প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৫
তানিশা সুলতানা
সমুদ্রের কাছাকছি ইট সিমেন্ট দ্বারা তৈরি হয়েছে সুন্দর রাজকীয় অট্টালিকা। এক হাজার তিনশো জন কর্মচারী চার মাসে তৈরি করেছেন দুইতালা বিশিষ্ট এই অট্টালিকাটি। প্রাসাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অভিরাজ মোটা অঙ্কের টাকা বকশিস দিয়েছেন কর্মচারীদের। এমনকি এই শহরে বসবাসরত সকল মানুষই ইতোমধ্যেই প্রাসাদ দেখতে ভিড় জমাচ্ছে। পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই প্রাসাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছে সকলেই। প্রাসাদটির সুন্দর একখানা নেইম-প্লেট টাঙানো হয়েছে মেইন গেইটের নিকটে। নামখানা অভিই ঠিক করেছিলো “অভিপূর্ণের শান্তি নিবাস”
হাতে কফির মগ,এলোমেলো চুল, পড়নে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, খালি গা। রাজকীয় মুছ কেটে ফেলেছে কিছু দিন আগেই। দাঁড়িতে নতুন নকশা এঁকেছে৷ কাঁধ সমান বড় চুল গুলো নতুন রূপে কেটেছে। মোট কথা নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলেছে জমিদার পুত্র অভিরাজ।
কফির মগে ক্ষণে ক্ষণে চুমুক দিচ্ছে আর কিছুটা দূরে কর্মচারিদের ব্যস্ত ভঙ্গিমায় প্রাসাদে কাজ করার দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
প্রাসাদের সামনে খনন করা হচ্ছে জমি। সেখানে লাগানো হবে কালো গোলাপ গাছ। ইতোমধ্যেই কিছু গোলাপের চারা চলে এসেছে। আর বাকি চারা গুলো ট্রাক ভর্তি করে আনা হচ্ছে।
অভির কড়া হুকুম আগামী দুই দিনের মধ্যে পুরো প্রাসাদ সম্পূর্ণ সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে।
তৃতীয় দিনের মাথায় প্রাসাদে প্রবেশ করবে পূর্ণতা। হ্যাঁ অভির পূর্ণতা।
পূর্ণতার কথা মনে হতেই চটজলদি পকেট হতে ফোন বের করে। কল করে কোনো এক নাম্বারে।
রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করা হয় কলখানা।
“আমার পূর্ণ কেমন আছে?
আর মিষ্টি?
আমার বোন কেমন আছে? কি করছে? ওদের বের করতে পেরেছেন জমিদার বাড়ি থেকে?
পুলিশ অফিসার জামিল শুকনো ঢোক গিলে। রিনরিনিয়ে জবাব দেয়
” স্যার আপনার বউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অভির। চিৎকার করে বলে ওঠে
“দুই দিন সময় দিলাম। দুই দিনের মধ্যে আমার পূর্ণকে আমার কাছে পাঠাতে না পারলে আপনাদের থানা আমি জ্বালিয়ে দিবো পুলিশ।
ভয়ে কেঁপে ওঠে জামিল।
আমতাআমতা করে জবাব দেয়
” অভিরাজ আমরা জেনেছি আপনার বউকে লুকিয়েছে আপনার দাদি।
“কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। যেখান থেকে পারেন আমার পূর্ণকে খুঁজে এনে দিবে।
আর মিষ্টির সাথে কথা বলিয়ে দিবেন আমায়।
” স্যার মিষ্টি ম্যাম মা
বাকিটা বলতে পারে না জামিল। ততক্ষণে অভি কল কেটে দিয়েছে।
মনার ঘুম ভেঙেছে বেশ,কিছুক্ষণ আগেই। গত কয়েকদিনে ঘুমটা তার বেশ বেড়েছে। সারাক্ষণ ঘুমতে ইচ্ছে করে। রাত দিন, সকাল বিকেল কিছুই অনুভব করতে পারছে না। আজকে চটজলদি ভেবে ফেলেছে ডাক্তারের চেম্বার হতে ঘুরে আসবে। এভাবে ঘুমাতে ঘুমাতে কখন জানি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম কমানো জরুরি অতিদ্রুত।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মনা। হাতা কাটা শর্ট নাইট ড্রেস প্রায় খুলে গিয়েছে। টেনে টুনে ঠিক করে নেয়। ঘুম পুরোপুরি কাটে নি। এখন আবার বালিশে মাথা রাখলে মুহুর্তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবে। কিন্তু এমনটা করা যাবে না।
দুর্বল শরীরখানা টেনে বিছানা হতে নামে। নরম তুলতুলের চটিজোড়া পায়ে চাপিয়ে হেলেদুলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
বেশ সময় নিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ঘুমের রেশ কাটায়। অতঃপর ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে।
বেলকনিতে চোখ যেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে মায়ার। এলোমেলো চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বেলকনিতে পা রাখে।
অভির পাশে দাঁড়ায়।
“গুড মর্নিং জান
অভি আড়চোখে এক পলক তাকায় মনার পানে৷ জবাব দেয় না। হাত বাড়িয়ে টি-টেবিলের ওপরে থাকা কফির মগ তুলে সেটা বাড়িয়ে দেয় মনার দিকে।
মুহুর্তেই মনার হাসিমুখ খানা চুপসে যায়। আমতাআমতা করে বলে
” তুমি যাই খেতে দাও আমায় সেটা খেলেই শুধু ঘুম পায়। খাবো না কফি
অভি নিঃশব্দে রেখে দেয় কফির মগ। নিজের আধখাওয়া কফির মগখানাও রাখে।
মনা বেশ খুশি হয়। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে অভিকে। কাঁধে মাথা রেখে আলতো স্বরে বলে
“আজকে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। তুমি প্রস্তুত?
আসমান পানে তাকায় অভি।
” আমাকে বিয়ে করার খুব শখ?
“ভীষণ
তোমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আমার শরীর আনচান করছে। সয্য হচ্ছে না জান।
কথা শেষ করেই ঠোঁট ছোঁয়ায় অভির গলায়। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে অভি। কঠিন স্বরে জবাব দেয়
” তোমার মনে হয় আমি তোমায় বিয়ে করবো?
বাঁকা হাসে মনা।
“আর কোনো অপশন আছে তোমার?
৫০ জন নারী বিদেশে পাচার করেছো তুমি। প্রমাণ আছে আমার কাছে। দশ জন পুরুষের কি ড নি বিক্রি করেছো সেটার প্রমাণও রয়েছে।
তোমাকে হুমকি দিচ্ছি না। শুধু অফার করছি। আমাকে বিয়ে করে সারাজীবন সুখে সংসার করো। নাহলে সারাজীবন জেলে পঁচে ম র তে হবে।
অভি ভয় পেলো কি না বোঝা গেলো না। তবে কপালে ভাজ ফেলে পাল্টা জবাব দেয়
” উহু
ভুল বললে। গত এক বছরে সাড়ে তিনশো মেয়ে বিক্রি করেছি পাঁচ কোটি টাকায়। পঞ্চাশ জন মানুষকে নিজে হাতে খু ন করে কি ড নি বিক্রি করেছি।
ভুল তথ্য পাও কোথায় মনা? সঠিকটা জেনে নিবে তো।
ঘাবড়ায় মনা। ছেড়ে দেয় অভির হাত। থমথমে মুখে তাকায় অভির মুখপানে। কতো সহজ ভাবে বলছে যে পঞ্চাশ জন মানুষকে খু ন করেছে” একটুও গলা কাঁপলো না। বা অনুসূচনা ফুটে উঠলো না মুখে।
“তোমায় নিয়ে সুখে সংসার করবো বলে তো এখানে আসি নি। তোমাকে ব্যবহার করে শুধু জমিদারদের নজর এড়িয়েছি।
ওই যে দেখো আমার প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। এবার পূর্ণতা মিষ্টি এবং আমার মাকে কায়দা করে এখানে নিয়ে আসবো। সেখানেও তোমায় ব্যবহার করবো।
মনা প্রাসাদের পানে তাকায়। ইতোমধ্যেই আঁখিতে অশ্রু জমেছে তার। অভিকে বিশ্বাস করে ভুল করলো? সব হারালো কি?
” তুমি আমায় ঠকালে অভি?
“হুমম ঠকালাম। ভীষণ বাজে ভাবে ঠকালাম।
নারীর শরীরের লোভ নেই আমার। পূর্ণতা ছাড়া দুনিয়ায় কোনো নারীই আমাকে আকর্ষিত করতে পারে না। আমার পূর্ণ ছাড়া দুনিয়াতে আর কোনো মায়াবতী নেই।
অসহায়ের মতো মনা জিজ্ঞেস করে
” আমার কি হবে অভি?
“তুমি দেখতে বেশ সুন্দর। বিক্রি করলে টাকা পাবো অঢেল।
তোমাকে বিক্রি করে জীবনের সর্বশেষ পাপ করবো আমি। নতুন জীবন শুরু হবে আমার। সেই জীবনে পাপ শব্দটা থাকবে না। থাকবে শুধু সুখ শান্তি আর ভালোবাসা।
মনার খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো ” অভিরাজ তোমার মিষ্টি আর বেঁচে নেই। তোমার পূর্ণতাও নিখোঁজ। এজীবনে সুখের সংসার করা হলো না তোমার। পাপীরা কখনোই সুখী হয় না”
কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে পূর্ণতা। লুটিয়ে পড়েছে সেঁতসেঁতে মাটিতে। বৃষ্টি হয়েছে সারারাত। বৃষ্টির পানি বয়ে গিয়েছে পূর্ণতার শরীরে। সারারাত ভিজেছে।
ইফতিয়ার সারারাত খুঁজেছে পূর্ণতাকে। পাগলের মতো কান্না করেছে। আল্লাহর কাছে মানত করেছে “পূর্ণতাকে পেয়ে গেলে পাঁচ হাজার কুরআন শরীফ বিভিন্ন এতিম খানায় দান করবে”
রাতের শেষ ভাগের দিকে হতাশ হয়ে জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে পড়ে ইফতিয়ার। পায়ে কাঁটা ফুটেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। খোলানোর হুশ ছিলো না বা এখনো নেই। আশাহত ইফতিয়ার পূর্ণরায় বলে ওঠে
“হে আল্লাহ হয় পূর্ণতাকে পাইয়ে দিন নাহলে আমার মরণ দিন।
মুহুর্তেই বোধহয় মিষ্টি সামনে দাঁড়ালো ইফতিয়ারের। ধবধবে সাদা পোশাক তার। মুখটা মলিন৷
উদাস ভঙ্গিমায় বলে
” জমিদার বাড়ির পেছনে রয়েছে পূর্ণতা”
ইফতিয়ারের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। কোমর জড়িয়ে ধরে মিষ্টির।
“এতোক্ষণ কেনো আসলে না তুমি? আমি খুঁজছিলাম তোমায়।
ইফতিয়ারের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দেয় মিষ্টি। কাঁধ জড়িয়ে দাঁড় করায়। হাঁটু মুরে বসে ইফতিয়ারের ডান পা নিজের কোলে রাখে। সাবধানে খুলে দেয় কাঁটা। মুহুর্তেই গল গল করে র ক্ত গড়িয়ে পড়ে। নিজ ওড়না দ্বারা র ক্ত মুছে দেয় মিষ্টি।
তারপর ইফতিয়ারের হাত ধরে বলে
” চলুন
পূর্ণতার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
ইফতিয়ার সভ্য ছেলের মতো মিষ্টির পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।
“অভিরাজের হাতে পূর্ণতাকে তুলে দিয়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাবো মিষ্টি। এভাবে বাঁচতে পারছি না আমি। তুমি থাকবে তো আমার সাথে?
আলতো হাসে মিষ্টি।
“আহারে জীবন
বাঁচতে চাইলাম আপনার সাথে, বাঁধতে চাইলাম ঘর
সুখের মুখটা দেখলাম কেবল, হায়য় দেহখানা করে দিলো পর
মিষ্টির কথা বুঝতে পারে না ইফতিয়ার। ফের প্রশ্নও করে না। করতে চেয়েছিলো কিন্তু ততক্ষণে তারা পৌঁছে গেছে পূর্ণতার কাছে।
ছোট ছোট গাছপালা ঢেকে ফেলেছে পূর্ণতাকে। মাথা পড়েছে কাঁদার স্তুপে। ইফতিয়ার পূর্ণতার সামনে হাঁটু মুরে বসে পড়ে। শরীরে হাত দিতে গিয়েও ইতস্তত বোধ করছে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় মিষ্টির পানে। মনে পড়ে মিষ্টির ডাইরিতে লেখা কিছু কথা
” জানেন চৌধুরী সাহেব
পূর্ণতার প্রতি আপনার দুর্বলতা আমার সয্য হয় না। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি যদি কখনো পূর্ণতাকে ছুঁয়ে দেন আমি বাঁচবো তো?
যার দিকে আপনি তাকালে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে তাকে আপনি ছুঁয়ে দিলে আমি বাঁচবো না।
আপনি পূর্ণতাকে ছোঁয়ার আগেই যেনো আল্লাহ আমাকে মরণ দেয়।
শুকনো ঢোক গিলে ইফতিয়ার। মিষ্টির সামনে কি করে ছুঁবে পূর্ণতাকে? মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পাবে তো। কি করবে এবার?
মিষ্টি বোধহয় বুঝলো। মুহুর্তেই গায়েব হয়ে যায় সেখান থেকে। ইফতিয়ার আশেপাশে তাকিয়ে মিষ্টিকে খুঁজে পায় না। চট করে পায়ের দিকে তাকায়। সেখানে এখনো কাঁটা ফুটে আছে। তাহলে কি এতোক্ষণ ভুল দেখলো? মিষ্টি ছিলোই না?
চোখ ভিজে ওঠে ইফতিয়ারের। নিজেই খুলে ফেলে কাঁটা। আসমান পানে তাকিয়ে বিরবির করে বলে
প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৪
“আহারে জীবন
বাঁচতে চাইলাম তোমার সাথে বাঁধতে চাইলাম ঘর
স্বপ্ন দেখলাম পাহাড় সমান হায়য় তুমিই করে দিলে পর।