হামিংবার্ড পর্ব ২২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
” ভাইয়া এরপর থেকে মাথাটা একটু ঠান্ডা রেখো, প্লিজ!”
আরিশের পেছনে এসে দাঁড়াল তালহা। আজকের ঘটনায় আরিশকে যেন নতুন করে চিনতে পেরেছে সে।
” হুম। চল, মিটিং শেষ করতে হবে। ”
” হ্যাঁ চলো।”
আরিশের সাথে মিটিং রুমের দিকে অগ্রসর হলো তালহা।
দুপুরের রোদ যেন মাথার উপর জ্বলন্ত আগুন হয়ে নেমে এসেছে। গ্রীষ্মের এই অসহ্য তাপে ধরণী কূল হাঁসফাঁস করছে। বাতাস নেই বললেই চলে, চারপাশের গাছের পাতাগুলোও নিথর। পাখিরা যেন গা ঢাকা দিয়েছে, তাদের কিচিরমিচির শব্দও আজ অনুপস্থিত। রাস্তায় চলাফেরা করছে খুব কম মানুষ, যারাও বেরিয়েছে, তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি আর বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তাপমাত্রার এই নির্মম দাপটে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি আর গাছপালাও নুইয়ে পড়েছে। মাটি শুকিয়ে ফেটে গেছে অনেক জায়গায়, বাতাসে যেন ধুলোর সাথে ঝুলে আছে এক ধরনের অস্বস্তি। এমন দিনে সকলে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।হয়তো এক পশলা বৃষ্টি নামবে, আর প্রাণ ফিরে পাবে এই জ্বালাময় পরিবেশ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরা আজ প্রথমবারের মতো রান্নাঘরে। তার মেনুতে রয়েছে ভাত, গরুর মাংসের ঝোল আর চিংড়ি মাছ ভাজা। গরুর মাংসটা আরিশের সবচেয়ে প্রিয়, আর তাই অরা ঠিক করেছিল, আজ সে আরিশের পছন্দের খাবাররান্না করবে ।
” ভাবি! আপনার রান্না শেষ হয়েছে?”
” হ্যাঁ, এইতো। আমার রান্না শেষ। ”
” তাহলে আপনি গিয়ে গোসল সেরে আসুন। আমি ততক্ষণ আছি এখানে। ”
তামান্নার কথায় মুচকি হাসল অরা। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমেছে আজকাল।
” বরের মন পাওয়ার জন্য রান্নাবান্না চলছে নাকি?”
আচমকা সাবিহার এমন কথায় হকচকিয়ে গেল অরা। তামান্না সাবিহাকে দেখেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছে। এই মেয়েটাকে একদম সহ্য হয় না তার।
” আমার বর, আমার ঘর৷ মন পাওয়া না পাওয়ার কী হয়েছে? আর উনার মন তো আমার কাছেই আছে। রান্না করতে ইচ্ছে হলো, করলাম। এতটুকুই ননদী। ”
অরার কথায় চমকাল সাবিহা। এই মেয়েকে দেখে যতটা ভোলা ভালা মনে হয় আসলে সে ততটা ভোলা ভালা নয়। ইচ্ছে করেই আরিশের সামনে নরম হয়ে থাকে। সবকিছুই নাটক! মনে মনে এসব ভেবেই নিজেকে সামলে নিলো সাবিহা।
” কথা তো ভালোই বলতে পারো। আরিশের সামনে গেলে তো বোবা হয়ে যাও। ”
অরা মুচকি হেসে বলল,
” এটা বোবা হওয়া নয়, ননদী। স্বামীকে সম্মান করা। ”
তামান্না ঠোঁট কামড়ে মুচকি মুচকি হাসছে। অরা বরাবরই চঞ্চল একটা মেয়ে, কথা বলতে পছন্দ করে, আবার প্রচন্ড ভীতুও বলাও চলে। এখনও আছে। তবে বিয়ের পর থেকে একটু একটু করে বদলে গেছে সে। ভয়টা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, চঞ্চলতাও কমে গিয়েছিল। কিন্তু আরিশের আচরণে ধীরে ধীরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার৷ ভয় পেতে, পেতে একটা সময় ভয় কাটিয়ে ওঠে। আরিশের করা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে। অরা ঠিক যেন পানির মতো। যখন যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।
” বাহ! দেখা যাক, কতদিন থাকে এতো সম্মান। আর তোমার স্বামীর মন তোমার ওপর না-কি অন্য কোথায় সেটাও খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে। ”
” মানে?”
” মানে….. চোখকান খোলা রেখেো। বুঝতে পারবে। ”
সাবিহা এটুকু বলে ঠোঁটের কোণে প্রসস্থ হাসির রেখা বজায় রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অরা সাবিহার কথায় বিশ্বাস না করলেও মনটা কেমন খচখচ করতে লাগলো। সত্যি কি আরিশের মন অন্য কোথাও? বিয়ের পরও কি সত্যি অন্য কেউ রয়ে গেছে তার জীবনে?
সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের রঙ গাঢ় হতে হতে এখন হালকা বেগুনি-মেরুন ছায়ায় ঢাকা। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা ডুবে গেছে, শুধু কিছু লালচে আভা রয়ে গেছে আকাশের কিনারে। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা, পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ ঠিকানায়। চারপাশে যেন এক শান্ত, ধীর রাত্রির পূর্বাভাস।
” মা আগামীকাল আপুর সাথে দেখা করতে যাই একটু?”
রোকসানা মল্লিক চা তৈরি করছেন। গরম পানিতে সদ্যই চাপাতি ছাড়লেন। চায়ের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে এক ঘর মৃদু সুগন্ধ।
বিকেল থেকে নয়না মায়ের পিছুপিছু ঘুরছে। তার অনুরোধ, বোনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে দিতে হবে। চোখেমুখে ব্যাকুলতা, গলায় মৃদু অনুনয়। এই সময়েই সোলাইমান মল্লিক বাসায় ফিরলেন। অফিসের ক্লান্তি তার চোখেমুখে স্পষ্ট। কিছু না বলেই সোজা চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।
” কালকে না, নয়না। পরে একদিন যাস। ”
” কালকে নয় কেনো?”
” কাল শুক্রবার, আরিশ বাসায় থাকবে। ”
” তো?”
রোকসানা মল্লিক মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। নয়না যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে বলেই এত অল্প সময়ে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে। কিন্তু বাসা থেকে বের হলে, যদি এলাকার লোকজন উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়? তখন নয়নার মন ভেঙে যাবে। এইজন্যই বাসা থেকে বেরোতে দিতে চাননা তিনি।
” তুই তো জানিসই, আরিশ একটু বেশি রাগী। যদি তোর সাথে রাগারাগি করে, তখন?”
নয়না লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
” মা! তুমিও না কীসব বলো! ভাইয়াকে নিয়ে আগে আমারও সমস্যা ছিলো। কিন্তু এখন নেই। উনি বাইরে থেকে যেমনই হোননা কেনো, ভেতরে একজন ভালো মনের মানুষ। তাছাড়া আমি প্রথম যেদিন ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনও ভাইয়া খারাপ আচরণ করেননি। ”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নয়নার মা। আরিশ কেমন সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু সমস্যা যে অন্য জায়গায়, সেটা নয়নাকে কীভাবে বোঝাবেন তিনি?
” মা-মেয়ের মধ্যে কী নিয়ে কথা হচ্ছে, শুনি?”
বসার ঘরে সোফায় এসে বসলেন সোলাইমান মল্লিক। মাত্র ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো নয়না। রোকসানা মল্লিকও চা নিয়ে সেদিকেই এগোচ্ছেন।
” দেখো না, বাবা– মা কিছুতেই আপুর বাসায় যেতে দিচ্ছে না আমাকে৷ কতদিন হলো বাসা থেকে বের হইনি! স্কুলে না হয় আর কিছুদিন পরে গেলাম, কিন্তু আপুর সাথে দেখা তো করতে পারি?”
রোকসানা মল্লিক স্বামীর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন৷ চায়ের কাপে ধীরস্থিরভাবে চুমুক দিয়ে বললেন সোলাইমান,
” অবশ্যই পারিস। রোকসানা নয়নাকে কেনো মানা করছ?”
একটু চুপ করে রইলেন নয়নার মা। স্ত্রী’র মনোভাব বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন সোলাইমান।
” এমনি। ”
” থাক মানা করার দরকার নেই। অরার সাথে দেখা করে এলে নয়নারও মন ভালো লাগবে। ”
” তাহলে আমি যাচ্ছি, বাবা?”
” হ্যাঁ যাস। ”
নয়না খুশিতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এজন্যই তোমার থেকে বাবাকে বেশি ভালোবাসি, হুহ্। ”
সোলাইমান মল্লিক মুচকি হাসলেন। সাথে রোকসানাও। নয়না খুশি খুশি মনে নিজের ঘরের দিকে গেলো। রোকসানা সোলাইমানের মুখোমুখি বসলেন।
” রোকসানা এভাবে ভয় পেলে তো চলবে না৷ কতদিন ঘরে থাকবে নয়না? এক সময়, না একসময় বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতেই হবে। তাই ও যখন চাইছে তখন ওকে যেতে দাও। আমাদের নয়না যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে, সবকিছু সামলে নিতে পারবে। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোকসানা। মাথা নেড়ে স্বামীর কথায় স্বায় দিলেন কেবল….
খান বাড়ির ডাইনিং রুমে সবাই রাতের খাবার খেতে ব্যস্ত। কেবল আরিশ এখনো বাসায় ফেরেনি। তালহা সেই আটটার দিকেই বাসায় ফিরেছে। অরা আজকে প্রথম আরিশের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আরিশের তো আসার নামগন্ধ নেই! অরা বারবার বারবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। রাত দশটা ছুঁইছুঁই এখন৷
” ভাবি মা, কী দেখছ এত? ভাইয়ার কিছু কাজ আছে, কাল ছুটির দিন তো। সেজন্য সবকিছু শেষ করে আসার কথা। এখুনি এসে পড়বে, তুমি টেনশন করো না৷ ”
অরার হাবভাব দেখে তালহা সবকিছুই বুঝতে পারছিল। সেজন্য আরিশের দেরিতে আসার কারণ সম্পর্কে অবহিত করল তাকে৷
” আচ্ছা ভাইয়া।”
তাসলিমা খাতুন খাবার খেতে খেতে তামান্নার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। ইদানীং তালহার সাথে বড্ড ভাব জমেছে মেয়েটার। যা তাসলিমার মোটেও ভালো লাগছে না৷ রাস্তার মেয়ে, না জানি আবার তালহাকে বশ করে ফেলে! মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতে খাবার খাচ্ছেন তিনি।
অরার অপেক্ষা ফুরল রাত এগারোটার দিকে। আরিশ বাড়িতে ফিরেছে একটু আগে, তবে খেয়েদেয়ে এসেছে। অরা বিছানায় চুপ করে বসে আছে। যখনই চায় সবকিছু ভুলে গিয়ে মনটা শক্ত করে আরিশকে আপন করে নিবে তখনই আরিশের থেকে কোনো না কোনো বাঁধা পায় সে৷ যেমন নয়নার ঘটনাটির পরে অরা ভেবেছিল, আরিশের সাথে সব ঠিক করে নিবে। কিন্তু আরিশের ব্যবহার তাকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল অরা।
ওয়াশরুমের ধোঁয়ায় ঢাকা দরজা খুলতেই বেরিয়ে এলো ফর্সা, চকচকে ত্বকের এক সুগঠিত দেহ। ছোট করে কাটা ভেজা চুলগুলো কপাল বেয়ে কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে, যেন স্বভাবজাত এক উদাসিন সৌন্দর্য। সাদা তোয়ালেতে কোমরজুড়ে জড়ানো মাত্র, বুক থেকে পেট পর্যন্ত জল বেয়ে পড়ছে অবিরত, প্রতিটি ফোঁটা যেন গলে যাচ্ছে অরার দৃষ্টিতে। শুকনো ঢোক গিলল সে। আরিশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
অরা যেন থমকে গেল। এক হাতে চুল মুছছিল আরিশ, অন্য হাতে তোয়ালেটা সামলে হাঁটছে ধীরভঙ্গিতে। তার প্রতিটি পা যেন অরার বুকে দোলা দিচ্ছে। কিশোরী থেকে যুবতী হওয়ার সন্ধিক্ষণে আছে মেয়েটির বয়স। তাই এমন সুদর্শন পুরুষ দেখে স্বাভাবিকভাবেই বিমোহিত হয়ে গেছে অরা। ফের গলায় একটা শুকনো ঢোক গিলে নিল সে—চোখ ফেরাতে চাইল, পারল না। আরিশের রাগ, পাগলামি বাদে ভাবতে গেলে একদম পারফেক্ট একটা মানুষ সে। যাকে বলে প্রতিটা মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ।
” হেই হামিংবার্ড! কী ভাবছ এত? ”
” কিছু না। ”
আরিশ মুচকি হেসে অরার দিকে এগিয়ে এল। অরা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল, নিঃশব্দে, নিথর। হঠাৎই কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই আরিশ তাকে তুলে নিলো কোলে, ঠিক সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে নয়।
অরার দুই হাত জড়িয়ে রইল আরিশের গলায়, আর দুই পা ছড়ানো অবস্থায় সে বসে আছে আরিশের কোমরের দু’পাশে। শক্ত করে আঁকড়ে আছে আরিশের পিঠ, যেন একটু নাড়লেও পড়ে যাবে। সদ্য গোসল করা শরীর থেকে ভেসে আসছে সাবানের হালকা, স্বচ্ছ সুগন্ধি। যা অরার বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
আরিশের ঠান্ডা, ভেজা ত্বকের সংস্পর্শে অরা যেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আটকে গিয়েছে। শরীর শীতল, কিন্তু উপস্থিতি যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে অন্তর।
” কেউ কিছু বলেছে? ”
” উঁহু। ”
” তাহলে?”
” আপনি বাইরে খেয়ে এলেন কেনো? আমি আপনার জন্য রান্না করেছিলাম, আর অপেক্ষাও করছিলাম। ”
আরিশের অবাক লাগলো অরার কথাগুলো। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য! কেউ তার জন্য রান্না করেছে? অপেক্ষা করেছে? আরিশ কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। অরাকে বিছানায় বসিয়ে, নিজেও মুখোমুখি বসলো। অরার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে রাখল।
হামিংবার্ড পর্ব ২১
” সত্যি? ”
” হুম। ”
” আমার জন্য অপেক্ষা কেন করছিলে, হামিংবার্ড?”
” মা’কে দেখেছি বাবার জন্য এভাবেই অপেক্ষা করে থাকেন, সেজন্য। ”
খালার সম্পর্কে এমন কথা শুনে একটু হলেও মন পরিবর্তন হলো আরিশের। মুচকি হেসে বলল,
” তুমি খাবার খেয়েছ?”
” হ্যাঁ, খেয়ে নিয়েছি। আমার খিদে পেয়েছিল খুব। ”
অরার সহজসরল স্বীকারোক্তি। আরিশ অরার গাল টেনে দিলো। হকচকিয়ে গেলো অরা।
” ভালো করেছ। ”