রাগে অনুরাগে পর্ব ১৪

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৪
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

সপ্তাহ খানিক পরে মালিহার বাবার বাড়ি থেকে সকলে আসলেন। সাথে নিয়ে এলেন নানান প্রকার মিষ্টান্ন, ফলমূল আর পিঠা পায়েস। তাদের সাদরে গ্রহন করলেন বাড়ির সকলে। মা এবং দাদুকে দেখে মালিহা অবাক হয় খুব। তাদের এ বাড়িতে প্রথম আসা। মালিহা ছোট ভাইবোন দুটো তো কাছ ছাড়া হতে চায় না বোনের। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্তির ছোট্ট মেয়েটির সাথে তাদের বন্ধুত্বও হয়ে যায়। সারা বাড়ি ছুটে বেড়ায় বাচ্চাগুলো। রিপ্তি হেসে বলে, “এতদিনে বাড়িটা প্রকৃত অর্থে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাচ্চাদের হাসির শব্দ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম আওয়াজ।”
মালিহা খুশি হয়। সবাইকে একসঙ্গে দেখে খুশি ধরে না মেয়েটির।

কিচেনে রান্নার ধুম পড়ে গিয়েছে। হরেকরকম রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। একপাশে বড় ধারালো বটিতে মাছ কাঁটছেন বুয়া। মালিহার বাবা বড় সাইজের দুটি কাতলা মাছ নিয়ে এসেছেন। মালিহা রান্নায় কোন সাহায্যই করতে পারলো না। কাঁচা মাছ মাংসের গন্ধে পেট উগরে আসতে লাগলো। কিন্তু একেবারে বসেও থাকলো না। সকলের জন্য নাস্তা রেডি করতে লাগলো। রিপ্তি নুডলস, সেমাই, চিকেন ফ্রাই করে দিলো। মালিহা কিচেন থেকে দূরে ডাইনিংয়ে বসে ফলমূল কেঁটে সাজিয়ে নিলো সার্বিং ডিসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লেবু চিনির শরবত করলো। তারপর সবকিছু ট্রেতে উঠিয়ে টি টেবিলের ওপর নিয়ে একে একে সবকিছু গুছিয়ে রাখলো। সকলের সাথে আলাপ হলেও কেবল কথা হলো না মায়া বেগমের সাথে। তিনি মেয়ের দিকে কেবল আড় চোখে তাকাচ্ছেন। মুখে কিছু বলছেন না। মালিহা মায়ের দিকে এক পলক তাকালো। মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। মনে প্রশ্নের উদয় হলো, “আম্মুর শরীর কি তাহলে ভালো নয়? অসুস্থ!”

খারাপ লাগে মালিহার। মায়ের ওপর রেগে থেকে একটুও খোজ নেওয়া হয়নি তার। মা যেমনই হোক। মা তো! মেয়ে হিসাবে তার অন্তত এতটা কঠোর হওয়া উচিত হয়নি। পরক্ষণেই মনে পড়ে সেদিনের মায়ের করা কঠিন ব‍্যবহার। কি হতো একটু সহজ হলে? আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো মালিহা। নিজ থেকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছো আম্মু?”

মায়া বেগম বোধহয় একটু অবাকই হলেন। চোখমুখ কিছুটা বিস্মিত হবার ভান। নিজেকে সামলে বললেন, “আল্লাহ রেখেছেন ভালো। তোমার শরীর কেমন আছে মা?”
“আমিও ভালো।”
মায়ের দিকে চিকেন ফ্রাই আর নুডলসের বাটি দুটো এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও আম্মু। ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না।”

মায়া বেগম বাধ‍্য মেয়ের মতো দু পিস চিকেন ফ্রাই খেলেন। নুডলস এর বাটিটা হাতে নিলেন। এরপর মা মেয়েকে নিরবতার নৈঃশব্দ ঘিরে ধরলো যেন। কেউ আর একটি কথাও বললো না। কিন্তু মালিহার বাবা আর দাদুর মধ্যে ব‍্যাপক কথা চালাচালি হলো। বাড়ির সৌন্দর্য নিয়েই তাদের কথোপকথন চললো।
কিছুক্ষণ পরে মালিহার শাশুড়ি মা চা করে আনলেন সকলের জন্য। বললেন, “ভাইসাহেব, আপা, খালাম্মা আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি একটু রান্নায় ব‍্যস্ত তো। হাতের কাজগুলো গুছিয়ে এসে গল্প করবো। ততক্ষণে মেয়ের সাথে কথা বলুন। মালিহা, তোমার মা-বাবা, দাদুকে নিয়ে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও। সাবধানে চলিও। পড়ে টড়ে যেও না যেন।”

মায়া বেগম হঠাৎ করে বলে উঠলেন, “আপনি একা পারবেন আপা? আমি এসে হাতে হাতে একটু করে দিই?”
হাসিমুখে নাকচ করলেন বেয়াইনের আবদার। বললেন, “আমি একা কোথায়? বড় বউমা আছে, কাজের মেয়েটি আছে। আমরা পারব। আপনি মেয়েকে সময় দিন। কতদিন পর কাছে পেয়েছেন একে অন‍্যকে। নিশ্চয় কত কথা জমে আছে মা মেয়ের! আমার মেয়েটাও তো দূরে। বুঝি তো আপা।”

মায়া বেগম আর কথা বাড়ালেন না। হাসিমুখে বিদায় দিলেন বেয়াইন সাহেবাকে। মানুষটা ভালো।
নাস্তা শেষে মা-বাবা, দাদু ভাইবোন দুটোকে নিয়ে বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো মালিহা। রিপ্তির মেয়েটি মালিহার বাবার কোলে। নতুন নানার আদর পেয়ে মেয়েটি দারুণ খুশি। মায়া বেগম ও জামিলা বেগম প্রথম এসেছেন মালিহার শশুর বাড়িতে। বাড়ির সৌন্দর্য, বাড়ির মানুষগুলোর অমায়িক ব‍্যবহার মুগ্ধ করলো তাদের। মালিহার বাবা হাসিঙর ছলে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আমার পছন্দ মন্দ নয়। কি হলো মা? মালিহার আম্মু?”

মায়া বেগম কিছু বলেন না। কেবল মেয়ের দিকে এক পলক তাকান। দৃষ্টি তো বলছে কত কথা। মালিহা মায়ের তাকানোর কারণ বোঝে। এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দেয় সে। মেয়ের হাসিমাখা মুখ মায়া বেগমের বুকের ওপর থেকে যেন ভারি পাথর নামালো। স্বস্তির শ্বাস নিলেন তিনি।

দুপুরের দিকে মালিহার শশুর বাড়িতে এলেন। তিনি মোবাইল ছাড়ঙ ঘোরাঘুরি করেন। যার কারণে বাড়িতে মেহমান আসার খবর তিনি জানতেন না। বাড়িতে এসে স্ত্রীর ধমক খেলেন কয়েকবার। নিজেও লজ্জিত খানিকটা। ছেলের শশুর বাড়ি থেকে মেহমান এসেছেন। ছেলে বাড়িতে নেই। তিনিও নেই। কি ভাবলো মানুষগুলো। বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাইলেন ভদ্রলোক।

খাবার টেবিলে হরেকরকম খাবারে ভরে উঠলো। প্লেন পোলাও, সাদা ভাত, রোস্ট, চিংড়ি মাছেঞ মালাইকারি, ইলিশের দোপেঁয়াজা, কাতলা মাছ শুকনো করে ভুনা, গরুর মাংস আলু দিয়ে পাতলা ঝোল আর খাসির মাংস কষা করে রান্না করা আর সবশেষে করলা ভাজি ও পাতলা ডাল। ডেজার্ট হিসাবে ছিলো, নবাবী সেমাই আর ফালুদা। এত এত খাবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে অথচ খেতে না পারার কষ্টে মালিহার খানিকটা দুঃখ হলো। একপাশে দাড়িয়ে রইলো বেজার মুখে। সকলে চেয়ার নিয়ে বসলে শাশুড়ি মালিহাকে বললেন, “খাবারগুলো বেড়ে দাও তাহলে তুমিই। আর হ‍্যাঁ তোমার শশুরকে মোটেও এসব হেভি খাবার দিবে না। ওনাকে শুধু করলা ভাজি আর ডালটা দিবে।”

“আব্বুর আনা মাছটাও খাবে না?”
“খাবে মা। তবে এখন নয়। দেখলেই তো দুদিন আগে শরীর কি খারাপ হলো। এসব তেল মসলার খাবার খেয়ে অসুস্থ হলে কে দেখবে? ছেলেরা কেউ বাড়িতে নেই। ওনার সামান্য অসুস্থতায় ছেলে দুটো কত দুশ্চিন্তায় ভোগে।”
“আচ্ছা মা।”
“আমি তাহলে রুমে যাচ্ছি। তুমি খেয়ে নিও। বড় বউমা এলে তাকেও খেয়ে নিতে বলিও। আমি নামাজটা পড়েই চলে আসব।”

রিপ্তি রান্না শেষ করেই গোসলে চলে গিয়েছে। মেয়েটিকে মালিহা আগেই গোসল করিয়ে দিয়েছে। শাশুড়ি মা সবকিছু গুছিয়ে রেখে তিনিও গোসলে ছুটলেন। এই গরমে দীর্ঘক্ষণ রান্নাঘরে কাটিয়ে গোসল না করে দাড়িয়ে থাকা দায়।
মালিহা একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো। কিন্তু নিজে বসলো না। তার পরিবারের মানুষদের আপ‍্যায়নে যে মানুষগুলো খেটে ম”রলো তাদের রেখে সে কি করে খাবে?

মায়া বেগম বারবার করে বলাতে মায়ের প্লেট থেকে একটু খেল। শাশুড়ি মায়ের কথামতো কাতলা মাছের মাথাটা বাবার পাতে তুলে দিলো। শশুর বাবার জন্য কিঞ্চিত খারাপ লাগলো। একই টেবিলে সকলে ভালো খাবার খাবে। একমাত্র তিনিই সবজি ডাল খাবেন। শশুর বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা একটু গরুর মাংসের পাতলা ঝোলটা দিই? এটাতে সম্ভবত তেল মসলা কিছুটা কম দেওেয়া হয়েছে।”

ভদ্রলোক সাথে সাথে অনুমতি দিলেন না। চারপাশটা দেখে তারপর বললেন, “দুপিস দিও বউমা।”
মালিহা বেছে বেছে চর্বি ছাড়া বড় সাইজের দুই টুকরো মাংস তুলে দিলো।
কিছু সময় পরে মেয়েকে নিয়ে রিপ্তি এলো। এক কোনায় বসে মেয়েকে খাইয়ে দিলো। মেহমানদের খাওয়া ততক্ষণে শেষ। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসেছেন তারা। তারপর তাদের শাশুড়ি মা এলে দুই বউমা এবং শাশুড়ি মা মিলে খেতে বসলো।
কাতলা মাছের আরেকটি মাথা ছিল। সেটা এনে মালিহা পাতে তুলে দিতেই মালিহা সাথে সাথে বলে উঠলো,

“আমাকে দিয়েন না মা। আমি খেতে পারব না।”
“পারবে। অনেকটা সময় নিয়ে তেলে ভেজেছি। বিভিন্ন রকম মসলা দিয়েছি। মাছের উটকো গন্ধ পাবেনা তুমি। তাছাড়া এ সময় মাছ খেতে হয়। এতে বাচ্চার আইকিউ বাড়ে। এসব আমার কথা নয় মা। ডাক্তাররাই বলেন।”
“খাব। তবে আপনাদেরও খেতে হবে। এত বড় মাথা আমার দ্বারা খাওয়া সম্ভব নয়। ভাবি মাথা খেতে পছন্দ করেন। সবাই ভাগ করে খাই?”
“আচ্ছা বেশ।”

রিপ্তি না না করলো কয়েকবার। শাশুড়ি মা সমান ভাগে ভাগ করে দুই বউমার পাতে তুলে দিলেন। নিজেও কিছুটা নিলেন। মনে মনে খুশিই হলে ছোট বউমার প্রতি। মেয়েটি ভাবে সকলের কথা।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে গল্প গুজব চললো। জাওয়াদ ফোন দিয়ে শশুর বাড়ির সকলের সাথে কথা বললো। আসরের দিকে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করলেন মালিহার আব্বু। বারবার করে থাকার রিকুয়েস্ট করলেও থাকতে চাইলেন না কেউ।

সকালে অফিস এবং বাচ্চাদের স্কুল থাকায় রাত কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু মালিহাকে নিয়ে যেতে চাইলে যেতে দিতে রাজি হলেন না শাশুড়ি মা। হাসিমুখেই বললেন, “কেবল এক মাস শেষ দু মাসে পড়েছে। এরমধ্যে জার্নি করা ঠিক হবে না। প্রথম তিনমাসে বাচ্চা খুব দূর্বল পজিশনে থাকে। এমতাবস্থায় ডাক্তার নিষেধ করেন জার্নি না করতে। প্রথম ট্রাইমেস্টার শেষ হলে তখন না হয় গিয়ে থেকে আসবে। মেয়েকে যখনই দেখতে মন চাইবে চলে আসবেন।”

এরপর সকলে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে বেরিয়ে পড়লো। মালিহার ছোট ভাইবোন দুটোর ভিষন মন খারাপ হলো। কাঁদো কাঁদো মুখে বিদায় নিলো ছেলেমেয়ে দুটো।
মালিহার ভিষন মন খারাপ হলো মা-বাবা চলে যেতে। আনিসা, অনিমের জন্য একটু বেশিই খারাপ লাগলো। চোখের সামনে বেড়ে ওঠা আদরের ভাইবোন তার। আজ কত দূরত্ব জটিলতা। মন খারাপ এড়াতে রিপ্তির মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ির সামনে শাশুড়ি মায়ের তত্বাবধায়নে করা ছোট বাগানটি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। প্রকৃতির সবুজের মাঝে নিজের মন খারাপকে বিলিয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ রিপ্তির ছোট্ট মেয়েটি বলে উঠলো, “তোমাল কি কষ্ট হচ্ছে মামনি?”

মালিহাকে সে ভালোবেসে মামনি বলে ডাকে। বেশ লাগে শুনতে। মালিহা পাল্টা প্রশ্ন করে, ”কেন বলো তো?”
“ওমা তোমাল বাড়ির সবাই তোমাকে ছেলে গেল না? আব্বু চলে গেলে আমার তো খুব মন খারাপ হয়। তোমার হয় না?”
মালিহা মেয়েটির মুখে পরপর দুটো চুমু দিয়ে বললো, “আমারও হয় মা।”
সর্বপরি একটি ভালো দিন কাটলো মালিহার। শশুর বাড়িতে মা-বাবার আগমন যেন ঈদের খুশির চেয়েও দ্বিগুণ খুশি হয়ে ধরা দেয় নারী জীবনে।

মালিহার এখন প্রেগনেন্সির চতুর্থ মাস চলছে। অর্থাৎ প্রথম ট্রাইমেস্টার সে পাড় করে ফেলেছে। এখন তার গর্ভবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার। গর্ভকালীন সময়ের প্রথম দিকে অতিরিক্ত ঘ্রাণশক্তির কারণে বিভিন্ন খাবার খেতে পারতো না। মর্নিং সিকনেসের কারণে বমিভাব বা বমি হওয়া, অরুচি, মাথা ঘোরা সহ বিভিন্ন গর্ভকালীন উপসর্গ কমে এসেছে অনেকটাই। কিছুটা রুচি ফিরে এসেছে। শরীরের ওজন বেশ কমেছে।

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৩

সপ্তাহ খানিক পরে বাবা আসবেন তাকে নিতে। একদিকে মনটা কিছুটা ভালো। বহুদিন পরে চেনা নিরে ফিরবে। আবার অন‍্যদিকে আধারে ঘিরে রেখেছে মনটা এক অজানা শঙ্কা।

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৫