লেপ্টে গালের সাথে মিশে বিশ্রী লাগছে তাকে। ঠোঁটে অনেকগুলো ছোটো ছোটো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সাদা রঙের বিছানার চাদরে লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ লেগেছে। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছিল এতক্ষণ । আরিশ গোসল সেড়ে বের হলো মাত্র। পরনে তার সাদা তোয়ালে কেবল। ভেজা চুল হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ওয়ারড্রবের দিকে এগোল সে। বত্রিশ বছর বয়সী আরিশ দেখতে সুদর্শন, বেশ পরিপাটি। ছোটো থেকে চাচার কাছে বড়ো হয়েছে সে। চাচা মারা যাওয়ার পর কাজই তার নিত্যসঙ্গী।
জামাকাপড় পড়া শেষে বিছানার দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হলো আরিশ। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে অরা । তবে ঘুমিয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। শরীরের দিকে নজর পড়তেই আরিশ খেয়াল করলো,অরা দেখতে এত্তটুকু! একেবারে হামিংবার্ডের মতই। তারচে বড়ো কথা, শেষে কি-না এতটুকু মেয়েকে বিয়ে করলো আরিশ? কত আর হবে বয়স? খুব বেশি হলে উনিশ! তা-ও মনে হচ্ছে না আরিশের। সে যাইহোক, বয়স যতই হোকনা কেনো, মেয়েটা অকালপক্ব। আরিশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বেলকনিতে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসল। আপাতত সিগারেট খেতে হবে তার, নিকোটিন ছাড়া নিজেকে শান্ত করতে পারবে না আরিশ।
শরীরের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে পেঁচানো শাড়িটা ঠিকমতো শরীরে জড়িয়ে নিলো অরা। ওয়াশরুমে যেতে হবে তাকে। কিন্তু পেটের ব্যথায় পা-ও যেন অবশ হয়ে গেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া অমানুষিক অত্যাচারের কথা মনে পড়তেই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। মা তো বলেছিল, আরিশ ভালো ছেলে। একটু-আধটু রাগী হলেও ওর মনটা ভালো এই বুঝি ভালো ছেলের নমুনা? খারাপের চেয়েও খারাপ লোকটা, ঠিক একটা জংলী পশু। অরার কান্না থামে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে থাকে। সেদিন এই লোকটার বিষয় ঠাট্টা করে কতবড় ভুল করেছিল আজ হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে অরা।
বুধবার , বিকেল প্রায় চারটা ছুঁইছুঁই । অরার বাবার অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় দুপুরে বাসায় যেতে পারেননি। বারবার কল করেও বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি অরা। সেজন্য আজ অফিসেই চলে এসেছে মেয়েটা। ওর সাথে কয়েকজন বান্ধবীও আছে। মূলত বাবার থেকে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্যই এতটা উদগ্রীব হয়ে আছে অরা। হুট করে বন্ধুরা জানাল, মুভি দেখতে যাবে কিন্তু অরার যখন তখন বাসা থেকে বেরোনোর অনুমতি নেই। বলতে গেলে খুব রক্ষণশীল মানুষ অরার বাবা সোলাইমান মল্লিক। হলরুমে সকল কর্মচারীদের নিয়ে মিটিং এ চলছে। অরা কোনোমতে গার্ডকে ঘোল খাইয়ে হলরুমে প্রবেশ করে এককোনায় দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে কখনো বাবার অফিসে আসা হয়নি তার। বছর দুয়েক হবে, এই অফিসে কাজ করছেন সোলাইমান মল্লিক।
” কী রে অরা? আঙ্কেলকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ”
শর্মিলার কথায় আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো অরা। ওই যে দূরে বসে আছে তার বাবা।
” ওই যে বাবা! একটু অপেক্ষা কর, আগে আমাকে দেখুক, তারপর নিশ্চয়ই আসবেন। ”
নিঝুম হুট করে অরাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তোর কাজিনের অফিস এটা? ”
” হ্যাঁ। তাই তো জানি৷ যদিও আমিও কখনো দেখিনি উনাকে। ”
” কেমন কথা? তোর কাজিন আর তুই দেখিসনি! ”
” আরে নানান কাহিনি। পারিবারিক সমস্যা, তোরা বুঝবি না। ”
” ওহহ!”
নিঝুম বিরস মুখে বলল। শর্মিলা বেশ আগ্রহী হয়ে শুধালো,
” বিয়ে করেছেন উনি?”
” না রে। বয়স তো কম হলো না বিয়ে কেন করে না কে জানে!”
” কত রে?”
” ত্রিশ, বত্রিশ হবে হয়তো। ”
” কী! ”
শর্মিলার রিয়াকশন দেখে অরা ও নিঝুম দু’জনেই হেসে উঠলো।
” মনে হয় মেশিন ঠিক নেই। সমস্যা। সেজন্য এখনও বিয়ে করেনি। ”
অরা কথাটা বলেই হাসতে লাগলো। ঠিক সেই মুহুর্তেই ওদের পাশ দিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছিল তেজরিন খান আরিশ। অচেনা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মস্তিষ্কে আগুন জ্বলছে তার। কিন্তু আরিশ তৎক্ষনাৎ কিছু না বলে নিজের কাজের দিকে এগোল। কিন্তু অরা তখনও জানতো না তার সামনে কী অপেক্ষা করছে! পরবর্তীতে আরিশ ঠিক খুঁজে বের করে অরাকে। সোলাইমান মল্লিক এবং রোকসানা মল্লিকের বড়ো মেয়ে অরা অর্থাৎ তারই আপন খালার মেয়ে। আরিশ প্রথমে ভালোমতো বিয়ের প্রস্তাব রাখে কিন্তু সোলাইমান এতটুকু বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানান। তার পরেই আরিশের বিশ্রী রূপটা দেখতে পান তারা৷
সোলাইমান মল্লিকের চাকরি খেয়ে, মানসম্মানের ভয় দেখিয়ে, অরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য মল্লিক পরিবারকে একপ্রকার বাধ্য করে আরিশ। রোকসানা আর না করতে পারেননি। আরিশের অতীত জানেন তিনি। ছেলেটা বাইরে যতই অহংকারী ও জেদি হোক, মনটা ভালো—এই আশা রেখেই মেয়েকে আরিশের সাথে বিয়ে দেন তিনি।
সকাল হয়েছে। সূর্যের প্রথম রশ্মি ধীরে ধীরে আকাশে ছড়াচ্ছে। ভোরের আলো ফুটতেই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে যান্ত্রিক আওয়াজ। অরা চোখ খুলে দেখে, বাইরের আলো তার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে আসছে। শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। শরীরের ব্যথা আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তার মনে গভীর একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে । বাইরের পরিবেশে স্নিগ্ধতা , কিন্তু অরার মনে এক ধরনের অস্থিরতা ভর করেছে। লোকট তো রুমে নেই! রাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর কি ফেরেনি? কোথায় গেলো? আবার যদি! না ফিরলেই ভালো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল অরা। ঠোঁট জ্বলছে, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যথা।
