হামিংবার্ড পর্ব ৫৮

হামিংবার্ড পর্ব ৫৮
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

সবাই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আরিশের মন শান্ত হয় না। অরার বলা কথাগুলো তাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিচ্ছে। সত্যি কি সবকিছুর জন্য সে দায়িত্ব?
তিন দিন হয়ে গেছে। অরার চোখে এখনো স্বাভাবিক ঘুম আসেনি। তবে চোখ বন্ধ করলেই একটা দৃশ্য – একটা গড়িয়ে পড়া শরীর, একটা চাপা চিৎকার, আর পেটের ভেতরে এক অদৃশ্য ফাঁক– সবকিছু যেন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খায়।
ওর নিজের শরীরটা এখন আগের মতো নেই।
হালকা হাঁটলে মাথা ঘোরে। বুক ধড়ফড় করে।

কিন্তু এর থেকেও যেটা তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে, সেটা হলো – আরিশের উপস্থিতি। আরিশ এখন পাশের কেবিনে ঘুরঘুর করে। ডাক্তারের মতো মাথা নিচু করে রাউন্ড দেয়, একেকবার চোখে কান্না লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। অরা এসব দেখতে চায় না। চোখে পড়লেই বুকের ভেতরটা গরম হয়ে ওঠে। অভিযোগে নয়, অসহ্য যন্ত্রণায়।
“কেন তুমি এমন? কেন তুমি আমাকে ভালোবেসে এইভাবে ধ্বংস করে ফেললে?”
অরা এসব বলে ফেলে আরিশকে। আরিশ চুপচাপ সব শোনে কেবল। রোজ রাতে অরাকে যখন নার্স এসে ঘুমের ওষুধ দেয়, তখন তার চোখের পাতার কোণে পিলোতে সাদা-ফর্সা ছোট একটা দাগ পড়ে। শুকনো কান্নার চিহ্ন।
আরিশ গতকাল থেকে আর ভেতরে ঢোকেনি।
শুধু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কখনো কড়া নড়ে না। শুধু ভেতরে আলো দেখলেই নড়েচড়ে উঠে।
তালহা বলেছিল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ভাবী একটু ভালো আছেন এখন। আপনি কথা বলে দেখুন।”
আরিশ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
“আমার একটাও কথা যদি ওর কান্না থামাতে না পারে, তাহলে সে কথার মানে কী? আমার উপস্থিতি যদি ওর অস্থিরতার কারণ হয় তবে সেই উপস্থিতির কী দরকার? ”
আরিশের কথায় তালহা আরকিছুই বলতে পারেনি। আরিশের উপস্থিতি সত্যিই অরাকে অস্থির, অসুস্থ করে তোলে এখন। তালহা সব বোঝে। তামান্নার দীর্ঘশ্বাসটুকুও বোঝে। ভাগ্য সহায় থাকলে এতদিনে তাদের বিয়েটা হয়ে যেতো, সবাই কতো আনন্দ করতো! কিছু হয়নি তা….
আজ সকালে নয়না এসেছিল। চুপচাপ বোনের পাশে বসে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর একটা ছোট্ট প্যাকেট অরার হাতে দিয়ে বলেছিল,

“এটা তোমার জন্য আপাই। আর শোনো, যে হারায়, সে ফিরেও আসে কোনো না কোনোভাবে। নিজেকে সামলাতে হবে ।”
অরা প্যাকেট খুলেনি। ভেতরে কী আছে দেখার ইচ্ছে নেই। শুধু তাকিয়ে ছিলো নয়নার দিকে । তারপর জানালা দিয়ে আকাশের দিকে। নির্বাক। বোনের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে আরিশের জন্য তারচে দিগুণ বেশি খারাপ লাগছে নয়নার। এই তিনটে দিন আরিশের কীভাবে কেটেছে সে তো অরা জানে না। প্রত্যেকটা মানুষ দেখছে, পাগলাটে আরিশ কতটা পাগলামি করতে পারে। অরার কেবিনের সামনে বসেই এই ক’দিন রাত কাটিয়েছে সে। আর সারাদিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এই ক’দিনে পানি ছাড়া আরকিছুই কেউ খেতে দেখেনি তাকে। তবে তালহা জোরাজোরি করে গতকাল রাতে ভাত খাইয়েছিল অল্প। হসপিটালের বাইরে খাওয়ার জায়গা আছে। সেখানেই নিয়ে গিয়েছিল।
নিস্তব্ধ রাত। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে।

অরা ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে ফুলের গাছগুলোর ওপর যেন শিশির পড়ে আছে। তবে সেখানে শিশির নেই। সবটাই অরার মনের ভুল। হঠাৎ নিচের দিক থেকে হালকা গলার আওয়াজ আসে। আরিশ!
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, জানালার পাশে । আলোআঁধারিতে ঠায়। কেবিনের দিকে তাকিয়ে, ডাকছেও না। শুধু… দাঁড়িয়ে আছে।
অরা চোখ নামিয়ে তাকায়। কিছু বলে না। কিছু ভাবেও না। আরিশ করুন স্বরে বাইরে থেকে বলে,
“ পাখি! আমাকে একবার তোমাকে সামনে বসে দেখতে দেবে? একটু আসবো ভেতরে? “
অরা জানালার পাশে একভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। আরিশের কথায় তার মন গলে না। শরীরের প্রতিটি যন্ত্রণা তাকে তার অংশ হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
“ অরা….. এভাবে শাস্তি দিও না। কলিজা পুড়ে যায় রে জান। আমি আর কখনো রাগারাগি করবোনা, বিশ্বাস করো…. বিশ্বাস করো…. আমি আর কখনো ওভার রিয়াক্ট করবোনা। আমিও তো সন্তান হারিয়েছি! আমি কি পাষাণ? আমার কি কষ্ট হয় না? “

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অরা। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার। আরিশকে দরকার তার, এই মুহুর্তে দরকার। ওই লোকটার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে হবে তার। কিন্তু! মানুষটা কি আদৌও বদলাতে পারবে? অরার মন মানে না। বারবার মনে হয় সেদিন আরিশ যদি একটু শান্ত হতো তবে আজ ছোট্ট প্রাণটা অরার শরীরের ভেতর থাকতো। হাউমাউ করে কাঁদে সে। আরিশ আর নিজেকে সামলাতে পারে না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। অরা কাঁপা কাঁপা শরীরে তখন জানালার গ্রিল ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরিশ এসে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। ছোট্ট পাখিটার কপালে, চুলে, মাথার তালুতে এলোপাতাড়ি চুমু খেতে থাকে আরিশ। অরাও তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

“তুমি পাগল ছিলে… এখনও আছো।
কিন্তু আমি সেই পাগলকে ভালোবেসেছিলাম, আর আজ… আমি সেই পাগলের জন্যই সন্তান হারালাম।”
“ ও আমারও সন্তান ছিলো। আমিও হারিয়েছি…. তবুও আমি অপরাধী। শাস্তি দাও, মাথা পেতে নেবো। কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দিস না রে পাখি। আমি তোকে ছাড়া অচল…. আমি… আমি তোমাকে ছাড়া অসহায় অরা। প্লিজ!”
অরা আরিশের বুকে মুখ গুঁজে রইলো। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বলল সে,
“ শুধু তোমার রাগটা কমাও! এই রাগ-ই আমার জীবনের কাল। “
“ আমি আর রাগারাগি করবোনা। “

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশ রাগ করবে না – কথাটা ঠিক বিশ্বাস হয়নি অরার। কিন্তু কী করবে সে? আরিশের এমন আকুতি ফেরাতে পারেনি সে। তবে মনে মনে অরা আরিশকে ক্ষমা করতে পারেনি এখনও। শুধুমাত্র পাগলের মতো উদভ্রান্ত মুখাবয়বটা দেখে মায়া হচ্ছিল বলেই কাছে টেনে নিয়েছে অরা।
রাত পোহাল। ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছুঁয়ে গেল খানবাড়ির ছাদ, দেয়াল, উঠোন।
পাঁচদিন হলো এই বাড়িতে ভালোভাবে রান্না হয়নি। কেউ কিছু খেতেও চায়নি। সকালের বাতাসে আজ একটু গন্ধ- মসলার, চাল-ডালের, রান্না হতে থাকা সুজির ঘ্রাণ। আজ রান্না হচ্ছে। সকাল সকাল। আরিশ ফোন করে জানিয়েছে–অরা একটু সুস্থ আছে। তাই ওর জন্য হালকা করে কিছু রান্না করে পাঠাতে বলেছেন। সেই খবর শোনার পর থেকেই তামান্না রান্নাঘরে নেমে পড়েছে। সঙ্গে সাবিহা আপু। তাসলিমা খালাম্মাও পাশ থেকে সাহায্য করছেন।
তালহা ভোরেই হসপিটাল চলে গেছে।

আরিশ গতকাল রাতেও বাড়ি ফেরেনি-হাসপাতালের কেবিনেই ছিলো, অরার পাশে।
রান্না যতটা হচ্ছে অরার শরীরের জন্য, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে একেকজনের মনের শান্তির জন্য। এই যেন খানিক আশ্বাস – ঘরের মেয়েটা বেঁচে আছে, ধীরে হলেও সুস্থ হচ্ছে। সবাই চুপচাপ, তবু যার যার কাজে ব্যস্ত। যেন এক নীরব প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে আছে পুরো বাড়ি। শুধু একটা কথাই ঘুরে ফিরছে সবার মনে––
“আল্লাহ, অরা যেন ঠিক হয়ে ওঠে… আবার আগের মতো হেসে ওঠে…”
রান্নাবান্না শেষ হলে সাবিহা ও তামান্না একসাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সবাই অরার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছে শুধু।

সকাল আটটা। তালহা আগে থেকেই হাসপাতালে, আরিশ আর অরার পাশে। রান্না শেষ হতে না হতেই সাবিহা আর তামান্না বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। তামান্নার হাতে রাখা ব্যাগে কিছু রান্না করা খাবার, দুধ, কয়েকটা ফল। এতকিছু যদিও অরা খায় না তবুও!
গাড়তিে বসে দু’জনেই চুপচাপ। তামান্না নিচু গলায় বলল,
“ভাবি এখন কেমন আছে জানো সাবিহা আপু?”

হামিংবার্ড পর্ব ৫৭

“ভেতরটা অনেক ভাঙা হয়ে গেছে হয়তো। শরীর তো ধীরে সুস্থ হবে… কিন্তু মন?”
সাবিহার চোখে একরাশ বিষণ্নতা।
হাসপাতালে পৌঁছেই কেবিনের দিকে হেঁটে গেল তারা। করিডোরটা আজ একটু শান্ত, তবে সেই চেনা চাপা ভার এখনও টিকে আছে বাতাসে।

হামিংবার্ড পর্ব ৫৯