দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ মনোযোগ দিয়ে দোলার চোখমুখ পরখ করে। তাতে ওর যা বুঝার বুঝে যায়। দোলার এ মন খারাপ এর পেছনের কারণ যে আয়মান সাহেবের করা কোনো দুর্ব্যবহার – এ বিষয়ে নিশীথের মনে কোনো সন্দেহ বাকি থাকেনা আর! বিষয়টা অনুধাবন করতেই নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, শক্ত হয়ে আসে দোলার বাহু ধরে রাখা ওর হাত। নিশীথের এ পরিবর্তন দোলার নজর এড়ায় না। ও বুঝে পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে! তাই নিশীথকে ঠান্ডা করতে বলে,

—আপনি যা ভাবছেন তা মোটেও সত্যি না। আমি বাবার কারণে মন খারাপ করিনি। উনি আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি!
—শাট আপ, দোলনচাঁপা। উনার জন্য তুমি আমার কাছে মিথ্যে কথা বলছো? সিরিয়াসলি? আমি কি উনাকে চিনিনা? নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছেন যা তোমায় কষ্ট দিয়েছে।
—আপনার বুঝতে সত্যিই ভুল হচ্ছে এবার। আমার কথাটা শুনুন প্লিজ। বাবা যেখানে আমার সাথে কোনো কথাই বলেন না, সেখানে দুর্ব্যবহার করবেন কিভাবে বলুন? আমি অযথাই কাদছিলাম।
—কিন্তু আমার তো বিশ্বাস হচ্ছেনা, দোলনচাঁপা। আমি তোমায় যতদূর চিনি, তুমি তো অযথা কাদার মতো মেয়ে নও!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিশীথের কথায় দোলনচাঁপা হাসে। কেমন যেন এক মায়াভরা দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—তাই? এ ক’দিনেই এতটা চিনে গেছেন আমায়?
দোলার কথায় এবার নিশীথও হাসে। এগিয়ে এসে মুহুর্তের মাঝেই ওকে বুকের মাঝে টানে। দু হাতে দোলার কোমড় জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,
—চেনার মতো চেনার জন্য কয়েক মুহুর্তই যথেষ্ট! তোমার কোনো সন্দেহ আছে? নাকি প্রমাণ দেবো?
নিশীথের ইংগিত বুঝে দোলা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। তাতে নিশীথ আরেকটু আশকারা পায়! ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই দোলা হাসফাস করে, ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করে। তবু নিশীথ থামেনা। নিজের মর্জি মোতাবেক কিছুক্ষণ ওভাবে থেকেই গলায় চুমু খায়। খানিকবাদে থেমে বলে,

—কাল রাতে আমি কষ্ট পেয়েছি, দোলনচাঁপা!
দোলা থমকায়। এতক্ষণ ছোটাছুটি করতে থাকা হাত-পা গুলো শিথিল হয়ে যায়। নিশীথ গলা থেকে মুখ তুলে দোলার দিকে তাকায়। ওর চাহনি দেখে দোলার খারাপ লাগে। সে জানে নিশীথের খারাপ লাগবে, কিন্তু এখানে তারও তো দোষ নেই! ওর চোখেমুখে উদাস ভাব বিরাজ করে।
মুখ ফুটে বলে,

—আমি ইচ্ছা করে ঘুমিয়ে পড়িনি, নিশীথ। বিশ্বাস করুন।
—আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছো। বিয়ের আগে ক’দিন তোমায় কাদিয়েছি তার বদলা নিতেই আমার সাথে এমনটা করেছো। সত্যিটা লুকিয়োনা। আমি সব বুঝি!
দোলার চেহারা দেখে নিশীথের মনে দুষ্টুমি চাপে। ও নিজের চোখমুখে সিরিয়াস ভাব এনে দোলাকে কথাগুলো বলে। এদিকে বোকা দোলা নিশীথের এ দুষ্টুমি ধরতে পারেনা। বেচারি পড়ে যায় মুসিবতে। নিশীথ যে ওর সাথে মজা করছে তা বুঝতে না পেরে অস্থির হয়ে বলে,

—আপনি কিছুই বুঝেন না! আমি কেন আপনার সাথে এমন করবো? বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের। এখন তো এসব ছেলেমানুষী করার মানে হয়না। আমি সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন। আপনি কষ্ট পেয়েন না, আই এম সরি।
এতক্ষণ সিরিয়াসভাবে তাকিয়ে থাকলেও এবার দোলার কথাগুলো শুনে নিশীথ গম্ভীর মুখে থাকতে পারেনা। ওর হাসি পায়। নিশীথের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখে দোলা বিস্মিত হয়। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ রে’গে ভ্রু নাচিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,

—আপনি হাসছেন কেন? তার মানে আপনি এতক্ষণ আমার সাথে মজা করছিলেন?
নিশীথ জবাব না দিয়ে বেশ জোরেই হাসতে আরম্ভ করে। দোলা রে’গে চলে যেতে নিলেই ও পেছন থেকে হাত ধরে ওকে আটকায়। দোলা শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করলেও নিশীথের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা আর! দোলা পেছন না ফিরেই বলে,

—ছাড়ুন তো। আপনি অনেক খারাপ।
—এতদিন পর জানলে?
নিশীথ আবারও মজা করে। দোলা চোখ পাকিয়ে পেছনে তাকায়, তা দেখে নিশীথ ভয় পাওয়ার অভিনয় করে। দোলা দ্রুত মুখ ফিরিয়ে হাসে, নিশীথকে হাসি দেখতে দেবেনা বলে। এরই মাঝে নিশীথ পেছন থেকে বলে,
—বাবার কথায় মন খারাপ করোনা, দোলনচাঁপা। তুমি তো কখনো বলবেনা তবুও আমি জানি তুমি পরোক্ষভাবে উনার ঠান্ডা ব্যবহারের জন্যই কাদছিলে।
এবার দোলা পেছন ফিরে তাকায়। নিশীথ মুখ অন্যদিক করে রেখেছে, ওর কণ্ঠ নরম। দোলা এগিয়ে নিশীথের হাত চেপে ধরে। নিশীথ তাকাতেই বলে,

—বিশ্বাস করুন, আমি কিছু মনে করিনি। বাবা আমাদের সম্পর্কটাকে এখনো মন থেকে মেনে নেননি তাই উনার পক্ষ থেকে ঠান্ডা ব্যবহার আশা করা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। বরং উনি নরমাল ব্যবহার করলেই আমি অবাক হতাম। আর মিষ্টি খাবার অনেকেই খায়না তাই এটা আহামরি কোনো বিষয়ই না। আমি সত্যিই কিছু মনে করিনি তার কথায়। কিন্তু আমি কেদেছি অন্য এক কারণে!
দোলার প্রথমদিকের কথাগুলো শুনে নিশীথ রিল্যাক্স হলেও শেষের কথাটা শুনে ওর ভ্রুযুগলের মাঝে ভাজ পড়ে। ও প্রশ্ন করে,

—তবে কি জন্য কাদছিলে? অন্য কেউ কিছু বলেছে? কে কি বলেছে? আমায় নামটা একবার বলো শুধু!
নিশীথের কথাবার্তা শুনে দোলা হাসবে কিনা কাদবে বুঝে উঠতে পারেনা। এ লোকটা এত অস্থির কেন? নিশীথকে দেখলে দোলার মনে হয়, ওর কিছু হলেই যেন লোকটা দুনিয়া উল্টে ফেলবে! দোলা কিছু বলছেনা দেখে নিশীথ ওকে ঝাকিয়ে বলে,
—কি হলো? চুপ করে আছো কেন?
দোলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—আসলে বাবা মারা যাওয়ার এত বছর পর এই প্রথম কাউকে “বাবা” বলে সম্বোধন করলাম তো, তাই একটু ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম!
নিশীথ কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। হয়তো কি বলবে ভেবে পায়না। এমন পরিস্থিতির সাথে সে অবগত নয়। এটা এমন এক কষ্ট যেটা যার আছে শুধু সে-ই অনুভব করতে পারবে। যার নেই সে পাশে থেকে সান্ত্বনা দিতে পারবে শুধু! নিশীথও তাই করলো। মুখে কিছু না বলেও চুপচাপ দোলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো৷ ওর ইশারা বুঝে দোলাও ঝাপিয়ে পড়লো ওর বুকে। যেন এতক্ষণ এটারই অপেক্ষায় ছিলো! কিছু না বলে, কিছু না করেও দুজনের মাঝে ভালোবাসা আদান-প্রদান হলো! নিশীথ এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে আলতোভাবে দোলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এদিকে ওর বুকে মাথা পেতে দোলা চুপটি করে পড়ে থাকলো।

নিশীথের প্রশস্ত বুকে যে এত শান্তি, এত নিরাপত্তা ওর জন্য বরাদ্দ ছিলো- দোলা আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। ভালোবাসা যে কত সুন্দর তা বিয়ের এ একদিনেই যেন একটু একটু করে অনুভব করতে পারছে সে!
দোলার ভাবনার মাঝেই নিশীথ বললো,
—রিসিপশনের কিন্তু বেশিক্ষণ নেই। তোমার তো রেডি হতে সময় লাগবে। এদিকে তোমার শশুড় অলরেডি একবার তাগাদা দিয়েছেন। তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত পার্লারে যেয়ো। আজকে দেরি হলে কিন্তু সত্যিই বকা খাবে!
দোলা মাথা নেড়ে সায় জানালো। অর্থাৎ, ও দেরি করবেনা! দোলা নিশীথকে ছাড়ছিলো। কিন্তু নিশীথ ওকে ছাড়লোনা। উল্টো মাথা নামিয়ে ওর কানের কাছে মুখ আনলো। ফিসফিসিয়ে বললো,

—কাল তোমায় ছাড় দিয়েছি। আজকে কিন্তু কোনোভাবেই ছাড়বোনা। বি রেডি ফর দ্যাট, দোলনচাঁপা!
নিশীথের কথায় লজ্জায় দোলার আত্মা উড়ে যায় যায় ভাব! কোনোমতে নিজেকে সামলে ওকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে দৌড়ে বের হয়। দরজা খুলে বের হতে নিবে এ সময় পেছন থেকে নিশীথ আবারো বলে ওঠে,
—যত পালানোর এখনি পালিয়ে নাও। রাতে তোমায় ছা’ড়ছিনা!

রিসিপশনের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। নিশীথদের তরফ থেকে অনুষ্ঠান হওয়ায় আজকে সিংহভাগ অতিথি ওদেরই চেনাজানার মধ্যে! বর-বউ স্টেজে বসে আছে। আয়মান সাহেব নিজের করপোরেট গেস্টদের আর আসমা বেগম আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন করছেন। একে একে সবার সাথে পালাক্রমে নিশীথ-দোলার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় সবাই দুজনের জুটির প্রশংসা করছে, কেউবা ছবি তুলছে। একিসাথে, পারভীন বেগমের সাথেও নিজের দিকের আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আসমা বেগম। মোটকথা, বেয়াই দিকের অতিথি হোক কিংবা নিজেদের দিকের -সবকিছু বেশ ভালোভাবেই চলছে। এত ব্যস্ততার মাঝেও সব ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এক ব্যাচ অতিথি খেতে বসে গেছেন। আসমা বেগম মাত্রই ননাশদের টেবিলে বসিয়ে দিয়ে এলেন। এমন সময় তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকলেন।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৮

—আসমা!
পরিচিত গলায় নিজের নাম শুনে পেছন ফিরতেই তার হাসি হাসি মুখটা শুন্যে মিলিয়ে গেলো। নিশীথের বড়খালা এসেছেন। নিজের বড় বোনকে দেখে এ মুহুর্তে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও, আসমা বেগমের মুখ দেখে তাকে ততটা খুশি মনে হলোনা! উল্টো, তার চেহারায় এক অদ্ভুত আ’তংকের রেখা দেখা গেলো!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯(২)