দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথদের গাড়ি পৌঁছালো সবার পরে। ওরা দুজন বাড়ি যেয়ে দেখে সবাই ইতিমধ্যে পৌঁছে বর-কনেকে স্বাগতম জানাতে প্রস্তুত! নিশীথ দোলাকে সোফায় বসিয়ে সবার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। রাত হয়ে যাওয়ায় দাদু ঘুমোতে চলে গেলো। বাকি বড়রাও যে যার মতো উঠে গেলো। এখন শুধু নিশীথের কাজিনরা বসে আছে। এরই মাঝে নিশীথের রুম থেকে ওর বন্ধুরা বেরিয়ে এলো। আকাশ, কবির,তূর্য এসেই নিশীথের দিক তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

বুঝাই যাচ্ছে, ওরা তিনটে মিলেই নিশীথের বাসরঘর সাজিয়েছে। একিসাথে চাপাস্বরে ফিসফিসিয়ে নিশীথকে কিছু একটা বলে ওরা হাসা শুরু করলো। নিশীথ প্রথমে রাগার ভান করে ওদের মারলেও পরক্ষণে ওদের সাথে হাসতে আরম্ভ করলো। ছেলেগুলোর অঙ্গভঙ্গি, চাপা কথার গুঞ্জনে একিসাথে নিশীথের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখায় দোলার বুঝতে বাকি রইলোনা ওরা কি নিয়ে হাসাহাসি করছে! ফলে, লজ্জায়-অস্বস্তিতে ও আরও জড়সড় হলো। এরই মাঝে নিশীথের কাজিন বোনেরা এসে দোলাকে নিশীথের রুমে নিয়ে গেলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঢিপঢিপ হৃদয়ে ফুলসজ্জিত বিছানায় বসে আছে দোলা। নিশীথ কতক্ষণে রুমের ভেতর ঢুকতে পারবে কে জানে? বাইরে ওর কাজিনরা আর বন্ধুরা মিলে যে দর কষাকষি করছে ওর সাথে, ওদের হইহুল্লোড়ে সারাদিনে ক্লান্ত দোলার মাথা ধরে গেলো! মন চাইলো সব ভারী পোশাক-গহনা খুলে এক্ষুনি সাধারণ জামা পড়তে কিন্তু চাইলেই তো আর সব করা যায়না। তাই ধৈর্যের সঙ্গে বসেই নিশীথের প্রতিক্ষা করলো। একিসাথে দোলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, আজ যে করেই হোক না কেন- নিশীথের থেকে সবকিছুর জবাব নিবে। কেন সে ইংগেজমেন্টের আগে সেদিন ওর সাথে ওমন আচরণ করেছিলো!

কেনই বা ওকে বিয়ে করবেনা বলে ওসব নাটক করছিলো! দোলার মনে পুরনো কথার স্মৃতিচারণ হয়। সেদিন বিকেলে নিশীথের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই নিজের অজান্তে চক্ষুদ্বয় ভরে উঠে জলে। ঠিক সে সময় কাজিনদের পাওনা মিটিয়ে নিশীথ ঘরে ঢুকে। দোলা চোখের পানি মুছতে যেয়ে নিশীথকে দেখে জমে গেলো। নিশীথ কিছু না বলে নীরবে খাটে বসা দোলার দিক এগিয়ে আসতেই মেয়েটা নড়েচড়ে বসলো। নিশীথ এসে পাশে বসে ধীরহাতে ওর ঘোমটা খুলতেই দোলা মাথা আরও নিচু করে গলার সাথে লাগিয়ে ফেললো। নিশীথ ডানহাতে ওর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলতেই দোলার চোখে পানি দেখে অবাক হলো। বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,

—এখনো কাদছো কেন, দোলনচাঁপা? কিছু হয়েছে কি? নাকি শরীর খারাপ লাগছে?
নিশীথের চিন্তায় মনে মনে দোলার একটু ভালো লাগলেও ও নিজেকে নরম হতে দিলোনা। বরং, কোনো উত্তর না দিয়ে ঝট করে নিজের উপর থেকে নিশীথের হাত সরিয়ে দিলো। নিশীথ চমকে গেলো। দোলা চুপচাপ উঠে ড্রেসিংটেবিলের সামনে যেয়ে একমনে নিজের পরিহিত গহনা খুলতে আরম্ভ করলো। নিশীথ কতক্ষণ বোকার মতো সেদিক চেয়ে রইলো। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই ওর চেয়ে থাকা মুগ্ধতায় পরিণত হলো। ওর মনে এলো, আজ থেকে দোলনচাঁপা ওর বউ। ওর রুমে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে বধূরুপে নিজের গহনা খুলছে, মেয়েটাকে দেখতে কতটা মায়াময়ী লাগছে তা কি সে জানে? দোলা না জানলেও নিশীথ জানে! তাইতো সে আর নিজের জায়গায় বসে থাকতে পারলোনা। দ্রুত উঠে দোলার কাছে হেটে গেলো। ততক্ষণে দোলা চুড়িগুলো সব খুলে ফেলেছে প্রায়। গলার মালা খুলবে সে মুহুর্তে নিশীথ ওকে বাধা দিলো।

—আপনার করার দরকার নেই। আমি একাই পারবো!
—দরকার আছে কিনা সেটা আমাকেই বুঝতে দাও!
দোলা হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই নিশীথ হাত ধরে ফেললো। ও আয়নায় তাকাতেই নিশীথের গভীর চাহনি দেখে বেশ খানিকটা কাবু হলো। বাধা দেবার শক্তি হারালো৷ ওকে থামতে দেখে নিশীথ নিজের মতো করে সব করলো। একে একে গলার মালা থেকে শুরু করে দোলার মাথার আঁচলসহ যাবতীয় সব ভারী জিনিস খুলতে সাহায্য করলো। গহনা ও আঁচলের ভার কমাতে দোলা অনেকটাই স্বস্তি পেলো। নিশীথ কিছু বলতে যাবে এর আগেই লাগেজ থেকে সুতি শাড়ি বের করে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বললো,

—ওয়াশরুম কোনদিকে?
নিশীথ কোনদিকে দেখিয়ে দিলো। দোলা তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। নিশীথ সেদিকে চেয়ে ভাবলো, দোলা কি এখনো ওর উপর রাগ করে আছে? নয়তো এমন বিহেভ করছে কেন? রুমে ঢোকার পর থেকে একটা কথাও বললোনা ওর সাথে। এরকম তো করার কথা না! দোলার মান কিভাবে ভাঙানো যায় এ ব্যাপারে নিশীথ ভাবতে লাগলো! প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগিয়ে দোলা গোসল করে বের হয়ে দেখলো, নিশীথ রুমে নেই। মেয়েটা অবাক হয়ে এদিক-ওদিক চাইলো৷ নিশীথকে না পেয়ে তোয়ালা দিয়ে মাথা ঝেড়ে বারান্দায় মেলে দিতে গেলো। বারান্দা থেকে বেরোতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে চট করে নিশীথ ওকে ধরে ফেললো। দোলা ভীত স্বরে শুধালো,

—কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
—তুমি বের হতে সময় নিচ্ছিলে তাই ভাবলাম আমিও ততক্ষণে অন্য বাথরুমে গিয়ে গোসল করে আসি। তাই বাইরে গিয়েছিলাম।
—ওহ!
নিজের কোমড়ে জড়িয়ে ধরে থাকা নিশীথের হাত সরাতে সরাতে দোলা জবাব দিলো। নিশীথ তো হাত ছাড়লোইনা উলটো আরও জোরে চেপে ওকে ধরে বললো,

—কেন? আমায় রুমে না দেখে ভয় পেয়েছিলে বুঝি?
—ভয় পাবো কেন? আজব!
—না মানে, বিয়ের রাতে জামাই পালিয়ে গেছে ভেবে যদি ভয় পাও!
নিশীথ মজা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এ মুহুর্তে এমন বিশ্রী মজা দোলার মোটেও পছন্দ হলোনা। বরং ও তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠলো। বললো,
—পালানো তো আমার উচিত। যে বলেছে তার সাথে আমার স্ট্যাটাস মিলেনা, আমি তার যোগ্য না এমন লোকের সাথে থাকার কোনো মানে আছে?
দোলার ঝাঝালো কথায় ওর কোমড়ে আবদ্ধ নিশীথের দৃঢ় বন্ধন শিথিল হয়ে এলো। চাপা ধম’কে রুষ্ট হয়ে বললো,

—দোলনচাঁপা! এখন কি এগুলো কথা বলার সময়?
—তো কখন সময়, নিশীথ? আপনিই বলুন। সবকিছু যখন আপনার ইচ্ছাতেই হয় তখন আপনিই বলে দিন কখন সময় হবে এসব কথা বলার?

—বাপরে! একটু থামো তো। এত রাগ পুষে রেখেছো আমার উপর?
নিশীথ আদুরে স্বরে দোলাকে থামানোর চেষ্টা করলো। দোলা এবারও শান্ত হলোনা। ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠায় নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠলো। তা খেয়াল করে নিশীথ হুট করেই ওর নাকের ডগায় চুমু খেলো। বিষয়টি এত দ্রুত ঘটলো যে দোলা থতমত খেয়ে গেলো। দোলা তাকালেও নিশীথ থামলোনা। একে একে দুই গালে ও পরক্ষণে ওর কপালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো। দোলা বুঝলো এসব কোনদিকে যাচ্ছে। কিন্তু আগে ওর নিশীথের কাছে জবাব চাই। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিশীথকে থামানোর চেষ্টা করে বললো,

—আজকে সবার আগে আপনার কাছে আমি জবাব চাই, নিশীথ। কেন করেছিলেন সেদিন আমার সাথে ওমন? আর কেন-ই বা ওভাবে ইনসাল্ট করেছিলেন? জবাব দেন প্লিজ!
দোলার নাছোড়বান্দা আচরণে নিশীথ ক্ষ্যান্ত হয়! নিজেকে এতক্ষণ শান্ত রাখলেও এবার ধৈর্যহারা হয়ে যায়। দোলার বাহু চেপে ধরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
—এতকিছু বলার পেছনে কারণ হলো, একটা ছোট্ট পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। বুঝেছো?
—কিসের পরীক্ষা?

দোলার কণ্ঠে বিস্ময়। নিশীথ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। কণ্ঠে বিষাদের ছাপ লাগিয়ে বলে,
—আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার দোলনচাঁপা আমাকে হারানোর ভয়ে কি করতে পারে! আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমিও আমার প্রতি ততটাই ব্যাকুল কিনা, যতটা আমি তোমার জন্য ব্যাকুল থাকি! আমি অনুভব করতে চেয়েছিলাম আমার প্রতি তোমার পাগলামি যেমনটা আমি তোমার প্রতি করে থাকি…
নিশীথ থামে। দম নিয়ে মুহুর্তে গর্জে উঠে বলে,

—কিন্তু বিনিময়ে আমি কি পেয়েছি জানো? এক সমুদ্র হতাশা! ট্রাস্ট মি, দোলনচাঁপা। আমার প্রতি তোমার উদাসীনতা আমায় ভীষণ কষ্ট দিয়েছে এবার! কিভাবে পারলে তুমি আমার ব্যাপারে না জেনেও বিয়েতে রাজি হতে? অন্য কাউকে বিয়ে করতে একটুও দ্বিধাবোধ হলোনা তোমার? নাকি আমার প্রতি তোমার অনুভূতি এতটাই ঠুনকো যে তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্য কারও হতে দিতে…

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৬

—নিশীথ!
দোলা রে’গে নিশীথের মুখ চেপে ধরে ডানহাতে। অনেক বলে ফেলেছে ছেলেটা। একে আজ থামাতে হবে। নয়তো বিষয়টা ওদের দুজনের সহনশীলতার বাহিরে পৌঁছে যাবে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭(২)