দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১
অবন্তিকা তৃপ্তি
‘ভেজা শাড়িতে এক যুবতী কন্যা পুকুর থেকে গোসল করে উঠছে’
দক্ষিণের ঘরের জানালা থেকে দৃশ্যটি দেখে অনিরূপের গায়ের সমস্ত লোম সোজা হয়ে গেলো। ভেজা শাড়িতে যুবতী মেয়েটাকে কী অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে- দেহের সমস্ত ভাঁজ কী নিদারুণ, আবেদনময়ী-মাথা নষ্ট সৌন্দর্য্যে নারীর শরীরের আগাগোড়া ডুবে। অসম্ভব মাতাল দৃশ্য দেখে অনিরূপ চোখ সরাতে পারল না।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটখানা ভিজিয়ে নির্লজ্জের ন্যায় চেয়েই থাকল। অনিরূপ কে জানালার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে- ভাই অরূপ পায়েসের বাটি রেখে উঠে আসলো। অনিরূপের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেও জানালা দিয়ে তাকালো। একটা মেয়ে ভেজা গায়ে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকছে। শুধু এটুকুই দেখল অরূপ। অনিরূপ বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে জানালার দিকে মুখ করে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল অনিরূপ- ‘মেয়েটা কে?’
অরূপ একবার উত্তরের ঘরে উঁকি দিল। মেয়ের বোন বোধহয়-এসে একটা গামছা মেয়ের গায়ে জড়িয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। অরূপ আশপাশ দেখে বুঝলো, উত্তর করল- ‘ওর নাম আশা। তোমার হবু স্ত্রী। আমরা ওকেই দেখতে এসেছি আজ।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিধি আশাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। মনেমনে নিধি আশার উপর প্রচণ্ড বিরক্ত। ইচ্ছে করছে, আশার দুগালে থাবড়াতে। আজ পাত্রপক্ষ আসবে, সকাল থেকে আশাকে এ কথা পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সাবধান করা হয়েছে, আজ বাড়ি ছেড়ে যে বেরুবে তাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেওয়া হবে। অথচ আশা তো আশা-ই। নিধি গোসলে যখন গেলো, এই ফাঁকে আশা কখন যে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলো কেউ জানলো না।
আশাকে ইচ্ছেমতো বকাঝকা করে শাড়ি পরানোর সময় নিধি লক্ষ করল, আশার হাতগুলো শীতে কেমন কুচকে আছে। প্রায় এক ঘণ্টা পুকুরে গোসল করেছে, পানির তো একটা প্রভাব পড়বেই। নিধি আশার কুচকে যাওয়া হাত খামছে ধরে রেগে জিজ্ঞেস করলো-‘হাত এমন কেন হয়েছে? পানিতে ভিজবি ভালো কথা। সবসময়ই ভিজিস, কিন্তু আজ তোকে মানা করা হয়নি? বল, হয়নি? শ য়তা নের বাচ্চা, জ্বা লিয়ে মারলি আমারে।’
আশা ঠোঁট উল্টে নিধির দিকে তাকাল। কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে বললো-‘আপা, আমি গোসল আজ করতাম না। মৌলিদের বাড়ির উঠোনে কাদায় পড়ে গেছিলাম, সত্যি।’
নিধি শুনলো না। রোজ রোজ এমন অজুহাত কে শোনে, পাগল ছাড়া। নিধি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভ্যাসলিন নিয়ে আশার দুহাতে মাখিয়ে দিল। আশা হতাশ গলায় নিজের নরম হয়ে আসা হাতের দিকে চেয়ে বললো- ‘আপা, হাত নরম করে কী লাভ? পাত্র কী আমার হাত ছুঁবে?’
নিধি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আশার গায়ে শাড়ি সেপটিপিন দিয়ে আটকে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে বললো-‘না, কিন্তু নজর হাতের দিকে গেলে যেন তোর হাত দেখে তার কোন খসখসে লাঠি না লাগে, সেজন্যে। শোন আশা, বড় ঘরের আলাপ। ঘেঁটে দিস না কোনোভাবেই, নাহলে খবর আছে তোর।’
আশা নিধির দিকে এবার নরম চোখে তাকাল। নিধি আশাকে নিয়ে কত চিন্তা করে! আশা আবেগে নিধির হাতখানা ছুঁয়ে বললো-‘আপা, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার বিয়ে কিভাবে হবে? তুমি সারাজীবন কি এভাবেই থাকবে, বলো।’
নিধি বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে আশার ঘরের। কাজে মন দিয়ে নজর লুকানোর চেষ্টা করে বললো-‘ডিভোর্সিদের বিয়ে একবারই হয়, বারবার না। এখন দ্রুত মুখে কিছু লাগা। পাত্র অপেক্ষা করছে।’
নিধি আশাকে নিয়ে এলো পাত্রপক্ষের সামনে। আশার হাতে চায়ের ট্রে। অনিরুপ তীক্ষ চোখে হেঁটে আসা আশার দিকে চেয়ে আছে। চোখ দিয়েই আশার শরীরের মাপ নেওয়ার কী নিদারুণ চেষ্টা তার। নিধি মৃদু হেসে সবাইকে বললো-
‘আমার বোন, নাম প্রণালী রহমান আশা। ও পাত্রী।’
অনিরূপের মা, ওয়াহিদা আরা মৃদু হেসে বললেন,’ভীষণ সুন্দর নাম, আশা।’’
আশা সবাইকে ধীরে ধীরে চা এগিয়ে দিলো। অনিরূপকে চায়ের কাপ দেওয়ার সময় অনিরুপ ইচ্ছে করে আশার হাতে আঙুল ছুয়ে মৃদু হাসলো। আশার গায়ে কাটা দিল যেন। আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে আশা চমকে হাত সরিয়ে অনিরুপের দিকে তাকাল। অনিরূপ চায়ে চুমুক দিচ্ছে, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে, আশার দিকে চেয়ে। আশার কেন যেন মনে হল, অনিরূপ কাপে নয় বরং আশাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আশা থতমত ভঙ্গিতে অনিরূপের দিকে চেয়ে সোফায় বসলো। অনিরূপের মা ওয়াহিদা বললেন:
‘আশা, পড়াশোনা কতদূর করেছো?’
আশা নম্র গলায় জবাব দিলো-‘এবার অনার্স এ ভর্তি হবো।’
ওয়াহিদার হালকা হেসে বললেন-‘অনার্সে ভর্তি করে কিছু করার ইচ্ছা আছে?’
আশা নিধির দিকে তাকাল। নিধি বুঝতে পারল ওয়াহিদার কথার অর্থ। সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলো-‘না না, পড়াশোনাটা করছে আরকি। এখন সংসারেই মন দিবে আশা।’
আশা বোনের দিকে একবার চেয়েই চোখ সরিয়ে নিল। নিধির কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রহমান সাহেব বললেন-‘হ্যাঁ, আশা ভালো কাজ জানে আপা। আমার ঘরের কাজ তো ওরা দুই বোনই সামলায়। কাজে ভীষণ-ই পটু।’
ওয়াহিদার উত্তরটা মনঃপুত হলো। তিনি হালকা হেসে অনিরুপের দিকে তাকালেন। অনিরূপের তীক্ষ দৃষ্টি তখনো আশার উপর নজর রাখছে। ওয়াহিদা বললেন-‘তোর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে অনি?’
অনিরূপ চায়ের কাপ টেবিলে রাখল। আশা অপ্রস্তত চোখে একবার অনিরুপের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল আবার। অনিরূপ বললো-‘একবার আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি’
একটু থেমে আশার দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বললো- ‘আলাদাভাবে।’
অনিরূপের ওমন করে বলা, তাকানো সবেতেই শিরশির করে উঠল আশার সমস্ত গা। পাত্রের মুখে বেশরম কথা শুনে নিধি ও রহমান একে অন্যের মুখের দিকে চাইলেন। সবার মুখেই অপ্রস্তুত ভাব ছড়িয়ে গেলো। ওয়াহিদা গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে কাশলেন। সবার মুখের দিকে চেয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললেন-‘পাত্র-পাত্রীর জীবন, বিয়ে যেহেতু ওরাই করবে। একটু আলাদা কথা বলে নিক ওরা, আমরা নাহয় বাকি কথা আলাপ করে নিব।’
নিধি আশার দিকে তাকাল। আশা ইশারায় মুখ দিয়ে মানা করছে বারবার। আশা চাইছে না দেখে- নিধি রহমানের দিকে তাকাল। রহমান সাহেব হালকা হাসার চেষ্টা করে বললেন-‘আশা, অনিরূপ বাবাকে আমাদের বারান্দা ঘুরিয়ে আনো, যাও।’
আশা নিধির দিকে তাকাল। নিধি আশার হাতে হালকা চাপ দিয়ে ভরসা দিল। অনিরূপ উঠে দাঁড়াল।গায়ের কালো পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে আশার দিকে তাকালো। আশা অনিরূপের দিকে একবার চেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দার দিকে গেল, পেছনে অনিরুপ আশার কোমরের দিকে চেয়ে হাঁটছে।
বারান্দায় নানারকমের গাছ লাগানো। অনিরূপ গাছগুলো একটা একটা করে ছুঁয়ে দেখছে। আশা এক কোণায় কোনঠাসা হয়ে শাড়ির আঁচল খামছে দাঁড়িয়ে আছে। অনিরূপের একেকটা আচরণ আশার গলায় কাঁটার মতো বোধ হচ্ছে। অনিরুপ লাল গোলাপের গাছটা দেখতে দেখতে বললো-‘ফুলের ঘরে ফুল? ইন্টারেষ্টিং। তবে অনিরূপের ফুলে নয়, ফুলের কাটায় বেশি ঝোঁক।’
কথাটা বলে অনিরূপ একটা টকটকে লাল গোলাপ ছিঁড়লো গাছ থেকে। আশা অনিরুপের হাতে থাকা গোলাপের দিকে তাকিয়ে আছে। অনিরূপ গোলাপের পাপড়ি একটার পর একটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে প্রশ্ন করলো-‘পড়াশোনা যতদূর করেছো, ওটুকুই এনাফ। শেখ বাড়ির বউদের পড়াশোনা করে লাভ নেই, সংসারে মন দিয়ে লাভ।’
আশা কিছু বললো না। বরং অবাক চোখে অনিরুপের হাতে সুন্দর এক গোলাপ ফুলের ধ্বংস দেখছে। আশা মুখ ফুটে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু অনিরূপ তার আগেই আশাকে বলতে না দিয়ে নিজেই বলে বসলো-
‘গান গাইতে পারো?’
আশা থামলো। পুরনো কথা গিলে ফেলে উত্তর দিলো-‘টুকটাক।’
আশা ভেবেছিল, অনিরুপ গান গেয়ে শোনাতে বলবে। কিন্তু অনিরুপ আশাকে অবাক করে বললো-‘গানের গলা কণ্ঠ অব্দিই যেন আটকে থাকে। গলার বাইরে আসলে বিপদ।’
আশা থমকে চেয়ে দেখছে অনিরূপকে। এ কেমন অদ্ভুত ছেলে? আশার এখন এই ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে? আশা জেনেবুঝে একটা জাহান্নাম পরিবারে যাবে? নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বোধহয় এটাকেই বলে। নিজের ভাগ্যের উপর হাসলো আশা।
অনিরূপ থামে, ঘেমে ভিজে যাওয়া আনমনা আশাকে একনজর দেখে শব্দ করে হেসে উঠে বললো—‘আরে ভয় পেয়ে গেলে নাকি? ভয় পেও না, মাঝেমধ্যে আমাকে গান শোনাতে পারো, অনুমতি আছে।’
আশা ঢোক গিলে। আশার বোঝা হয়ে গেছে- এই মানুষটাকে আশার কখনোই গান গেয়ে শোনানো হবে না। গান একটা শিল্প, কিন্তু অনিরুপ শিল্পের পূজারী নয়। আশা অনিরূপের দিকে চেয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু কথাগুলো যেন ঝট পাকিয়ে আশার গলায় আটকে আছে। অনিরুপকে আশার মোটেও সুবিধার ছেলে লাগছে না। কনে দেখতে এসে অনিরুপ চূড়ান্ত অভদ্রতার পরিচয় ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে।
‘বাই দ্য ওয়ে, তোমার বডির মাপ কত?’
হুট করে বলে বসলো অনিরূপ। এতক্ষণ সব ঠিক থাকলেও, এই কথা শুনে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেলো আশা। থমকে তাকাল অনিরুপের দিকে। অনিরূপ আবারো প্রশ্ন করল -‘বলো?’
হতবম্ব আশা অস্বস্তিতে ডুবে মুখটা অন্যপাশে ফিরিয়ে বললো-‘জানিনা।’
‘নিজের বডির মাপ নিজে জানো না? কেমন মেয়ে তুমি?’
অনিরুপ যেন এবার সমস্ত বাঁধ ভেঙে ফেলল। অভদ্রতার সবোর্চ্চ সীমা অতিক্রম করে নিলো। অনিরুপের প্রত্যেকটা অপমানজনক কথা আশা সহ্য করলেই, নিজের শরীর নিয়ে এই কথাটা আশা একদমই নিতে পারলো না। আশা এবার নিজের শান্ত চরিত্র আর ধরে রাখতে না পেরে ক্ষেপে গিয়ে গরম চোখে তাকাল, ভস্ম করা রাগ নিয়ে বললো -‘না। আমাদের গ্রামে এসব হয়না। আর মেয়েরা এসব নিয়ে মাথাও ঘামায় না। আপনাদের শহরে এসব চলতে পারে। মেয়ে দেখতে এসে প্রথমদিন যে পুরুষ এ কথা জিজ্ঞেস করতে পারে, সে কেমন পুরুষ আমার বোঝা হয়ে গেছে।’
আশা কথাটা বলে খামছে ধরা শাড়ির আঁচল ছেড়ে মুখ ঝাঁমটা দিয়ে চলে যেতে নিলো। অথচ অভদ্রের ন্যায় অনিরূপ এবার রীতিমত আশার হাত চেপে ধরল। আশা একপ্রকার থমকে পেছনে তাকাল। অনিরূপ আশার হাতের কব্জি এতটাই শক্ত করে ধরেছে যে আশার মনে হচ্ছে হাড্ডি আর একটাও আস্ত নেই।
আশা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে হাত ওর পিঠের পেছনে মুড়ে অনিরূপ কড়া স্বরে বললো -‘অনিরূপকে মুখ ঝামটা দাও? বিয়ে করছি না? এত ন্যাকামি কেন করছো? হবু স্ত্রীর বডি কতটা অ্যাট্রাকটিভ- বিয়ের আগ আমার জানা উচিত, রাইট? বিয়ের পর জেনে কী লাভ? ছাড়তে তো পারব না তখন।’
ছিঃ, অনিরুপের কথায় আশার নিজের উপরই ঘৃণা ধরে গেল। এতটা নোংরা চিন্তাভাবনা কেউ আশাকে নিয়ে করতে পারে-সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আশা। আশা এবার হাতটা যতটা পারে জোর করেই ছাড়িয়ে নিলো। কঠিন চোখে অনিরুপের দিকে চেয়ে বললো-‘এইজন্যে?এইজন্যে বিয়ে করার এত তাড়া আপনার? শরীর চাই মেয়েদের? তাহলে বিয়ে না করে কোঠায় চলে যান। জেনে রাখুন- আমি আপনার মতো অভদ্র কোন ছেলেকে বিয়ে করছি না। আমি আজই এটা নিয়ে আব্বাকে বলবো, ছিঃ। আপনি প্লিজ আমার সামনে আর আসবেন না, আমার আপনাকে দেখলেই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।’
আশা ঘেন্নার দৃষ্টি অনিরূপের দিকে ছুঁড়ে বারান্দায় অনিরূপকে একা রেখেই চলে গেল। অনিরূপ ছিঁড়া গোলাপ মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পি ষে দেয়ালে এক হাত ঠেসলো। আশার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো-‘বিয়ে করবে। না করে যাবেটা কোথায়? তুমি করবে, তোমার ঘাড়ও করবে।নামটা কী যেন? আশা? নাহ, আশাবরি।’