আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৩

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৩
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘ভাই মুখে যাইই বলি আমার খুব টেনশন হচ্ছে। ডাক্তার দেখানোর কথা শুনলে কুহু হাঙামা শুরু করবে। আমি বোনকে ভয় পাই না। ভয় পাই ওর জেদকে। ‘
-‘আমিও কোনো দায়িত্ব নিলে সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে না সারা অবধি শান্ত থাকতে পারি না। টেনশন করে লাভ নেই। নিজেকে শক্ত কর। কুহুর জন্য যতটুকু করার দরকার। আমরা সবটুকু করব।’
-‘এখন তুইই আমার একমাত্র ভরসা। পাশে থাকিস ভাই।’
-‘ইনশাআল্লাহ!’

এরপর দুই বন্ধু আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল। রুপক সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে একা একা কত কিছু ভাবল। তারপর মনে মনে ঠিক করল যত কিছুই হয়ে যাক সে আর পিছনে ফিরে তাকাবে না। বোনকে নিয়ে যাবেই সে। প্রয়োজনে নিজে আরো শক্ত হবে। শক্ত হয়ে শক্ত হাতে বোনকে সামাল দেবে। এভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। বসে থাকাটাও ঠিক হচ্ছে না। কারণ কুহুর সমস্যাটা দিন দিন জটিল রুপ ধারণ করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সে সারাদিনে কি করে না করে রাতের বেলা মনে করে বলতে পারে না। আত্মীয় কিংবা চেনা মানুষদের চিনতে পারে না। ছোটোবেলার স্মৃতি মনে করতে পারে না। প্রয়োজনীয় জিনিস কোথায় রাখে না রাখে পরক্ষণেই ভুলে যায়। কখনো কখনো এমনও হয় কলেজ থেকে ফেরার পথে বাসার রাস্তা ভুলে যায়। কিছুতেই মনে করতে পারো না তার বাসা কোথায়। কোন পথ দিয়ে এসেছে। তখন তাকে ফোন করে কান্নাকাটি করে। সে গিয়ে বোনকে নিয়ে আসে। এমনিতেই নিকিতাদের

বলা আছে কুহু একা বের হলেই তাকে জানাতে। তারাও তাই করে। ওরা বুঝতেই দেয় না যে ওরা জানে কুহুর সমস্যার কথা। এমন ভাব করে যে তারা কিচ্ছুটিই জানে না। আর কুহুও সুস্থ স্বাভাবিক কেউ। অথচ কুহুর অনুপস্থিতিতে তারা কুহুর বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে মন খারাপ করে, কাঁদে। অথচ কুহুর জন্য বাবা মা সহ সবাই অভিনয়ের জাল এমন করে বিছিয়ে রেখেছে যেন সব সত্যি। কুহু যখন যা বলে তারা বিশ্বাসও করে।
আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ তারা জানে কুহু ভাবনা জগতের বাসিন্দা।

সে ভাবতে ভালোবাসে। ভাবতে ভাবতেই সত্য মিথ্যা দিয়ে ভাবনার এক
জগৎ তৈরি করে ফেলে। সেসবের প্রভাব বিস্তার করে তার বাস্তব কর্মে।
আর এসব বেশি হয় যখন কুহু কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করে। কাঁদে।
অতিরিক্ত ভাবে। এমনকি চলতিপথে রিলেটিভরা কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে পূর্বের কথা স্মরণ করতে পারে না। বুঝতে পারে না মানুষটার অচেনা নাকি চেনা। একেক দিন অচেনা ভেবেই পাশ কাটিয়ে চলে আসে। তখন সেই রিলেটিভ তাকে অহংকারী ভাবে।

গালমন্দ করে। কখনো কখনো বাসার এসে অভিযোগ জানিয়ে যায়। তখন সে আর তার বাবা মা চুপ করে শোনে। এছাড়া তো কোনো পথ খোলা নেই। এতসব আগে হতো না কিন্তু আজকাল তার সমস্যাগুলো খুব বেশি নজরে পড়ছে। অবস্থা দেখে ভাবাচ্ছেও। তাছাড়া রিদওয়ানকে নিয়ে যা অভিযোগ করেছে সেটা অন্য কাউকে নিয়েও যদি করে তাতেও অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কারণ তার সমস্যা এটাই। তবে এটা কি কেউ বুঝবে? অনেকে তো এই রোগের নাম জানে না। শোনেও নি কখনো। তারা তো আর বুঝবে না এটা রোগ।এমনও রোগ হয়। ঠিক এই ভয়ে সে এতদিন বাসায় কোনো হোম টিউটর রাখতে পারে নি। পড়াশোনায় চাপ দিতে পারে না। বকাবকি করে না। সে
শুধু চুপ করে আছে বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার বোন সুস্থ হলে একদিন পড়াশোনা করবে। বড় হবে। এখন যেভাবে চলছে চলুক। আর

দেশে বাইরে গিয়ে কি হবে, না হবে, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ভেবে
মাথা আওলাতে চাচ্ছে না। আপাতত যাওয়ার কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
যত দ্রুত সম্ভব কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। সে কালই যাবে ভিসা অফিসে।
আর বসে থাকা যাবে না। বোনকে ভালো করতে হবে। সুস্থ করতে হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আর এটা করাটা এখন তার জীবনের লক্ষ্য।

পরেরদিন খুব সকালে কুহু একা একা ছাদে এসেছে। ছাদের মাঝখানে চুপ করে বসে আছে। কেন এসেছে, কি করতে এসেছে সে জানে না তার ইচ্ছে হয়েছে তাই সে এসেছে। মেয়ের রুমের দরজা খোলা পেয়ে ইসমত আরা মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসেছেন। এসে ছাদের গাছগুলোয় পানি দিলেন। তখন পাশের ছাদে একটা ভাবিও এলেন। কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ভাবিটা কথায় কথায় বলে বসলেন,

-‘ভাবি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম।’
-‘হ্যাঁ বলুন।’
-‘কুহুর কি জ্বিন ভূত অথবা মানসিক সমস্যা আছে নাকি?’
-‘এ আবার কেমন কথা? আর একথা মনে হলো কেন?’
-‘রাস্তায় দেখা হলে এক কথা বলে। একদিন বলে না। মাঝে মাঝে এমন আচরণ করে যেন চেনেই না।’
-‘ছোটো মানুষ। কখন কোন মুডে থাকে।’
-‘তাও অদ্ভুত আচরণ করে। আচ্ছা ভাবি আপনাদের বাসায় কিছুদিন আগে একটা ছেলে থাকত সম্ভবত রুপকের ফ্রেন্ড। তাকে আর দেখা যায় না কেন? চলে গেছে নাকি?’

-‘হুম। কিছু কাজের জন্য দেশে বাইরে থেকে এসেছিল। কাজ সেরে চলে গেছে আবার।’
-‘ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। কুহুর সঙ্গে জোড়া বেঁধে দিতেন। বিয়ে হলে কুহুর এসব ত্যাড়ামি সেরে যেতো।’
-‘আমার মেয়ের কিসে কি হতো সেই চিন্তা নাহয় আমাকেই করতে দিন। আমরা এখনো মারা যাই নি।’
-‘আরে ভাবি রাগ করলেন নাকি? আমি কুহুর ভালোর জন্যই বললাম। রাগ কইরেন না। ওর কথাবার্তা, চালচলন অদ্ভুত লাগে এজন্যই বললাম আর কি। তবে আপনি বললে আমি একটা হেল্প করতে পারি আপনাকে।’
-‘কি হেল্প?’

-‘আমার চেনা জানা একটা কবিরাজ আছে আপনি বললে তাকে নিয়ে আসতে পারি। মেয়েকে দেখালেন নাহয়।’
-‘পাগল ছাগল, জ্বি নে ধরা, ভূতে ধরা, যাই ইচ্ছে তাই হোক আমার মেয়েটাকে নিয়ে এতকিছু ভাবার জন্য ধন্যবাদ। নাসত
একথা বলে উনি ছাদ থেকে নেমে এলেন। রোদ চড়ে গেছে দেখে কুহু অনেক আগেই নেমে এসেছে। উনি ডায়নিং টেবিলের চেয়ার বসলেন। তারপর আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আর কত!

ইন সুইজারল্যান্ড,
দিনটি রবিবার। সময় রাত আটটা। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে ডিনার
করতে বসেছে রিদওয়ানের পরিবার। সবাইই খাচ্ছে। নিলুফা ইয়াসমিন আতিকুল রহমানের সঙ্গে শপ নিয়ে কথা বলছেন।

আজ রিমির পছন্দের ডিশ রান্না হয়েছে। সেও মজা করে খাচ্ছে। তখন রিদওয়ানও এসে বসল। সামান্য খাবার তুলে নিলো প্লেটে। চামচ দিয়ে খাবার মুখে পুরো কিছু ভাবল। তারপর কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে
ধীরে সুস্থে কুহুর সমস্যর কথা জানাল। জানাল, কুহু আর রুপক এখানে আসবে। থাকবে। চিকিৎসা করাবে। তাদের যেন সমস্যা না হয় সেটাও দেখতে হবে এই বাসার প্রতিটা সদস্যকে। এই নিয়ে যেন কেউ ভুলেও টু শব্দটি না করে৷ কোনো অভিযোগও তার কানে না আসে। তাছাড়া ওরা গেস্ট হিসেবে নয় আসবে এই বাসায় সদস্য হয়ে। তাই তাদেরকে় যেন সেভাবেই ট্রিট করা হয়। আর কুহুর চিকিৎসার কথা যেন আগ বাড়িয়ে তাকে কেউ না বলে। এখানে আসার পর ধীরে সুস্থে নাহয় বোঝানো যাবে। একথা বলে রিদওয়ান রিমিকে বলল,

-‘কুহুর আইডি লিংক তোমার ইনবক্সে পাঠিয়েছি। তোমার দায়িত্ব কুহু আসার আগেই তার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা সহজ করা। সে যেন তোমার
সঙ্গে কথা বলে, মিশে, এখানে আসার আগ্রহ পায়।’
-‘পারব না।’
-‘কি?’
-‘পারব না এসব করতে৷’
-‘কেন?’

-‘কেন করব? চিনি না, জানি না। আর তুমি তার জন্য এত হাইপার হচ্ছো কেন ভাইয়া? যার বোন সে নাহয় এসব বুঝে নিবে। আর এদেশে থাকার জায়গায় অভাব আছে নাকি? আমাদের বাসায় কেন আসবে? কতদিন থাকবে তারও ঠিক নেই। তোমার বন্ধু বলেই কি আজাইরা প্যারা নিতে হবে আমাদের?’
-‘কলেজ কি শুধু আড্ডা দিতেই যাও নাকি কিছু শিখতে যাও? একজন স্টুডেন্ট হয়ে তোমার বিহেভিয়ার ছোটলোকের মতো হলে কবে? এটা আশা করি নি তোমার থেকে।’
-‘কার না জন্য তুমি আমাকে ছোটলোক বললে?’

-‘বললাম। তো? বড় হোচ্ছো আদব কায়দা শিখো। সব সময় ফাজলামি করা ছ্যাচড়াদের কাজ।’
-‘আমি বেয়াদব। ছ্যাচড়া। ছোটলোক। তাই এসব ভদ্র কাউকে দিয়েই করিয়ে নাও। আমি পারব না তাইই সরি।ঙ্গিবাদ
একথা বলে রিমি উঠে দাঁড়াল। রিদওয়ান শান্ত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। বহুদিন পর ভাইয়ের এমন সর্পশীতল দৃষ্টি দেখে রিমি চুপ করে চেয়ারে বসল। তারপর মাথা নত করে রইল। নিজেও বুঝল বেশি বলে ফেলেছে। তখন রিদওয়ান বলল,

-‘অহংকার জিনিসটা নিজের মধ্যে থেকে ঝেড়ে ফেলো। ভাইরা যেমন বোনদের গর্ব। তেমনি বোনরাও ভাইদের গর্ব। এমন কিছু কাজ কোরো না বা বোলো না যেন রুপকের কাছে আমাকে ছোটো হতে হয়। কখনো কেউ বলতে না পারে আমাদের শিক্ষায় ক্রুটি থেকে গেছে।’

একথা বলে রিদওয়ান না খেয়েই উঠে চলে গেল। আতিকুল রহমান এত ডাকলেও শুনল না। বোনের ব্যবহারে পুরোপুরিই হতাশ রিদওয়ান। তার ধারণা ছিল রিমির সাপোর্ট পাবে। আর এতদিন ভেবেছিল রিমি যথেষ্ট উদার মনে। কিন্তু এখন মনে হলো চাকচিক্যময় জীবনে বোনটাকে সে সঠিক শিক্ষায় দিতে পারে নি। তাদের শিক্ষায় ক্রুটি থেকে গেছে। নতুবা তার ব্যবহারে অহংকার প্রকাশ পেতো না। এদিকে এ প্রথমবার ভাইয়ের
বকা খেয়ে রিমি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছে ছিল তার আর ম্যাকসানের সম্পর্কের কথা আজকালকের মধ্যে রিদওয়ানকে জানাবে। কিন্তু এ আপদগুলো সব ভেস্তে দিচ্ছে। এরা কবে যাবে তারও ঠিক নেই। তাই ভীষণ বিরক্ত এসে কুহুদের প্রতি। আর তাই বিরক্ত নিয়েই সে মনে মনে বলল,

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২২

-যাদের কারণে আমাকে এতগুলো কথা শুনতে হলো। ঠিক আছে, তারা আসুক। তাদের এখানে থাকা যদি হারাম না করেছি তো আমার নামও রিমি না। আর ভাইয়া নিষেধ করল কুহুতে এসব কথা না জানাতে। সে আমার প্ল্যান ভেস্তে দিলো তো এবার আমিই কুহুকে সবার আগে জানাব তার সমস্যার কথা। বলে দেবো তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য আনা হচ্ছে।’

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৪