আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৭
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে অজানার উদ্দ্যেশ্যে। এখন সে অনুভব করতে পারছে যে এই পৃথিবীতে সে সত্যিই ভীষণ একা। হঠাৎ ঈশিতার মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগে তার কাছে চট্টগ্রামের একটা প্রাইভেট মেডিকেলে জয়েন হবার অফার এসেছিল। ঈশিতা চেয়েছিল ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তার হিসেবে যোগদান দিতে তাই সে অফারটার আর জবাব দেয়নি কিন্তু নাও করেনি।
বর্তমানে এই ঢাকা শহরটাই তার কাছে সবথেকে বিষাক্ত লাগছে। তাই ঈশিতা চায় যেকোন মূল্যে এই শহর থেকে দূরে চলে যেতে। তাই ঈশিতা নিজের ফোন বের করলো। ইমেইলের মাধ্যমে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো সেই হাসপাতালে। এখন একটা কাজের ভীষণ দরকার তার। নিজের জন্য না হলেও নিজের অনাগত সন্তানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাকে এমনটা করতেই হবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঈশিতা জয়েনিং হবার মেইল পাঠিয়ে দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এখন শুধু ফিরতি মেইলের দরকার। ঈশিতার যা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সেসব জাহানারা বেগম তার ব্যাগে পুড়ে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এখন সেসব সম্বল নিয়েই ঈশিতা হেটে চলেছে অজানার পথে। ফিরতি মেইল আসলেই সে রওনা দেবে তার নতুন গন্তব্যের পানে।
রাসেল এবং আয়ুশ ঈশিতাকে খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও তারা ঈশিতার সন্ধান পায়নি। আয়ুশের এবার ভীষণ চিন্তা হলো। ঈশিতার আবার বড় কোন বিপদ হলো নাতো? চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আয়ুশ রাসেলকে বললো,”আচ্ছা, ঐ তামিম আবার ঈশিতার কোন ক্ষতি করে নি তো?”
“তোর এই কথাটাকে আমি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছি না। চল তাহলে আমরা তামিমের কাছে যাই। এখন ও এসব কিছুর জবাব দিতে পারবে।”
রাসেল ও আয়ুশ একই সঙ্গে চলল তামিমের বাড়ির দিকে।
তামিম সকালে উঠে নাস্তা করতে বসে পড়েছিল। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
“এই সকাল সকাল আবার কে বিরক্ত করতে চলে এলো। শান্তিতে একটু খেতেও পারবো না।”
একথা বলেই সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। দরজা খুলেই আয়ুশকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো। তুতলিয়ে বলে উঠল,”তু..তুমি..”
আয়ুশ তামিমের শার্টের কলার চেপে ধরল। তামিমের নাক বরাবর কয়েকটা ঘু*ষি দিয়ে বলল,”ঈশিতা কোথায়?”
“ঈশিতা কোথায় সেটা আমি কি করে জানবো?”
আয়ুশ ঈশিতাকে আরো কয়েকবার প্রহর করলো। আজ সে একদম উন্মাদে পরিণত হয়েছে। রাসেল এই উন্মাদ রূপ দেখে বলে উঠলো,”আয়ুশ আস্তে…মরে যাবে তো।”
“মরুক। ওর মতো জঘন্য মানুষ মৃত্যুই ডিজার্ভ করে। চুপ করে আছিস কেন? বল,আমার ঈশিতা কোথায়?”
“আমায় বিশ্বাস করো, আয়ুশ। আমি জানি না ঈশিতা কোথায়। আমি ঈশিতাকে আমার সাথে আসতে বলেছিলাম কিন্তু ও আসে নি। একা একা কোথাও চলে গেছে।”
আয়ুশ মারধর করা থামালো না। রাসেল আয়ুশকে থামিয়ে বলল,”ওকে ছেড়ে দে, আয়ুশ। আমার ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে না ও মিথ্যা বলছে।”
“ছেড়ে দেব? কখনো না। ওর জন্য আজ আমার ঈশিতা আমার থেকে দূরে সরে গেছে। ওকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।”
বলে আবার মা*রতে উদ্যত হলো। রাসেল কোনরকমে আয়ুশকে আটকে রাখলো। ইতিমধ্যেই তামিমের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে তার শরীর থেকে। রাসেল তামিমের উদ্দ্যেশে বলে,”আমি কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে আয়ুশকে সামলে রাখতে পারবো না। তুমি যদি নিজের ভালো চাও তাহলে আয়ুশের কথা মতো কাজ করো।”
“বলুন আমায় কি করতে হবে। আমি তাই করবো।”–ভয়ার্ত সুরে বলে তামিম।
আয়ুশ বলে,”তুই সবার সামনে আমার ঈশিতার সম্মান নষ্ট করেছিস…এবার তোকে ওর হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে হবে।”
“সেটা কিভাবে?”
“আজ ঐশীর বৌভাত। বিয়েতে উপস্থিত সবাই বৌভাতেও আমন্ত্রিত। এই মানুষগুলোর সামনেই তো তুই ঈশিতার মান সম্মান নষ্ট করেছিলি এবার তোকে ওদের সামনেই সব সত্য বলতে হবে। ঈশিতা যে চরিত্রহীন নয় সেটা তোকে প্রমাণ করে দিতে হবে..নাহলে তোকে আমি..”
তামিম বলে ওঠে,”তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর মে*রো না।”
রাসেল আয়ুশের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ও যদি সবটা স্বীকার করে নেয় তাহলে তোকে আর ওর গায়ে হাত তুলতে হবে না। আমি ওকে মানহানীর মামলায় জেলে ঢোকাবো।”
তামিম কাতর সুরে বলে,”প্লিজ এমন করবেন না। আমার ক্যারিয়ার একদম শেষ হয়ে যাবে।”
“এসব করার আগে তোর এটা ভাবা উচিত ছিল।”
বলেই আয়ুশ তামিমকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। রাসেলও তাদের পেছন পেছন যায়।
আজ ঐশীর বৌভাত। নাহিদ ও ঐশীকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে দুটি আসনে। অনেকে এসে নবদম্পতিকে দোয়া করে যাচ্ছে। তালুকদার পরিবারের লোকেরাও এখানে উপস্থিত। আলতাফ তালুকদার চুপ করে একপাশে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্য করছেন অনেকেই বাকা চোখে তার পানে তাকাচ্ছে। গতকাল যা কেচ্ছা হলো ভাবতেই তার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। ঐশীকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন তিনি, তাই না এসেও পারেন নি। এখন বুঝতে পারছেন এখানে আসাটাই তার মস্ত বড় ভুল হয়েছে। জাহানারা বেগমও একপাশে মুখ কালো করে বসে আছেন। ভাই-ভাবির কথা ফেলতে পারে নি বিধায় তাকে এখানে আসতে হয়েছে। কিন্তু তিনিও সবার বাকা নজর দেখে ব্যথিত।
ঐশীর কানেও ঈশিতার ব্যাপারটা এসেছে। ঐশী কথাটা শুনেছে থেকে অস্থির হয়ে আছে। ঐশীর কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না ঈশিতা এমন কিছু করতে পারে। এই ক’দিনে সে ঈশিতাকে যতটা চিনেছে তাতে সে এমন কিছু করার মেয়ে নয়। বরং এমন হতে পারে তামিমই তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তবে কোন প্রমাণ না থাকায় সে কিছু বলতেও পারছে না।
হঠাৎ করেই নাহিদদের বাড়িতে আগমন ঘটে আয়ুশের। সে একা আসে না, তামিমকে সাথে নিয়ে আসে। আশেপাশের সবার দৃষ্টি এদিকেই। আলতাফ তালুকদার উঠে এসে বলেন,”কি হয়েছে আয়ুশ? তুমি এই ছেলেটাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন?”
আয়ুশ তামিমের কলার শক্ত করে ধরে বলে,”তুই কি এবার নিজের সব অপরাধ স্বীকার করবি নাকি আমি আবার টোটকার ব্যবস্থা করবো..”
বলে শার্টের হাতা ফোল্ট করতে যাচ্ছিল। এমন সময় তামিম বলে ওঠে,”আমি বলছি..সব বলছি।”
তামিম সবার সামনে বলতে শুরু করে,”গতকাল আপনারা যা দেখেছিলেন সবটাই আমার সাজানো একটা নাটক। আমি গতকাল ঈশিতাকে ফাসিয়েছিলাম। ওর কোন দোষ ছিল না।”
বলেই তামিম গতকালকের সব ঘটনা খুলে বলে। শুধু তাই নয়, তার সাথে তার মামার কল রেকর্ডিও শোনায় যেখানে সে তারা ঈশিতাকে ফাঁসানোর চক্রান্ত করেছে। এসব দেখে শুনে সেখানে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত।
জাহানারা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে বলেন,”আবারো আমি মেয়েটাকে ভুল বুঝে ওর উপর চরম অন্যায় করে ফেললাম। নিজের হাতে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম।”
আয়ুশ সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আজ আপনাদের সো কলড সমাজের জন্য আমার স্ত্রীকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। এতসব সম্মান,আভিজাত্য এসবের দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে ঈশিতা আজ আমার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আমি পরোয়া করি না আর কোন সমাজকে। আপনারা কি পারবেন আমার স্ত্রীকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে?!”
আয়ুশ আলতাফ তালুকদারের সামনে গিয়ে বলে,”তোমার সম্মানের কথা ভেবে গতকাল আমি কোন স্টেপ নিতে পারিনি। আমার স্ত্রীকে নির্দোষ প্রমাণ করার অপেক্ষা করতে হয়েছে।”
জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন,”আর তুমি..তুমি তো ঈশিতাকে মেয়ের মতো দেখতে। তাহলে কিভাবে পারলে ওকে বের করে দিতে?”
আয়ুশ বলে ওঠে,”আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি..সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি অজানার উদ্দ্যেশ্যে…যতদিন না আমার ঈশিতাকে খুঁজে পাব ততদিন আর ফিরবো না তালুকদার ভিলায়। এটা আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৬
বলেই আয়ুশ বেড়িয়ে যায়। রাসেল তামিমকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আলতাফ তালুকদার এবং জাহানারা বেগম ব্যথিত হৃদয়ে চেয়ে থাকেন। নিজেদের দোষেই সব হারিয়ে ফেললেন তারা!