হামিংবার্ড পর্ব ২০

হামিংবার্ড পর্ব ২০
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

আরিশকে এমন ভাঙা, নিঃসঙ্গ দেখেনি অরা আগে কখনো। কিছুটা হতচকিত হয়ে গেছে মেয়েটা—কী বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না।
আরিশ একটু থেমে আবারও বলতে লাগলো,
“জানো হামিংবার্ড, আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। আমার কাছে সবকিছুই চাহিদা দিয়ে মাপা হয়হতে পারে সেটা আর্থিক, মানসিক, কিংবা শারীরিক। সবকিছুর ভেতরেই একটা প্রয়োজন লুকিয়ে থাকে। এই যে তোমার সঙ্গে জেদ ধরি, রাগ করি, তবুও কেমন একটা অনুভব হয় ভেতরে। কেন হয়, নিজেই জানি না।”
অরা কিছু বলতেও পারছে না। হাত বাঁধা, মুখও। শুধু আরিশের আধপাগলের মতো কথা শুনে যাচ্ছে। একটু-আধটু মায়া লাগছে ভদ্রলোকটার জন্য। কারণ, এই মুহূর্তের আরিশ অন্য সময়ের আরিশ থেকে একদম আলাদা। আরিশ অরার দিকে দৃষ্টিপাত করল। অরা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। মুচকি হাসল আরিশ।

“কথা বলতে চাও?”
অরা মাথা নাড়ল।
আরিশ শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপর অরার মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে দিয়ে আবার তার কোলেই মাথা রাখল।
এতক্ষণ মুখ বাঁধা থাকার ফলে, অরা কিছুক্ষণ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল।
” আমার সাথে থাকবে না, হামিংবার্ড?”
চোখে চোখ রেখে নিচু স্বরে শুধালো আরিশ। অরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কত্ত মায়া নিয়ে জিজ্ঞেস করছে লোকটা! চোখে অসহায়ত্ব, কণ্ঠে হারিয়ে ফেলার আকুতি, বাচ্চাদের মতো কেমন কেমন করে তাকিয়ে আছে সে। অরা দোটানায় পড়ে গেলো। এই কঠিন, পাগলাটে পুরুষটির মধ্যেও একটা শিশুসুলভ মানুষ আছে। আরিশ ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় আবারও জিজ্ঞেস করলো। অরা ভাবনার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। কী বলবে সে? মায়ের কাছে যতটুকু শুনেছিল, আরিশের ছোটোবেলা খুব খারাপভাবে কেটেছে। সেজন্য না-কি লোকটার মানসিক অবস্থা এমন। আসলেই কি তাই? তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন সে? ডাক্তার দেখালেই তো সুস্থ হয়ে যেত। অরা কি একবার চেষ্টা করবে? হাসফাস লাগছে অরার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ছোট্ট পাখি? বলো?”
আরিশের সবকিছু খারাপ লাগলেও এই ডাকগুলো দারুণ লাগে অরার। ছোট্ট পাখি, হামিংবার্ড! ভীষণ কিউট ডাকনামগুলো। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল অরা। আরিশের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” থাকব, থাকব আপনার সাথে। ”
অরার এমন জবাব আশা করেনি আরিশ। ফলশ্রুতিতে কিছুটা অবাকই হয়েছে সে। আনন্দে বিমোহিত হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো সে,
” সে এগেইন, হামিংবার্ড। প্লিজ?”
” আপনার সাথে থাকব আমি, যাবো না। ”

অরা নিজের সাথে যুদ্ধে করে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে এই লোকের সাথে একদিনও থাকবে না সে। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের কথা, আরিশের এমন অসহায়ত্বের কথা ভেবে মনে হচ্ছে – একবার চেষ্টা করা দরকার। হয়তো যত্ম, ভালোবাসা আর ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে মানুষটা ঠিক হয়ে যাবে। আরিশ খুশিতে অরার মাথা নিচু করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে যথারীতি চমকাল অরা। বিয়ের পর থেকে কতবার আরিশ তাকে এভাবে ছুঁয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু বেচারি কখনো কোনো কিছু অনুভব করতেই পারেনি। পারবে কীভাবে? আরিশের ছোঁয়া তো স্বাভাবিক নয়, যেন একেবারে আগ্নেয়গিরির লাভা!

” যাক কেউ তো আমার সাথে থাকবে বলল! আচ্ছা হামিংবার্ড, তুমি ভয়ে বললে না তো?”
” উঁহু! ”
” কী হলো? ব্যথা পেয়েছ?”
” আরে না। বললাম যে, ভয়ে বলিনি। ”
” তাহলে? ”
” বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে। আমারও একটা চেষ্টা করা উচিত বলে মনে হলো।”
আরিশ উঠে বসলো। অরার হাতের দিকে তাকাল একবার।
” তাহলে একেবারে থাকার কথা বলোনি?”
অরা চুপ করে গেলো। আরিশ ধীরে ধীরে অরার হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলতে লাগলো।
” যাইহোক, এখন আছো সেটাই যথেষ্ট। আর হ্যাঁ সব সময় আমার মেজাজ একরকম থাকবে না৷ তাই পরবর্তীতে এমন মারামারির চিন্তাও করবে না হামিংবার্ড। ”
শুকনো ঢোক গিলে বলল সে,
” আসলে, মানে…. আমি বুঝতে পারিনি তখন। সরি!”
” আমি বুঝতে পারিনি দেখতে ছোটো মরিচ হলেও যথেষ্ট ঝাল আছ তুমি। আমার সামনেই শুধু জড়সড় হয়ে থাকো। ”

অরা হাত নাড়াচাড়া করছে। একটু সময় আটকে ছিলো তাতেই কেমন লাগছে। যদি সত্যি সত্যি আটচল্লিশ ঘন্টা এভাবে হাত আটকা অবস্থায় থাকত, তবে? অরার বেখেয়ালি মনোভাব দেখে আরিশ তাকে কোলে তুলে বসাল। তবে অরা এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
” কী করছেন? ”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো অরা। মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দেওয়ার পরিবর্তে, আরও কিছু চুল কপালে এনে রাখল সে। চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে অরার ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অরার হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরিশকে এভাবে কাছে আসতে দেখে কেমন অস্থির লাগছে তার। এই মুহুর্তে আরিশকে থামাবে কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে৷ অরা এখনও এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না৷

” শুনুন। ”
” হুম। ”
” জোর করবেন? ”
অরার প্রশ্নে থেমে গেলো আরিশ। কপালে কপাল ঠেকাল। বলল,
” নাহ। তুমি যখন চেষ্টা করবে, আমিও চেষ্টা করবো সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে। তুমি নিজে থেকে না চাইলে কখনোই আর জোর করবোনা আমি। ”
আরিশের এমন জবাব আশাতীত ছিলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। তবে আজ দুঃখে নয়, আরিশের আচরণে খুশিতে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা। একটা সময় জীবনসঙ্গী নিয়ে কত-শত স্বপ্ন দেখত অরা৷ উপন্যাস, গল্প, মুভি দেখে দেখে ভাবত গল্পের নায়কের মতো টক্সিক, পজেসিভ, ওয়াইল্ড রোমান্স করবে এমন কাউকে বিয়ে করবে সে। অথচ বাস্তবে যখন সেটা হলো তখন অরা বুঝতে পারলো, কল্পনা আর বাস্তব আলাদা। বাস্তব আলাদা, কঠিন। উপন্যাসের পাতায় নায়কদের এমন টক্সিক, ওভার পজেসিভ চরিত্র পড়ে হৃদয়ে প্রেম জাগলেও বাস্তবে কেবল বিতৃষ্ণা জাগে মনে। জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। অরাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আরিশ বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। অরা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,

” আপনি প্লিজ এমনই থাকুন। রাত পেরিয়ে ভোর হতেই দুঃস্বপ্নের মতো হারিয়ে যাবেন না প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়, ভয় লাগে। আমি, আমি……. ”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে মেয়েটা। আরিশ অরার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” শান্ত হও। আমি এমনই থাকব। তুমি শুধু আমার অপছন্দের কাজগুলো থেকে দূরে থেকো। আমি মাঝে মধ্যে চাইলেও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আর একটা বিষয় হলো, তুমি ভীষণ কিউট, পাখি। এই যে দেখো, তোমার জন্য কতটা শান্ত হয়ে গেছি আমি! ”
অরা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। এতদিন আরিশের থেকে এত এত যন্ত্রণা পেয়েছে যে, আজ হঠাৎ তার এত কোমল ব্যবহারে অরার মনে দাগ কেটেছে। অরা চুপচাপ আরিশের বুকেই মাথা রেখে বসে রইলো। আরিশ একা একা অনেকক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারল, অরা ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটা আসলেই বাচ্চা! কেমন কোলেই ঘুমিয়ে গেলো…………

সকালের আলোটা ধীরে ধীরে শহরের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে। আধো ঘুমন্ত রাস্তার ওপর দিয়ে প্রথমে কিছু পত্রিকা বিক্রেতা, দুধওয়ালা, আর ক্লান্ত ভ্যানচালকেরা নীরবভাবে চলতে শুরু করেছে। ফুটপাথের চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে, তপ্ত লাল চায়ের সঙ্গে জেগে উঠেছে শহরের চিরচেনা গুঞ্জন।
ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর হর্ন, অফিসগামী মানুষের হন্তদন্ত দৌড়, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভেসে আসা হকারদের হাঁকডাক সব মিলিয়ে শহর যেন এক প্রাণবন্ত কোলাহলে জেগে ওঠে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আকাশ। হাতের গুলিটা বেশ যন্ত্রণা দিয়েছে তাকে। আকাশের বাবা ছেলের এমন পরিণতিতে ভীষণ রেগে গেছেন। গতকাল আকাশের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে আরিশের কাছে যেতে পারেনি। কিন্তু আজ ভোরের আলো ফুটতেই থানায় চলে গেছেন তিনি।

হামিংবার্ড পর্ব ১৯

ঘরটা শান্ত, নিস্তব্ধ। যেন ঘুম আর নীরবতায় মোড়া এক টুকরো সকাল। জানালার পর্দা হালকা হাওয়ায় দুলছে, আর তার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া রোদ একপ্রকার নরম আলোর চাদর ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরের ভেতর। অরা এখনো ঘুমিয়ে, শরীরটা একটু গুটিয়ে রাখা। চুলগুলো এলোমেলো, বালিশের কোণে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই একফালি রোদ এসে পড়ল তার চোখেমুখে। চোখের পাতার ওপর উষ্ণ আলো পড়ে অরার মুখে মিশে গেল একটা অদ্ভুত কোমলতা। যেন সূর্য নিজেই তার ঘুম ভাঙাতে এসেছে নিঃশব্দে। আরিশ কিছুক্ষণ আগে জেগে উঠেছে। সে এক কোণে চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছে অরার দিকে, চোখে মুগ্ধতা। কেমন করে যে রোদটাও তার ছোট্ট পাখিটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, সেটাই দেখছে সে। রোদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অরার গাল, নাক, কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে এগোচ্ছে আরিশ। খুবই ক্ষিপ্ত গতিতে সবগুলো জানালা আঁটকে দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল সে। এতক্ষণে শান্তি! রোদ কেনো স্পর্শ করবে অরাকে? তাও বন্ধ ঘরের মধ্যে?

হামিংবার্ড পর্ব ২১