হ্যালো 2441139 পর্ব ১৯

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৯
রাজিয়া রহমান

বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজেকে ভীষণ একা লাগছে পিয়াসার। তার থেকে দুই টেবিল দূরে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে এক মুহূর্তে পিয়াসার পুরো দুনিয়া কেঁপে উঠলো যেনো।
পারভীন বসে আছে সাদিক আলীর সাথে।
পিয়াসার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে পিয়াসা মা’কে খুঁজতে লাগলো। এখানে সে থাকবে না আর।বুকের ভেতর যেনো সাইক্লোন।
এতো যন্ত্রণা হচ্ছে কেনো?
একবার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেনো এরকম করলো তার সাথে।
পরমুহূর্তে নিজেকে সামলায় পিয়াসা।
কি হবে জিজ্ঞেস করে?
কাকে জিজ্ঞেস করবে?

কাগজে কলমে তার মায়ের নাম এখন শারমিন।পারভীন নামের কারো কোনো অস্তিত্ব নেই তার জীবনে। জন্ম দিলেই মা হয়ে যায় এটা পিয়াসা এখন আর বিশ্বাস করে না।
শারমিন পিয়াসাকে খুঁজছিলো এতোক্ষণ। দেখতে পেয়ে মেয়ের পাশের চেয়ারে এসে বসে।
পিয়াসার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “কি হয়েছে মা?”
পিয়াসা শারমিনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার ভালো লাগছে না মা।আমার কেমন দমবন্ধ লাগছে।তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।”
শারমিন মেয়ের অস্থিরতা দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়ে এতো ঘাবড়ে আছে কেনো?
মেয়েকে শক্ত করে ধরে রাকবে শারমিন।
পিয়াসা কাঁদছে না কিন্তু তার চোখ জ্বলে যাচ্ছে তবুও।পারভীনের কোলে বছর তিনেকের একটা বাচ্চা ছেলে।পারভীন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
পিয়াসা চোখ বন্ধ করে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে কেনো এতো অবহেলিত ছিলো তাহলে?
না-কি মেয়ে বলে তাকে ফেলে চলে যেতে দুই বার ভাবে নি!
নার্গিস একবার পিয়াসাকে দেখছে আবার দূরে বসে থাকা পারভীনকে দেখছে।
কি আশ্চর্য!
এই মেয়েটার মা হচ্ছে শারমিন অথচ এই মেয়ের চেহারা পুরোপুরি দূরের ওই টেবিলের মহিলার সাথে মিলে যাচ্ছে।
অবাক হয়ে নার্গিস শারমিনকে বললো, “আপা দেখেন,আপনার মেয়েটার সাথে ওই টেবিলে বসা মহিলার চেহারার সাথে অনেক মিল।তাই না?”
শারমিন তাকায়।এক মুহূর্তের জন্য শারমিনের মনে হলো সে ভুল দেখছে।পারভীন এখানে?এজন্যই কি তার মেয়েটা এরকম ঘাবড়ে আছে?
নার্গিসের দিকে তাকিয়ে বিব্রত সুরে বললো, “এরকম কাকতালীয় কতো ঘটনাই তো ঘটে দুনিয়ায়। ”
নার্গিস চলে গেলো কথা না বাড়িয়ে।
শারমিন পিয়াসার চুলে বিলি কেটে বললো, “যাবি,মা’য়ের সাথে দেখা করতে? ”
শারমিন খেয়াল করলো এই কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা যেনো ভেঙে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।

পিয়াসা গভীর শ্বাস নিয়ে বললো, “আমি আমার মা’য়ের কাছেই তো আছি আমার আর কোনো মা নেই।মা তো একজনই হয়।”
শারমিনের বুকের পাথর নেমে গেলো।
“আমি ভেতরে যাবো মা।আমার ভালো লাগছে না।”
পিংকির সাথে শারমিন পিয়াসাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলো।
পিয়াসা চলে যাওয়ার পর শারমিন উঠে দাঁড়ায়। পারভীনের সাথে কথা বলতে হবে তার।কেনো মেয়েকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলে চলে গেলো তা জানতে হবে।
পারভীন তিন বছরের ছেলে পিয়াসকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো কোলে নিয়ে। হঠাৎ করেই শারমিন ম্যাডামকে দেখে পারভীন কেমন চমকে উঠে।
সাদেক আলী বসে কথা বলছে ফোনে।স্বামীকে ইশারা করে পারভীন উঠে দাঁড়ায়।
যেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে এসেছে পারভীন সেই অতীত এসে তার সামনে দাঁড়াবে কখনো কি ভেবেছে সে?
শারমিন ম্যাডাম এখানে কোথা থেকে এলো?

লোকে ঠিক বলে। পৃথিবীটা গোল,কখনো না কখনো দেখা হয়ে যায়।
অতীত, বর্তমানের দোলায় পারভীনের মন দুলতে থাকে।যে অভিশপ্ত জীবন পার করে এসেছে সে, সেই জীবনের কোনো ছায়া আর নিজের উপর আসতে দিতে চায় নি।শুধু বুকের এক কোণে ছোট্ট পিয়াসার জন্য যন্ত্রণার আগুন জ্বলতে থাকতো দাউদাউ করে।
৫ বছর!
৫ বছরে কতো কিছু বদলেছে শুধু ঘুমন্ত পিয়াসার পবিত্র মুখটা বদলায় নি মানসপট থেকে।
পারভীনের হাত ধরে শারমিন বললো, “কেনো এরকম করেছিলো?”
পারভীন ডুকরে কেঁদে উঠে।

“মাস্টারের ভাত কই?”
পারভীন রান্নাঘরে রান্না করছে। জমিরনের তাড়া শুনে বললো, “রান্না শেষ আম্মা।এই তো,দিচ্ছি খেতে।”
আজকে শুক্রবার। সাদেক আলী বাড়িতেই আছেন।
সাদেক আলী মালিহার কলেজের স্যার। এই বাড়িতে লজিং থাকছে।কোনো এক অজানা কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছে।
জমিরন দীর্ঘ দিন ধরে ছক কষছে কোনোমতে যদি মালিহাকে এই ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারে।
আশেপাশের সবাইকে জানিয়ে রেখেছে এই স্যারের সাথেই মালিহার বিয়ে হবে।
জানালা দিয়ে সাদেক আলী বাহিরের দিকে তাকায়। সে যে রুমে থাকে সেখান থেকে রান্নাঘর আর পুকুর ঘাট পুরোপুরি দেখা যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় জানালায় পর্দা দেওয়া থাকে তাই।
পারভীন গুনগুন করে গান গাইছে।
একটা বই হাতে নিয়ে সাদেক সেদিকে কান পাতে।পারভীন গুনগুন করে গাইছে,

“আমার গায়ে,যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়…
আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়…
নিঠুর বন্ধুরে…
বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষী কেউ ছিল না সে সময়
ও… ও… বন্ধুরে…
সাক্ষী শুধু চন্দ্র তারা
একদিন তুমি পড়বে ধরা রে বন্ধু
ত্রিভুবনের বিচার যেদিন হয়… রে বন্ধু
ত্রিভুবনের বিচার যেদিন হয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
নিঠুর বন্ধুরে… এ
দুঃখ দিয়া হিয়ার ভিতর
একদিন ও না লইলে খবর
এই কি তোমার প্রেমের পরিচয়
ও… ও… বন্ধুরে…
মিছামিছি আশা দিয়া
কেন বা প্রেম শিখাইয়া রে… বন্ধু
দূরে থাকা উচিৎ কি আর হয় রে… বন্ধু
দূরে থাকা উচিৎ কি আর হয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়…”

সাদেক আলী জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে বাহিরে তাকায়।রান্নাঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পারভীন গান গাইছে।গানের গলা ভীষণ সুন্দর না হলে ও ভীষণ দরদ দিয়ে গাওয়ায় শুনতে ভীষণ ভালো লাগছে।একেবারে বুকের ভেতর এসে তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধছে।সাদেক হারিয়ে যায় নিজের অতীত স্মৃতিতে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো নিজের চাচাতো বোনকে।কিন্তু ধরে রাখতে পারে নি।বাবা চাচার মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান হবে ভেবে দুজনেই বিয়ে করে নিলো অথচ সেই আগুনে যেনো ঘি ঢেলে দিলো তাদের বিয়ে।
১ মাসের মাথায় ডিভোর্স দিতে হলো।সাদেকের বাবা আবেদ আলী এক কথার মানুষ। সাদেক যদি কবিতাকে তালাক না দেয় তাহলে তিনি গলায় দড়ি দিবেন।যে ভাই তার সব টাকা আত্মসাৎ করেছে তার মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তুলবেন না।

পুরো পরিবারের কেউ সাদেকের পাশে ছিলো না।সাদেক ভাবলো যাই হয়ে যাক,কবিতাকে সে ছাড়বে না।কিন্তু সাদেককে অবাক করে দিয়ে কবিতাই বললো, “সে আর এই সম্পর্কে থাকতে চায় না।তার বাবা তার জন্য ভালো পাত্র দেখেছেন।পাত্র ইউকেতে সেটেল।এই সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই।কখনো কেউ মানবে না।কবিতা এরকম অনিশ্চিত জীবন মানতে পারবে না।”
যতটা ঝামেলা করে দুজন বিয়ে করেছিলো, ঠিক ততটাই সহযে দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবার উপর রাগ করে সাদেক বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে।
কবিতার বিয়ে হয়েছে। একটা মেয়ে ও হয়েছে। স্বামীর সাথে দেশের বাহিরে আছে।সাদেক ভেবেছিলো সে বুঝি বাঁচতেই পারবে না কবিতাকে ছাড়া। অথচ একটা সময় বুঝতে পারলো কেউ কারো অভাবে ম রে যায় না।
সে দিব্যি বেঁচে আছে। কবিতার কথা মনে পড়লে ঘৃণায় রিরি করে উঠে পুরো দেহ,মন।
আজকে পারভীনের গাওয়া গানটা যেনো সাদেককে তার অতীতে নিয়ে যায়। কবিতা নিজেই এগিয়ে এসেছিলো তাদের এই সম্পর্কে।আবার নিযেই ছেড়ে গেলো।
সাদেক আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে।পারভীন পরনের সুতি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ,গলা,বুকের ঘাম মুছে। ডীপ নেক ব্লাউজ পরনে পারভীনের ফর্সা বুকটা হুট করেই সাদেকের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য সাদেক চমকে উঠে।

দ্রুত পর্দা ছেড়ে দেয় সাদেক।কি দেখলো সে!
কবিতার সাথে ছাড়াছাড়ির পর নারীদেহের প্রতি কখনো বিন্দুমাত্র আগ্রহ জন্মে নি সাদেকের।এইযে মালিহা সারাক্ষণ গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে,সাদেক কখনোই তাকিয়ে দেখে না।
তাহলে হঠাৎ করে এখন পারভীনকে দেখে বুকের ভেতর এরকম ঝড় উঠলো কেনো?
সাদেক নিজের ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত হয়।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৮

নিজের লজ্জা ছাপিয়ে হঠাৎ করে মনে প্রশ্ন জাগে,পারভীনের এতো কিসের কষ্ট!
সবসময় পরিপাটি সেজে থাকা পারভীনকে দেখে কেনো মনে হয় ভেতরে ভেতরে সে খুবই এলোমেলো হয়ে আছে।ভেতরের অগোছালোভাবকে লুকাতেই সে এতটা পরিপাটি ভাব দেখায়।
সাদেকের মনে হলো, তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে পারভীনের মনের সব কষ্ট দূর করে দিতো।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২০