হামিংবার্ড শেষ পর্ব
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই খান ভিলায় যেন আলোয় ভেসে উঠল চারদিক। প্যান্ডেলজুড়ে ঝলমলে চন্দনের রঙের কাপড়, ঝুলন্ত মোগলাই ঝাড়বাতি আর ফুলের নকশায় সাজানো সেন্টারপিস। সবার মুখে হাসি, কানে কানে গুঞ্জন।
তামান্না পরেছে গাঢ় লাল জমকালো শাড়ি, মাথায় নেটের ওড়না, গলায় ভারী সোনার হার। পাশে তালহা কালো শেরওয়ানি পরে একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে। তাদের কাবিনের সময় সবাই নিঃশব্দ। তালহা স্পষ্ট কণ্ঠে কবুল বলতেই তামান্নার মুখে রঙ ছড়ানো এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। তার চোখেমুখে একটু কেঁপে ওঠা, একটু লজ্জা, আর অনেক আনন্দ।
দ্বিতীয় কাবিন হয় মেহরাব আর সাবিহার। সাবিহা পরেছে সোনালি বেনারসি, খোঁপায় গাঁথা টিউলিপ আর কাচফুল। মেহরাব সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর ওড়না গলায় জড়িয়ে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে সাবিহার দিকে। কাবিনের পর, একটু চুপচাপ হয়ে বসেছিল মেহরাব। তার পাশে সাবিহা বসা। মেহরাব তার কানে কানে বলল,
“আজ থেকে তুমিই আমার সব।”
সাবিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো। মেহরাব নিশ্বব্দে সাবিহার হাত ধরে রইলো।
এই রাত্রি, এই আলো সব মিলিয়ে খান ভিলার উঠোন যেন সাক্ষী হয়ে রইল দুই জোড়া ভালোবাসার এক নতুন শুরুতে।
আরিশ অরার হাত ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সকলেই খুশি। খান বাড়িটা আজ আনন্দে আনন্দে ভরে উঠেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। সময়ের নিয়মে খান ভিলার সেই ব্যস্ততা এখন অনেকটা স্তিমিত, কিন্তু দেয়ালগুলো এখনো সাক্ষ্য দেয় সেই বর্ণিল দিনগুলোর। উঠোনের একপাশে ছোট্ট খেলার জোন, যেখানে একরত্তি সিয়াম দৌড়াচ্ছে হাসতে হাসতে,তামান্না আর তালহার ছেলে। তার হাসি যেন পুরো বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখে।
তামান্না এখন পুরোপুরি মায়ের ভূমিকায়। চোখেমুখে যেন মাতৃত্বের প্রশান্ত দীপ্তি। সে মাঝে মাঝে বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করলেও তার পুরো সময়টাই সিয়ামকে ঘিরে।
অন্যদিকে, অরা এখন ঘরের শান্ত কোণেই গড়ে তুলেছে নিজের অফিস কর্নার। কোম্পানির প্রজেক্ট মেইল, কনফারেন্স, রিপোর্ট—সবই বাসায় বসে সেরে নেয় সে। প্রতিদিন সকালে কফির মগ হাতে খোলা জানালার পাশে বসে কাজ শুরু করে অরা। আরিশ অরাকে একেবারে বিজনেস হিউম্যান করে তুলেছে। তবে সবকিছুই বাড়িতে বসে। খুব দরকার ছাড়া অরাকে নিয়ে বাইরে বের হয় না সে। কারণ একটাই! আরিশের জেলাসি…
অবশ্য অরা এখন আরিশের সবকিছু নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। তার রাগ, জেদ, বিষাক্ত ভালোবাসা, দখলদারিত্ব সবকিছুই এখন অরার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রাত দশটা বাজে। অরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো গায়ে পড়ছে। তার হাতে ধরা এক জোড়া ছোট বেবি বুটিজ, যেগুলো সে কয়েক মাস আগে না ভেবেই কিনে ফেলেছিল, শুধু হঠাৎ আশা জাগায়। আরিশ পেছন থেকে এসে অরাকে জড়িয়ে ধরে।
“আবার এই বুটিজটা বের করেছো?”
অরা কিছু বলে না। শুধু মাথা নাড়ে।
আরিশ একটু চুপ থেকে বলল,
“ এবার অন্তত আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসুক, হামিংবার্ড।”
অরা চোখ বন্ধ করে। বুকের মধ্যে কী যেন একটা ভেঙে পড়ে। তারপর আস্তে করে বলে,
“আমি ভয় পাই, আরিশ। আবার যদি… আবার যদি হারিয়ে ফেলি তাকে?”
আরিশ এবার অরার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে।
“তুমি জানো, আমি তখন কীভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু তুমি? তুমি তো আরও বেশি কষ্ট পেয়েছিলে। আমার থেকে হাজারগুণ বেশি যন্ত্রণা সহ্য করেছিলে। কিন্তু অরা ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো। তাই বলে কি আমরা নিঃসন্তান থাকবো?”
অরা এবার চোখ মুছে বলল,
“আমি জানি, আপনিও চান। আমিও চাই… কিন্তু আমার সাহস হয় না।”
আরিশ অরার কপালে চুমু দেয়।
“আমি তো তোমাকেই চাই, অরা। বেবি আসবে, যখন সে আসার কথা। শুধু এটুকু মনে রেখো।তোমার পাশে আমি আছি, ছিলাম, থাকবো। আবার না-হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখি? আমি আর তুমি একসাথে?”
অরা একটু হাসল। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আরিশ তা মুছে দিলো।
“ ঠিক আছে। এবার সময় এসেছে ছোট্ট আরিশকে নিয়ে আসার।”
” আরিশ না, আমার ছোট্ট অরাকে চাই। ঠিক তোমার মতো একটা ছোট্ট পাখি”
অরা খিলখিল করে হাসে। আরিশ জবাব দেয় না। সে শুধু অরাকে বুকে চেপে ধরে রাখে।
একটা রাত, দুটো মানুষ, একটা আশা…
সন্ধ্যাবেলা। ড্রইংরুমে বসে আছে তালহা, আরিশ। সিয়াম এককোণায় বসে খেলছে। তামান্না ও অরা রান্নাঘরে, চা – নাস্তা তৈরি করছে। তাসলিমা খাতুন নিজের ঘরে আছেন। বয়স হয়েছে উনার। ইদানীং বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না। সাবিহা মেহরাবের সাথে চুটিয়ে সংসার করছে।
“ বড়ো আব্বু….. “
সিয়াম এসে আরিশের সামনে দাঁড়াল। আরিশ মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“ ইয়েস, পাপ্পা। “
“ আমার একটা কালো জামা লাগবে, তোমার মতো। “
তালহা সিয়ামের কথায় হাসলো। আরিশ জিজ্ঞেস করলো,
“ আমার মতো?”
“ হু, তোমার মতো। তুমি চব সময় কেমন কালো জামা পরে থাকো, কুব সুন্দর লাগে । “
রান্নাঘর থেকে অরা ও তামান্না হাতে চা ও স্নাকস নিয়ে ড্রইংরুমে উপস্থিত হতেই সিয়ামের মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো শুনতে পেলো। সবাই ওর কথায় হাসছে।
“ যাক… তুমি অন্তত বুঝলে, কালো পোশাকে আমাকে সুন্দর লাগে। আমি তোমাকে বিকেলে একটা সুন্দর ব্লাক শার্ট এনে দেবো, ওকে?”
সিয়াম আরিশের কপালে চুমু খেলো।
“ ওকে বড়ো আব্বু। “
সিয়াম আরিশের কোল থেকে নেমে আবারও খেলতে চলে গেলো। অরা, তামান্না বসলো। সবাই মিলে চা খেতে খেতে কথা বলতে লাগলো।
[হামিংবার্ড বইয়ের প্রি-অর্ডার চলছে। মাত্র তিনশো বিশ টাকায় বইটি অর্ডার করতে পারবেন যেকোনো বুকশপে। ]
বিকেলের নরম আলো এসে পড়েছে খান ভিলার ছাদের এক কোণে। সেখানে একা বসে আছে নয়না। হাতে একটা ছোট্ট স্কেচবুক, পাশে পেনসিল ছড়িয়ে রাখা। কিন্তু সে কিছু আঁকছে না। শুধু বসে আছে, চোখ রাখছে দূরের রোদে ভেজা গাছে, কোথাও একটুকরো একাকিত্ব জমে উঠছে তার চোখে।
গতকাল খান বাড়িতে এসেছিল নয়না। নয়না এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। খুব বেশি ব্যস্ততা নেই, কিন্তু মনটা আগের মতো চঞ্চলও না। আনমনে স্কেচবুকে কিছু একটা লিখে ফেলল নয়না।
“কখনো কখনো কারো কাছে কিছুই না হয়েও তার অনুপস্থিতি যেন অসম্পূর্ণ করে তোলে একটা গোটা দিন।”
পেছন থেকে ছোট্ট সিয়াম ছুটে এলো ছাদের সিঁড়ি বেয়ে।
“নয়ন খালামনি! সিয়াম খালা খাল খেলবে!”
নয়নার মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। সিয়ামকে কোলে তুলে নিলো সে, হালকা বলল,
“সিয়াম খালা খাল না, সিয়াম হচ্ছে রাজা। খালামনি হলো রাজ্যের একজন সৈনিক।”
“তা হলে তুমি আমার ঘোড়া। হিনহিন করে হাঁটো!”
নয়না এবার হেসে ফেলল। একটুখানি সারল্য ফিরল তার চোখে। সিয়ামকে পিঠে তুলে দৌড় দিতে দিতে ভাবল,হয়তো জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে আসে না, কিন্তু কিছু উত্তর পাওয়া যায় শিশুদের হাসির ভেতরেও।
পেছনে পড়ে রইল সেই ফাঁকা ছাদে এক পৃষ্ঠা খোলা স্কেচবুক। পাতাটায় লেখা:
“আমি ভালো আছি – এই বলে বাঁচা আর সত্যিই ভালো থাকা এক না।”
তামান্না ছাদে এসেছে জামাকাপড় তুলতে, সিয়ামও সাথে এসেছিল তাই। নয়নার সাথে সিয়ামকে খেলতে দেখে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে তামান্না।
অরা টেবিলে বসে ল্যাপটপে কোম্পানির একটা রিপোর্ট টাইপ করছে। চুল খোলা, চোখে হালকা চশমা, পরনে সফট মেরুন কামিজ। পাশের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ আর বাচ্চাদের কিছু ছবি ছড়ানো।
আরিশ একটু আগে বাইরে থেকে ফিরেছে। এখন সে দাঁড়িয়ে আছে অরার ঠিক পেছনে। অরার কাঁধে হাত রাখতেই সে থেমে যায়, তাকায় পেছনে।
“আপনি এসেছেন? কখন ফিরলেন?”
“এই তো। মিনিট দশ হবে। তুমি কিছু খেয়েছো?”
অরা হালকা মাথা নাড়ে।
আরিশ চুপচাপ তার চুল সরিয়ে গালে আলতো চুমু দেয়।
“তুমি আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছো জানো?”
অরা হেসে বলে, “আপনিও আগের মতোই আধপাগল, টক্সিক একটা মানুষ হয়ে রয়ে গেছো।”
আরিশ এবার চেয়ারে বসে অরার মুখোমুখি হয়ে বলে,
“ সে আমি যেমন আছি বেশ আছি। আজ কোনো কাজ নয়। এখন আমি তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। সবকিছু সাইডে রাখো ডার্লিং। ”
“ আরিশ প্লিজ! অনেক কাজ…..”
অরা কথা শেষ করার আগেই আরিশ তার ঠোঁট দখল করে নিলো। এক মুহূর্তে সব রিপোর্ট, মেইল, সময়ের হিসাব ভুলে গিয়ে অরা আবার ভেসে গেল ভালোবাসার অথৈজলে। যেখানে কেবল ছিল তারা দু’জন, একটা চুম্বনে গলে যাওয়া যত ভুল বোঝাবুঝি,আর একটা প্রেম– যেটা কোনোদিনও শেষ হয়নি, হবেও না।
শেষকথা
সব গল্প শেষ হয়, কিন্তু কিছু সম্পর্ক কোনোদিনও শেষ হয় না। অরা আর আরিশের সম্পর্ক ছিল সেইরকমই রাগে-ভালোবাসায় বাঁধা, ক্ষতে-ঘায়ে গড়া, অথচ ভীষণ নিজের। তাদের ভেতরে যত হিংস্রতা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল আকুলতা। তারা একে অপরকে জিতেছে, আবার হারিয়েছে। শেষমেশ, ভালোবাসা জিতেছে শব্দহীন এক স্বীকারোক্তিতে, নিঃশ্বাস গায়ে লাগার মুহূর্তে। কারণ ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, সেটার শেষ হয় না, ওটা শুধু রূপ বদলায়।
হামিংবার্ড পর্ব ৭১
আর নয়না? সে ভালোবাসা পায়নি, ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পায়নি, তবু সে ভালোবেসে যাচ্ছে।
কারণ ভালোবাসা না পেলেও, কখনো কখনো ভালোবেসে যাওয়াটাই একমাত্র পূর্ণতা।