হৃদপূর্ণিমা পর্ব ১৬

হৃদপূর্ণিমা পর্ব ১৬
লাবিবা ওয়াহিদ

রথি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাশিদ তার পাশেই বসা। নয়ন ড্রাইভ করছে। রথির কনুইয়ের কাছে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ। সে একমনে গত দিনগুলোর কথা ভাবছে। ওরা এখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। রথি নাশিদকে সামনে পেয়েও কোনরকম রিয়েকশন করেনি৷ নাশিদও ওকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। কারণ, রথির ফ্যাকাসে মুখটা দেখলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ চাপের মধ্যে গেছে। ডাক্তার তাকে বারণ করেছে কোনো ব্যাপারে চাপ দিতে। তাই নাশিদ এখনো গতদিনের প্রশ্নগুলো করতে পারেনি। রথির রিফ্রেশ হওয়া দরকার, আপাতত নাশিদ সেই ব্যবস্থাই করবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা গুলশানে পৌঁছে গেলো। ভোর হওয়ায় রাস্তায় জ্যাম তেমন একটা নেই। নাশিদ ফিসফিস করে বলে,

-‘চা খাবে?’
রথি বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। তার এই দৃষ্টি নির্বিকার। রথি অস্ফুট সুরে বললো,
-‘খেতে ইচ্ছে করছে না!’
-‘খেতে হবে। নয়ন, ওই টঙের পাশের গাড়ি থামাও আর দুই কাপ চা নিয়ে এসো। তুমি খেলে তুমিও নিও।’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে টঙের সামনে গাড়ি থামিয়ে চলে গেলো। নয়ন চলে যেতেই নাশিদ বললো,
-‘খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে সেন্সিটিভ হও! আমি জানি তুমি গতকাল সারাদিন কিচ্ছু খাওনি! এরকম হলে চলে বলো তো? খেতে হবে, নয়তো তোমায় এখানে ফেলেই চলে যাবো!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাশিদের কথা শেষ হতেই রথি নাশিদের হাত খামচে ধরলো। অতঃপর নাশিদের কাঁধে আচমকাই মাথা রাখলো। এতে নাশিদ মুহূর্তেই জমে গেলো। কী বলবে না বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রথি তার কাছাকাছি থাকলে এমন অনুভূতি হয় কেন? এই অনুভূতির নাম তার যে অজানা। তবে সব এলোমেলো লাগে। হঠাৎ নাশিদ তার কাঁধের শার্টে ভেঁজা কিছু অনুভব করলো। নাশিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো রথি কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদলেও মাঝেমধ্যে ফোঁপানোর শব্দও হচ্ছে। নাশিদ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। রথি ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘দয়া করে আমায় ছেড়ে যাবেন না। অনেক কষ্টে আমি আপনাকে পেয়েছি, আপনি ছাড়া আমি মস্তিষ্কশূন্য হয়ে যাই। এই বিরাট পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে এক আপনি আমার ভরসার স্থান, আমার সবচেয়ে আপনজন। এতোটা নিষ্ঠুর আপনি হতে পারেন না পুলিশম্যান!’

কথার মাঝে মাঝে রথি হেঁচকি দিয়ে উঠছিলো। আর নাশিদ? তার অবস্থা নাই-বা বর্ণনা করলাম। তার চোখের কোণও সমানতালে ভিঁজে গেছে। তার ভেতরটায় কেউ যেন ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। সে মনে করতে লাগলো গতদিনটার কথা। কীভাবে তোপ্রে তোপ্রে রথিকে পাগলের মতো খুঁজেছে। রথিকে হারানোর ভয়ে অনেকটা অস্থির হয়ে গেছিলো সে। এই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললে সে কী করে বাঁচবে? প্রিয়জনকে হারানোর ভয়টা বুঝি এতোই তীব্র? নাশিদ এবার তার অন্য হাত দিয়ে রথিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এই মেয়েটাকে ছাড়া সে পারবে না থাকতে। কিছুতেই পারবে না। এই মেয়েটা তার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে মিশে গেছে। সব ভালোবাসা কী ছুঁয়ে অনুভব করা যায়? কিছু ভালোবাসা তো দূরত্বেই আসল চাওয়া-পাওয়া বুঝিয়ে দেয়, বুঝিয়ে ভালোবাসার মর্ম, পবিত্রতা!
নাশিদ রথির কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-‘শিসসস! আর কেঁদো না। আমি তো তোমারই কাছে, রথ! এভাবে কেঁদে নিজেকে ভাসালে হয়? আমি এসেছি তো।’
রথি নাশিদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে হেঁচকি তুলে চোখ-মুখ লাল করে বলতে লাগে,
-‘আ..আবির যদি সময়মতো ন..না হেল্প করতো সত্যি সত্যিই আমি অন্যকারো..!!’
বলেই রথি আবার কেঁদে উঠলো। নাশিদের ভেতরটাও ধক করে উঠলো। সত্যিই তো কী হতো? নাশিদ রথির চোখ মুছে মৃদু সুরে বললো,
-‘ওসব ভুলে যাও রথ। সকলের জীবনে কোনো না কোনো কালো দিন আসেই। মনে রেখো দুঃখের পরেই সুখ। অতীত মনে রেখো না। কাল যেটা ঘটে গেছে সেটা তোমার অতীত আর এখন তোমার বর্তমান। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎটাকে উপলব্ধি করো। আল্লাহ আছেন, কোনো বিপদ হবে না আর। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ রথ!’
রথি নাক টেনে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়েই মাথা নাড়ায়। নাশিদ মুচকি হাসলো। নয়ন এসে দুই কাপ চা দিলো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,

-‘দুই কাপ চা আনতে এতো সময় লাগে?’
নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আসলে হয়েছে কী স্যার আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি! তাই আপনাদের টা আনতে দেরী করে ফেলেছি!’
নাশিদ কটমট দৃষ্টিতে নয়নে পানে তাকালো। রথি নিঃশব্দে হাসলো। সেই হাসিটা নাশিদ না দেখেও উপলব্ধি করলো। অতঃপর নাশিদ চা দুটো নিয়ে নয়নের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরেকটা পানির বোতল আনো, সেটা দিয়ে ১০ মিনিট দূরে রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থাকবা!’
নয়ন দাঁত কেলানো বন্ধ করে বলে, ‘কেন স্যার?’
-‘চা দেরী করে আনার শাস্তি!’
নয়ন মুখ গোমড়া করে পানির বোতল আনতে চলে গেলো। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও এলো। নাশিদ আর রথি ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। পানির বোতল দিয়ে নয়ন চলে গেলো ছায়া থেকে রোদে। নাশিদ রথির দিকে বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চোখে-মুখে পানি দাও। ইচ্ছে হলে মাথায়ও হালকা পানি দাও, অস্থিরতা কমবে!’

রথি মাথা নাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে চোখ-মুখ ধুঁয়ে নিলো। মাথার মাঝেও হালকা পানি দিলো। অতঃপর কয়েক ঢক পানি খেয়ে নাশিদকে দিলো। নাশিদও দুই ঢক খেয়ে বোতল ফেলে দিলো কারণ, পানি শেষ। রথি ওড়না দিয়ে মুখ আর মাথা মুছে নাশিদের থেকে চা টা নিলো। আস্তে ধীরে চায়ে চুমুক দিলো আর নাশিদের সাথে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। এই পাশটা খানিক নির্জন। কিছুক্ষণ বাদে বাদে দু-একটা রিকশা যাচ্ছে। চা খেতে খেতে রথি নাশিদকে বললো,
-‘ভাইয়াটাকে ওদিকে পাঠালেন কেন? বেচারা তো ঘেমে একাকার! এমনেই কতো গরম!’
-‘মাঝেমধ্যে বাঁকাকে সোজা করতে এসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়!’
-‘আমি বাঁকা হলে?’
নাশিদ মুচকি হেসে ওয়াইনটাইম কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে মৃদু সুরে বললো,

-‘আমার স্টাইলে আবার সোজা করে দিবো!’
নাশিদের রুদ্ধ দৃষ্টি রথি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেলে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে তার মধ্যে, ভীষণ অদ্ভুত! অবশেষে রথির জন্যই নাশিদ নয়নকে ডাকলো। নয়ন রুমালে কপাল মুছতে মুছতে আসলো।
-‘রথের জন্য আজ শাস্তি কম দিলাম।’
নয়ন চোখ-মুখ চকচক করে বললো, ‘ম্যাম বলেছে?’
নাশিদ মাথা নাড়ায়। নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আপনি আসলেই অনেক ভালো, ম্যাম!’
-‘হুম হয়েছে। জলদি বাসায় চলো তোমার ম্যাম এখনো না খেয়ে আছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রথি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,
-‘আমরা এখন কোথায় যাবো?’
-‘আমার বাসায়। দুইদিন নাফিসার সাথেই থাকবে তুমি!’
-‘কিন্তু মা….’
রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাশিদ বললো,

-‘কোনো কথা না, চলো। তোমার মাইন্ড রিফ্রেশ হওয়া আমার জন্য বেশি জরুরি!’
রথি নিচের দৃষ্টি নত করে মৃদু হাসলো। এই জোর খাটানোগুলো তার ভেতর প্রতিনিয়ত ভালোবাসার খোদাই করে যাচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যেই নাশিদদের বড় গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করলো। রথির এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার আসা। তবে বাড়িতে ঢুকবে প্রথম। পথের দু’ধারের সৌন্দর্যে রথি বরাবরের মতোই মুগ্ধ। দরজা খোলার শব্দেই রথির ধ্যান ভাঙলো। নাশিদ দরজা খুলে রথির সামনে দাঁড়িয়েই বললো,
-‘কী ম্যাডাম? সারাদিন কী গাড়িতে বসে থাকার ইচ্ছা আছে? খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না?’
-‘আপনি এতো খাওয়া খাওয়া করেন কেন?’
-‘নামো!’
রথি ভেংচি কেটে নামলো। রথির এমন ভেংচি কাটা দেখে নাশিদ নিঃশব্দে হাসলো। এখন সকাল আটটা বাজে। নাশিদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে রথি পুরো অবাক। এ যে পুরোই সৌখিন। শো-পিজ থেকে শুরু করে ফার্নিচার সব! রথির মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো। রথির ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটিয়ে নাশিদ বললো,

-‘চলো নাফিসার ঘরে। ওখান থেকে ফ্রেশ হয়ে ভালো ড্রেস পরে নিবা!’
বলেই রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রথির হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। তখনই হাই তুলতে তুলতে মনিকা নিজের ঘর থেকে বের হলো। সদর দরজার দিকে নয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনিকা বললো,
-‘কী নয়ন? সকাল সকাল স্যারকে নিতে এসেছো বুঝি?’
নয়ন কী বলবে বুঝলো না। বেকুবের মতো হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। মনিকা আর কিছু না বলে কিচেনের দিকে চলে গেলো। নয়ন হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নাশিদ বলুক আর না বলুক এই মহিলাকে তার শ্রীময়ী ভয়ংকরী লাগে। ভাগ্যিক স্যারকে ম্যামের সাথে দেখেনি৷ নয়তো নয়নের সিক্সথ সেন্স বলছে কোনো না কোনো ঝামেলা হতোই!

হৃদপূর্ণিমা পর্ব ১৫

নাশিদ রথিকে নিয়ে নাফিসার ঘরে এসে দেখলো নাফিসা ঘুমে কাত। নাশিদ ধমকিয়ে নাফিসাকে ঘুম থেকে উঠালো। নাশিদকে আর রথিকে দেখে নাফিসার ঘুম হারিয়ে গেলো। সে চোখ বড় বড় করে রইলো। নাশিদ রথিকে নাফিসার কাছে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো। নাফিসা রথিকে একটা জামা দিতেই রথি জামাটা নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। রথির সাথে কোনো জামা-কাপড় নেই আবার এই ড্রেসে তার নিজেরও আনকনফরটেবল লাগছে। তাই উপায় না পেয়ে নাফিসার ড্রেসই পরছে। শাওয়ার নিয়ে নিজের ড্রেস ধুঁয়ে বেরিয়ে আসলো। নাফিসা তখন ঘরে ছিলো না। রথি বেলকনিতে গিয়ে জামা-গুলো মেলে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে এমনেই রোদের উত্তাপ বাড়বে, কাপড় তখন আরামসেই শুকিয়ে যাবে।
রথি বিছানায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করলো। মায়ের কথা বড্ড মনে পরছে। আর নাশিদই বা কোথায় চলে গেলো? নাশিদের কথা ভাবতে ভাবতেই নাশিদ ইউনিফর্ম পরে হাজির!

-‘আমি নয়নকে নিয়ে থানায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং এ খাবার দিবে একসাথে খেয়ে নিও। আমি নাফিসাকে বলে যাচ্ছি, আর হ্যাঁ সবসময় নাফিসার সাথে থাকবে!’
-‘কখন ফিরবেন?’
-‘তা তো বলতে পারি না৷ তবে শীঘ্রই!’
বলেই নাশিদ চোখ টিপ দিয়ে চলে গেলো। রথির কেমন যেন লজ্জা, লজ্জা লাগছে। ওদের বিয়ে হলে বুঝি এভাবেই রথি জিজ্ঞেস করবে, নাশিদ কখন ফিরবে? নাহ রথির আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। রথি বেলকনি গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ ওইতো নাশিদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রথি খানিক অপেক্ষা করতেই দেখলো নাশিদ বেরিয়ে গাড়িতে উঠছে। মুহূর্তেই গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

হৃদপূর্ণিমা পর্ব ১৭+১৮