রাগে অনুরাগে পর্ব ১৬
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
“নিতে আসলেই আমি চলে যাব সেটা ভাবলে কি করে তুমি? দেবরের বাসায় এসেছো থাকো, খাও। কিন্তু আমি কোথাও যাচ্ছিনা।”
শাশুড়ি মায়ের মুখ থেকে এমন কঠোর কথা শুনে মায়া বেগমের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি হতাশ চোখে মেয়ের দিকে তাকান। মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না মালিহার। কিন্তু সেদিন মায়ের করা অন্যায় আচরণও তো ভুলবার নয়। মালিহা দাদুর শরীর ঘেঁষে বসলো। আলতো হাতে দাদুর ভাজ পড়া হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে বললো, “আমি জানি আম্মু যা বলেছেন সেটা ভুল হয়েছে। তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু এখন আমি তো এসেছি। আমার জন্য অন্তত চলো দাদু। তোমাকে ছাড়া ও বাড়ি শূন্য শূন্য লাগে। ঘরের সবচেয়ে দামি বস্তুটাই তো তুমি। তুমি না থাকলে ভালো লাগে বলো?”
নাতনির কথার পরিপ্রেক্ষিতে জামিলা বেগম কিছুই বলেন না। কেবল চুপ করে থাকেন। ওনার নিরবতাকে অবলম্বন করে মায়া বেগম আবেগী গলায় বললেন, “আপনি তো আমার মায়ের মতো তাই না? সেই সতেরো বছর হতে আপনার সাথে সাথে রয়েছি। আজ তেইশটা বছর আপনার আমার সম্পর্ক। এতগুলো দিন আমার মায়ের কাছেও থাকা হয়নি। সেদিক দিয়ে আপনি আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝবেন এটাই স্বাভাবিক নয় কী? সেদিনের জন্য আমি আজীবন আমার মেয়ে এবং আপনার কাছে অপরাধী থেকে যাব। ভুলের থেকেও বেশি কিছু করে ফেলেছি আমি। অন্যায় যেহেতু করেছি আপনি তো আমার গুরুজন হন, শাস্তি দিন। তবুও আজ আমাকে খালি হাতে ফেরাবেন না আম্মা। মেয়ে তার মাকে নিতে এসেছে। মা যাবে ব্যাস!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জামিলা বেগম বললেন, “মা মনে করলে সেদিন এত বড় কথাটা বলতে পারতে না। তুমি জন্ম দিছো ওগের। আর আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করছি। ওদের প্রতি আমার কোন অধিকার নাই। ওদের জীবনের ভালো মন্দ কোন সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারিনা। বয়স হয়ে গেলে যে মানুষ অধিকারবোধ হারিয়ে ফেলে জানা ছিল না আমার। জানায় বড় উপকার করলে বউমা। আমি আমার সীমার মধ্যেই থাকবো।”
“আমি এত আশা নিয়ে এসেছি আপনি যাবেন না মা? আজ ওই কথাগুলো যদি আপনার নিজের মেয়ে বলতো পারতেন তাকে ভুলে যেতে?”
“ভুলি নাই কিছুই। গেলাম সেদিন নাতনির শশুর বাড়ি। যখন সেইখানে যাওয়ার দরকার যাই তো। এক পোলার বাসায় আর কতদিন থাকবো? ছোটটার কাছেও তো থাকতে হয়।”
“তুমি তাহলে যাবেই না দাদু? আমি এসেছি তাও?”
“তুমি আইছো আমি খুশি হইছি বুবু। আইছো, থাকো খাও। সাবধানে থাকবা। পোয়াতি হইছো। এহন মেলা নিয়মনীতি মাইনা চলার দরকার। যদিও এহন যুগ পাল্টাইছে। মানুষ আধূনিক হইছে। কিন্তু আমাগো সময় মুরব্বিরা কত নিয়মকানুন বাইধা দিছে। তা মালিহা সুত নাতা কিছু দিছে নাকি? শরীর বন্ধ দেওয়ার দরকার আছে না?”
“সুতার বা তাবিজের কোন প্রয়োজন পড়ে না দাদু। ব্যক্তির অন্তরের সচ্ছতা, আল্লাহ্ ভীরুতা এবং মৌখিক আমলই যথেষ্ট ইন শা আল্লাহ। দোয়া করিও যেন সব ঠিকঠাক থাকি।”
“তা তো অবশ্যই। ম্যালা দামি কথা কইছো বুবু। কত কি এহনো জানার বাকি আছে।”
নাতনি দাদুর কথোপকথনের মাঝেই মালিহার ছোট চাচি খেতে ডাকলেন। তিনি টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছেন।
সবাইকে নিয়ে জামিলা বেগম খেতে বসলেন। সকালবেলায় খুব হালকা কিছু মুখে দিয়েই মায়া বেগম বেরিয়ে পড়েছিলেন শাশুড়ি মায়ের রাগ ভাঙাতে দেবরের বাসায়। ভেবেছিলেন শাশুড়ি মাকে নিয়ে তবেই ফিরবেন। কিন্তু বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার কথার যে তেজ তাতে মনে হয় না তিনি তার বড় ছেলের বাসায় ফিরবেন। মায়া বেগম হতাশ হলেন কিছুটা। হতাশার চিহ্ন চোখেমুখে ফুটে উঠলো। বিষণ্ণ লাগলো তাকে। মায়া বেগমের মন খারাপ নজর এড়ায় না ছোট জায়ের। তিনি বলেন, “কি ব্যপার আপা? মন টন খারাপ নাকি? নানু হচ্ছেন, এখন মন মেজাজ থাকা উচিত সবসময় ফুরফুরে। কি হয়েছে বলুন তো?”
মায়া বেগম সবে কলিজা ভুনা দিয়ে পরোটা মুখে পুড়েছে। জায়ের কথা শুনে হালকা হাসলেন। খাবার গিলে বললেন, “তেমন কিছু না রে। সাত সকালে এসে তোদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”
“ধূর কি যে বলেন না! ঝামেলা আর কিসের। আপনারা তো এদিকে আসেনই না। এসেছেন যখন আজ থেকে যাবেন। বাচ্চারা, মালিহার চাচা ওকে দেখলে খুব খুশি হবেন।”
মায়া বেগম তীব্র আপত্তি করে বললেন, “না না। আজ নয়। অন্য কোনদিন। ছেলেমেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো স্কুল থেকে ফিরে না পেলে আরেক ঝামেলা। একটু পরেই বেড়ব। তোরা সময় করে যাস কিন্তু!”
“আচ্ছা সে দেখা যাবে।”
খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে বেলা তেতে ওঠার আগেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মায়া বেগম। মনটা তার ভিষন খারাপ। তিনি খুব আশা করে গিয়েছিলেন শাশুড়ি মাকে আনতে। অথচ! মেয়ের দিকে এক নজর তাকালেন। তার চঞ্চল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়েটি কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছে। খুব একটা কথা টথা বলে না। সারাক্ষণ কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত থাকে। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না। মেয়ে মানুষের বিয়েটা যদি সুখের না হয় তাহলে বাকি জীবনে দুঃখে কষ্টেই কেঁটে যায়। কিন্তু তার মেয়েটির দুঃখ কোথায়? বিয়ের প্রথম রাতের ঘটনায়? কিন্তু এরপর তো সব ঠিকই ছিল। ও বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ খুব ভালো এবং বিনয়ী। মায়া বেগম মেয়ের দুঃখের কারণ খুজে পেলেন না। অথচ তিনি জানতেই পারলেন না মানুষ আত্মসম্মান হারিয়ে ফেললে বা বিসর্জন দিয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারে না। প্রতি মরমে তাদের ভোগায়!
মালিহার বারবার ফোন চেক করে। কল লিস্ট, হোয়াটস অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার চোখ বুলায়। যদি কাঙ্খীত মানুষটির একটি ছোট্ট বার্তা চোখে পড়ে। কিন্তু হায়! না আসে জাওয়াদের ফোনকল আর না কোন ম্যাসেজ। প্রতিবার মন খারাপ নিয়ে ফিরতেঔওঅও হয় মালিহার।
বাড়িতে যখন এসেছেই মালিহা মনস্থির করলো ভার্সিটি যাবে। বাড়িতে বসে থেকে বেকার সময় যাচ্ছে। এমনিতেও বহুদিন ভার্সিটি প্রাঙ্গণে পা রাখা হয় না। বাড়ি বসে বই পত্তর পড়ে আর কতই বা উপকার হয়! বান্ধবীদের টেক্সট করে জানিয়ে দিলো সে আসছে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে হিজাব বাধছিল মালিহা। হঠাৎ বহুদিন পরে আরহামের কথা মনে পড়ল। মনে প্রশ্নের উদয় হলো, “ওই খুড়কুটো ধরে ভেসে বেড়ানো মানুষটা কী ভালো আছে এখন?”
দুই তিনমাস ঠিক করে খেতে না পারায় বেশ শুকিয়েছে মালিহা। ওজন কমেছে প্রায় চার কেজি। আগের জামাকাপড় পড়লে বেশ ঢোলাঢিলে হয়। আজকের পরনের সাদার ওপর লাল গোলাপের ফুল করা কুর্তিটা আগে ঠিকঠাক হলেও এখন বেশ ঢোলা হয়। এতে আবার সুবিধাও আছে। চার মাসের ছোট্ট বাড়ন্ত পেটটা বোঝা যায় না একদমই। কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে একেবারে খাবার টেবিলে এসে বসলো মালিহা।
সে আসার আগেই তার বাবা, অনিমা আনিসা এসে বসে রয়েছে। মায়া বেগম গরম গরম খাবার এনে রাখছেন টেবিলে। মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা যান্ত্রিক পাখার বাতাসে খাবারের সুঘ্রাণ পুরো ঘর ময় ছরিয়ে পড়েছে। আজ রুটি, আলু ভাজি, ডিম পোস আর গরুর গোশত ভুনা করা হয়েছে সকালের নাস্তায়। মালিহা দুটো রুটি আর কিছুটা গোশত ভুনা প্লেটে উঠিয়ে নিলো। বাড়িতে গোশত রান্না হলে সেদিন আর অন্য খাবার মেয়েটি ছুয়েও দেখে না। এ তার ছোটবেলার অভ্যাস। মায়া বেগম ডিম সিদ্ধ এনে মালিহার প্লেটের পাশে রাখলেন।
ভার্সিটি গেটে ঢোকার মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়ে গেল আরহামের সাথে। চলতি পথে চোখাচোখি হলো দুজনের। দুজনই শুকনো হাসলো। অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু একজনের যেন বহুদিনের তৃষ্ণা নিবারণ হলো। আরহাম খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিল। হাতে ফাইলপত্তর। পোশাক আশাকে বেশ পরিবর্তন। ফর্মাল গেটআপ। আরহাত হাঁটা থামিয়ে শুধালো, “ভালো আছো মালিহা?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন আরহাম ভাই?”
“এইতো চলছে। ক্লাসে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা থাকো। যাই তাহলে!”
“ইন্টার্ভিউ আছে?”
“আছে। আমার আবার স্পেশাল লাক। দেখঙ যাবে আজকেরটাও বাতিল।”
আরহামের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
মালিহা বললো, “এভাবে বলছেন কেন? ভালো কিছুও তো হতে পারে। চর্মচোখে আমরা যা দেখি সবসময় সেটাই হবে এমনটা নয়। পজিটিভি নিবেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ধন্যবান সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। ভালো থেকো। চলি..।”
আরহাম দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। মালিহা কিছুটা অবাকই হলো। এই ছেলে তার সাথে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো। কখনও সখনো কথা হলেও শেষ হতো তার ইচ্ছেয়। কথায় কথা বাড়াতো। অথচ আজ কত ব্যস্ততা। যদিও এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। জীবন চলে তার নিয়মে। চিরকাল একভাবে চললে তাকে জীবন বলে না। জীবনের মানেই তো প্রয়োজন অনুসারে ছন্দপতন ঘটবে। আবার নতুন ছন্দে চালিত হবে। তবে মালিহার ভালোও লাগে। অন্তত তার জন্য কেউ থেমে নেই, কষ্টে নেই। এভাবেই এগিয়ে যাক আরহাম। মনে মনে সেই দোয়ায় করে মালিহা। তারপর এগিয়ে যায় ক্যাম্পাসের দিকে। বহুদিন পরে বান্ধবীদের সাথে দেখা। কত কথা জমে আছে। ক্লাসও করা হয় না মাসের পর মাস।
মালিহার চোখের আড়াল হলেও আরহাম ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে দূরে। সে দূর থেকে তার না হওয়া খুব আপন কাউকে দেখতে থাকে। সে ভুলেনি একটি দিনের জন্যও। পুরুষ তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না। সে প্রেম হয় খুব সচ্ছ। আজীবন মনের ঘরে খুব যত্ন করে রেখে দেয়। মালিহাও তার খুব যত্নের একজন। অথচ এই মেয়েটি তার কেউ নয়। আর না কোনদিন হবে। সম্পূর্ণ অন্য এক পুরুষের অধিকারপ্রাপ্ত স্ত্রী! ছেলেটির বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়। তার সাথেই কেন এমন হবে? কেন তার মা খুব তাড়াতাড়ি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন? কেন সে পৃত্রি স্নেহ থেকে বঞ্চিত? কেন সব থেকেও সে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াবে? কেন তার ভালোবাসার মানুষটি তার হলো না? কতশত অভিমান অভিযোগ জমা হয়। কিন্তু যত্ন নিয়ে এই এতিম ছেলেটির অভিমান অভিযোগ কেউ দূর করে না।
ভাগ্যক্রমে আরহাম প্রথমবারের মত সফল হলো। চাকরির ইন্টার্ভিউয়ে সে সফল। এবার চাকরিটা হয়েই গিয়েছে। রাতে মেইল পেয়ে ছেলেটি আবেগে একদফা কেঁদে ভাসালো। কে বলে ছেলেরা কাঁদে না? নারী যেমন হাতের চুরিটা ভেঙে গেলেও কাঁদে, খুব যত্ন নিয়ে সেই ভাঙা চুরিটা এক কোনায় তুলে রাখে। ঠিক বিপরীতে পুরুষ মানুষ। তারা খুব কষ্টে কিংবা খুব সুখে কাঁদে। পুরুষও কাঁদতে জানে। কেবল এ সমাজের বেরিবাধের জন্য নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না।
রাগে অনুরাগে পর্ব ১৫
সমাজের বড় অদ্ভুত নিয়ম। নারীর চলতে হবে মানিয়ে প্রতি পদক্ষেপে। তার সে যত প্রতিকূলতায় থাকুক না কেন। অপরদিকে বুক ফেঁটে গেলেও পুরুষের মুখে গম্ভীরতার মুখোশ পড়ে চলতে হবে।