হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৮
রাজিয়া রহমান
পিয়াসার রেজাল্ট দিয়েছে। রেজাল্ট পেয়ে পিয়াসা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আষাঢ়ের দিকে। আষাঢ়ের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা।পিয়াসা আচমকা ছুটে গিয়ে আষাঢ়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
এই প্রথম স্বেচ্ছায় মন থেকে ভালোবেসে পিয়াসা আষাঢ়কে জড়িয়ে ধরলো।
আষাঢ় পিয়াসার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আংকেল আন্টিকে সুখবরটা জানাও।”
পিয়াসা ছুটে গিয়ে ফোন নিয়ে আসে।ডায়াল করতে যাবে সেই মুহূর্তে আষাঢ় বললো, “আচ্ছা শুনো,কল করার দরকার নেই। এরচেয়ে ভালো আমরা দুজন গিয়ে সরাসরি খবরটা দিবো।আংকেল আন্টির কেমন রিয়েকশন হ্য নিজ চোখে দেখবে।”
খুশিতে পিয়াসার নিজেকে পাগলের মতো লাগছে।তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। তাতেই রাজি হয়ে গেলো পিয়াসা।তাৎক্ষণিক ছুটে যায় ব্যাগ গোছাতে। খানিক বাদে আষাঢ় রুমে যায়।
পিয়াসা আষাঢ়কে দেখে সহজ ভাবে বললো, “শুনুন,আপনার সবকিছু কিন্তু আমি ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি।”
আষাঢ় অবাক হয়। একটা জিনিস ভালো করে বুঝতে পারে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর পিয়াসা আস্তে আস্তে আষাঢ়ের সাথে সহজ হচ্ছে। সম্পর্কটা আগে যেমন দমবন্ধ মনে হতো,পিয়াসা আষাঢ়কে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ড্রয়িং রুমে বসে থাকতো,আষাঢ় পিয়াসাকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য ছাদে বসে থাকতো। নতুন বাসায় আসার পর এখন আর আগের মতো লুকোচুরি করছে না পিয়াসা।বরং আগের চাইতে একটু কথাবার্তা বলছে নিজ থেকেও।
আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো, “কী নিয়েছো তুমি? আমার কী কী দরকার তুমি কি তা জানো?”
পিয়াসা মিষ্টি হেসে আষাঢ়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তিন সেট শার্ট-প্যান্ট,দুটো টি-শার্ট,দুটো ট্রাউজার,হেয়ার জেল,একটা নতুন টুথব্রাশ, টুথপেষ্ট অবশ্যই আপনার পছন্দের ব্র্যান্ড,একটা টাওয়াল,বডি স্প্রে,একজোড়া স্লিপার।”
“এতো কিছু!”
“প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছেন, দুদিন ভালো করে না বেড়িয়ে তো আসতে দিবো না।এজন্য যাতে কোনো কিছুর বাহানা দিয়ে আসতে না পারেন তাই সবকিছু নিয়ে নিয়েছি আপনার।”
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে পিয়াসা রজনীকে কল করে জানায় ওর রেজাল্ট এবং বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা। রজনী শুনে শান্তি পায়।দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটা যে দূরত্বের তা রজনীর চোখে ঠিকই পড়েছে। রজনী নিজেই ভেবে রেখেছিলো যেকোনো ভাবে সুযোগ পেলেই ওদেরকে আলাদা বাসায় থাকার কথা বলবে।সেই সুযোগ যে বৈশাখীর কর্মকান্ডে হয়ে যাবে এতো শীঘ্রই রজনীর জানা ছিলো না।
বহুদিন বাদে রজনীর অন্তরটা শান্তিতে ভরে গেছে।
পিয়াসা সিরাজুল ইসলামকে কল করলো।সিরাজুল ইসলাম আষাঢ়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।কিন্তু পিয়াসার উপর তার কোনো রাগ নেই।
ছেলের কর্মকান্ডের জন্য পুত্রবধূকে দোষারোপ করার মতো মানসিকতা তার নেই।
পিয়াসার রেজাল্টের কথা শুনে ভীষণ আনন্দিত হলেন তিনি।
বহুদিন বাদে পিয়াসা বাড়িতে যাচ্ছে। আষাঢ় শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় রাজ্যের জিনিসপত্র কিনেছে।
পিয়াসা যতোই নিষেধ করে আষাঢ় ততই কেনাকাটা করতে উৎসাহী হয়।প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে বলে কথা।
বাড়ির সামনে আসতেই পিয়াসার মনে পড়লো মা’য়ের কথা। এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন পিয়াসা কোচিং করতে ঢাকায় যাবে সিদ্ধান্ত হলো।মা ভীষণ কেঁদেছে। সেদিন বলেছিলো মেয়েরা একবার বাড়ি থেকে বের হলে এরপর সেই বাড়ির অতিথি হয়েই আসে।বাড়ির সাথে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়।
মিথ্যা ভাবে নি মা।
সেই যে বের হয়েছে পিয়াসা বাড়ির মেয়ে হয়ে আজকে ফিরে এলো আবার অন্যের বউ হয়ে।
শারমিন ঘরেই ছিলো।
একটানা একটা গাড়ির হর্ণ। দরজা খুলেই শারমিনের পা যেন হঠাৎ থমকে গেল। সামনে পিয়াসা!
তার মেয়ে!
বিয়ের পর এই প্রথম ফিরে এসেছে। অজান্তেই বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। এক মুহূর্তে সব গুলিয়ে যায়—আনন্দ, অবিশ্বাস, অভিমান আর উপচানো ভালোবাসা।
শারমিনের চোখ পিয়াসার মুখে আটকে যায়।
পিয়াসা কি মিষ্টি করে হাসছে।
আজ ওর মুখে একটা পরিণত প্রশান্তি, যে প্রশান্তির নাম ‘সংসার’।মেয়েটা বুঝি সংসারী হয়ে গেলো এবার!
শারমিনের বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কতগুলো না-বলা কথা যেন ঢল নামে হৃদয়ের ভেতর থেকে। হাতটা নিজে থেকেই উঠে যায়। ঠোঁট কাঁপে। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোয় না। শুধু মনে হয়, “এই তো আমার পিয়াসা,আমার বুকের ধন,আমার মানিকরতম।যাকে পেয়ে আমি পূর্ণ হয়েছিলাম।যে আমার জীবনে এসেছে আলোর প্রদীপ হয়ে ”
“কেমন আছিস মা?”
ততক্ষণে পিয়াসা ছুটে এসে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফেলে।
সেই চেনা গন্ধ মায়ের শরীরের, মায়ের শাড়ির, আর চুলের হালকা তেলের গন্ধ।এক মুহূর্তে সমস্ত দূরত্ব, মনের সব যন্ত্রণা সব গলে যায়।
পিয়াসার চোখ ভিজে ওঠে। ফিসফিস করে বলে, “মা, খুব ভালো আছি, কিন্তু তোমার বুকটাই আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।”
মনে মনে বলে, “তুমি না জানলেও, প্রতিদিন মনে মনে তোমায় ছুঁয়ে থাকি মা।তোমাকে কী ভীষণ মিস করি বুঝাতে পারবো না।”
শারমিন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু বুকের মধ্যেকার ঢেউ যেন চিৎকার করে বলে, “তোকে না বলে কতদিন ভেবেছি,এই এখন যদি এসে পড়িস। এই এখন যদি দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিস!
তুই এলি মা, তুই এলি…”
এক হাত পিয়াসার মাথায়, আরেক হাতে ওর পিঠে।
“আমাকে বললি না কেনো আসবি যে!তোর বাবা জানলে তো আজকে চেম্বারে যেতো না।”
পিয়াসা মুখ তুলে তাকায়। মায়ের চোখে জল দেখে ওর গলার স্বর আটকে যায়। ফিসফিসিয়ে শুধু বলে, “মা, তোমাকে না বলে আসার কারণ ছিল একটাই,তোমার চোখে হঠাৎ ভালোবাসা দেখে আমার বুকটা ভরে উঠুক, ঠিক সেভাবে, যেমন করে ঝড়ের রাতে কুড়িয়ে পাওয়া আমাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলে পরম যতনে।আমি সেটাই চেয়েছিলাম মা”
শারমিন চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “খবরদার এসব বলবি না।তোকে আমি কুড়িয়ে পাই নি।তুই আমার মেয়ে।আল্লাহ তোকে আমার জন্য পাঠিয়েছেন।”
মা মেয়ের দীর্ঘ কান্নাকাটি শেষ হতেই আষাঢ় এগিয়ে এসে সালাম দেয় শারমিনকে।।মেয়েকে পেয়ে ভুলেই গেছেন জামাইও সাথে আছে।শারমিন হেসে জবাব দেয়। তারপর ওদের নিয়ে ভেতরে যান।
মহুয়া বেগমের সময় ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। ছেলেরা কেউ তাকে নিতে আসছে না।তিনিও রাগ করে বের হয়ে এসেছেন বিধায় ফিরতে পারছেন না।
এই কয়দিনে তার শরীর ভেঙে গেছে।
শিরিনকে তার ভীষণ ভয় ও করে।
শিরিন কেমন পাগলের মতো ব্যবহার করছে তার সাথে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে শিরিন নরম সুরে বললো, “মা তোমার সাথে একটা কথা আছে।”
মহুয়া বেগম অবাক হলেন।বাড়ি থেকে আসার পর শিরিন তার সাথে কেমন করে কথা বলে জানি।আজ হঠাৎ এমন নরম সুরে কথা বলছে!
নিরা মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে শিরিনকে।
শিরিন বললো, “মা,বাড়িটা তো তোমার নামেই।ওই বাড়িটা তুমি আমার নামে লিখে দাও।”
মহুয়া বেগম চমকে উঠেন।পাগল হয়ে গেছে নাকি শিরিন।কী বলছে ও!
“বাড়ি তোর নামে লিখে দিবো মানে?তোর আব্বা মারা যাওয়ার আগেই সব সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে গেছেন।তোদের দুই বোনের ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে তোদের ভাগেরটা।ওই বাড়ি আমার ছেলেদের।”
নিরা হিসহিসিয়ে বললো, “না নানি,ওই বাড়ি তুমি আমার মায়ের নামে করে দিবে।ওখান থেকে আমাদের বের করে দিয়েছে তোমার ছেলেরা যেভাবে, সেভাবেই ওদের বের করে দিবো আমরা।”
মহুয়া বেগম কঠোর হয়ে বললেন,”খবরদার শিরিন,আর কখনো এসব কথা বলবি না।ওই বাড়ি আমার ছেলেদের। আমি কখনোই এমন অন্যায় করতে পারবো না।”
শিরিন চোখ রাঙিয়ে বললো, “তা বললে তো হবে না মা।তোমার ছেলেরা যে তোমাকে আর ওই বাড়িতে নিবে না তুমি ও জানো,আমি ও জানি।তাই তোমার উচিত ওদের একটা শিক্ষা দেওয়া।”
“আমার ছেলেরা কোনো অন্যায় করে নি,আমি বরং ওদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি তোর জন্য ও তো ছেলেদের কতো হেনস্থা করেছি।কিন্তু এই কাজ কখনো হবে না।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৭
নিরা রেগে উঠে বললো, “ওই বাড়ি আমার মায়ের নামে চাই নানী।তুমি দিতে বাধ্য।”
মহুয়া বেগম রাগ করে উঠে যান খাবার না খেয়ে।
শিরিন বললো, “কতো দিন থাকবে না খেয়ে।এখানে যখন আছে,দিতে বাধ্য। “
“কোনো মতে বাড়িটা তোমার নাকে করতে পারলে পরদিনই ডেভেলপারকে দিয়ে দিবো মা।এরকম একটা বাড় জায়গায় কতো কিছু যে হবে,আর কতো টাকা পাওয়া যাবে ভাবতে পারছো!মামলা হামলা করে লাভ নেই মা।মামাদের হাত অনেক লম্বা।ওদেরকে এভাবে শিক্ষা দিতে হবে।নানীকে ফুঁসলায়।সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে পরে না হয় আঙুল বাঁকিয়ে নিবো।”
শিরিন হাসে।