মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪১

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪১
মুসতারিন মুসাররাত

প্রীতির মাথার মধ্যে বলের মতো ঢপ পারছে কয়েকটা কথা। ভাবছে বারংবার— প্রত্যাশা ওনাদের নিজের মেয়ে নয়? তাহলে প্রত্যাশার আসল পরিচয়? আর এটা কী সবাই জানে? নীরব? নীরবের পরিবার?
বৃদ্ধা মহিলার গলা স্পষ্ট শোনে প্রীতি। অধরা অবশ্য তখনিই মহিলাকে থামিয়ে দিয়ে রাগঢাক করেন। এতে সুচতুর প্রীতির সন্দেহ তীব্র হয়। তারমানে —- এই চরম সত্যিটা আসলে সকলে জানে না।

আঙুলের খাঁজে আঙুল গুঁজে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে প্রীতি একমনে ভাবতে থাকে; যদি সত্যিই নীরবের ফ্যামেলি না জেনে থাকে, তাহলে জানার পর রিঅ্যাকশন কেমন হবে? এতবড় একটা বিষয় আড়াল করে বিয়ে দেয়া মানে তো ঠকানো। বিশেষ করে শাশুড়ি মা সমন্ধে একটু হলেও জানে প্রীতি। ঠকানোর দায়ে শাশুড়ি মা কী কোনো স্টেপই নিবে না? চাল চুলোহীন, না জানি কোন নিচু পরিবার, নিচু মানুষের র*ক্ত। এমন একটা মেয়েকে আদরের ছোট ছেলের বউ হিসেবে কস্মিনকালেও নীহারিকা মানতে চাইবেন না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এটা ভাবতেই প্রীতির মনে পৈ’শা’চি’ক আনন্দ অনুভব হয়।
ওদিকে বিদায় মূহুর্ত ঘনিয়ে এসেছে। প্রীতি ঠোঁট চেপে ভাবতে থাকে কী করবে? এক্ষুনি সবাইকে জানিয়ে দিবে?
নিজের মাথায় অদৃশ্য হাতে চাটি মা*রে প্রীতি। নিজেকে আশ্বস্ত করে ভাবল— রিল্যাক্স প্রীতি, রিল্যাক্স। সবুরে মেওয়া ফলে। এত অধৈর্য হলে চলে? এটাই সুবর্ণ সুযোগ। আগে শাশুড়ি মায়ের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ওনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তারপর সময়-সুযোগ মতো যা করার করতে হবে। আর প্রত্যাশা? তোমার মতো একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য নীরব আমাকে চ’ড় মে*রে*ছে না। তখন খুব উপভোগ করেছিলে বুঝি? সবকিছু সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়া হবে।

চারদিকের হাসি-আনন্দ ক্ষীণ হয়ে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। শফিক সাহেব ধীরপায়ে এগিয়ে এসে প্রত্যাশার হাত ধরে নীরবের হাতে তুলে দিলেন। কণ্ঠ ভেজা হলেও দৃঢ়ভাবে বললেন,
-” মেয়েটা আমার একটু বেশিই অবুঝ বাবা। তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার। যত সমস্যা, দুঃখ-কষ্টই আসুক, মেয়েটাকে যেন কখনো একা মনে না হয়। সবসময় পাশে থেকো।”
নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে নম্রস্বরে আশ্বস্ত করতে উত্তর দিল,
-” আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বাবা। প্রত্যাশাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সর্বদা চেষ্টা করবো ওকে ভালো রাখার।”

-” তোমার উপর আমার বিশ্বাস ভরসা আছে বাবা। তবুও অবুঝ মেয়েটাকে নিয়ে একটু বাড়তি চিন্তা হয়।”
প্রত্যাশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এতক্ষণের আঁটকে রাখা কান্না বাঁধ ভাঙার যোগাড় হলো। আর হতেই প্রত্যাশা আর সামলাতে পারল না। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শফিক সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” কাঁদে না মা আমার। কান্না করলে মাথা ধরবে। তারপর তোমার আম্মুর আমার বেশি খা’রাপ লাগবে যে।”
প্রত্যাশার কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। মনে হচ্ছে সব বুঝি পর করে চলে যাচ্ছে। হৃদয়টা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে কষ্টে। বাবার কাছে যত আবদার আহ্লাদ ছিলো তা বুঝি আর আগের মতো রাখা হবে না। বিয়ে শব্দটাই মেয়েদেরকে কেমন বাবার বাড়ি থেকে পর করে দেয়। প্রত্যাশা বাবার পিঠের পাঞ্জাবী খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

-” আব্বু আমি কোথাও যাব না।”
নীরব ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সব তো ঠিকঠাকই ছিলো। হঠাৎ বিদায়ের সময় কী হলো? বন্ধু বান্ধব, কলিগরা ভাববে— বউ মনেহয় বিয়েতে রাজি ছিলো না। না হলে এত ম*রা কান্না কেউ করে? আবার হেঁচকি তুলে ডিরেক্ট বলে— ‘আব্বু আমি কোথাও যাব না।’
নীলার পাশে দাঁড়িয়ে নিভান ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আরে তোমার বোনকে একটু বোঝাও। আমার বেচারা ছোট ভাইটার ফেস দেখে বোঝা যাচ্ছে সে টেনশনে পড়েছে। যে সে টেনশন নয়, মহা টেনশনে।”
নীলা ঝারি মে’রে বলল,

-” বাদ দাও তো। ওর ঢং।”
চোখের পানিতে শফিক সাহেবের পাঞ্জাবি ভিজিয়ে ফেলল প্রত্যাশা। মাহবুব সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
-” প্রত্যাশা মা কাঁদে না। তুমি যদি এভাবে কাঁদো তোমার বাবা-মায়ের বেশি খা’রাপ লাগবে। তাদের কথা একবার ভাবো। আর মা তোমার যখন মন চায় তুমি বাবা-মায়ের কাছে আসবে যাবে। নীরব নিয়ে যাবে, কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া দূরত্বও তো বেশি নয়। এতে মন খা’রা’প করার কিছু নেই মা। নীলাশা আছে, দুইবোন একসাথে মিলেমিশে থাকবে। তুমি তো হেসে হেসে যাবে, যা দেখে তোমার বাবা মায়ের ভালো লাগবে।”

অধরা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ প্রায়। অবুঝ, সরল বাচ্চা মেয়েটাকে শ্বশুড় বাড়ি পাঠাতে একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। অধরাকে সামনে আনতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। মা-মেয়ে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। বড় মামা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” থাম তোরা। ওদিকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। আর এত কান্নাকাটির কী আছে। কালকেই তো আবার ফিরনি আসবে।”
মামী এসে প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে বললেন,
-” আচ্ছা, এবার থামো। আর দেরি করো না। মুরুব্বীরা তাড়া দিচ্ছেন।”

বাড়ির খানিকটা আগ থেকে রাস্তার দুইধার সজ্জিত করা। দু’পাশে রঙিন আলো, ফুলের সাজ, টিপটপ পরিবেশ। টিপটপ বাতিগুলো সাজানো স্বপ্নের মতো ঝলমল করছে। মেইন ফটক রাজকীয় ভাবে সাজানো। মেইন গেইট পেরিয়ে গাড়ি নীরবদের আলোকসজ্জিত বাড়ির ঠিক সামনে থামল। গাড়িতে নীরব একটাও কথা বলেনি প্রত্যাশার সাথে। প্রত্যাশা এখনো নাক টেনে যাচ্ছে। নীরব পকেট থেকে টিস্যু বের করে বাড়িয়ে দিল। না তাকিয়ে বলল,
-” গাড়ি ঘোরাতে বলব?”
-” ম-মানে?”
-” তোমাকে রেখে আসি। তুমি তো আর নিজ ইচ্ছায় আসতে চাওনি। জোর করে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই ভাবছি রেখে আসি।”

প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বিড়বিড় করল— শ্বশুর বাড়িতে আবার নিজ ইচ্ছায় কেউ আসে নাকি।
নীরব ভ্রুকুটি করে শুধাল,
-” কী বলো, রেখে আসব?”
প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
-” আপনার তো আর বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে হয়নি। তাই আপনি আমাদের মেয়েদের কষ্টটা বুঝবেন না। এটা শুধু মেয়েরাই জানে, হুঁ।”
বাড়িতে বড়রা ছিলেন। ছোটরাও দৌড়ে গিয়ে জড় হয়। ড্রাইভার গাড়ির গেট খুলে দিতেই নীরব নামতে নেয়। শর্মিলা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-” এই নীরব একটু বস। একসাথে নামতে হবে। দাঁড়া ভাবী আসছে, মিষ্টি মুখ করাতে হবে আগে।”
নীরব বিরক্ত স্বরে বলল,

-” এত রিচুয়াল।”
শর্মিলা একগাল হেসে বললেন,
-” তুই বিরক্ত হোস জন্য তো অনেক রিচুয়ালই বাদ দেয়া হয়েছে। এটুকু কোনো ব্যাপার না।”
নীহারিকা এগিয়ে আসলেন। কাঁটা চামচে এক টুকরো মিষ্টি তুলে ছেলের সামনে ধরলেন,
-” হা কর বাবা।”
নীরব মুখে নিতেই পরপর প্রত্যাশার দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা নাও।”
প্রত্যাশা অল্প করে একটু নেয়। নীহারিকা আরেকটু সাধতেই প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। নীহারিকা প্রত্যাশার হাতে সালামি দিয়ে নরম গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা মা, এ বাড়িটা তোমারও বাড়ি। যেদিন থেকে আমার নীরবের বউ হয়েছো, সেদিন থেকেই এ বাড়ির সম্মান তুমি। তোমার সাথে আমার ছেলের, আমার বাড়ির মানসম্মান জড়িয়ে আছে। নিজের সম্মান, বাড়ির সম্মান কীভাবে রক্ষা করে চলতে হয় আশাকরি এতটুকু বোধবুদ্ধি নিয়ে চলবে। আমার দিন তো ফুরিয়ে আসছে, তোমরা সংসারটাকে যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। আশাকরি সময়ের সাথে সাথে সব শিখে পড়ে যাবে। শুধু মন থেকে শেখার চেষ্টাটুকু রাখবে।”
এক সেকেন্ড থেমে ফের বললেন,

-” শাশুড়ি-শ্বশুর বলে কিছু নেই, আমরা সবাই তোমার আপনজন। তবে একটা কথা মনে রেখো, সংসার মানেই মান-অভিমান, টানাপোড়েন। এসব কিছু থাকবেই। সবকিছু বুদ্ধি আর ধৈর্য দিয়ে সামলাতে হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, সুখে থেকো, আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে সুখে রেখো। তোমাদের জীবন অনাবিল সুখ প্রশান্তিতে ভরপুর থাকুক।”
দৃষ্টি নুইয়ে প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন চুপচাপ সবটা শুনল।‌ আরো দুএকজন মিষ্টি মুখ করানোর পর বর-বউ একসাথে ভেতরে ঢোকে। দুইপাশ থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে ওয়েলকাম জানানো হয়।

চারিদিকে লোকজনের কোলাহলে প্রীতির বিরক্ত লাগছিল। ও রুমে যাচ্ছিল এমন সময় আবির সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে কস টেপ আর কাঁচি। ব্যস্ত স্বরে বলল,
-” এইযে মেঝো ভাবী, তোমাকেই খুঁজছি?”
প্রীতি কিছুটা অবাক স্বরে বলল,
-” আমাকে? কিন্তু কেনো?”
-” ছোট দাদানের রুমে চলো। একটু হেল্প লাগবে। এখনো বাসরঘর সাজানো কমপ্লিট হয়নি। এদিকে নতুন ভাবি ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ছোট দাদান রাগ করছে, ভাবি ফ্রেশ হবে। দ্রুত রুম ছাড়তে বলছে আমাদের। তুমি একটু হাতে হাতে সাহায্য করবে?”
সেকেন্ডের মধ্যেই প্রীতির মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁলো।‌ রাগে হিসহিস করল। তবে বাইরে প্রকাশ না করে স্রেফ বলে দিল,

-” আমার কাজ আছে, আমি পারব না।”
আবির নাছোড়বান্দার মতো বলে,
-” আরে তোমারই তো দেবরের বাসরঘর, তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। যাও বেশি কিছু না তুমি অনেক লম্বা আছো, শুধু অর্কিডগুলো দেয়ালে সেট করে দিবে।”
প্রীতি কাটকাট গলায় বলল,
-” আমার মাথা ধরেছে। আই নিড রেস্ট। নীলাশাকে ডেকে নাও।”
নীহারিকা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে গিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,

-” নীলাশা এ বাড়ির বড় বউ। বয়সে তোমার ছোট হলেও সম্মানে বড়। আশাকরি এরপর থেকে সেভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।”
শর্মিলা হাসি মুখে বলল,
-” প্রীতি যাও না, নীলাশাও যাচ্ছে। দেবরের বিয়েতে ভাবিরা এসব ব্যাপারে একটু কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক।”
প্রীতির ফর্সা মুখে অমাবস্যা নামল। উপায়ান্তর না পেয়ে অগত্যা গেল।

শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতে ব্যস্ত হয়ে নীরব ড্রয়িংরুম দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল। প্রত্যাশা ড্রয়িংরুমে বসে, পাশে জয়নব আরাও আছেন। এতক্ষণ আত্মীয়-স্বজন বউকে ঘিরে রেখেছিল। এবারে অবশ্য একটু ভিড় কমেছে। বুড়িটার কথায় প্রত্যাশা খুব বি’র’ক্ত হচ্ছে। নীরবকে দেখে প্রত্যাশা তড়িঘড়ি ডেকে উঠল,
-” নীরব?”
নীরব সাথে সাথেই ফিরে তাকিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে ইশারায় প্রত্যুত্তর দেয়। প্রত্যাশা উঠে দাঁড়ালো, সাথে গায়ের গহনা শাড়ির শব্দ ঝনঝন করে উঠল। হাতের ফোনটা বাড়িয়ে বলল,
-” আপনার ফোন। কেউ বোধহয় কল দিচ্ছে।”
নীরব ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” ওহ্। কথা বলেছো?”

ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দেয় প্রত্যাশা। শফিক সাহেব খানিকক্ষণ আগে নীরবের নম্বরে কল দিয়েছিলেন। নীরব কথা বলে প্রত্যাশার কাছে দেয়। নীরব যেতেই পাশে বসা আবিরের নানু মুখ কালো করে বলে উঠলেন,
-” এই মাইয়া জানো না কিছু? স্বামীর নাম মুখে নেওয়া লাগে না। আমরা এতকাল সংসার করেছি, চুলে পাক ধরেছে তাও কোনোদিন ভুলেও স্বামীর নাম মুখে আনি নাই। আর এইটুকু বাচ্চা মাইয়া হইয়া একদিনেই স্বামীরে নাম ধরে ডাকো।”
মান্ধাতার আমলের চিন্তা ধারার মানুষ জয়নব আরা। বৃদ্ধার কথায় প্রত্যাশার বদনখানি বিরক্তিতে ঠাসা হলো। বিড়বিড় করল,

-” আরেব্বাস…. এই তো একটু আগেই ফিসফিস করে নীরবের বাচ্চার মা হওয়ার ট্রিপস দিচ্ছিল। দ্রুত বাচ্চা নেয়ার পরামর্শ ফ্রিতে দিচ্ছিল। তখন আমাকে বাচ্চা মেয়েটি মনে হয়নি? এখন বরের নাম ধরে ডাকাতে ঠিকই বাচ্চা মেয়েটি মনে হলো। উফ্! যত্তসব!”
মুখে বলল প্রত্যাশা,
-” ও খেয়াল ছিলো না। দুঃখিত নানু।”
প্রীতির অসহ্য ঠেকছিলো। ও রুম থেকে বেরোনোর ফাঁকফোকর খুঁজছিলো। চালাকি করে অফিশিয়াল জরুরী কল এসেছে বলে বেরিয়ে আসে।

জানালার সাদা পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো জানালার ফাঁক গলে রুমে ঠিকরে পড়ছে। রুম জুড়ে তাজা ফুলের ঘ্রাণ ম-ম করছে। বিছানার চারপাশ জুড়ে তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধার গন্ধ ছড়িয়ে। বেডের মাঝখানে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ আঁকা। দেয়ালে ঝুলছে অর্কিডের তোড়া। চতুর্দিকে রাখা সুগন্ধি ক্যান্ডেলগুলো রুমের সৌন্দর্য কগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রত্যাশা বেডের একপাশে চুপচাপ বসে। গায়ে গোলাপি রঙের সিল্কের সফট শাড়ি। ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো এতক্ষণে শুকেছে প্রায়। শাওয়ার নিয়ে সবার সাথে অল্প কিছু খেয়েছে। তখন রুমে ঢুকতে আবির আর এক কাজিন নীরবের থেকে বাসর সাজানোর বখশিস দশ হাজার নিয়েছে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। ডিনার টেবিলে নীরবের সাথে দেখা হয়েছিল এরমধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। উনি নাকি বাইরে ফ্রেন্ডদের সাথে আছেন। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই মেসেঞ্জারে মেসেজ নোটিফিকেশন এল। গ্রুপে ঢুকতেই ফ্রেন্ডদের মেসেজে সয়লাব। প্রত্যাশাকে দেখেই হ্যাপি মেসেজ পাঠাল,
-” oi tui online a ki korchis?”
কোয়েল সেখানে হা হা দিলো। ফাজলামি করে গানের লাইন লিখলো,
-” আমার বুক কাঁপে যে দুরুদুরু মনে লাগে ভ’য়, জানি না তো আজ নিশিতে কী জানি কী হয়!”
রোহান সেখানে রিপ্লাই দেয়,

-” আমার ইচ্ছে করে ময়ূরপঙ্খি নায়ে চড়িয়া, তোমায় নিয়ে প্রেম যমুনায় যাব ভাসিয়া, আমি যাব ভাসিয়া ঘরের বাত্তি নিভাইয়া।”
হ্যাপি আঙরি রিয়েকট দিয়ে লিখলো,
-” fazil dui ta. Ak lathi diye grp theke ber kore dibo. Ai duitar Jonno poribesh nosto.”
নাহিদ লিখলো,
-” মামু এভাবেই চলবে কী তবে? ওদের হয়েছে কবে আমাদেরও হবে।”
আবার মেসেজ দিল নাহিদ,

-” শা”লার মিঙ্গেলদের মাঝে নিজেকে একেবারে এতিম এতিম লাগছে।”
ওদিকে প্রত্যাশা নীরবদর্শক হয়ে এদের মেসেজ দেখে যাচ্ছে। নাহিদ এবার একটু অবাক হওয়ার ইমুজির সাথে লিখলো,
-” অ্যাই তুই বাসর ঘরে না থেকে অনলাইনে কী করছিস?”
প্রত্যাশা লিখলো,
-” mosquito martichi.”
কোয়েল লিখলো,
-” তোর বরকে বিড়াল মা*রতে বলিস।”

প্রত্যাশা চট করে এক কাজ করে বসল। ফট করে গ্রুপ থেকে লিভ নেয়। আগামী এক সপ্তাহ আর গ্রুপে জয়েনটয়েন হবে না। ওরা সবকটা যা ফা’জি’ল। লজ্জা দিয়ে মে*রে ফেলবে।
দরজা ঠেলে নীরব রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় একপল তাকায়। প্রত্যাশা শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচাচ্ছে তো খুলছে। কোনোকিছু না বলে সরাসরি নীরব ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোয়। পরনে নেভি ব্লু টিশার্ট আর অফ হোয়াইট ট্রাউজার। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে শুধাল,
-” মন খা’রাপ?”
মাথা নাড়িয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” উঁহু।”
.
.
নীহারিকা, শর্মিলা টেবিল গুছিয়ে রাখছে। নীলাও হাতে হাতে সাহায্য করছে। জগ থেকে ওয়াটার বোতলে পানি ঢালছিলো প্রীতি। এরমধ্যে জয়নব আরা এগিয়ে এসে বললেন,
-” এই যে মেজো নাতবউ? এদিকে আয়ো।”
প্রীতি কাছে আসতেই বৃদ্ধা ফিসফিসিয়ে বললেন,
-” শোনো তোমারে বলি, বড় নাতবউ তো আবার নতুন বউয়ের বোন হয়। সে কেমনে এসব ব্যাপারে থাকবো। তাই তোমারেই বলতাছি, এইযে দুধের গ্লাসটা একটু দিয়া আইসো। আর শোনো, নতুন বউটা নাদান, বাচ্চা মাইয়া। হেতিরে একটু সবকিছু বুঝাইয়া দিও। তুমি জাও মানুষ। এগুলান তো তোমার দায়িত্ব।”

প্রীতির মেজাজের পারদ আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে যাওয়ার অবস্থা। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে টিপিক্যাল বউদের মতো রসিকতার ছলে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে,
-” আরে নানু এত টেনশন করবেন না তো। আমাদেরকে কিছু শিখিয়ে দিতে হবে না। যার বউ সেইই শিখিয়ে পড়িয়ে নিবে।”
পরপর দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইয়ে নানু, ইচ্ছে রুমে একলা আছে। ও ভ’য় পাবে। আমি রুমে যাচ্ছি। দুধটা পরী দিয়ে আসুক। কী হলো পরী দুধটা তুমি গিয়ে দিয়ে আসো।”
এই বলে প্রীতি কে*টে পরে।

পরী দুধের গ্লাস আর ফলের প্লেট প্রত্যাশার হাতে দিয়ে চলে যায়। প্রত্যাশা দরজা লক করে হাতের ট্রে বেড টেবিলে রাখে। নীরব তোয়ালে ব্যালকনিতে রেখে রুমে পা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” কে এসেছিল?”
প্রত্যাশা দেখিয়ে বলল,
-” পরী এসেছিল। নানু বলেছেন দুধটা আপনাকে দিতে।”
-” ওটা তুমি খাও। আমার থেকেও তোমার জন্য বেশি জরুরী।”
মুখ লটকে ‘না’ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল প্রত্যাশা। নীরব একটা গোলাপ হাতে নিয়ে পাপড়িগুলো একটা একটা করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,

-” ফার্স্ট নাইটে কী গিফট করতে হয়, আই হেভ নো আইডিয়া। অনেক ভেবেও কী গিফট করব ভেবে পাইনি। তাই অবশেষে ভাবলাম গিফটটা তোমার উপর ছেড়ে দিই। এবার বলো, কী গিফট চাও?”
-” যা চাইব তাই দিবেন?”
-” অফকোর্স! আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, সেটা তোমাকে দেয়ার।”
-” গিফটটা তোলা থাক। পরে পাছে কখনো চেয়ে নিবো।”
ফুলের পাপড়ি গুলো প্রত্যাশার মাথার উপর ছেড়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল নীরব,
-” ওকে, শুধু মনে করে চেয়ে নিয়ো।”
প্রত্যাশার চুলের ভাঁজে ভাঁজে লাল গোলাপের পাপড়ি বেঁধে থাকল। মুখের উপর পড়তেই নীরব ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল। বলল,

-” আজ পূর্ণিমা। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, তোমার পরীক্ষা শেষ হতেই একটু তাড়াহুড়ো করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার কারন আজকের ডেট। ক্যালেন্ডারে দেখলাম আজকের তারিখটায় পূর্ণিমা। আকাশের পূর্ণ চাঁদকে সাক্ষী রেখে আমার জীবনের চাঁদের সাথে প্রথম মূহুর্ত কাটাবো, এটা আমার শখ ছিলো। শখটা উপরওয়ালার মেহেরবাণীতে পূরন হয়ে যাচ্ছে।”
নীরব উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। প্রত্যাশা ঝটপট পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল
-” আগে বলেননি কেনো?”
নীরব পেছন থেকে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল,
-” এখন তো শুনলে।”
আকাশে থালার মতো চাঁদটা রুপোলি আলো ঠিকরে দিচ্ছে। মূহুর্তটাকে আরো আবেশিত করে তুলছে। নীরবের গরম নিঃশ্বাস প্রত্যাশার ঘাড়ে আঁছড়ে পড়ছে। প্রত্যাশার শরীর কেঁপে উঠল। নীরবের হাত প্রত্যাশার শাড়ির আঁচল গলে পেট ছুঁয়েছে। প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

-” নী-নীরব..”
প্রত্যাশাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় নীরব। প্রত্যাশার ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল রেখে হাস্কি স্বরে বলল,
-” চুপ…সে নাথিং। জাস্ট ফিল মি।”
প্রত্যাশার চোখ বুঁজে আসার যোগাড়। কপালে চুমু এঁকে বলল কোমল স্বরে নীরব,
-” দিস মোমেন্ট, জাস্ট আস।”
নীরবের আবেশ প্রত্যাশার আকস্মিক প্রশ্নে যেনো হালকা হলো। প্রত্যাশা নিভু নিভু দৃষ্টিজোড়া অদূরে রাখে। আকস্মিক প্রশ্ন করে উঠে,
-” নীরব, হাউ মাচ ডু ইউ লাভ মি?”
নীরব আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদের দিকে একপল চাইল। পরপর মুগ্ধ চোখে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে সম্মোহিত কণ্ঠে বলল,

-” ইফ দ্য ফুল মুন এভার আস্কড্ মি হু আই লাভ মোর হার অর ইউ? আই’ড স্মাইল অ্যান্ড সে, ‘ইউ… বিকজ ইভেন দ্য মুন ফেডস হুয়েন ইউ আর অ্যারাউন্ড।”
প্রত্যাশার ভেতর একটা শীতল শান্ত প্রশান্তির স্রোত বইয়ে গেল। দু’জনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রত্যাশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরো বলল নীরব,
-” আই লাভ ইউ সো মাচ।”
নীরবের বুকে মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজে অস্ফুটে বলল প্রত্যাশা,
-” আই লাভ ইউ সো মাচ ঠু।”
নীরব কিছুক্ষণ প্রত্যাশাকে বুকের ভেতর ধরে রাখল। তারপর ছেড়ে কাবার্ডের উপর রাখা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে সামনে ধরল। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,
-” উম! বাসর রাতে কিছু তো একটা গিফট দিতে হয়। সেই হিসেবে এটা। তবে তোমার পছন্দ মতো, তোমার চাওয়া অনুযায়ী গিফটটাও পাওনা রইল।”
একটা সূক্ষ্ম নকশার বিছা প্রত্যাশার সামনে জ্বলজ্বল করছে। প্রত্যাশা হেসে ফেলল। বলল,

-” এইরে আমি তো কোনো গিফট আনিনি।”
প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে বলে নীরব,
-” আস্ত তুমিটাই তো আমার। এরচেয়ে বড় গিফট আর কিছু হয় নাকি।”
একহাতে শাড়ির আঁচল সরিয়ে বিছাটা যত্ন সহকারে পড়িয়ে দেয় নীরব। আঙুলের স্পর্শে প্রত্যাশার শরীর শিরশির করে উঠছে। পড়ানো শেষে নীরব অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। প্রত্যাশার কোমড় দুই হাতে শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টানল। পেটে মুখ ডুবিয়ে নরম এক চুমু আঁকে। প্রত্যাশার নিঃশ্বাস বুকে আঁটকে আসলো। আঙুল ছুটে গেল নীরবের চুলের ভাঁজে। খিচে চোখ বুঁজে নেয় প্রত্যাশা। নীরব এক ঝটকায় বউকে কোলে তুলে নিয়ে আলগোছে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

জানালার পর্দা টেনে আলো নিভিয়ে দেয় নীরব। ক্যান্ডেলের মৃদু আলো জ্বলছে। সেই আলোয় লজ্জায় লাল হওয়া প্রত্যাশাকে মোহনীয় লাগছে। নীরবের নিঃশ্বাস বেপরোয়া ছুটছে। প্রত্যাশার উপর ভার ছেড়ে চোখে চোখ রেখে গম্ভীর কোমল স্বরে বলল নীরব,
-” বিয়ে শুধু একটা পবিত্র বাঁধনই নয়। বিয়ে হলো দুইটা হৃদয়ের একসাথে চলার অঙ্গিকার। দায়িত্ব, বিশ্বাস, সেক্রিফাইস আর ভালোবাসা দিয়ে যে বাঁধন গড়ে ওঠে, সেটা কখনো ভাঙে না, অটুট থেকে যায়। আমি চাই, আমাদের তেমনই দৃঢ়, অম্লান বাঁধন হোক।”
গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণ প্রত্যাশার চোখেমুখে পড়ছে। প্রত্যাশার বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। কথারা আজ যেন খেই হারিয়েছে। কিছুই বলতে পারছে না। নীরব প্রত্যাশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪০

-” তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। আজ থেকে আমি প্রতিদিন তোমাকে নতুন করে চাইবো, নতুন করে ভালোবাসবো। পৃথিবী বদলালেও, সময় বদলালেও আমি বদলাবো না। তুমি থাকবে আমার প্রথম আর শেষ ঠিকানা হয়ে। ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখব তোমাকে। প্রত্যাশা, মে আই?”
প্রত্যাশা মুখে কিছুই বলতে পারল না। অনুভূতিতে টালমাটাল প্রত্যাশা নীরবতাকে বেছে নিল। আপনাআপনি প্রত্যাশার হাত দু’টো নীরবের টিশার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। আরেকটু কাছে টানল। বউয়ের নীরব অনুমতি পেতেই নীরব চূড়ান্ত বেসামাল হয়।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪২