হ্যালো 2441139 পর্ব ১০

হ্যালো 2441139 পর্ব ১০
রাজিয়া রহমান

পিয়াসার সকালটা শুরু হলো চায়ের মিষ্টি সুঘ্রাণে। মা চায়ের মধ্যে গোলাপের পাপড়ি ও ব্যবহার করে। মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই পিয়াসা উঠে বসে।ভালো করে তার বেডরুমের দিকে তাকায়।খুব সুন্দর তার রুমটা।পিয়াসার আগের কথা মনে পড়ে। একটা রুম ছিলো মা মেয়ের।সেই রুমে একটা খাট আর একটা আলমারি। খাটে পিয়াসার পুরনো একটা টেডি বিয়ার থাকতো। মা’কে কতো বলেছে একটা পুতুল কিনে দিতে
মা দেয় নি
অথচ এখন পিয়াসার নিজের রুমেই কতো কিছু।বিছানায় অনেকগুলো টেডি বিয়ার,পুতুল।

বাবা তো প্রতিদিনই কিছু না কিছু আনবেনই মেয়ের জন্য। তবুও পিয়াসার মাঝেমাঝে মনে হয় তার মনটা যেনো ভীষণ স্বার্থপর। এখনো মাঝেমাঝে পিয়াসার মায়ের কথা ভাবলেই পারভীনের ছবি চোখে ভেসে উঠে শারমিনের নয়।
নিজের ভাবনার উপর পিয়াসার নিজের কন্ট্রোল নেই।যদি নিয়ন্ত্রণ থাকতো তাহলে পিয়াসা আজীবনের জন্য ভুলে যেতো তার জীবনে বাবা মা হিসেবে অন্য কেউ ও ছিলো কখনো।
যারা তাকে এতো ভালোবাসা,আদর দিচ্ছে তাদের সাথে মনটা বেইমানি করছে।
পিয়াসা মনকে বুঝায় তবুও মন কথা শুনে না।
আজ শুক্রবার। বাসায় মেহমান আসবে।পিয়াসা গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে উঁকি দেয়।
মা কেমন ব্যস্ত হাতে রান্না করছে। কপালে ঘাম।পিয়াসা এগিয়ে যায়। নিজের ফ্রকটা দিয়ে মা’য়ের কপালের ঘাম মুছে দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সামান্য একটা কাজ অথচ এটুকুতেই শারমিনের চোখ ভিজে উঠে। বুকে কেমন বিজয়ীর আনন্দ অনুভব হয়।
এটাই বুঝি সন্তানের মায়া!
কই,এতো বছর তো কেউ এই ছোট্ট কাজটা এতো মায়া নিয়ে করে নি।
কেউ তো এমন উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে দেখে নি।
এই কপালে এতো সুখ লিখা আছে কখনো কি ভেবেছিলো শারমিন!
শারমিন নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “টেবিলে সেমাই রান্না করে রেখেছি আর ফ্লাস্কে চা আছে।খেয়ে নে।বাবাকে গিয়ে বল তাড়াতাড়ি তৈরি হতে।এখনো মাছ আনা হয় নি।কখন যাবে বাজারে কে জানে!”
পিয়াসা বাবার ঘরে যায়।বাবা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। হাতে একটা পেপার। মেয়েকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন,”গুড মর্নিং মা।”

পিয়াসা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “গুড মর্নিং বাবা।মা বলেছে তাড়াতাড়ি বাজারে যেতে,মাছ আনতে।”
আনোয়ার চৌধুরী ভুলেই গেছেন মাছের কথা। তাড়াতাড়ি উঠে বললেন,’ইশ,ভুলেই গেছি একেবারে। যাচ্ছি। ”
পিয়াসা কি ভেবে বললো, “বাবা আমি ও যাবো।”
আনোয়ার চৌধুরী হেসে বললেন,”যাবে!মাছ বাজার কিন্তু খুব একটা ভালো জায়গা না মা।চারদিক থেকে মাছের গন্ধ পাবে।যদি সহ্য করতে পারো তবে চলো।”
পিয়াসা আতঙ্কিত হয়ে বললো, “গন্ধে যদি বমি পেয়ে যায় বাবা,তখন?”
আনোয়ার চৌধুরী হেসে উঠেন মেয়ের কথায়।মেয়েকে বুকে টেনে বললেন,”বমি পেলে বাবার হাত আছে না?কিসের চিন্তা মা?বাবা আছি তো।”
পিয়াসার কান্না পায়।এতো আদর করে বাবারা কথা বলেন!
তার আগের বাবা কখনো তো বলে নি।

সবসময় তো তাচ্ছিল্য আর অবহেলা শুনে এসেছে।পিয়াসা তৈরি হয়ে নেয়।শারমিন মেয়েকে যেতে দেখে বাঁধ সেধে বললো, “মেয়েটা এখনো নাশতা খায় নি,মেয়েকে নিয়ে চললে কোথায়?”
আনোয়ার চৌধুরী বললো, “ওর বাবার সাথে যাচ্ছে ও,তোমার এতো মাতব্বরি করতে হবে না।যাও তো।”
পিয়াসা খিলখিল করে হাসে।মেয়ের খিলখিল হাসি বাবা মা দুজনের কানে যেনো সুধাবর্ষণ করে।
মেয়ের সাথে যেনো তাদের দুনিয়া হাসছে।
মাছ বাজারে ঢুকে পিয়াসা অবাক হলো।এই প্রথম সে মাছ বাজারে এসেছে। সবসময় তো দেখেছে বাড়িতেই মাছওয়ালা আসে সেখান থেকেই মাছ নেয় দাদী।
পিয়াসার মনে আছে একবার দাদীকে বলেছিলো দাদী একটা ইলিশ মাছ কিনো।
দাদী খুবই বিশ্রী একটা শব্দ বলেছে এই মাছকে জড়িয়ে।
পিয়াসা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে।
আনোয়ার চৌধুরী এসেছেন চিংড়ি মাছ কিনতে।চার কেজি গলদা চিংড়ি কিনলেন।পিয়াসা দেখলো একটা বড় ডালা ভর্তি বড় বড় ইলিশ মাছ।

পিয়াসা সেদিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা ইলিশ মাছ নিবে না?”
মেয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে আনোয়ার চৌধুরী দেখেন প্রায় ১/১.৫ কেজি সাইজের ১০/১২ টা ইলিশ মাছ।
ইলিশ মাছ অতিথিদের জন্য রাতেই নিয়ে গেছেন তিনি।কিন্তু মেয়ের দুই চোখে কেমন আনন্দ ফুটে উঠেছে মাছ দেখে।আনোয়ার হোসেন সবগুলো মাছ কিনে নিলেন মেয়ের খুশির জন্য।
চারদিকে কাঁদা আর কাঁদা।পিয়াসার পা কাদায় আটকে গেলো।পিয়াসা ভয় পায়। আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের অবস্থা দেখে হেসে ফেলেন।তারপর কাদা থেকে মেয়ের জুতা তুলে আনেন।
একটা টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে মেয়ের জুতা পরিষ্কার করে দিলেন।মেয়ের পা ধুয়ে দিলেন নিজ হাতে।
পিয়াসা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
মনে মনে বলে, “আল্লাহ, আমাকে কখনো বেইমান বানাইও না।আমার বাবা মা এরাই।এরা আমাকে যে ভালোবাসা দিচ্ছে তার হাজারগুণ করে যাতে আমি ফেরত দিতে পারি আমাকে সেই তৌফিক দিও।”
একটা হোটেলে ঢুকে মেয়েকে নিয়ে নাশতা সারলেন আনোয়ার চৌধুরী। তারপর রিকশা নিয়ে বাড়িতে।
এতো মাছ দেখে শারমিন বললো, “এতো মাছ এনেছো কেনো!”
“গিয়েছি তো শুধু চিংড়ি কিনতে কিন্তু আমার মা’য়ের ইলিশ পছন্দ হলো।মায়ের পছন্দ বলে কথা, ফেলি কি করে বলো?”

শারমিন হেসে বললো, “তা বেশ করেছো।মেয়েকে কিছু খাইয়েছো না-কি এখনো আমার মেয়ে উপোস করে আছে?”
“তোমার মেয়ে হলে খাওয়াতাম না যদিও,এখন তো আমার মা’কে নিয়ে গেছি সাথে করে,না খাইয়ে রাখি কি করে বলো!”
১২টার দিকে বাসার বাহিরে গাড়ির হর্ণ শোনা গেলো। আনোয়ার চৌধুরী মেয়েকে সাথে নিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে গেলেন।
গাড়ি থেকে একে একে অতিথি নামছে।পিয়াসা অবাক হয়ে দেখছে সবাইকে।
রজনী এগিয়ে এসে পিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। মেয়েটা কি যে মিষ্টি দেখতে।যেনো পরীর রাজ্য থেকে ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে। পাখা দিলেই উড়ে যাবে।
রজনীর অবাক ও লাগে।শারমিন, আনোয়ার দুজনেই শ্যামবর্ণ অথচ তাদের মেয়েটা একেবারে অন্য রকম।
অবশ্য এখানে কারো কিছু করার নেই।সব মানুষ তো এক রকম হয় না।সবসময় সব বাবা মা’য়ের সাথে মিলবে এমন তো নয়।

তার ছেলে আষাঢ় যে ৬ ফুট লম্বা অথচ তাদের পরিবারে ৫.৭” এর উপর আর কেউ নেই।আআষাঢ়ের কথা ভাবতেই রজনীর রাগ হলো।ছেলেকে এতো বার বললেন অথচ এলো না সে আজও। কোথাও যায় না এই ছেলে।
পিংকি পিয়াসাকে দেখে এগিয়ে এলো।এই মেয়েটা তার বয়সী হবে।
খানিকক্ষণের মধ্যে রিংকি,পিংকি,বর্ষার সাথে পিয়াসার ভাব হয়ে গেলো।
তবে নিরা,মিরা,মিনি পিয়াসাকে তেমন একটা পছন্দ করলো না।
নিজের চাইতে সুন্দর কাউকে দেখলে তিন বোনের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়।
সবসময় সবখানে তারাই সৌন্দর্যের জন্য সবার কাছে আকর্ষণীয় হয় অথচ এই মেয়ের পাশে আজ নিজেদের ভীষণ ম্লান মনে হচ্ছে।

তিন বোন এক সাথে ঘুরতে লাগলো আলাদাভাবে। শিরিন বিরক্ত হয়ে সোফাগুলো দেখছে।এক ফাঁকে ছোট ভাই মিরাজুল ইসলামের বউ নার্গিসকে ডেকে বললো, “নার্গিস দেখে যা।”
বড় ননদকে নার্গিস খুব একটা পছন্দ করে না।তবুও এগিয়ে গেলো।
শিরিন বললো, “এরা কেমন মানুষ দেখ না,এগুলো কোনো সোফা হইছে?কেমন মরামরা কালার না এগুলোর? কোনো ডিজাইন নাই কিছু নাই।মনে হয় যেনো ফ্রিতে পাইছে।”
রজনী পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথাটা শুনতে পেলো।নিজের বান্ধবীর অপমান যেনো রজনীর নিজের গায়ে লাগলো। এগিয়ে এসে বললো, “আপা,এগুলো ব্র‍্যান্ডের ফার্নিচার। সবসময় নিজের পছন্দ দিয়ে অন্যকে জাজ করতে যাবেন না আপা।আপনার পছন্দ আপনার কাছে, সবার পছন্দ এক না।”
শিরিন সাথে সাথে বললো, “আমারে ব্র‍্যান্ড শিখাইতে আসিও না। আমরা জমিদার বংশের মাইয়া।তোমাগো থাইকা অনেক বড় খান্দান আমাদের।”

রজনীর ইচ্ছে করলো একেবারে যুৎসই একটা উত্তর দিতে কিন্তু বান্ধবীর বাড়িতে সিনক্রিয়েট করতে চায় না ভেবে চুপ করে চলে গেলো।
মিনি এসে মা’কে বললো, “এদের মেয়েটাকে দেখেছো মা?কেমন বিদেশীদের মতো দেখতে তাই না!”
শিরিন ভালো করে খেয়াল করে নি পিয়াসাকে।মেয়ের কথা শুনে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে।তারপর পিয়াসার হাত ধরে বলে, “এই মেয়ে তোমার কি শ্বেত রোগ আছে না-কি?”
পিয়াসা অবাক হয়ে বলে, “শ্বেত রোগ কি আন্টি?”
নিরা মিরা হেসে উঠে।বেশ হয়েছে মা ভালো একটা কথা বলেছে।
শিরিন বললো, “হ্যাঁ, শ্বেতী মনে হচ্ছে। নিরা মিরা মিনি,সাবধানে থাকিস।দূরে থাকিস।শ্বেত রোগ হইবো আবার বেশি মাখামাখি করলে।”

পিয়াসা বুঝতে পারলো না কি বললেনে এই আন্টি।
রজনী, নার্গিস, মহুয়া বেগম,ঝুনির সাথে শারমিন কথা বলছে।এমন সময় পিয়াসা মা’র কাছে যায়।মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা শ্বেত রোগ কি?আমার কি শ্বেত রোগ?”
শারমিন চমকে উঠে। কি বলছে মেয়ে এসব!
রজনীর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। এই মহিলাকে আনার কোনো ইচ্ছে ছিলো না রজনীর।এ যে বিষাক্ত সাপের মতো সবখানে বিষ দাঁত ফুটাতে থাকে তা রজনী আর নার্গিসের চাইতে ভালো কে জানে!
পিয়াসা বললো, “ওই আন্টিটা বলেছে আমার নাকি শ্বেত রোগ, ওনার মেয়েদের বলেছে আমার থেকে দূরে থাকতে নয়তো শ্বেত রোগ হবে না-কি! ”

মহুয়া বেগমের মুখ গম্ভীর হয়ে যায় শুনে। নিজের বড় মেয়ের উপর ভীষণ রাগ হয়।এই মেয়েটা এরকম কেনো!
স্থান,কাল কিছুই বুঝতে পারে না।
ঝুনি খালা এগিয়ে এসে পিয়াসাকে বললো, “ওই আন্টির কথা ভাইবো না তো আম্মা।ওই আন্টির মাতার ইস্কুরু একটু লুজ।সবসময় কোনোখানে যাওনের আগে আমরা সবাই টাইট দিয়ে দিই।আইজ তাড়াহুড়ায় ভুইলা গেছে সবাই টাইট দিতে।এজন্য উল্টাপাল্টা কথা কয়।”

হ্যালো 2441139 পর্ব ৯

রজনী অপরাধী চোখে তাকায় শারমিনের দিকে। শারমিন হেসে বললো, “তুই এতো মন খারাপ করছিস কেনো।আমি সবই বুঝি।ননদ যে কতো বড় কাঁটা তা আমি ও জানি রজনী। ভাবিস না।ভাগ্যিস আমাকে বলেছে মেয়ে।ওর বাবা শুনলে আজকে তোর ননদের কপালে দুঃখ ছিলো। মেয়ের ব্যাপারে এক চুল ও ছাড় দিতে রাজি না চৌধুরী। ”
রজনী কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১১