হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৫
রাজিয়া রহমান
বিশাল নীল আকাশ জুড়ে একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। আষাঢ় মুগ্ধ হয়ে তাকায় সেদিকে। বিড়বিড় করে বলে, “তোমার এক ফোঁটা ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা মানুষটা যখন তোমার এক বুক ঘৃণা পেয়ে যায়, তখন তাকে আর রক্ত মাংসের মানুষ বলা যায় না প্রিয়তমা।
সে হয়ে যায় তখন পোড়া কয়লা।তোমার ঘৃণার আগুনে পুড়ে পুড়ে যার সারা অঙ্গ জ্বলসে যায়।
প্রিয়তমা,এক ফোঁটা সুখ খুঁজতে গিয়ে কবে যে দুঃখ আমার প্রিয়া হয়ে উঠলো টের পেলাম না।”
ঝুনি এলো জমিয়ে রাখা চা পাতা আর ডিমের খোসা নিয়ে। আষাঢ়কে এমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, “মামা কি হইছে?”
“কই খালা!কিছু হয় নি।” আষাঢ় আকাশের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো।
ঝুনি খালা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বললো, “মুখটা এমন শুকনা লাগে ক্যান আপনের?পানিশূন্যতা?”
“কিসের পানিশূন্যতা খালা?”
“কে জানি মামা,আমি ভাবছি আপনের পেট খারাপ করছে মনে হয়। এমনি যেই বিষ আপনার জীবনে আসতেছে,আপনি যে এখনো বেঁচে আছেন এইটাই তো অনেক।”
আষাঢ়ের মাথায় ধরলো কথাটা।ঝুনি খালা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে!
রেলিং এ হেলান দিয়ে আষাঢ় ঝুনি খালার দিকে মুখ করে তাকালো।ঝুনি শুকনো ঢোক গিলে বললো, “ভুলে বলে ফেলছি মামা।কঠিন নিষেধাজ্ঞা চলছে যাতে আপনাকে কিছু না জানানো হয় মামা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কি হয়েছে?”
“আপনার দাদী আপনার বিয়া ঠিক করছে আপনের কাল নাগিনী ফুফু শিরিনের মাইয়া মিরার সাথে।”
আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হলো মুহুর্তেই।তাকে না জানিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো!
এই মুহূর্তে আষাঢ়কে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।ঝুনি খালা এক দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।আষাঢ় ছাদের ট্যাপ থেকে মাথায় পানি দিলো।
চোখ মুখ দিয়ে গরম ভাঁপ বের হচ্ছে তার ক্রোধে।তার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সে দাদীকে দেয় নি।
ধীর পায়ে আষাঢ় নিচে নেমে এলো।
রজনী আষাঢ়কে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “কোথায় ছিলি এতোক্ষণ তুই?তোকে তো খুঁজছি আমি।”
“কি হয়েছে?”
“তোর রুমে আয় তারপর বলছি।”
রজনীর আজকে ভীষণ নির্ভার লাগছে।আষাঢ় মা’কে নিয়ে রুমে গেলো।
রজনী ভালো করে আষাঢ়ের রুমের চারদিকে নজর বুলায়।কেমন অগোছালো সবকিছু। তার রুমে কাউকে আষাঢ় ঢুকতে দেয় না।কোনো কিছুতে হাত দিতে দেয় না কাউকে।এজন্যই বেশি এলোমেলো হয়ে থাকে সবকিছু। নিজের বোনদের পর্যন্ত কোনো কিছু কখনো গোছাতে দেয় নি আষাঢ়।
রজনীর হাসি পায়। এবার বউ এলে বউকে কিভাবে নিষেধ করবে?
রজনীর মুচকি হাসি দেখে আষাঢ়ের অশান্ত হৃদয় কেমন প্রশান্তি অনুভব করছে।
রজনী ছেলের হাত ধরে বললো, “আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি।”
আষাঢ় হেসে ফেলে।
“পাত্রী কে জানিস?”
আষাঢ় আড়মোড়া ভেঙে বললো, “আমার জানার প্রয়োজন মনে করলে আমাকে আগেই জানাতে মা।সব ঠিক করে এসে আমাকে বলতে না।”
রজনীর মুখ কালো হয়ে গেলো। ছেলে কি তার উপর রাগ করেছে!না-কি আষাঢ়ের পিয়াসাকে অপছন্দ!
এমন তো কখনো তার মনে হয় নি। বরং সবসময় মনে হয়েছে আষাঢ়ের মনের কোনো এক জায়গায় পিয়াসা আছে।তিনি মা,সন্তানের মনের অনেক কিছুই অনুভব করতে পারেন তিনি।
তা না হলে কখনো রাতে রজনী দরজা না খুলে অন্য কেউ খুললে আষাঢ় যেখানে বিরক্ত হতো সেখানে সে নিজেই বলেছিলো একদিন কষ্ট করে আর রাত জাগতে হবে না,পিয়াসা তো নিচে আছেই।ও পারবে দরজা খুলে দিতে।
সেদিনই রজনী ছেলের মনের হদিস পেয়ে গেছেন।
রজনী কোমল গলায় বললো, “পিয়াসাকে তোর পছন্দ না?আমি তো কথাবার্তা সব ফাইনাল করে ফেলেছি বাবা।”
আষাঢ় এবার ভীষণভাবে চমকায়।
পিয়াসা!
পিয়াসার কথা মনে পড়তেই আষাঢ়ের মনে পড়ে যায় কিছু সময় আগে বলা কথাগুলো।
ক্যারেক্টারলেস!
আষাঢ়ের বুকে কাঁপন ধরে। হাহাহা করে হাসতে শুরু করে আষাঢ়।
এরকম ও প্রহসন হয় না-কি!
আষাঢ় কিছু বলার আগেই রজনী বললো, “তোর দাদী মিরার সাথে তোর বিয়ে দিতে চায়।উনি চেয়েছিলো দুদিনের মধ্যে তোর বিয়ে দিতে।সেখানে আমি তোর পছন্দের কথা ভেবে পিয়াসার বাবা মা’য়ের সাথে কথা বলে পিয়াসার সাথে বিয়ে ঠিক করলাম আর তুই বলছিস রাজি না তুই!
তাহলে কি মিরাকে বিয়ে করতে রাজি তুই?”
আষাঢ় হেসে ফেলে। মা এতো বোকা কেনো!
মা’য়ের দুই হাত ধরে বললো, “মা,তুমি সবকিছু তোমার মতো করে বুঝে নিলে কেনো?আমাকে কি একবার জিজ্ঞেস করা যেতো না?দাদী আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলবে আর তুমি কি ভেবেছো আমি নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিবো?এটা আমার জীবন মা।আমি ডিসাইড করবো কাকে বিয়ে করবো,কবে বিয়ে করবো।দ্বিতীয় কেউ না।”
রজনীর দুই চোখ টলমল করে উঠলো। আষাঢ় কি পরোক্ষভাবে তার কথাই বুঝিয়েছে?
কিন্তু বাবা মা হিসেবে সব বাবা মা’য়েরই তো স্বপ্ন থাকে নিজেরা দেখেশুনে একটা বউ আনবে ছেলের জন্য।
টুপ করে এক ফোঁটা জল আষাঢ়ের হাতের উপর পড়ে। আষাঢ় হাতের দিকে তাকায়। মায়ের চোখের জল আষাঢ়ের কাছে মুক্তোর চেয়ে দামী।ভীষণ সন্তর্পণে নিজের বুকে মুছে নেয় হাত।
মা’কে সে কিভাবে বুঝাবে সেই পাষাণীকে আষাঢ় যতটা ভালোবাসে,সে আষাঢ়কে ঠিক ততটাই ঘৃণা করে।
বিয়ে তো সারাজীবনের বন্ধন।
“তোর অমত যেহেতু আমি পিয়াসার বাবা মাকে গিয়ে বলবো তুই বিয়ে করতে চাস না।আমি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবো।”
আষাঢ় মা’কে জড়িয়ে ধরে। এক বুক দ্বিধা নিয়ে কি একটা নতুন জীবন শুরু করা যায়?
চাইলেও আষাঢ় মা’কে পিয়াসার ব্যাপারটা খুলে বলতে পারছে না।বড় হওয়াটাই যেনো একটা অভিশাপ।চাইলেই মনের সব কষ্ট মা’য়ের কাছে বলা যায় না।
তবে মা’য়ের কাছে বলতে না পারলেও পিয়াসার সাথে আর একবার কথা বলা দরকার।কিছুক্ষণ আগেই যে আষাঢ়কে তীব্রভাবে অপমান করে গেছে, সে নিশ্চয় হাসতে হাসতে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে না।তাকে জোর করে হয়তো বিয়েতে রাজি করানো হচ্ছে।
ভালোবাস বলে যে জোর করে তাকে নিজের করে নিবে সেই মানুষ আষাঢ় নয়।ভালোবাসা মানে আষাঢ়ের কাছে মনে হয় স্বাধীনতা।
যে স্বাধীনতা পেলে একটা পাখি স্বেচ্ছায় ভালোবাসা নামক খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকে।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে পিয়াসা যা বলে গেছে তার পর আর আষাঢ়ের ইচ্ছে করে না ওই চোখে চোখ রাখতে।ওই দুই চোখে যে ঘৃণার আগুন তা আষাঢ়কে পুড়িয়ে ছাই করে দিবে।
আষাঢ় রজনীকে বললো, “মা,আমি আগে পিয়াসার সাথে কথা বলতে চাই একবার। ও রাজি কি-না নিজ কানে শুনতে চাই আমি।”
রজনী উঠে গেলো। ৫ মিনিটের মাথায় রজনী ফরে এলো পিয়াসার হাত ধরে। পিয়াসা রজনীর সাথে হাসতে হাসতে আষাঢ়ের রুমে এলো।
“আমি বাহিরে আছি,তুমি কথা বলে নাও আষাঢ়ের সাথে।”
রজনী পিয়াসাকে রেখে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই পিয়াসার মুখের হাসি মিলিয়ে কাঠিন্য ধরা দেয়।
আষাঢ় ভেবে পায় না এই মেয়ের এক অঙ্গে কতো রূপ!
“তুমি বিয়েতে কেনো মত দিয়েছো?”
আষাঢ় সরাসরি প্রশ্ন করে।
পিয়াসা জানতো এই ব্যাপারটা ঘটবে।আষাঢ় যে তার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে পিয়াসা জানে।হোমওয়ার্ক পিয়াসা আগেই করে ফেলেছে তাই।কিছুতেই আষাঢ়কে জানাবে না সে বাবার কথার বাহিরে যাবে না বলেই রাজি হয়েছে।
এই লোকটা তাকে ভালোবাসলেও এই কথা জানলে কখনোই বিয়েতে রাজি হবে না।
“রাজি না হওয়ার কি আছে?একদিন না একদিন তো বিয়ে করতেই হবে।খামোখা দেরি করবো কেনো বলেন?”
আষাঢ় বিরক্ত হয় এমন হেয়ালি শুনে।
“পিয়াসা,বিয়ে আজীবনের জন্য। জীবনে বিয়ে একবারই আসে পিয়াসা।তা অবশ্যই নিজের মনের মানুষের সাথে হওয়া উচিত। যে আমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে, সে আমাকে বিয়ে করতে কেনো সম্মত হবে?”
“ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই মন থেকে আসে।আপনি আমাকে ভালোবাসেন বলে যদি আমি আপনার মনের মানুষ হই,সেই হিসেবে আপনাকে আমি ঘৃণা করি বলে আপনি ও আমার মনের মানুষ।
তো মনের মানুষকে যখন বিয়ে করা উচিত আপনি বললেন,আমি তো এখন সেটাই করছি।”
আষাঢ়ের বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে। শেষ একটু আশা ছিলো তার যে পিয়াসার মনের মধ্যে একটু হলেও হয়তো তার জন্য জায়গা আছে।কিন্তু প্রতিবার পিয়াসা তাকে বুঝিয়ে দেয় যে পিয়াসা তাকে ঘৃণা করে।
রজনী বাহির থেকে ডাক দিয়ে বললো, “কথা শেষ হয়েছে তোদের?”
আষাঢ় জবাব দেওয়ার আগে পিয়াসা বললো, “হ্যাঁ আন্টি,আসছি।”
রজনী ভেতরে এসে আষাঢ়কে বললো, “তুই এখন আর কোথাও বের হোস না।সন্ধ্যায় কাজী আসবে।পিয়াসার এডমিশন টেস্টের পর আমরা বড় করে আয়োজন করবো।তোদের দুই ভাইয়ের বিয়ের প্রোগ্রাম একসাথে হবে।”
আষাঢ় চাইলেই এই বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু দিচ্ছে না।পিয়াসার বলা কথাটা ভাবছে আষাঢ়।
কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে আষাঢ় বললো, “আমার কইতর,তুমি এটা জানো না যে ঘৃণা থেকেও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।
কতো ঘৃণা করবে তুমি আমাকে!আমি ও দেখতে চাই তা।তোমার ঘৃণা শেষ পর্যন্ত কি ঘৃণার ফর্মে থাকতে পারে কি-না আমিও দেখতে চাই।
তুমি ভালোবাসার রূপ দেখেছো,বিরহের রূপ দেখো নি।ওয়েলকাম আমার জীবনে। একদিন তুমি ও কাঁদবে আমাকে ভালোবেসে।তোমার জীবনের প্রথম কান্না হবে সেটা।
বিকেলে মহুয়া বেগম বাড়িতে ফিরলেন হাসপাতাল থেকে। মনে ভীষণ আনন্দ থাকলেও মুখখানা ভার করে রেখেছেন।মহুয়া বেগম ফিরতেই শিরিন এসে মা’কে বললো, “এসব কি হচ্ছে মা?মিরার সাথে আষাঢ়ের বিয়ে দিবে বলে এখন কেনো পিয়াসার সাথে বিয়ে হচ্ছে?এই বাড়িতে এখন দেখছি তোমার কথার বাহিরে গিয়ে কাজ হয়।”
মহুয়া বেগম গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, “আমি এখন অচল সিঁকি তাই কারো কাছে দাম নেই।নাতির বিয়ে দেখার খায়েশ ছিলো। আমার পছন্দের বাইরে গিয়ে বিয়ে দিতেছে।”
শিরিনের এতো রাগ হচ্ছে। কতো খুশি হয়েছিলো সে প্রথমে।
সন্ধ্যা বেলায় কাজী এলো বাড়িতে।
শারমিনের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে।নিজের জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটা আজকে বুঝি অন্য কারো
নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে?
সেই যেদিন মেয়েটা কোচিং-এর জন্য বের হয়েছিলো বাড়ি থেকে সেদিন তার মনে হয়েছিলো একবার ঘর ছাড়লে মেয়েরা আর ঘরে ফেরে না।আজ সেই শঙ্কা সত্যি হয়ে গেলো।
আর ফিরবে না তার মেয়ে হয়ে। এখন থেকে আষাঢ়ের বউ হয়ে ফিরবে তার মেয়ে।
শারমিন মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে।
বিয়েতে নগদ দশ লাখ টাকা কাবিন ধরা হলো।
সেই মুহূর্তেই আষাঢ় সম্পূর্ণ টাকা আনোয়ার চৌধুরীর হাতে তুলে দিলো।
আনোয়ার চৌধুরী স্ত্রীর দিকে তাকায়।
মহুয়া বেগম নাখোশ হলেন। তার নাতির যে ভালোই অর্থকড়ি আছে মহুয়া বেগম আজকে বুঝতে পারলেন।আর বুঝা মাত্রই মহুয়া বেগমের মনে হলো এই প্রথম তিনি একটা ভুল চাল চেলেছেন।
মিরার সাথে বিয়েটা হলেই ভালো হতো। সব অর্থসম্পদ এখন এই মেয়ে খাবে।শিরিন এজন্যই আষাঢ়কে মেয়েজামাই করতে চেয়েছিলো।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৪
পিয়াসা শুকনো দৃষ্টিতে বাবা-মার দিকে তাকিয়ে আছে। মনকে সে বারবার বলছে আজকে যাতে অন্তত একটু দুই চোখে জল আসে।কিন্তু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে গেলেও দুই চোখে এক ফোঁটা অশ্রু এলো না।
সেদিকে তাকিয়ে শিরিন মিরাকে বললো, “দেখলি,একটুও কাঁদলো না এই ডাইনি।”
মিরা সবটা দেখলো।বিয়ে হওয়া মাত্রই মিরার মনে হলো সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বোধহয়।
মহুয়া বেগম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবদম্পতির দিকে।রজনী মিটিমিটি হাসছে।রজনীর হাসি মহুয়া বেগমের বুকে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
মন বারবার বলছে নিজের হাতেই তিনি নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন।