হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩৯
সানা শেখ
আলভী ফ্রেস হয়ে রাতের খাবার খেল মাত্র।
ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ায়। আলভী কে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, ওর বিশ্রামের দরকার। আলতাফ মাহমুদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“এখন আর এখানে বসার দরকার নেই। অনেক রাত হয়ে গেছে, মায়া কে নিয়ে রুমে যাও দুজনেই বিশ্রাম নাও।”
আলভী কিছু না বলে মায়া কে নিয়ে রুমে ফিরে আসে।
ওর এখন ঘুম পাচ্ছে , লং জার্নিতে ক্লান্ত লাগছে।
বাড়িতে এসেছে দশটায় এখন বাজে রাত দেড় টা।
এখন অক্টোবর মাসের শেষ প্রায়। মাঝরাতের পর শীত শীত লাগে।
এসি অন করে টেম্পারেচার বাড়িয়ে দেয় তারপর
ডিম লাইট অন করে বড় লাইট অফ করে দেয় আলভী।
মায়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ওকে নিয়ে বেডে উঠে শুয়ে পড়ে।
আলভী কে আঁকড়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দেয় মায়া। আলভীও আগলে নেয় মায়া কে।
আলভীর বুকে মুখ গুঁজে রেখে মায়া বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“গত কাল যখন হসপিটালে গিয়েছিলাম চেকআপ করাতে তখন তোমাকে অনেক বেশি মনে পড়ছিল। হসপিটালে যত জন প্রেগন্যান্ট মেয়ে ছিল সকলের সাথেই তাদের হাজব্যান্ড ছিল কিন্তু আমার সাথে তুমি ছিলে না।”
আলভী আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়া কে। মায়ার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
“সরি বউ আমি তো জানতাম না আমার মায়া পরী টা মা হবে আমি বাবা হব। যদি জানতাম তাহলে সব কিছু ফেলে তোমার পাশে চলে আসতাম, তোমাকে একা ছাড়তাম না।”
“যেদিন জানতে পারলাম আমি মা হব সেদিন যে আমার কত আনন্দ হচ্ছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। ইচ্ছে করছিল তখনই কল করে তোমাকে বলতে তুমি বাবা হবে। কিন্তু আবার সারপ্রাইজ দেব ভেবে নিজেকে দমিয়ে নিয়েছিলাম। আব্বু তোমাকে কল করে বলতে চাচ্ছিল আমিই নিষেধ করেছিলাম, সবাই কে বলেছিলাম তুমি আসার পর তোমাকে জানাতে।”
“আমি কল্পনাও করিনি বাড়িতে এসে এত বড় সারপ্রাইজ পেয়ে যাব। সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই বিশাল বড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেছি।”
“ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“তাও ভালো যে আমার অবস্থা দেখে তোমার কিছু হয়নি।”
জুমার নামাজ আদায় করে বাড়ি ফিরে আসে পাঁচ বাপ ব্যাটা। পাঁচ জনের পরণেই সাদা পাঞ্জাবি পাজামা।
আলভী সোফায় না বসে সোজা রুমে চলে আসে।
মায়া মাত্রই নামাজ আদায় করে বেডে বসেছে।
মা হবে জানার পর থেকে এক ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেয়নি মায়া।
আলভী এসে মায়ার পাশে বসে।
মায়া আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“পাঞ্জাবি পাজামা চেঞ্জ করে খাবার খেতে চলো।”
“হুম খাব তো, আগে তোমাকে মন ভরে দেখে নেই।”
মায়া হেঁসে বলে,
“আর কত দেখবে? ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে তো দেখছই।”
“তাও তো মন ভরছে না।”
“খিদে পেয়েছে নিচে চলো।”
আলভী বসা থেকে উঠে পাঞ্জাবি পাজামা চেঞ্জ করে নেয়। তারপর মায়া কে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়। রুম থেকে বের হতেই দেখে মানতাসা আর মাহিরও নিচে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আলভী কে দেখেই মানতাসা মাহিরের কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে আলভীর কাছে আসে। আলভী কোলে তুলে নিতেই গলা জড়িয়ে ধরে মানতাসা। খুশি হয়ে বলে,
“তোমাতে কুঁজেছিলাম।”
“নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম আম্মু।”
“পলা শেষ?”
“শেষ হয়েছে দেখেই তো আবার ফিরে এসেছি।”
“কাবা?”
“হ্যাঁ, তুমি খাবা?”
“হ্যাঁ।”
“কি রান্না করেছো?”
“আমি কলি নাই, আম্মু কলছে।”
“ওহ, তুমি জানো না কি রান্না হয়েছে?”
দুদিকে মাথা নাড়ায় মানতাসা।
কথা বলতে বলতেই ডাইনিং রুমে চলে এসেছে চার জন। আস্তে আস্তে বাকি সবাইও চলে আসে।
একসাথে খাওয়া শুরু করে সবাই।
খাওয়া দাওয়া সেরে মায়া কে নিয়ে রুমে ফিরে আসে আলভী। মায়া কে বেডের উপর বসিয়ে রেখে স্যুটকেস দুটো টেনে মায়ার সামনে এনে ফ্লোরে রাখে।
প্রথম স্যুটকেস টা তে মায়ার জন্য ড্রেস, আলভীর নিজের কয়েক টা ড্রেস। বাকি সব ক্রিম, লোশন, ফেসওয়াশ, শ্যাম্পু, বডি ওয়াশ সহ আরো অনেক কিছু। অর্ধেকের বেশি জিনিস মায়ার জন্য। সব কিছু বের করে এক পাশে ফ্লোরে রাখে আলভী।
তারপর দ্বিতীয় স্যুটকেস টা খুলতেই মায়ার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। স্যুটকেস ভর্তি শুধু বেবি দের প্রোডাক্টস। ছেলে মেয়ে উভয় বেবির জন্য ড্রেস, ছোট ছোট জুতো সহ আরো যা যা প্রয়োজন সেসব কিছুই আছে।
আলভী মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়া কে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেঁসে বলে,
“কি হয়েছে?”
মায়া বেড থেকে নেমে আসে। আলভীর সামনে বসে ছোট ছোট ড্রেস, জুতো হাতে নিয়ে বলে,
“এগুলো!”
“আমাদের বেবি দের জন্য।”
“তুমি তো জানতে না, তাহলে এগুলো?”
“জানতাম না তবুও নিয়ে এসেছি। এক সময় না এক সময় বেবি তো হবেই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেটা তো জানি না তাই দুজনের জন্যই নিয়ে এসেছি। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক একজনের তো লাগবেই। নিয়ে এসে তো ভালোই হয়েছে। এখন যেহেতু টুইন বেবি হবে তাহলে আল্লাহ তায়ালা যেন একজন ছেলে আরেক জন মেয়ে দেন।”
“তুমি বাবা হবে সেটা বোধহয় তোমার ভেতর থেকেই জানান দিয়েছিল সেজন্যই না জেনেও এসব নিয়ে এসেছো।”
“তাই হবে হয়তো, র/ক্তের টান আছে না!”
মায়া বেবি দের প্রোডাক্টস গুলো নাড়াচাড়া করে দেখতে থাকে। আর একটু পর পর আলভীর মুখের দিকে তাকায়।
আলভী ওদের দুজনের সব কিছু তুলে নিয়ে তুলে রেখে দেয়। এগুলোর এখন আর প্রয়োজন নেই।
মায়ার দেখা শেষ হলে বেবি দের প্রোডাক্টস গুলো আবার স্যুটকেসে তুলে রাখে।
রুমের ডোর ভিড়িয়ে দিয়ে এসে জানালার পর্দা টেনে দেয়। রুমের লাইট অফ করে মায়া কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মায়া কে নিয়ে ঘুরতে বের হবে।
সময় পানির স্রোতের মতো নিজ গতিতে এগিয়ে যায়।
মায়া এখন আট মাসের প্রেগন্যান্ট। উঁচু ভারী পেট নিয়ে নড়া চড়া করা কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়াও অনেক টা মোটা হয়ে গেছে। এখন ওজন ষাট কেজি।
আর এক সপ্তাহ পর মায়ার ডেলিভারির ডেট, দু এক’দিন আগ পিছও হতে পারে।
আলভী বাড়িতে আসার পর মায়া কে দুবার ডক্টর দেখিয়েছে। এমনিতে মায়ার সেরকম কোনো সমস্যা নেই। মা আর বেবি তিন জনেই এখনো সুস্থই আছে।
ইদানিং মায়ার হাত পায়ে পানি আসা শুরু করেছে। হঠাৎ হঠাৎ হাত পায়ে পানি এসে হাত পা ফুলে যায়।
এখন রাতে ঘুমোতে পারেনা ঠিক মতো। বেবীরা এত জোরে জোরে কিক মা/রে যে ব্যাথায় ঘুম ভেঙে যায়।
প্রচুর নড়াচড়া করে।
আলভী মায়ার সব রকম খেয়াল রাখে, যত্ন করে। নিজের হাতে মায়ার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ায়। গোছলের পর মায়ার কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়, নিজে রুম মোছে, ঝাড়ু দেয়। মায়া কে নিয়ে বাড়ির অন্য সকলের খুব একটা ভাবতে হয় না।
মায়া ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই, আলভীও একটু আগেই ঘুমিয়েছে। আলভীর ঘুমের সমস্যা হয় প্রচুর। রাতে মায়ার জন্য ঘুমোতে পারেনা, মায়া জেগে থাকবে আর ও নাক ডেকে ঘুমাবে তাতো হয় না। আর দিনের বেলায় অফিসের কাজে বিজি থাকে। সব কিছু মিলিয়ে অনেক দিন ধরে ঠিক মতো ঘুমোতে পারেনা।
এখনো প্রকৃতির ভাঁজে শীত জেঁকে বসে আছে। সকাল বেলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে প্রকৃতি। ঘাসের ডগায় জমে থাকে শিশির বিন্দু।
রাত প্রায় তিন টা বেজে গেছে। মায়ার ঘুম ভেঙে যায়। আলভী ওকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মায়া আলভীর দিকে ফিরে শোয়, এতক্ষণ উল্টো ঘুরে কাত হয়ে ছিল।
আলভী একটু নড়েচড়ে মায়া কে আলতো ভাবে আবারো আগলে নেয় ঘুমের ঘোরেই।
মায়া ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে মাথা ঢুকিয়ে আলভীর বুকে মুখ গোজে। এখন আর আগের মতো করে আলভীর সাথে মিশে যেতে পারে না মায়া। উঁচু ভারী পেটের জন্য দুজনের মাঝখানে একটু দূরত্ব রাখতে হয় নয়তো পেটে চাপ লাগে।
শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মায়ার চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে ফুঁপিয়ে কাদতে শুরু করে। মায়ার ফপানোর শব্দ শুনেই আলভীর ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে মায়ার মুখ বুক থেকে তুলে দেখার চেষ্টা করে বলে,
“কি হয়েছে মায়া পরী? কাদঁছো কেনো পেট ব্যাথা করছে? পেইন হচ্ছে? কি হয়েছে মায়া পরী কথা বলছো না কেন?”
মায়া আলভীর হাত ধরে নিজের গায়ের উপর দিয়ে তুলে দেয়। আলভী কে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বলে,
“আমার কিছু হয়নি, শান্ত হও তুমি।”
“তাহলে কাদঁছো কেন? বাজে স্বপ্ন দেখেছ?”
“না।”
“কি হয়েছে তাহলে?”
“তুমি এত ভালো কেন?”
আলভী বুঝতে পারে না মায়ার কথা। হঠাৎ এমন কথা কেনো বলছে মাঝরাতে? আবার কান্নাও করছে।
মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“কি হয়েছে তোমার বলো আমাকে?”
“আমাকে এত ভালোবাসো কেন? মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি লম্বা একটা স্বপ্ন দেখছি। কবে যেন ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি নেই। ইদানিং এরকম টা বেশি মনে হয়। ভয় লাগে। সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগে বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত। ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখলে ভয় পেয়ে যাই। তুমি অনেক ভালো, তোমাকে যত দেখি তত অবাক হই এখনো। তুমি দুনিয়ার বেস্ট হাজব্যান্ড।”
“তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছিলাম, যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তাহলে তোমার মনের আগে পরের সব কষ্ট দূর করে দিতাম।”
“আমাদের দুজনের জীবন থেকে কত গুলো বছর নষ্ট হয়ে গেছে। আরো আগে যদি আমরা এক হয়ে যেতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। তুমি যদি আরো আগে ফিরে আসতে তাহলে তোমার সাথে আরো কয়েক টা বছর বেশি বাঁচতে পারতাম। আমার এখনো ভীষণ আফসোস হয় আরো আগে কেনো ফিরে আসোনি! আমি কত শত দিন-রাত তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলাম। ভাবতাম এই বুঝি তুমি ফিরে আসলে। জানো সবাই যখন আমাকে কটু কথা বলতো না, তখন তোমার উপর অনেক রাগ হতো আমার। তখন মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে পচা মানুষ তুমি। আমি না এখনো আগের দিন গুলোর কথা ভুলতে পারি না। ওই দিন গুলোর কথা মনে করতে চাই না তবুও ভুলতে পারি না।
হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩৮
কিন্তু আমি এখন অনেক খুশি তোমাকে পেয়ে। তুমি বেস্ট।”
আলভী চুপ করে থাকে মায়া কে জড়িয়ে ধরে।
আলভীরও ভীষণ আফসোস হয় এখনো, কেনো আরো আগে ফিরে আসেনি? কেনো বাবা মায়ের কথা শোনেনি? নিজের হাতে কত গুলো বছর নষ্ট করে ফেলেছে, আফসোস।
মায়ার মাথায় আবারো চুমু খেয়ে বলে,
“ঘুমাও, ম/রার আগে আর তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না আমি।”