পূর্ণতা পর্ব ৩১
নন্দিনী নীলা
ডায়েরী হতে অতীত,
তপ্ত দুপুর সূর্য খাড়া হয়ে পূর্ণতার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণতার পরনের কলেজের সাদা,নীল ড্রেস। মাথায় হিজাব, কাঁধে স্কুল ব্যাগ। গরমে পূর্ণতার ফরসা মুখশ্রী লাল হয়ে উঠেছে, কপালে ও নাক বেঁয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। শরীর ঘামে ভিজে উঠছে। পূর্ণতা খাম্বার মতো শক্ত হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর পায়ে কালো জুতো। পূর্ণতা টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল। গরমে ওর শরীর যেন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাতের ওর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। পূর্ণতার নজর আটকে আছে একজায়গায়। আশেপাশে গাছের অভাব নেই কিন্তু পূর্ণতা শক্ত হয়ে এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যেন রোদের তাপে ইচ্ছে করে তার শরীর পুড়ছে।
হঠাৎ কারো ধাক্কায় সম্মতি ফিরে পেল পূর্ণতা।
পূর্ণতার কলেজের নিউ ফ্রেন্ড রুপা বলল,“ এই পূর্ণ কি হয়েছে তোর? এমন ঠাটা পড়া রোদের তাপে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
পূর্ণতা তাকাল ওর দিকে তারপর মুখে আঙুল চেপে বলল,” শশ আস্তে কথা বল। আমি একজনের উপর নজর রাখছি।”
কপাল কুঁচকে এলো রুপা নিচু স্বরে বলল,“ কার উপর?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
পূর্ণতা ওকে টেনে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তারপর দুজনেই গাছের আড়াল থেকে মাথা বের করে উঁকি মারল। পূর্ণতা হাত উঁচু করে সামনে একটা ছেলে ও মেয়েকে দেখাল দুজনে বেঞ্চের উপর বসে কিছু নিয়ে কথা বলছে। ছেলেটা কিছু বলছে মেয়েকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পূর্ণতা জ্বলন্ত আঁখি পল্লব এ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল ধ্যানজ্ঞান ভুলে।
রুপা একপলক দুজনকে দেখে পূর্ণতা কে ফিসফিস করে বলল,“ তাদের উপর নজর রেখে কি করবি? তারা হয়ত গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। দেখিস না মেয়েটা কাঁদছে মনে হয় বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই বয়ফ্রেন্ড তাকে বুঝাচ্ছে। এদের দেখে আমাদের কি কাজ?”
রুপা নিচু স্বরে বলে তাকাল পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতা ওকে টেনে গাল বরাবর থাপ্পর দিয়ে বসল।
রুপা গাল ধরে অবুঝ কন্ঠে বলল,“ কি হলো মারলি কেন?”
পূর্ণতা আরেকবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ওই দু’জন কে দেখে তোর গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড মনে হচ্ছে?”
রুপা পূর্ণতা রাগে কটমট চেহারা দেখে ঢোক গিলে বোবা বনে গেল।
পূর্ণতা রাগে অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করে বলল,“ ও কে জানিস?”
রুপা মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দিল।
পূর্ণতা বলল,“ ওটা প্রভাত।”
রুপা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,“ কিহ? তোর বয়ফ্রেন্ড প্রভাত?”
পূর্ণতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ হুম। আজকে ওর একদিন কি আমার যতদিন লাগে। ওর কত বড়ো সাহস ও গার্লফ্রেন্ড থাকতে আরেক মেয়ে নিয়ে পার্কে আসে।”
রুপা বলল,“ তোকে ঠকালো।”
পূর্ণতা রাগে কাঁপতে কাঁপতে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল প্রভাতের দিকে। প্রভাত একটা মেয়েকে নিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। পূর্ণতা আর রুপার কলেজ থেকে এই পার্ক দশ মিনিটের রাস্তা। কলেজ শেষ হয়েছে আজ আগেই। সবগুলো ক্লাস হয়নি। এজন্য দুই বান্ধবী মিলে পার্কে এসেছে। পূর্ণতা কলেজে এডমিশন নিয়েছে একমাস হয়েছে। এই পার্কে এখনো আসা হয়নি এজন্য আজ সুযোগ পেয়েই দুই বান্ধবী চলে আসে। এসে পূর্ণতার নজরে পরে প্রভাত ও একটা মেয়ের উপর। দুজনে বেঞ্চে বসে আছে মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর প্রভাত তাকে কি যেন বলছে দুজনকেই ভালো মতো দেখা যাচ্ছিল। ওদের একসাথে দেখে পূর্ণতার তো সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। রাগে কাঁপতে থাকে ও। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।
পূর্ণতার পিছু রুপা ও এগিয়ে আসছে। এক মাসেই দুজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
এজন্য তো বান্ধবীর হাতের থাপ্পর খেয়েও ওর মধ্যে রাগের ছিটেফোঁটা নেই।
পূর্ণতা কে দেখে চমকে উঠে প্রভাত।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,“ পূর্ণতা তুমি এখানে? এখন তো তোমার ক্লাস টাইম।”
পূর্ণতা একপলক রাগী চোখে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে তাকাল পাশের বসে থাকা মেয়েটার দিকে। মেয়েটি পূর্ণতা ও রুপার উপস্থিতিতে কান্না থামিয়ে দিল।
পূর্ণতা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,“ হুম ছিল কিন্তু আজকে দুইটা ক্লাস হয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। নয়তো জানতেই পারতাম না তুমি আমার চোখের আড়ালে কি করে বেড়াও। আরেক মেয়ে নিয়ে পার্কে এসে বসে আছো?”
প্রভাত কিছু বলতে যাবে পূর্ণতা হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে বলল,“ কিছু বলো না। তুমি এখন বলবে এটা তোমার গার্লফ্রেন্ড না। বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। হ্যানত্যান, আমার সেসব শুনে সময় নষ্ট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এই মেয়ে তোমার গার্লফ্রেন্ড হলেও আমার কিছুই যায় আসে না। কারণ আমার এতো দয়ার শরীর না যে আমি তোমাদের একসাথে দেখে কেঁদে কেটে চলে যাব, তোমাকে মেয়ের সাথে ফেলে যাব। নো নেভার। আমার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে প্রেম করার অপরাধে আমি এই মেয়েকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব নচেৎ আমার নাম পূর্ণতা নয়।”
বলেই ক্রোধের সাথে এগিয়ে গেল পূর্ণতা মেয়েটির দিকে এবং খামচে ধরল ওর মাথার চুল। শক্ত করে টেনে ধরে বলল,“ তোর এতো বড় সাহস তুই আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পার্ক এসে ন্যাকামি করে কাদিস? আমার বয়ফ্রেন্ডের দিকে হাত বাড়ানো হাত আমি আজ ভেঙে দেব। যে চোখ দিয়ে প্রভাতের দিকে নজর দিছিস ওই চোখ আমি গেলে দেব।”
বলেই পূর্ণতা ওর হাত মোচড়ে দিল। প্রভাত বিস্ময়ে, হতবাক, নির্বাক। দৌড়ে গিয়ে প্রভাত পূর্ণতা কে ধরার আগে আরেকটা ছেলে দৌড়ে মেয়েটাকে ধরল।
প্রভাতের দিকে চেয়ে ছেলেটি অসহায় কন্ঠে বলল,“ প্রভাত তাড়াতাড়ি তোর গার্লফ্রেন্ড কে থামা। এই মেয়ে তো নিধির অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে।”
প্রভাত দৌড়ে এসে দুহাতে পূর্ণতার হাত চেপে ধরে ওকে টেনে সরিয়ে আনল নিধির থেকে। নিধি ছাড়া পেতেই বলল,“ এটা কি মেয়ে নাকি ডাইনি।”
পূর্ণতা চিৎকার করে উঠল,“ তুই ডাইনি, শাকচুন্নী।”
পূর্ণতা রাগে কাঁপছে। প্রভাত ওকে শান্ত করতে ওর দু গালে হাত রেখে বলল,“ এতো রাগ কেন? এতো রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলেছিলাম না? এতো রাগ করতে মানা করেছিলাম।”
পূর্ণতা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,“ ছাড়ো আমাকে। ওই মেয়েকে আমি মেরে ফেলব। ও কীভাবে তোমার সাথে এখানে এসেছে ও জানে না তুমি শুধু আমার।”
“ দোষ তো শুধু ওর না আমার ও তাহলে একা ওকে মারছো কেন?”
“ তোমাকে আমি কিছু করব না ভেবেছ? আমি ভালোবাসি তোমায় তাই বলে সব মেনে নিব এতো সোজা না। আমি আগে ওকে মেরে তোমার জীবনে থেকে সরাবো। তারপর তোমার ব্যবস্থা করব। আমার মতো কিউট সুইট একটা মেয়ের এতো ভালোবাসা পেয়েও ওই ডাইনি শাকচুন্নী মেয়ের সাথে তুমি এখানে এসেছ? লুচ্চামি করার জায়গা পাও না? আমি থাকতে তুমি ওই মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ করো।”
প্রভাত ওর কথায় হেসে ফেলল।
“ আমার কথা শুনে তোমার হাঁসি পাচ্ছে?”
প্রভাত বলল,“ না হাসছি না সরি তুমি বলো না।”
“ ভাবি আপনি শান্ত হোন। আপনার আর কাউকে শাস্তি দিতে হবে না। নিধি আমার গার্লফ্রেন্ড। প্রভাত শুধু আমাকে হেল্প করছিল। কিন্তু আপনি যা করলেন আগে জানলে আমি আরো একমাস নিধির রাগ সহ্য করতাম। তবুও প্রভাত এর সাহায্য নিতে আসতাম না। এখন এক মাস কি নিধি মনে হয় আমার সাথে ব্রেকাপই করে দিবে। প্রভাত তোর গার্লফ্রেন্ড এতো ডেঞ্জারাস আগে বলবি না। জুড়তে এসে আরো ভেঙে গেল সম্পর্কটা।”
বলেই ছেলেটি রাগী নিধির পিছু গেল। পূর্ণতা কপাল কুঁচকে ছেলেটার কথা শুনল। প্রভাত পূর্ণতা কে বেঞ্চে বসিয়ে পূর্ণতা ব্যাগ থেকে মামপট বের করে বলল,“ পানি খাও।”
পূর্ণতা ঢকঢক করে পানি খেয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকাল প্রভাতের দিকে।
প্রভাতের মুখে মিটিমিটি হাঁসি। পূর্ণতা অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বলল,“ ওটা তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না?”
প্রভাত গা ঝাড়া দিয়ে বলল,“একটা কেই সামলাতে পারি না। আরো?”
“ ইশ ওনারা আমাকে কি ভাবল?”
লজ্জায় পূর্ণতার চোখমুখ শুকিয়ে এলো।
প্রভাত বলল,“ যে রূপ আজ দেখালে আরেক মেয়ে দিকে এখন তাকাতেও তো আমার ভয় করবে। বাপরে এতো রাগ কারো থাকে?”
পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে বলল,“ তো কি তুমি ভাবো আমি এসব দেখেও শান্ত থাকব? আমার বান্ধবী রুপা কে জিজ্ঞেস করো ও নিজেও তোমাদের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভেবেছে। আমার ভাবাটা কি ভুল?”
“ তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারতে। এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে আসলে নিধি তো বেচারা উপর আরো রেগে গেল। এমনিতেই দুজনে একমাস যাবত রাগারাগী করে কথা বলছে না। এরপর তো মুখ ও দেখবে না।”
“ সরি কিন্তু এটা যদি সত্যি তোমার গার্লফ্রেন্ড হতো আমি ওকে মেরেই দিতাম।”
“ তা আর বুঝতে বাকি নেই। আপনার রাগের সাথে আমি পরিচিত হয়ে গেছি অনেক আগেই। এবার এই অধম কে ক্ষমা করেন।”
“ বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের সাথেও আমি তোমায় সহ্য করতে পারব না বুঝেছ। মেয়েদের থেকে দশ হাত দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। নয়তো আমার এই রূপ তুমি অনেকবার দেখবে।”
প্রভাত পূর্ণতার হাত ধরে বলল,“ রাগ কমাও তো। রাগে নাকমুখ লাল করে ফেলেছ। এখন তো জানো তোমার প্রভাত তোমার ই আছে। অযথা রাগ করে আর মাথা গরম করো না। এখন আসো একটু প্রেম করি। বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের রাগ তো কমাতে পারলাম না। তুমি চলে এসেছে এখন প্রেমটা অন্তত করতে দাও।”
পূর্ণতা ওর হাত থেকে হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে বলল,“ দূরে যাও আমার থেকে। এখন প্রেম পাচ্ছে তাই না? তোমাকে আমি বলেছিলাম না যা করবে করার আগে আমাকে আগে জানিয়েছেন নিবে। আগে থেকে জানালে কি আমার এমনটা করতাম? সব তোমার জন্য হয়েছে তারা আমায় এখন কি ভাবছে ছিঃ আমার খুব লজ্জা লাগছে।”
“ কিন্তু তোমার ওই রূপ দেখে আমার কিন্তু ভীষণ মজা লেগেছে।”
পূর্ণতা নাক কুঁচকে বলল,“ কিহ?”
পূর্ণতা কে দুহাতে প্রভাত জড়িয়ে ধরতে চাইল। পূর্ণতা লাফ দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,“ এই রুপা এখানে আয় ওতো দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
চমকে উঠে প্রভাত দুহাত গুটিয়ে নিল। এবং রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,“ আসেন আসেন পাবেন লজ্জা পাবেন না।”
রুপা এগিয়ে এসে পূর্ণতার কানে কানে বলল,“ আমি যাই তোরা প্রেম কর। তোদের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। কাল দেখা হবে। বায়।”
রুপা প্রভাতের দিকে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,“ ভাইয়া নেক্সট টাইম আমার মাথা গরম বান্ধবী কে সব জানিয়ে করবেন। এমন রাগ করেছিল এই দেখেন আমার গাল লাল করে ফেলেছে আপনার উপর রাগ করে। আপনি উল্টোপাল্টা কিছু করলে শুধু আপনি না ওর আশেপাশের সব মানুষকে ও নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।”
প্রভাত হেঁসে ফেলল ওর কথায়। রুপা বিদায় নিয়ে চলে যেতে পূর্ণতা আড়চোখে তাকাল প্রভাতের দিকে তারপর বলল,“ হাসছেন কেন?”
প্রভাত এগিয়ে এসে পূর্ণতাকে দুহাতে বাহুডোরে আবদ্ধ করে জড়িয়ে ধরে বলল,“ ভাবছি আমি না থাকলে এই মেয়েটির কি হবে? তখন কিভাবে তার দিন কাটবে।”
পূর্ণতা ওর হাতের বাঁধন আলগা করে বুকে কিল মেরে বলল,“ আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? একেবারে মেরে ফেলবে আমায় ছারতে চাইলে।”
পূর্ণতা পর্ব ৩০
প্রভাত পূর্ণতার চোখে চোখ রেখে বলল,“ পাগলি প্রভাত তার পূর্ণতা কে রেখে কোথায় যাবে? কোথাও গিয়ে কি আমি শান্তিতে থাকতে পারব? যেখানে পূর্ণতা যেখানে প্রভাত।”
পূর্ণতা এক চিলতে হেসে শক্ত করে প্রভাত কে জড়িয়ে ধরল।