আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৮
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। সবার এত অপমান, এত গঞ্জনা তার মনকে বিষিয়ে তুলেছে। নানা খারাপ চিন্তা মাথায় আসছে কিন্তু ঈশিতা নিজেকে সামলে রাখলো। জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,”আমায় এখন কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলে চলবেনা। আগে সবার সামনে এটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে হবে যে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তারপর কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।”
ঈশিতা আয়ুশের দেখানো সমস্ত ভিডিওর কথা ভাবতে লাগলো। ঈশিতা খেয়াল করেছে আয়ুশ ফেসবুকে মেসেঞ্জারে এই ভিডিও এবং ছবি গুলো দেখাচ্ছিল। আর এই সব টিনার আইডি থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে। ঈশিতা বোকা বনে গেল। এতক্ষণ তো এই কথাটা মাথাতেই আসে নি।
“টিনা আমার সাথে এমন কেন করল? ওর সাথে তো আমার কোন শত্রুতা নেই!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঈশিতা কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সেদিন যে তারা নাটক করেছে এই তথ্য তো টিনার মা-বাবা জানে। ঈশিতাকে তো টিনার মা-বাবা ভীষণ আপন করে নিয়েছে। একদম নিজের মেয়ের মতোই দেখেছেন। তারা নিশ্চয়ই সব জানলে ঈশিতার পক্ষেই কথা বলবে। টিনার সব চক্রান্ত তখন ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাঝে ঈশিতার মনে এই চিন্তা এলো যে টিনা কেন তার কোন ক্ষতি করতে যাবে। তার সাথে তো ঈশিতার কোন পার্সোনাল শত্রুতা নেই। বরঞ্চ তাদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক ছিল। হিসাব গুলো কেন জানি মিলতে চাইছে না। কি স্বার্থ থাকতে পারে টিনার এসব করার পেছনে? ঈশিতা ভেবে পেলো না। তবে তার হাতে এখন এত কিছু ভাবার সময়ও নেই৷ আপাতাত তাকে সবার সামনে নিজের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ পেশ করতে হবে। তারপর বাকি কিছু।
আয়ুশ সোফায় একদম মন খারাপ করে বসে আছে। জাহানারা বেগম আয়ুশের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”আমি বুঝতে পারছি তোর মধ্যে দিয়ে এখন কি বয়ে যাচ্ছে। তোর মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি আয়ুশ। আমি নিজেও ভাবতে পারিনি ঈশিতা এমন একটা কাজ করবে এভাবে তোকে ধোকা দেবে।”
“প্লিজ মা, এসব আর বলো না। আমার আর এসব শুনতে ভালো লাগছে না।”
“তোকে শুনতে হবে আমার কথা। দেখ বাবা, ঈশিতাকে তুই যথেষ্ট সময় দিয়েছিস। এই পাঁচ বছর তোকে অপেক্ষা করানোর পর এখন ও এইসব ধোকাবাজি উপহার দিচ্ছে। এটা আমি মানতে পারছি না৷ ৭২ ঘন্টা পর যদি ও নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে না পারে তাহলে কিন্তু তুই ওর উপর একটুও দয়া দেখাবি না। ওকে তোর জীবন থেকে আর এই বাড়ি থেকে একদম দূর করে দিবি।”
আয়ুশ মাথা নাড়িয়ে বলে,”আমি এমনই করবো মা। ওকে অনেক সুযোগ দিয়েছি। ৫ বছর ওর জন্য অপেক্ষা করে নিজের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি কিন্তু আর না। এবার আমি সবকিছুর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। আমায় একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হবে।”
ঈশিতা টিনার বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। ঈশিতা যারপরনাই হতাশ। একটা সারাদিন দিন তার এসব চেষ্টাতেই কেটে গেল। কিন্তু এর কোন সুফল এলো না। ঈশিতার হাতে আর সময় মাত্র দুই দিন। এই দুদিনের মাঝে তাকে নিজের নিরপরাধ হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে। নাহলে হয়তো আয়ুশ কোন বড় ডিশিসন নিয়ে নিবে, যা অবশ্যই তার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
ঈশিতা বুঝতে পারছে আজ যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এর পেছনে তার নিজেরও অনেক দায় আছে। বিয়ের পর থেকে আয়ুশ তার সাথে স্বাভাবিক হতে চাইলেও সে নিজের জেদ বজায় রেখেছে। তাছাড়া যেভাবে সে তামিমের কাছে সবসময় সাহায্য নিয়েছে সেটাও আয়ুশের খারাপ লাগতে পারে। তার উপর ঈশিতার লেখা ডায়েরি যেটা আয়ুশ পেয়েছে। এসব ঘটনার পর যেকোন পুরুষই সন্দেহ করবে এটাই স্বাভাবিক।
আয়ুশ নিজের যায়গা থেকে একদম ঠিক আছে। ভুল শুরু থেকে ঈশিতারই। কিন্তু ঈশিতা এতদিন নিজের ভুল গুলো উপলব্ধি না করে বরং এড়িয়ে গেছিল। ভীষণ স্বার্থপরতা করেছে সব ক্ষেত্রে যার ফলে আজ এমন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও না কোথাও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে তারই দায় আছে। এসব জন্যই ঈশিতা আয়ুশের উপর পুরোপুরি রাগ করছে না বা তাকে ভুলও বুঝছে না। ঈশিতা জানে এখন যদি সে আবার নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারে যদি আয়ুশকে এটা বোঝাতে পারে যে তার সাথে তামিমের এমন কোন সম্পর্ক নেই তাহলে আয়ুশ নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার ঈশিতাকে কাছে টেনে নেবে। এই জন্য ঈশিতা আশায় বুক বেধে আছে।
এসব কিছুর পর হয় তো তাদের দুজনের ভীষণ সুখের সংসার হবে।
আয়ুশ ঈশিতার মুখোমুখি। মুখোমুখি হয়েই বলে,”এখনো অব্দি কোন প্রমাণ জোগাড় হলো?”
ঈশিতা দুপাশে মাথা ঝাকিয়ে বলে,”না।”
“আর কিন্তু মাত্র ২ দিন। এর মাঝে যদি কোন প্রমাণ না দিতে পারো তাহলে কিন্তু আমি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো।”
“কঠোর সিদ্ধান্ত?”
“হ্যাঁ, কঠোর সিদ্ধান্ত। জানো, তোমার দিকে তাকাতেও আমার ইচ্ছা করছে না। শরিয়া আইন মোতাবেক তো তোমায় পা*থর নিক্ষেপ করে মা*রা উচিৎ, কত বড় স্পর্ধা তোমার বিয়ের পর পরপুরুষের সাথে রঙ্গ তামাশা করো।”
“আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। সবটা জানার পর অনেক আফসোস করবেন দেখে দিয়েন।”
“আই উইশ..যেন আমায় আফসোস করতে হয়। কিন্তু আপাতত সবকিছু তোমার বিরুদ্ধে। তুমি নিজের সপক্ষে এখনো কোন প্রমাণ দিতে পারো নি, তাই আমার কাছে এখনো তুমিই অপরাধী।”
ঈশিতার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। আয়ুশ আর কিছু না বলে চলে যায়। আয়ুশ চলে যাবার পর গুলশেনারা বেগম চলে আসেন সেখানে। ঈশিতাকে দেখেই কুকুর তাড়ানোর মতো করে বলতে থাকেন,”দূর হ শয়তান দূর হ।”
ঈশিতার গায়ে লাগে খুব। গুলশেনারা বেগম তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকেন,”বেলাজ, বেশরম মেয়ে মানুষ। জামাই থাকতে অন্য লাং এর সাথে ঘষাঘষি করে। আমাদের সময় হলে একে ন্যাড়া করে গাধার পিঠে চড়িয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হতো।”
ঈশিতা আর চুপ থাকতে পারে না। প্রতিবাদী সুরে বলে,”দোহাই লাগে এমন কথা বলবেন না। আমার অপরাধ এখনো প্রমাণ হয়নি।”
তখনই ঐশী সেখানে চলে আসে। এসেই ঈশিতার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ছোটবেলায় শুনেছিলাম চোরের মায়ের বড় গলা আর এখন দেখতেও পারছি। তোমার লজ্জা বলে কিছু নেই? বিয়ের পর কোথায় সংসারে মন দেবে, পর্দা করে চলবে তা না বিদেশে গিয়ে বেশরম ভাবে বেপর্দা হয়ে চললে, স্বামীর থেকে দূরে গিয়ে অন্য ছেলেদের নিজের রূপ দেখাতে লাগলে। এটা তো হবারই ছিল। ”
ঈশিতা কিছু বলতে পারল না। সবাই তাকে এভাবে ঘিরে ধরলো। একটু পর আলতাফ তালুকদার এসে বললেন,”এই পাপটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বাড়ি থেকে দূর হবে ততোই ভালো। এ থাকা মানেই আমাদের বাড়ি নাপাক হয়ে থাকা।”
সবগুলো কথা ঈশিতার বুকে ছুরির মতো বিধল। এতটাই ঝাঝালো।
২ দিন পর,
তালুকদার বাড়িতে সভা বসেছে। ঈশিতাকে তাড়ানোর সভা। আলতাফ তালুকদার আয়ুশের উদ্দেশ্যে বলেন,”ঐ মেয়েকে দেয়া ৭২ ঘন্টার আলটিমেটাম তো শেষ। এখনো ও নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারে নি। এবার কি তুমি কোন স্টেপ নিবে নাকি আমি ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করবো?”
গুলশেনারা বেগমও বললেন,”অনেক হয়েছে এবার দূর কর ঐ নাপাক মেয়েটাকে।”
জাহানারা বেগম বললেন,”সবাই ঠিক বলছে। আমরা অনেক সুযোগ দিয়েছি ওকে আর না।”
আয়ুশ সবার কথা শুনে ঈশিতার রুমে গেলো। অতঃপর ঈশিতাকে বললো,”তোমার সময় শেষ এখন বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে। যাবার আগে এই ডিভোর্স পেপারে সু করে দিও।”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৭
ঈশিতা কান্নাভেজা চোখে আয়ুশের দিকে তাকায়। ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে কাপা কাপা হাতে সই করতে যায়। আয়ুশই যখন তাকে বিশ্বাস করছে না, তাকে চায়না তখন আর এই সম্পর্ক রেখে কি হবে। ঈশিতা ডিভোর্স পেপারে সই করতে যাবে এমন সময় জাহানারা বেগম এসে তাকে থামিয়ে দেয়। ডিভোর্স পেপারটা কেড়ে নিয়ে বলে,”থামো! দেখো কে এসেছেন।”
ঈশিতা সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে,”আপনি?!”