হ্যালো 2441139 পর্ব ৭
রাজিয়া রহমান
সিরাজুল ইসলাম ছক্কা একজন স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছেন।তার হাতে একটা পুরনো দিনের রেডিও।আজকে অফিসে যাবেন না।তার সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি। সাথে জলপাইয়ের আচারের বয়াম রাখা।জলপাইয়ের আচার থেকে সরিসার কড়া ঘ্রাণ আসছে।ছক্কা সাহেবের এই আচারটা ভীষণ পছন্দ। তার গিন্নি জলপাইয়ের সিজনে বেশি করে আচার করে রাখেন।
ভাত,খিচুড়ি, বিরিয়ানি সবকিছুতেই তিনি আচার খান।
তার ছোট ভাই মিরাজুল ইসলাম কালো গাউনটা গায়ে চাপিয়ে গলায় সাদা ব্যান্ড কলারটা ঠিক করতে করতে ছুটছে।আজকে ভীষণ বৃষ্টি, তবুও তাকে কোর্টে যেতে হবে।সুপ্রিম কোর্টের একজন দুঁদে উকিল তিনি।আজকে তার একটা মামলার শুনানি আছে।
বড় ভাইকে আয়েশ করে বসে থাকতে দেখে পাইঞ্জা বললো, “দিন তোমারই ভাইজান।কেমন আরাম করে দিন কাটাও।শালার ওকালতি না পইড়া তোমার লাইন ধরলেই ভালো হইতো।সচিব হইতে পারতাম যদি তোমার মতো! ”
উৎফুল্ল হয়ে সিরাজুল ইসলাম বললেন,”তা মন্দ বলিস নি।খেয়েছিস?”
“না ভাই,খাওয়ার আর সময় কই?রাতে কেস স্টাডি করতে করতে তিনটা বেজে গেছে। বৃষ্টিতে ঘুমটা এতো ভালো হলো যে উঠে দেখি অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন বের হতে হবে।আরাম করে খাওয়া আমার কপালে নাই।”
“আচ্ছা যা,সাবধানে যাস।”
ছোট ভাই বের হয়ে যেতেই সিরাজ সাহেব মোবাইল হাতে নেন।ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে একটা ভিডিও আসে সামনে। একজন পেডিয়াট্রিশিয়ানের একটা শর্ট ভিডিও সামনে আসে।সিরাজ সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠেন।
আনোয়ার!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্কুল লাইফের বন্ধু আনোয়ার!
১৫ বছর আগে শেষ বার দেখা হয়েছিলো। এরপর এক প্রকার ভুলেই গেছেন।
আজ হঠাৎ আনোয়ারের ভিডিও সামনে আসতেই সিরাজুল ইসলাম পুরনো স্মৃতির রাজ্যে হারিয়ে গেলেন।
বড় মেয়ে বৈশাখীর জন্মের পর ৩ বছর পর্যন্ত ওর সম্পূর্ণ চিকিৎসা আনোয়ার করেছিলো। সম্পূর্ণ ফ্রীতে।কোনো দিন তিনি ভিজিট দিতে পারেন নি।
উল্টো আনোয়ারের গালাগাল শুনতেন টাকার কথা আসলে।
এরপর আনোয়ার স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে গেলো আর যোগাযোগ ও হারিয়ে গেলো। আজ বহু বছর পর আনোয়ারকে দেখে সিরাজুল ইসলাম নিজের স্ত্রী রজনীকে ডাকলেন।
রজনী রান্নাঘরে দুপুরের রান্না বসিয়েছে। প্রায় ২০/২৫ জন মানুষের জন্য রান্না করতে হচ্ছে। বাড়ি না-কি হোটেল রজনী ভেবে পায় না। সিরাজুল ইসলামের দুই মেয়ে বৈশাখী,বর্ষা আর এক ছেলে আষাঢ়।
তার ভাই মিরাজুল ইসলামের আবার দুই ছেলে দুই মেয়ে।নির্জন,নীরব,রিংকি,পিংকি।বড় ননদ শিরিন আর ছোট ননদ তারিন।তারিন থাকে স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়া কিন্তু শিরিন নিজের তিন মেয়ে নিরা,মিরা,মিনিকে নিয়ে এখানেই থাকে।শিরিনের স্বামী রবিউল থাকে দুবাই।
নিজের ছেলে মেয়ে,দেবর,ননদের সবাই মিলেই সদস্য সংখ্যা ঝুনিকে নিয়ে ১৭-১৮ জন।এরমধ্যে আবার গ্রাম থেকে আসা অতিথি আছেন ৪ জন।বাড়ির কেয়ার টেকার আছে।
রজনীর মাথায় আগুন জ্বলছে যেনো।একান্নবর্তী পরিবারের ঠ্যালায় পড়ে নিজের জীবন কেটে গেলো রান্নাঘরে হাড়ি পাতিলের সাথে যুদ্ধ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করা রজনীগন্ধার জীবন কি-না একটা একান্নবর্তী পরিবারের রান্নাবান্নার কাজেই আটকে গেলো!
অথচ রজনী ম্যাথে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছিলো।বাবা মা’য়ের কতো স্বপ্ন ছিলো মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু বনেদী পরিবারে বিয়ে হয়ে এসে জীবনের সব শখ,স্বপ্ন তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম তখনও চেঁচিয়ে ডাকছেন স্ত্রীকে। রজনীর ইচ্ছে করলো রান্না করার হাতা দিয়ে পিটিয়ে ছক্কা মিয়ার মাথা ফাটিয়ে দেয়।
একটা মেরুদণ্ডহীন লোকের সংসারে এসে তার জীবন একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো যে কি-না নিজের স্ত্রীর চাকরি করার কথা শক্ত গলায় বলতে পারে নি মায়ের সামনে।
যে কি-না এতো বছরে ও স্ত্রী কে একটা সংসার দিতে পারে নি।যে কিনা পারে নি স্ত্রীকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে আলাদা করে। সবসময় গুষ্ঠিশুদ্ধ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হয়েছে।
সে না-কি আবার সচিব!
ঝাঁটা মারে রজনী এই সচিবের মুখে। জীবনের অর্ধেক তো শেষ হয়েই গেলো।
কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রজনী বের হলো রান্নাঘর থেকে। সিরাজুল ইসলাম গুণগুণ করে গান গাইছে।ভীষণ ফূর্তিতে আছে লোকটা।
স্ত্রীকে দেখে জোরে গাইতে লাগলেন,
“আমি রজনীগন্ধা, ফুলের মতো
গন্ধ বিলিয়ে যাই
আমি মেঘে ঢাকা,চাঁদের মতো
জোছনা ঝরিয়ে যাই….”
রজনী মুখ অন্ধকার করে বললো, “কি সমস্যা, ষাঁড়ের মতো এরকম চেঁচানোর মানে কি?”
“আরে চেঁচাচ্ছি কই?গান গাইলাম তোমাকে নিয়ে একটা, খুশি হও নি?”
“না খুশি হই নি।এসব নাটক করবে না আমার সাথে তুমি।”
সিরাজুল ইসলাম স্ত্রীর ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”রান্না শেষ করো,আজকে তোমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবো।”
রজনী ভীষণ বিরক্ত হয় এসব আদিখ্যেতা দেখে।এখন বুড়োকালে লং ড্রাইভে যাবে সে!
বয়সকালে স্বামীর সাথে একটু নদীর পাড়ে বসে বাদাম খেতে ও পারেন নি।
রজনী যেতে যেতে বললো, “আমি কোথাও যাবো না।এই সংসারে এসেছি দাসী হিসেবে, দাসীবৃত্তি করেই জীবন শেষ হলে বের হবো এই সংসার থেকে।তার আগে না।”
স্ত্রীর অভিমান, অভিযোগ সবই সিরাজ সাহেব বুঝেন কিন্তু স্ত্রীর কথা মতো আলাদা সংসার করার মতো মানুষ তিনি না।
তবুও স্ত্রীকে চটালেন না।
এদিক ওদিক তাকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “প্লিজ সুগন্ধা,অনুরোধ করছি।আমাকে নিরাশ কর না।তোমার ও ভালো লাগবে।”
রজনী রাগ করতে গিয়ে ও করলেন না।সংসারের দায়িত্ব থেকে একদিন ছুটি বের করে নিজের জন্য একটু সময় কখনো পান নি।এই মনে কতো শত অভিমান,অভিযোগ জমে আছে। এই মানুষটা কখনো বুঝে নি।না বুঝেছি নিজের একমাত্র ছেলেটা।
রজনী হাতের হাতা নামিয়ে রেখে দুই তলায় নিজের ঘরে গেলো।পরনের শাড়ি বদলে একটা গোলাপি সুতির শাড়ি পরে নিলো।
কতো দিন পর সাজতে বসেছে!
লম্বা কালো চুলে আজ সাদা আভা পড়তে শুরু করেছে। দুই মেয়ে এক ছেলের জননী এখন। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ছেলের বউ আনবেন।
এরপর এই সংসারের দায়িত্ব বউয়ের কাঁধে তুলে দিবেন তিনি ও মহুয়া বেগমের মতো।
নিজের গাড়ি বের করে সিরাজ সাহেব নিজেই ড্রাইভিং করছেন আজকে।
রজনী জানতে চাইলো না কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না।বরং স্বস্তি পাচ্ছে কিছু সময়ের জন্য তো সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
তিন ঘন্টা ড্রাইভিং করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় মেডিল্যাব হাসপাতালের সামনে।
রজনী অবাক হয়। এই লোক স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে ঘুরতে এসেছে!
এই লোক কি এই জন্মেও ঠিক হবে না?
জেলা সদরের এই হাসপাতালে আনোয়ার চৌধুরীর চেম্বার। সিরাজুল ইসলাম স্ত্রীর হাত ধরে ভেতরে গেলেন।
কম্পাউন্ডারকে বললেন, “আনোয়ার ডাক্তারকে ডেকে দিন তো,বলুন তার ফ্রেন্ড এসেছে।”
কম্পাউন্ডার হোমরাচোমরা চেহারার, আভিজাত্যপূর্ণ চলনভঙ্গি দেখে বুঝে গেলো এই লোক সাধারণ লোক না।তাই দেরি না করে আনোয়ার চৌধুরীকে ডাকতে গেলো।
আনোয়ার চৌধুরী গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে বাহিরে বের হলেন।তারপর ছক্কাকে দেখে ভীষণ হতবাক হলেন।ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন বন্ধুকে।১৫ বছর পর দেখা হয়ে ও একের অন্যের প্রতি টান কমে নি।
রজনী নিজেও ভীষণ খুশি হলো।তারমানে শারমিনের সাথে দেখা হবে।শারমিন তার বান্ধবী ছিলো।
আনোয়ার চৌধুরী আর দেরি না করে বন্ধু আর বন্ধু-পত্নীকে নবাড়ির পথ ধরলেন।এরমধ্যে কল করে শারমিনকে টুক করে ইনফর্ম করে দিলেন।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৬
এ যেনো এক মিলনমেলা। শারমিন রজনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।দুই বান্ধবী একে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরে আকুল নয়নে কাঁদতে লাগলো।
পিয়াসা মা’কে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে।শারমিন চোখ মুছে বান্ধবীকে বলে, “আমার একমাত্র মেয়ে,চৌধুরী পিয়াসা বিনতে আনোয়ার।আর এ আমার বান্ধবী রে মা।তোর খালামনি হবে। ”
রজনী ভালো করে পিয়াসাকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”কেমন আছো মা?”
পিয়াসা কোমল গলায় বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন খালামনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো আছি।”