হ্যালো 2441139 পর্ব ২৮

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৮
রাজিয়া রহমান

পিয়াসার সারা শরীর কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো। লিপস্টিক!
সে লিপস্টিক চুরি করেছে!
পিয়াসা হতভম্ব হয়ে আষাঢ়ের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পিয়াসার মনে হচ্ছে এই অপমানের চাইতে মৃত্যু যেনো শ্রেয়।
আষাঢ়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়।এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসায় মিরার গালে।
অতর্কিত থাপ্পড়ে মিরা চমকে উঠে। তেমনই চমকায় রুমে উপস্থিত থাকা সবাই।
শিরিন ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “কি করলি তুই এটা?তুই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললি?”
আষাঢ় শান্ত সুরে বললো, “হ্যাঁ, হাত তুলেছি।এরপর যদি আরেকটা মিথ্যা কথা ও বলে তাহলে পরের থাপ্পড়ে ওর গালের সব ক’টা দাঁত আমি ফেলে দিবো ফুফু।”

নিরা এগিয়ে গিয়ে বললো, “কেনো,তোর এতো জ্বলনি কিসের?এই শ্বেতী মেয়ের জন্য এতো দরদ কেনো তোর?”
আষাঢ় কথা না বলে নিরার গালেও একটা থাপ্পড় মারে।
নিরা হতবাক হয়ে তাকায়।বয়সে সে আষাঢ়ের বড়।
আষাঢ় শান্ত সুরে বললো, “আর একবার যদি পিয়াসাকে অপমান করে কথা বলস তাহলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।”
পিয়াসা তখনও আতংকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পুরো ঘরে থমথমে অবস্থা।
আষাঢ় এগিয়ে যায় পিয়াসার দিকে। পিয়াসার দুই চোখ টলমল করছে।
পিয়াসার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আষাঢ় বললো, “সরি পিয়াসা।এরা তিন বোন মিলে তোমাকে অপমান করার জন্য এই কাজটা করেছে এটা সবাই জানে।তুমি নির্দোষ এটাও সবাই জানে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিরিন বললো, “তোরে কে বলছে আমার মেয়েরা এই কাজ করছে?”
“কেউ বলতে হয় না ফুফু।তোমার যদি বিবেক থাকতো তাহলে তোমার চোখে ও পড়তো এই অসামঞ্জস্য। পিয়াসাকে তোমার কোন দিক থেকে মনে হয় এমন মেয়ে?আর তোমার মেয়েদের এরকম অনেক কাহিনি আছে। সবার জানা আছে।
বৈশাখী আপার বিয়েতে কি করছে মিরা তা কি আমি সবার সামনে বলবো?”
মিরা ভয়ে কেঁপে উঠে। আষাঢ় সেদিন দেখে ফেলেছিলো মিরা যখন বৈশাখীর জন্য কেনা ব্র‍্যান্ডের জুতাজোড়া নিজের রুমে নিয়ে যাচ্ছিলো।কাউকে কিছু না জানিয়ে আষাঢ় মিরার হাত থেকে জুতাজোড়া এনে রেখে দিয়েছিলো।
আষাঢ় মিরাকে বললো, “তুই কি অপরাধ স্বীকার করবি না-কি আমি সবাইকে সেদিনের ঘটনা জানাবো?”
মিরার লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো, “লিপস্টিকটা আমি আর মিনি মিলে পিয়াসার রুমে এনে রেখেছি।পিয়াসাকে আমরা তিন বোন পছন্দ করি না।

তাই ভেবেছিলাম ওকে একটা যথাযথ শিক্ষা দিবো।”
পিয়াসা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তাকে নিয়ে ও কেউ এরকম নোংরা চক্রান্ত করতে পারে!
সে তো এদের সাতেপাঁচে থাকে না।ওদের সাথে কথা ও বলে না। এই রুমেই থাকে সারাক্ষণ। তবুও কেনো এতো রাগ ওর উপর!
এতো অপমানের পর পিয়াসার পক্ষে এখানে থাকা অসম্ভব।
সবাই চলে গেলো কিছুক্ষণ পর। পিয়াসা বিছানায় চুপ করে বসে রইলো। তারপর উঠে গিয়ে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নেয়।
অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই পিয়াসার।

আগামীকাল কোচিং থেকে পিয়াসা বাড়িতে চলে যাবে।
রাতে খাওয়ার সময় সিরাজুল ইসলাম পিয়াসাকে ডাকলেন।পিয়াসা তখন নিজের রুমে বসে আকাশ দেখছে।ঝুনি নিঃশব্দে এসে পিয়াসার পেছনে দাঁড়ায়। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে মা মেয়ে তিন ডাইনি মিলে কষ্ট দিয়েছে। ঝুনির যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে ওদেরকে এই বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো।কিন্তু সেই ক্ষমতা ঝুনির নেই।মনে মনে গালাগাল দেওয়া ছাড়া ঝুনির কিছু করার নেই আপাতত।
কোমল গলায় বললো, “খালাম্মা,আপনারে বড় ভাইজান ডাকে।”
পিয়াসা চমকে উঠে ঝুনির কথা শুনে। ঝুনি খালা কখন এলেন!
লজ্জা লাগছে পিয়াসার আংকেলের সামনে যেতে।তবুও এলো।একজনের ভুলের জন্য অন্য জনকে অসম্মান করার মেয়ে তো পিয়াসা না।

আষাঢ় উঠে দাঁড়িয়ে পিয়াসাকে চেয়ার টেনে দেয় বসার জন্য।
পিয়াসার হুট করে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। তার বাবা ও তাকে নিজে উঠে চেয়ার টেনে দেয় সবসময় বসার জন্য। বাবা ছাড়া এই প্রথম কেউ তাকে এভাবে যত্ন করলো।মেয়েদের এই একটা স্বভাব। যেই পুরুষ তাকে তার বাবার মতো করে একটু যত্ন করে, তাকেই তারা পছন্দ করে।
ঠিক যেমন এই একটা ছোট কাজেই পিয়াসার কাছে আষাঢ়কে ভালো লাগছে।
সিরাজুল ইসলাম নিজের পাশের চেয়ার দেখিয়ে পিয়াসাকে বললো, “আম্মাজান,এখানে বসেন।আজকে আপনার এই ছেলের সাথে বসে খাবার খান।”
পিয়াসা চারদিকে তাকায়। তার এক পাশে সিরাজ আংকেল অন্য পাশে আষাঢ়। টেবিলে শিরিন আন্টি,নিরা,মিরা,মিনি ও আছে।নির্জন আছে,মহুয়া বেগম আছে,মিরাজ আংকেল ও আছে।একসাথে এতো মানুষের মুখোমুখি পিয়াসা কখনো হয় নি।সে তো রুম থেকেই বের হয় না।হঠাৎ করেই ভীষণ অস্বস্তি লাগে।
রজনী চোখের ইশারায় পিয়াসাকে চেয়ারে বসতে বলে। ইতস্তত করে পিয়াসা চেয়ারে বসে।
এই প্রথম সে এই ডাইনিং এ বসেছে এই বাড়ি আসার পর।

“আজকে যা হয়েছে তার জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত আম্মাজান। আমার বাড়ির মানুষ যে তোমার সাথে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারে আমার ভাবনায় ও ছিলো না। আমি জানি এই ঘটনায় তুমি কতটা কষ্ট পেয়েছো।বাবা মা’কে ছেড়ে এখানে এসেছো,এখানের সবাই তোমাকে আপন করে না নিয়ে উল্টো আঘাত দিলো।
তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছো কষ্ট পেয়ে।আম্মাজান, তুমি যদি এখান থেকে রাগ করে চলে যাও আমি যে তোমার বাবার কাছে ভীষণ ছোট হয়ে যাবো।আমি বড়মুখ করে তোমাকে এনেছি এই বাড়িতে। আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছিলাম তার মতো করে তার মেয়ের খেয়াল রাখবো আমি। অথচ আমি তা পারি নি।

আম্মাজান, তোমার এই ছেলেটা তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।তুমি কি তাকে ক্ষমা করে এই বাড়িতে থেকে যাবে?
আমি কথা দিচ্ছি এরপর যে-ই তোমাকে অপমানিত করতে চাইবে আমি তাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবো।”
নার্গিস স্বামীর পাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলো।বড় ভাসুরের এসব আদিখ্যেতা দেখে তার ভীষণ বিরক্ত লাগলো।
মিরাজুল ইসলাম বললো, “পিয়াসা,আমরা সবাই ভীষণ লজ্জিত।তুমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার বাবা মা’য়ের সাথে আমার ভাই ভাবীর যে-ই আন্তরিক সম্পর্ক তা ভেঙে যাবে। ”
পিয়াসা কি বলবে ভেবে পায় না। তার কি বলা উচিত এখন?
সে এদিক ওদিক তাকিয়ে রজনীর দিকে তাকায়। রজনীর দুই চোখ টলমল করছে। পিয়াসার হুট করে মনে হলো, সে চলে গেলে এই মানুষটা খুব কষ্ট পাবে।
কি মনে করে যেনো আষাঢ়ের দিকে তাকায় পিয়াসা।সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
আষাঢ় তার দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকায়।

পিয়াসার মনে হলো এই মানুষটা আজকে যেভাবে তার জন্য ফাইট করেছে,এরকম কেউ কখনো করে নি তার জন্য।
নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো পিয়াসা।তার জন্য বাবা মা’য়ের এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হোক সে চায় না।মানুষ হারানোর যন্ত্রণা অনেক। যারা তার সাথে অন্যায় করেছে তাদের জন্য যারা ভালোবাসে তাদের কেনো ছেড়ে যাবে!
মহুয়া বেগমের ভীষণ রাগ হলো তার দুই ছেলের কথা শুনে। তার মেয়ে,নাতনিকে নিয়ে এরকম কথা বললো ছেলেরা!
সিরাজুল ইসলাম পিয়াসাকে বললো, “আম্মাজান,তুমি আজকে থেকে আমাদের সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করবে। সব বেলা।নিজেকে আর একা রুমে বন্দী করে রাখবে না।আমি আমার পাশের চেয়ারে তোমাকে যেনো পাই প্রতিদিন,প্রতিবেলা খাবারের সময়।”
পিয়াসা কিছু বললো না আর।

রাতে শোয়ার সময় মহুয়া বেগম সিরাজুল ইসলামকে ডেকে পাঠালেন।সিরাজুল ইসলাম মা’য়ের রুমে ঢুকতেই দেখেন শিরিন বসে বসে প্যাচপ্যাচ করে কাঁদছে।বিরক্তিতে সিরাজুল ইসলামের ভ্রু কুঁচকে গেলো।তার এই বোনটা যে ভীষণ ঝামেলা করার তা তিনি জানেন।
মহুয়া বেগম বললেন, “তুই কারে বাড়ি থেকে বের করে দিবি বলছস?ওই মাইয়া কে?”
আজকে আর সিরাজুল ইসলাম চুপ থাকতে পারলেন না।এরা এতো ছোটলোকের মতো কাজ করে আবার কিভাবে বড় গলায় কথা বলে!

মায়ের মুখের উপর সিরাজুল ইসলাম বললো, “আপনার মেয়ে আর আপনার নাতনিদের। ওরা যদি আর একবার কারো সাথে কোনো অপরাধ করে আমি নিজে ওদের বের করে দিবো।আপনি বলবেন আপনার বাড়ি?তাহলে সেদিনই আমি বের হয়ে যাবো আমার সপরিবারে।এতো বছর ধরে আপনার মেয়েনার নাতনিদের সব অন্যায়,অপরাধ মেনে নিয়েছি।সবস সময় নিজের স্ত্রী, সন্তানকে শাসন করেছি।আজ মনে হচ্ছে আগেই যদি এদের এই বাড়ি থেকে বের করে দিতাম অথবা নিজে চলে যেতাম তাহলে অন্তত মনে শান্তি পেতাম।না পেলাম নিজে কোনো শান্তি, না দিতে পারলাম স্ত্রীকে সুখ।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৭

শুধু সবসময় আপনার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে গেছি।আপনি ও বুড়ো হয়েছেন,আমরা ও এখন বুড়ো হয়েছি মা।এখনো কি চান আপনার আঁচলে বাঁধা থাকি?আমার সত্যি এসব আর ভালো লাগছে না।”
মহুয়া বেগম দেখলেন প্রসঙ্গ বদলে যাচ্ছে। তাই কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে বললেন, “লাইট অফ কর।আমি ঘুমাবো।”
সিরাজুল ইসলাম উঠে চলে গেলেন।আজ মনে হচ্ছে মাঝেমাঝে স্ত্রীর কথা ও ভাবা দরকার। সবসময় এক তরফা তো তাকে কষ্ট দিয়ে গেছেন।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৯