হামিংবার্ড পর্ব ২৩

হামিংবার্ড পর্ব ২৩
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

অরার সহজসরল স্বীকারোক্তি। আরিশ অরার গাল টেনে দিলো। হকচকিয়ে গেলো অরা।
” ভালো করেছ। ”
” আপনি কী করলেন, এই মাত্র? ”
অরার চোখমুখ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আরিশের।
” কী করলাম? ”
” আমার গাল টেনে দিলেন! ”
” হ্যাঁ দিলাম। ”
” আমি কি বাচ্চা? ”
” অবশ্যই। আমার জন্য বাচ্চাই তুমি, বাচ্চা বউ একটা। ”
” আচ্ছা আপনি আমাকে হামিংবার্ড বলে ডাকেন কেনো? আপনার তুলনায় দেখতে ছোটো বলে?”
অরা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। আরিশ বসা থেকে উঠে ওয়ারড্রবের দিকে অগ্রসর হলো। অরাও চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে আছে। আরিশ জামাকাপড় পরতে পরতে বলে,

” বুদ্ধিমতী মেয়ে। ”
মুচকি হাসল অরা। বলল,
” তালহা ভাই বলছিলেন, কাজকর্ম শেষ করে ফিরবেন বলে লেট হয়েছে। আসলেই কী তাই? অফিসে ছিলেন?”
অরার প্রশ্নটা শুনেই হঠাৎ করেই আরিশের চোখেমুখের ভঙ্গি বদলে গেল । তার দৃষ্টি হিংস্র হয়ে উঠল, ঠোঁটটাও কেঁপে উঠল রাগে। এক পলকেই কাছে এসে অরার গাল চেপে ধরল সে। অরার চোখে পানি চলে এলো যন্ত্রণায়। কী এমন জিজ্ঞেস করেছিল সে, যার জন্য এমন প্রতিক্রিয়া দরকার ছিল?
” তালহার থেকে দূরে থাকতে বলেছি, না? কেনো কথা বলেছ? আমার আসতে দেরি হওয়ার কারণ জানার থাকলে আমাকে কল করে নিতে। তালহার কাছে কেনো? এটা অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ ছিলো হামিংবার্ড। ”
অরা গালে, মুখে ব্যথা পাচ্ছে। আর আরিশের আচরণে অবাকও হচ্ছে। এইতো কতো সুন্দর করে কথা বলছিল লোকটা, চোখের পলকে এভাবে বদলে গেলো কীভাবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আমার ব্যথা লাগছে। প্লিজ ছাড়ুন! আমি জিজ্ঞেস করিনি, ভাইয়া নিজে থেকে বলেছিলেন। ”
আরিশ শান্ত হতে পারছে না। রাগে শরীর কাঁপছে, কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অরা আরিশের এই রূপটাকে ভয় পায়, পাওয়ারই কথা। এমন অস্বাভাবিক রাগ কেউই সহ্য করতে পারবে না৷ আরিশ অরাকে ওভাবেই বিছানায় শুইয়ে দিল। অরার মনে হচ্ছে ওর মুখের হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙেই যাবে আজ। ওর শরীরের ওপর কিছুটা ঝুঁকে বলল আরিশ,
” অহেতুক কখনো তালহার সাথে কথা বলবে না৷ ”
” বলব না। ”

অরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। হুঁশ ফিরলো আরিশের। হাত সরিয়ে নিলো ওর গাল থেকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে লাগলো অরা। মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে অপরাধবোধ অনুভব হচ্ছে আরিশের। সে অরার গালে আলতো করে চুমু খেলো কয়েকটা, হাত দিয়ে আস্তে আস্তে আদর করে দিতে লাগলো । অরা চুপচাপ আরিশের চোখের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। একবার মনে হচ্ছে এই মানুষকে নিয়ে সংসার করা হবে না তার, আবার মনে হচ্ছে মানুষটা যতই হিংস্র হোক– তার ভেতর একটা নরম মনের মানুষ বিরাজ করে। পরিস্থিতি, সময়, কিছু মানুষের অবহেলা তাকে এরকম তৈরি করেছে।
” আম সরি, লিটল বার্ড। সরি!”
দু’হাতে গাল ধরে, কপালে কপাল ঠেকাল আরিশ। অরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আরিশের বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল তাতে।

” আমি বুঝতে পারিনি, তুমি ভয় পাবে। এভাবে ব্যথা পাবে। ”
অরা চুপ করে আছে। আরিশ তাকে নিজের শরীরের ওপর উঠিয়ে শুইয়ে, দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল।
” পাখি? ও পাখি? কথা বলবে না?”
” না। ”
অরার কন্ঠে তীব্র অভিমান, যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। আরিশ অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কয়েকবার, পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
” বললাম তো, সরি! ”
” হুটহাট কী হয় আপনার? এরকম করলে তো ভয় লাগে। ”
” আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। আম সরি, হামিংবার্ড। ”
” হুম। ”
” কী হুম?”
” কিচ্ছু না। ”
আরিশ অরাকে বিছানায় শুইয়ে দিল এবার, নিজের হাতের ওপর মাথা রাখল তার।
” অফিসেই ছিলাম। কাজ ছিলো। ”
” আচ্ছা। ”

চুপ করে গেলো অরা। আরিশও কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। চোখাচোখি হলো দুজনের, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আরিশ। কয়েক মিনিট পর ছাড়া পেলো মেয়েটা, ঠোঁট জ্বলছে, নিঃশ্বাস ঘনঘন ফেলছে। আরিশের স্পর্শ মানেই জ্বলেপুড়ে খাক করে দেওয়া অনুভূতি।
” তোমার বর বদমেজাজী হতে পারে, চরিত্রহীন নয় হামিংবার্ড। ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, তেজরিন খান আরিশ কেবল অরা মেহরীনে আসক্ত থাকবে। সুতরাং কাজেই ছিলাম, অন্য কোথাও নয়৷ ”
মুচকি হাসল অরা। সাবিহাকে আগামীকাল কিছু কথা শোনাবে বলেও ঠিক করে নিলো।
” ভালো মানুষ আপনি। ”
” মোটেও না। আমি খারাপ, জগতের সকল অন্ধকার আছে আমার মধ্যে। ”
” তাই? তো সেজন্যই কি সব সময় এই কাইল্লা রঙ পরে থাকেন?”
আরিশ হাসল। কাইল্লা রঙ! অরা উঠে বসলো। আরিশ কনুইতে ভর দিয়ে অর্ধ শোয়া অবস্থায় বলে,
” কালো আমার পছন্দের রঙ। সব সময় রঙটা ভীষণ টানে আমাকে, সেজন্যই পরি। বিশেষ কোনো কারণ নেই। ”
” বুঝতে পেরেছি। ঘুমাতে হবে। অনেক রাত হয়েছে। ”
আরিশ অরার নাকে নাক ছুঁইয়ে ফিসফিস করে শুধালো,
” আ’ম ওয়েটিং, মাই হামিংবার্ড। অধৈর্য আমিও তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে আছি। বুঝতে পারছ? বেশিদিন অপেক্ষা করিও না। আপাতত শুভ রাত্রি! ”

কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো অরা। আরিশ আর কথা না বাড়িয়ে দূরে সরে গেলো। নিজের জায়গায় শুয়ে ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো সে। অরা কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে রইলো। আনমনে অনেক কিছু ভাবল, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসল, আরিশের দিকে তাকাল। লোকটা বড্ড নির্লজ্জ, ঠোঁটকাটা, পাগল আর সাইকো…..
” কলিংবেলটা এতোবার বাজানো লাগে? এতো সকালে কে এলো আবার!”
কলিংবেলের শব্দে সাবিহা বেজায় বিরক্ত হচ্ছে। এমনিতেই রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তার, শরীর খারাপ ছিলো একটু। তারমধ্য সকালেও ঘুমাতে পারেনি। তালহা দুষ্টমি করে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। বড়ো ভাই হলেও তালহা প্রায়শই সাবিহার সাথে ঝামেলা করে, দুষ্টমি করে।

” আমি দেখছি গিয়ে। ”
তামান্না রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলো। নয়নাকে দেখেই হাসল সে।
” কেমন আছেন আপু?”
” আলহামদুলিল্লাহ। ভেতরে এসো তুমি। ভাবি রুমে আছে এখনও। তুমি বসো, আসো, আসো। ”
নয়নাকে নিয়ে বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে তামান্না। সাবিহা আড়ালে মুখ ঝামটি দিলো। নয়না আশেপাশে নজর বুলিয়ে, সোফায় বসল। সাবিহা নিজের মতো বসে আছে। কোনো কথা নেই মুখে। নয়না বুঝতে পারছে না, সামনে থাকা আপুকে কিন্তু জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কিনা । আর নয়না জানেও না উনি কে! বাড়ির সদস্য তো নিশ্চয়ই! কুশলাদি জানতে না চাইলে কেমন একটা দেখায়। নয়না লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে শুধালো,
” কেমন আছেন আপু?”
আড়চোখে তাকাল সাবিহা। নয়নার পরনে মেরুন রঙের সুতির থ্রিপিস, চুলগুলো ছাড়া, চোখেমুখে কেমন অস্থিরতা।
” ভালো। ”

মুচকি হাসল নয়না। মনে মনে সাবিহাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল, কিন্তু কিছু না বলেই চুপচাপ রইল। এদিকে তামান্না আবার রান্নাঘরে ফিরে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সিড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেল অরাকে। হেঁটে আসা যেন এক উৎসবের ঝামেলা। নয়নার ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিল একটুখানি হাসি। অরাও বোনকে দেখে বেশ খুশি হল। নয়না উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল বোনের দিকে।
” কেমন আছিস নয়না? মা-বাবা কেমন আছেন?”
” সবাই আছেন,আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? ”
” ভালো আছি। চল খাবার খেতে খেতে কথা বলব। খিদে পেয়েছে খুব। ”
অরা হেসে বলল। নয়নাও মুচকি হাসল, বলল,
” আচ্ছা। ”

বিদ্যুৎ নেই প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল। এমনিতেই তীব্র গরম, তার উপর বিদ্যুৎ না থাকায় হাঁসফাঁস করছে সবাই। নয়না আর অরা ড্রইংরুমে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, মাঝে মাঝে বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে।
আরিশ নিজের রুমেই আছে। তার তেমন গরম লাগে না। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একবার সে। রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। অরা এখনো রুমে আসেনি। এই কয়দিনেই অরা আরিশের অভ্যাস হয়ে গেছে। তাকে ছাড়া ঘুম আসছে না ভদ্রলোকের। অগত্যা বউকে ডাকতে ঘর ছেড়ে ড্রইং রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে।
চাঁদনি রাতের নরম আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে তালহা, হাতে গিটার ধরে রাখলেও আঙুলগুলো থেমে আছে কোন নিঃশব্দ সুরের অপেক্ষায়। কোন গান গাইবে বুঝতে পারছে না। গরমের জন্য তামান্নাও ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলো । চাঁদের আলো তার মুখে পড়ে তাকে আরও কোমল, আরও স্নিগ্ধ করে তুলেছে। কারো পায়ের শব্দে পেছনে ফিরে তাকাল তালহা। তার চোখ মুহূর্তেই আটকে গেলো তামান্নার দিকে।
” গরমে শেষ! ভাই কি গান গাইবেন? ”
তামান্না জিজ্ঞেস করলো। তালহা হুঁশে ফিরলো যেন৷ ইদানীং তামান্নাকে বেশ ভালো লাগে তার৷ কিন্তু কেনো? তামান্না তালহার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও। তালহা কথা না বলে মুচকি হেসে গান ধরলো–

হামিংবার্ড পর্ব ২২

Yeh aasma tere pairon mein hai
Themeri jaan meri khairon mein hai
Tera rang hai laal dhalte suraj ka jaise
Itna khoobsurat koi lagta hai kaise
Aaja mein batao tujhe kya rakha
Maine tera naam nasha rakha
Jab jab bole mujhe lagta hai yun
Koi ragni….
Hum tujhko sanam o sanam itna chahenge
Jaise chand ko chand ko chahe chandni

হামিংবার্ড পর্ব ২৪