হামিংবার্ড পর্ব ৪৯

হামিংবার্ড পর্ব ৪৯
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

ইতালি।
মিলান শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে গাড়িটা ছুটে চলেছে দক্ষিণের পথে– বালডিচিয়ার দিকে।
হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাস্তাগুলো নিঃশব্দ, চারপাশে যেন এক অজানা ঘুমঘুম নিস্তব্ধতা। সামনে বসা চালক — মারিও, তিনি স্থানীয় একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভার। সে-ই অরা ও আরিশের পুরো ভ্রমণসঙ্গী, গাইড। এই কয়দিন সে-ই ওদের নিয়ে যাবে পাহাড়ের পথে, ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে, আর ফিরিয়ে আনবে শহরের আলোয়।
পেছনের সিটে অরা আর আরিশ পাশাপাশি বসে আছে। জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অরা। রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পুরোনো পাথরের বাড়ি, ভাঙা প্রাচীর, দূরে পাহাড়ের কোল ছুঁয়ে জ্বলে থাকা একটি-দুটি লণ্ঠনের আলো। গাছপালার ফাঁক গলে শুকনো ম্যাপল পাতারা রাস্তার উপর নেমে আসছে ধীরে ধীরে।

আরিশ পাশে বসে অরার ঠান্ডা হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছে। হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দিচ্ছে মাঝে মধ্যে।
গাড়ির ভিতরে হালকা কোনো রেডিওতে বাজছে পুরোনো ইতালিয়ান গান।
“ আর কেবল আধঘণ্টা। তারপরই আমরা পৌঁছে যাবো।”
হালকা ইংরেজিতে জানালেন চালক মারিও।
“ ঠিক আছে। “
সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো আরিশ। অরার নজর বাইরের দিকে। নতুন শহরে আসা থেকেই সবকিছু দেখে যাচ্ছে কেবল।
“ আচ্ছা আমরা কতদিন থাকবো এখানে? “
“ তোমার ইচ্ছে। “
অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল আরিশ। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। অরা আরিশের বুকে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মৃদু কেঁপে উঠল যেন আরিশ। অরার ঠোঁটের কোণে হাসি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ হামিংবার্ড বড্ড দুষ্টমি করছো, তুমি। বাসায় পোঁছাই, তারপর তোমাকে দেখে নেবো। “
“ আমি কী করলাম!”
“ কিচ্ছু না। “
অরার ঠোঁটে আলতো করে কামড় দিয়ে বলল আরিশ। অরা এবার একেবারে চুপ হয়ে গেছে। পাগল ক্ষেপে গেলে পরে আবার সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
রাত দশটা ।
শেষমেশ গাড়িটা এক সরু পাথুরে রাস্তায় থামল । চারপাশ নীরব– এমনকি পাখির ডাকও নেই, শুধু দূরের কোথাও হালকা বাতাসে নড়েচড়ে ওঠা পাতার শব্দ। পাহাড় ঘেরা উপত্যকার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো দোতলা পাথরের বাড়ি, যার বেলকনিতে ঝুলে থাকা ছোট ছোট আলোগুলো বাতাসে দুলে উঠছে।
“ আপনারা পৌঁছে গেছেন।”

বলে ড্রাইভার মারিও। সে দরজা খুলে দেয়, লাগেজ নামায়।
অরা নেমে দাঁড়ায়। ঠান্ডা হাওয়ায় গা ছমছমে অনুভূতি,কিন্তু সেই অনুভবের ভিতরেই এক অদ্ভুত রকমের শীতল শান্তি। মাথার ওপর রাতের আকাশে তারা ঝিকিমিকি করছে, আর পেছনের পাহাড় ধরা দেয় ধোঁয়াটে কুয়াশার পর্দায়।
বাড়িটার সামনে পুরোনো ওয়াইন ব্যারেল সাজানো, একপাশে আঙুরগাছের লতা গেঁথে উঠেছে দেয়াল ধরে। ড্রাইভার তাদেরকে পৌঁছে দিয়ে আপাতত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই ঠান্ডা একটা বাতাস গায়ে এসে লাগল অরার। পাথরের মেঝে, কাঠের সিলিং, আর মাঝখানে ধুলোমাখা কার্পেট। দেয়ালে টাঙানো পুরনো পেইন্টিংগুলো ঝাপসা আলোয় যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই। অরা সবকিছু বিস্ময় নিয়ে দেখছে। এতো চমৎকার বাড়ি আগে দেখেনি সে।
বাড়িটা পুরনো হলেও পরিপাটি। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা আছে কিছু ফুলের তোড়া, অতিথিদের জন্যই হয়তো রাখা হয়েছে।
আরিশ ব্যাগটা নামিয়ে রাখতেই একটা কাঠের সিঁড়ি চোখে পড়ল। উপরের ঘরের দিকে উঠে গেছে সরু সে পথ।

“চল, ওপরে গিয়ে দেখি। বাড়ির মালিকের সাথে কথা হলো একটু আগে। উনার কথামতো, ওপরে দু’টো বেডরুম আছে, সাথে বারান্দা।”
আরিশ বলল।
অরা একটু কাঁপা গলায় জবাব দিল,
“ বাড়িটা কেমন শুনশান। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। “
“ হ্যাঁ। বালডিচিয়ার উপত্যকায় এমনি হয়। বাড়িগুলো একেবারে শুনশান নীরবতায় ছেঁয়ে থাকে। ভালো হয়েছে। সময়টা ভালো কাটবে। এখানে শুধু আমরা দু’জন।”
অরা মুচকি হাসল। নতুন জায়গা বলে একটু অন্য রকম লাগছিল। কিন্তু আরিশের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল একটা কাঠের দরজা – বাম পাশে আধা খোলা। আরিশ হাত দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে দিল। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই অরা খানিক থমকে গেল।

বেডরুমটা মধ্যযুগীয় কোনো কাহিনির মতোই নীরব, ভারী আর রহস্যময়। বড় একটা কাঠের খাট, যার মাথার দিকটা নিপুণ খোদাই করা। বিছানার উপর ঝুলছে সাদা পাতলা মশারির মতো একটা কাপড়, যা হালকা বাতাসে কাঁপছিল ধীর গতিতে। এখানকার বাড়িগুলো অদ্ভুত! ইট, কাঠ আর পাথরের মিশ্রণে তৈরি।
ঘরের একপাশে একজোড়া বড় জানালা, আর তার ঠিক পাশেই এক কাঠের দরজা বারান্দার দিকে। আরিশ দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখল। বারান্দাটা যেন আলাদা একটা জগৎ।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পড়ে অরা। নিচে দেখা যায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া উপত্যকা, দূরে ম্যাপল গাছের ছায়া। বাতাসে হালকা ফুলের গন্ধ, যেন কোথাও কাছাকাছি কোনো ফুলের গাছ আছে, যা এখনো অদৃশ্য।
আরিশ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়, হাত রাখে কাঁধে।

“এটা কি স্বপ্ন ?”
ফিসফিস করেজিজ্ঞেস করলো অরা।
আরিশ বলল,
“যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে কেউ যেন আমাকে না জাগায়।”
“ চলুন ফ্রেশ হয়ে নেবো। খিদে পেয়েছে খুব। “
শেষের কথাগুলো কিছুটা নিচু স্বরে বলল অরা। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
“ তুমি গোসল সেরে আসো। আমি ততক্ষণে দেখি কী খাবার রাখা আছে। বাড়ির মালিকের কথামতো ডাইনিং টেবিলে সবকিছু রেডি থাকার কথা। কিছুক্ষণ আগেই না-কি সবকিছুই রেডি করে রেখে গেছেন রোসালিয়া। “
অরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিছুটা কৌতুহল প্রকাশ করে শুধালো,
“ বাড়ির মালিক কি রোসালিয়া?”
“ নাহ, উনি স্থানীয় একজন ভদ্রমহিলা। এ বাড়ির দেখাশোনা করেন। বাড়িটা মূলত পর্যটকদের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়ির মালিকের নাম লুইগি বেনাভেন্তো। ”

“ওহ আচ্ছা। “
“ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করো।”
আরিশের এমন তাড়াহুড়োর কারণ বুঝে উঠতে পারছিল না অরা। তার মনজুড়ে তখনও পথের ক্লান্তি, নতুন জায়গার অভ্যস্ততা– তবু কিছু জিজ্ঞেস করেও উঠতে পারলো না। চুপচাপ মাথা নেড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
অরা দরজা পেরিয়ে যেতেই আরিশ এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে পাশের ঘরের দিকে এগোল। দরজার হাতলে হাত রেখেই একবার চারপাশে তাকাল। খুলে ফেললো ধীরে ধীরে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে রহস্যময় হাসি।
রাত প্রায় এগারোটা।
পাহাড়ঘেরা নিঃশব্দ উপত্যকার ছোট্ট পাথরের বাড়িটা এখন আলতো আলোয় ঘেরা। কাঠের ফ্রেমে মোটা পর্দা টানানো জানালার বাইরে রাত নামছে ধীরে ধীরে, দূরের কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে একটানা।
অরা আর আরিশ ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। চুল্লির উষ্ণতা আর মোমবাতির নরম আলোয় তাদের মুখে ছায়া পড়ছে।

রোসালিয়া সন্ধ্যায়ই খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেছে। দুটো হালকা টোস্ট করা ব্রুশেত্তা, উপরে টমেটো আর বেসিল। পেকোরিনো পনিরের ছোট ছোট টুকরো, পাশে কিছু জলপাই। হালকা উষ্ণ টাসকান মিনেস্ট্রোন স্যুপ। আর অরার জন্য ছিল এক কাপ গরম লেমন-হানি ইনফিউজড ওয়াটার।
আরিশ এক গ্লাস ওয়াইন নিয়েছে, কিন্তু একবার চুমুক দিয়ে রেখে দিয়েছে টেবিলের পাশে।
“খুব বেশি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
অরা ধীরে বলে, এক চামচ স্যুপ তুলে।
আরিশ হেসে মাথা নাড়ে,
“আমারও না। এত শান্ত পরিবেশ, মনে হচ্ছে খাওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে একটু একটু করে তোমাকে পাগল করে তুলি।
অরা মাথা নিচু করে রইলো। লজ্জা লাগছে তার। আরিশ অরার দিকে তাকিয়েই আছে। অরা জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,

“এই বাড়িটার পরিবেশ অদ্ভুত শান্ত লাগছে…”
আরিশ হালকা হাসে।
“কিছুক্ষণের মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠবে, বেবি।”
অরা ঠিক বুঝতে পারছে না। ভ্রু উঁচিয়ে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। আরিশ ফিক করে হেসে বলল,
“ খাওয়া শেষ করে রুমে চলো। তারপর বুঝবে কেন বাড়ির পরিবেশ অশান্ত হবে। “
শুকনো ঢোক গিলল অরা। মাথা নিচু করে বলল,
“ আপনি খুব খারাপ।”
“ বিশ্বাস করো, আজকে খারাপের সব সীমা পেরিয়ে যাবো আমি।”
অরা কিছু বলল না। খাওয়া শেষ তার। ব্যাপারটা আরিশ খেয়াল করলো। এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে অরাকে কোলে তুলে নিলো সে। চমকাল অরা।

“ কী হলো? “
“ ক্যান্ট ওয়েইট এনি লঙগার, হামিংবার্ড। লেটস গো। “
অরা আরিশের বুকে কপাল ঠেকাল। যা বোঝার বুঝে গেছে সে। তারপর ধীরে ধীরে অরাকে নিয়ে চলে গেল সেই দ্বিতীয় বেডরুমের দিকে –যেখানে অপেক্ষা করছিল এক নতুন রাতের গল্প। অরা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ রুম তো ওইটা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
“ ওয়েট এন্ড সি, বেবি। “
অরার চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়। আরিশ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে সেই দ্বিতীয় বেডরুমের দরজা খুলল। চমকে উঠল অরা।

রুমটা যেন ঠিক বাস্তবের কোনো অংশ নয়–বরং কোনো ছবির ফ্রেম থেকে উঠে আসা এক নিখুঁত মুহূর্ত। চুপচাপ জ্বলছে অসংখ্য ছোট ছোট ক্যান্ডেল, তাদের আলোয় রুমটা নরম, উষ্ণ আর একরকম মায়ায় ভরে আছে। ফ্লোরজুড়ে গোলাপি আর সাদা বেলুন–যেন নিঃশব্দে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিছানার ওপর পরিচ্ছন্ন, সাদা চাদরের বুকে ছড়িয়ে আছে টকটকে লাল গোলাপের পাপড়ি–যেন এক মৌন ভালোবাসার ভাষা। মৃদু আলোয় ওদের ছায়া পড়ে বিছানার চারপাশে, আর বাতাসে গোলাপ আর মোমবাতির হালকা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
আরিশ ধীরে ধীরে অরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
“ এগুলো কখন করলেন?”
আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো অরা। আরিশ অরার হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।
“ ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, পাখি। তোমার পছন্দ হয়েছে? “
“ খুব। “
“ গুড। ভয় পাচ্ছো?”
“ উমম… না তো।”
“ শিওর? “

আরিশের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। অরা কিছুটা ইতস্ততভাবে বলে,
“ জি, না। ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি আপনি কেমন, আপনার স্পর্শ কেমন।”
“ অভ্যস্ত হয়ে গেছো?”
“ তা বলা যায়। “
অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরিশ। কপাল কুঁচকে ফেলল মেয়েটা। আস্তেও তো শুইয়ে দেওয়া যেতো!
“ আমার পাগলামি সহ্য করার জন্য তৈরি হও, হামিংবার্ড। “
অরা কিছু বলল না। চুপ করে রইল, ঠিক যেন নিঃশব্দ এক স্বীকারোক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখে-মুখে ছিল না কোনো লাজ, ছিল না ভয় – শুধু এক অনুচ্চারিত উত্তেজনা, কেমন একটা অচেনা স্রোতের টান। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, বুকের ওঠানামা চোখে পড়ার মতো।
আরিশ এগিয়ে এলো খুব সন্তর্পণে। সে যেন শব্দ ভাঙতে চাইছে না। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে আঙুল তুলল, খুব ধীরে অরার কপালের মাঝখানে ছুঁয়ে দিল এক অপার্থিব প্রশান্তিতে। তারপর সেই আঙুলটা নামিয়ে আনল ধীরে ধীরে – কপাল থেকে নাকের ডগায়, নাকের ডগা থেকে ঠোঁটে।

ঠোঁটের কাঁপা কাঁপা প্রান্ত ছুঁয়ে যখন তার আঙুল গলায় পৌঁছায়, তখন অরার শরীর যেন একটু কেঁপে ওঠে, একেবারে নিজে থেকেই।
কোনো জোর নেই, কোনো তাড়াহুড়ো নেই – শুধু ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠা একটা ভালোবাসার শিখা, যা শুধু শরীরেই নয়, গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ে আত্মায়ও।
আরিশ জানে—এই মেয়েটা তার, শুধুই তার।
তবু আজ যেন নতুন করে তাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। অরা জানে, আরিশ তাকে অনেকবার ছুঁয়েছে। তবু আজকের স্পর্শটা আলাদা।
এতটা ধীরে, এতটা মায়াময়, এতটা ভেতর ছুঁয়ে যাওয়া আগে কখনো আসেনি।
তার গলায় নামা আঙুলটা থেমে নেই, আরও নিচে নামছে। অরার নিঃশ্বাসের ফাঁকে ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে – দমবন্ধ করা কিছুর, না বলা এক গভীর অনুভবের। সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে । নিমিষে হারিয়ে যায় এক দাহময় অথচ আশ্চর্য কোমল অনুভবের ভিতরে।

“ আরিশ!”
“ বলো, হামিংবার্ড। “
“ এমনভাবে আমাকে পাগল করছেন কেন? “
আরিশ ক্রুর হাসল। অরার শরীরের ওপর কিছুটা ঝুঁকে বলে,
“ এতগুলো দিন ধরে নীরবে নিভৃতে আমাকে পাগল করে এসেছ, আজ তোমার পালা। “
অরা আবেশে চোখ বন্ধ করে দিল। আরিশ তার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট জড়িয়ে ধরল। সময় নিয়ে, ভালোবেসে তারা দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করল। আজ আরিশের স্পর্শটা অরার জন্য বিশেষ করে আদুরে লাগছে। সেই আদুরে স্পর্শে সে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শুয়ে থাকার থেকে উঠে বসল আরিশ। অরার চোখে অস্পষ্ট হতাশা আর ব্যাকুলতা; সে যেন আরিশকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দিতে চাইছে না।

আরিশ খুব ধীরেসুস্থে অরার কপালের ওপর এক-একটা গোলাপের পাপড়ি রাখল, যেন তার ভালোবাসার নরম হাতছানি। তারপর নাকের ওপর, আর ঠোঁটের ওপরও, একে একে পাপড়িগুলো ভাসিয়ে দিল। অরার বুকে গর্জন করছিল একটা অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা, আর ও নিঃশ্বাস ফেলল, নিজের জড়াজড়ি ভাব সামলানোর চেষ্টা করে।
আরিশ আবার তার ঠোঁট দিয়ে ধীরে ধীরে সেই পাপড়িগুলো সরাতে লাগল, প্রত্যেকটি স্পর্শে যেন মধুর বিদ্রোহ। অরার হাত-পা ছটফট করতে লাগল, ওর মন চাইল আরিশের কাছে শক্ত করে লেগে থাকতে। কিন্তু আরিশ যেন আজ পুরোপুরি নিজেকে ছাড়ছে না, যেন একটু খেলা করছে ভালোবাসার ভাষায়, আরাঢ়তা আর আকাঙ্ক্ষার মাঝে।
আরিশ যেন ইচ্ছে করে আজ পুরোপুরি ধরা দিচ্ছে না তার কাছে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে অরা মুখ খুলল,
“ আমাকে আপন করে নিন, রাগী ভূত। “
“ অবশেষে নিজে থেকে বললে!”
ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর মতো এক হালকা হাসি ফুটল আরিশের মুখে। এবার আর কোনো কালক্ষেপণ নেই তার। মোমবাতির মৃদু আলোয় প্রেয়সীকে প্রাণভরে একবার তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে অরার সামনে উন্মুক্ত করতে লাগল।

অরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে চাদর টেনে ধরে নিজের সংযম ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আরিশ আর সময় নষ্ট করল না। আগুনের মতো উত্তপ্ত স্পর্শে সে শুরু করল অরাকে পোড়ানো – সেই আগুন, যা বারবার জ্বলে উঠেছিল।
ভালোবাসার স্পর্শে অরার মন ও শরীর একসঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই তীব্রতা সহ্য করতে পারল না সে। আরিশের স্পর্শের তীব্রতা তার জন্য পুরোপুরি সহ্য করার মতো ছিল না।
কিন্তু ক্লান্ত শরীরটা সেই মুহূর্তে আর কোনো বাধা দিতে পারল না; স্বভাবতই তাকে আরিশকে সহ্য করতে হলো।
রাতের শেষ প্রহরে ক্লান্তি আরিশের শরীর জড়িয়ে ধরল, নিমিষেই দু-চোখ জুড়ে ঘুমের নরম ছোঁয়া এসে গেল।
বাংলাদেশ।
মেঘের থলথলো ছায়ায় শহর ভিজে হয়ে আছে। বাতাস ঠান্ডা, ভেজা মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসছে। রাস্তার ছোট ছোট জলকুণ্ডগুলোতে ফুটেছে আকাশের প্রতিচ্ছবি। মানুষের ছাতার ছায়ায় রঙিন ছটা ছড়াচ্ছে, আর নীরব বৃষ্টির স্মৃতি মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

আরিশ ইতালি যাওয়ার আগে অফিসের সব কাজকর্ম কড়াভাবে তালহাকে দেখাশোনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। যদিও তালহা এই অল্প সময়েই কাজে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে, কিন্তু ইদানীং মায়ের জন্য তার মন বড় বিক্ষিপ্ত থাকে। ফলে কাজেও মনোযোগ দিতে পারছে না ঠিকমতো।
অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে তালহা। দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন সোলাইমান মল্লিক। আরিশের অনুপস্থিতিতে এখন তালহাই কোম্পানির সবকিছু সামলাচ্ছে।
“ মে আই কাম ইন স্যার? “
ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকাল তালহা। সোলাইমান মল্লিককে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ – ভেতরে আসুন আঙ্কেল। “
সোলাইমান মল্লিক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন। তালহা নিজে থেকেই আবার বলল,
“ বসুন আঙ্কেল। “
সোলাইমান বসলেন। তালহা উৎসুকভাব তাকিয়ে আছে উনার দিকে।
“ আরিশ স্যার কবে ফিরবেন, বাবা? ছুটি লাগতো কিছু দিনের। “
“ ভাইয়ারা হয়তো আগামী সপ্তাহে ফিরবে। মোটামুটি ছয়দিন পর, এমন। আপনার ইমার্জেন্সি ছুটি লাগলে নিন, সমস্যা নেই। আমি দেখে নেবো।”

এরমধ্যে তালহা কল দিয়ে কফির অর্ডার দিয়েছিল। পিয়ন এসে দু’জনের জন্য কফি দিয়ে গেলো।
“ ইমার্জেন্সি লাগবে না। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাবো, অরা ফিরুক। ওদেরকেও যেতে হবে। “
“ তাহলে ভাইয়া ফিরুক। নিন, কফি খান। “
“ এসবের দরকার ছিল না, বাবা। “
“ সমস্যা নেই, আঙ্কেল নিন। আমি তো ভাইয়া নই, উনি অফিসে অফিশিয়ালি আচরণ করেন। অবশ্য প্রফেশনালি তো এমনি হওয়া উচিত। “
সোলাইমান কফির কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন।

হামিংবার্ড পর্ব ৪৮

“ হ্যাঁ, আরিশ স্যার ঠিকই আছেন। এতো বড়ো কোম্পানি গড়ে তুলতে নিয়মকানুন মেনে চলা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “
“ জি আঙ্কেল। সময় পেলে বাড়িতে আসবেন। ভাবি নেই বলে ইতস্ততবোধ করবেন না। “
“ ঠিক আছে বাবা। দরকার পড়লে যাবো। এখন আমি উঠলাম। “
সোলাইমান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তালহাও উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ ঠিক আছে। “
সোলাইমান ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কটপের দিকে এগিয়ে গেলেন। তালহার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। তাসলিমা খাতুন তামান্নার বিষয়টা কবে মানবে, এই চিন্তাতেই তার মন সব সময় অশান্ত।

হামিংবার্ড পর্ব ৫০