আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ৯
জেনিফা চৌধুরী
৮মাসের বড় পেট নিয়ে যখন চোখের সামনে তারিন পা পিছলে ওয়াশরুমে পড়ে গেলো, তখন মনে হলো এই বুঝি ওর বেঁচে থাকার সময় ফুরিয়ে এসেছে। জোরে চিৎকার করারও সুযোগ পেলো না। নিচে পড়ে যাওয়ার টাইমে বেসিনের সাথে মাথায় আঘাত লাগলো। নিচে পড়ে যাওয়ার পর এক মুহূর্ত চোখ খুলে রাখতে পারলো না। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসার আগে শরীরে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে অস্ফুটে স্বরে ‘মাস্টার মশাই’ বলে ডেকে উঠলো।
অতঃপর চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসলো। তামজিদ তারিনকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ছাদে গিয়েছিলো জামা কাপড় আনতে। রুমে ঢুকে একবার ‘তারিন’ বলে ডাকলো। কিন্তু ওপাশ থেকে শব্দ আসলো না। তামজিদ বাসায় থাকলে তারিনকে নিয়ে একসাথে গোসল করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। গোসল করার জন্যই ছাদে জামা-কাপড় আনতে গিয়েছিলো। আর তারিন টয়লেট ব্যবহারের জন্য আগে ঢুকেছে। তামজিদ পুনরায় একবার ডেকে বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“তোমার হয়েছে? তাহলে আমি ঢুকি?”
এবারও ওপাশ থেকে শব্দ আসলো না। ভেতর থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে। তা শুনে তামজিদ ভাবলো তারিন পানির শব্দে হয়তো শুনতে পাচ্ছে না। তবুও মনের মধ্যে খচখচ করছে একটু। তাই একদম দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা হালকা খুলে ডাকলো,
“ও সোনা। শুনতে পাচ্ছো? আসবো?”
নাহ! এবারও কোনোরকমে শব্দ কানে আসলো না। তামজিদ এবার পুরো দরজাটা খুলে ফেললো। মেঝের দিকে চোখ যেতেই কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করলো। ওয়াশরুমের সারা ফ্লোর জুড়ে রক্তের ছড়াছড়ি। তারিনের পড়নের জামাটাও রক্তে লাল হয়ে আছে। মেয়েটার কোনো হুঁশ নেই। একদম চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে ফ্লোরে। কী আশ্চর্য এভাবে শুয়ে আছে কেনো? ওর তো ঠান্ডা লেগে যাবে। উফ! আর পারলো না এই দৃশ্যটা সহ্য করতে। গলা দিয়েও শব্দও বের হচ্ছে না। হাত পা চলছে না। কি হলো?
শরীর কি অবশ হয়ে গেলো? মস্তিষ্ক কি কাজ করছে না? স্বপ্ন দেখছে? এটা কি স্বপ্ন? এমন বিদঘুটে একটা স্বপ্ন হতে পারে? তামজিদ একবার চোখ বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবার চোখ মেলে তাকাতেই কেমন যেনো বুকের ভেতর প্রচন্ড ব্যাথায় কাতর হয়ে গেলো। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ‘তারু’ বলে চিৎকার করে উঠলো। কোনোরকমে গিয়ে তারিনকে আগে কোলে তুলে নিলো।
সাথে সাথে হাতটা রক্তে মেখে গেলো। তামজিদের চিৎকার শুনে তানহা, তারিনের মা, আমজাদ সাহেব সবাই হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন। উনারা সবাই একসাথে ড্রয়িং রুমে ছিলেন। তামজিদের চিৎকার শুনে একসাথে দৌড়ে আসলেন। তারিনের যখন ৬মাস তখন থেকেই তারিনের মা এখানে এসে থাকেন। তানহাও প্রায় ১৫দিন যাবৎ এখানে এসেছে। সবাই মিলে তারিনকে একদম পুতুলের মতো যত্নে রেখেছিলো। আর আজ হঠাৎ কি হয়ে গেলো! তারিনের মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তানহাও কাঁদছে। তামজিদ তারিনকে বুকে চেপে ধরলো। তানহা তাড়াতাড়ি নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে তারিনের মাথা প্যাঁচিয়ে দিলো। তানহা চিৎকার করে আমহাজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
“বাবা, তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলো।”
আমজাদ সাহেব ছুটলেন সেদিকে। তানহা এবার তামজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, ওর প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। এখন এভাবে ভেঙে পড়ার সময় নয়। তাড়াতাড়ি চল, ভাই।”
তামজদের কান অব্দি কথাগুলো যেতেই তামজিদ উঠে দাঁড়ালো। তারিনকে পাজকোলে তুলে ছুটলো গাড়ির দিকে। তামজিদ, তারিনসহ গাড়িতে উঠে বসলো আমজাদ সাহেব, তারিনের মা।
“ও কাকা, তাড়াতাড়ি চালান। আর কত দূর? আল্লাহ রাস্তা শেষ হয় না কেন? আল্লাহ! তুমি এমন কেন করলা? কি পাপ করছিলাম আমি? আল্লাহ! আমার পাপের শাস্তি এভাবে দিলা? ও বাবা! কি করব আমি? কি হবে এখন? আমার বউ! আমার তারিন! আমার ছোট্ট প্রাণ!”
তামজিদ কিছুক্ষণ পর পর ড্রাইভের উদ্দেশ্যে এভাবে তাড়া দিচ্ছে। আর তারিনকে বুকে আঁকড়ে ধরে যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছে। পাগলের প্রলাপ যাকে বলে। প্রায় ২০মিনিটের মাথায় ওরা এসে পৌঁছালো হসপিটালে। হসপিটালের ভেতরে ঢুকতেই নার্সরা এসে তারিনের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে তারিনের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি পার্লস চেক করলো। তামজিদ অস্ফুট সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“ও ও বেঁচে আছে, আংকেল?”
“বেঁচে আছে তবে…।”
বলেই তিনি থেমে গেলেন। অতঃপর আঁতঙ্কিত সুরে নার্সদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ওহ মাই গড! নার্স তাড়াতাড়ি ও.টি রেডি করো। ওকে নিয়ে যাও।”
জুনিয়র ডাক্তার, নার্সরা তারিনকে নিয়ে যাওয়ার সময় তামজিদ তারিনের হাত ধরে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলো। ডাক্তার ইউসুব তামজিদকে খুব ভালো করেই চিনেন। কারণ তিনি আমজাদ সাহেবের বন্ধু। তামজিদের অবস্থা দেখে আমজাদ সাহেব ডাঃ ইউসুবের হাত জোড়া প্যাঁচিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। কান্নারত স্বরে বললেন,
“আমার মেয়েটার যেনো কিছু না হয় দেখিস।”
ইউসুব সাহেব মিনমিনে স্বরে বলল,
“আল্লাহকে ডাকো। তারিনের অবস্থা মোটেও ভালো না। যেকোনো খবরের জন্য প্রস্তুত থাকো।”
বলেই তিনি চলে গেলেন। তামজিদ হাটু ভেঙে বসে পড়লো। আমজাদ সাহেব গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখতেই তামজিদ বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা! আমার বউ! আমার বাচ্চা! আমার তারিন। আমি কিভাবে বাঁচবো, বাবা? আমি কিসের জন্য বাঁচবো? কত যত্ন করে আমার ঘরের পুতুলকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। আজ সেই পুতুল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো অথচ আমি কিছু করতে পারলাম না। সব আমার জন্য হয়েছে তাইনা বাবা? সব দোষ আমার। আমি আমার চাঁদকে যত্নে রাখতে পারিনি। আমি ব্যর্থ স্বামী। ব্যর্থ পুরুষ।”
বলেই আবার কাঁদতে লাগলো। এর মধ্যেই তানহা এসে পৌঁছালো সাথে রিহাব, রাফি, রামিম ও এসেছে। তামজিদের পাগলের মতো অবস্থা দেখে ওরা তিনজন দৌড়ে আসলো এদিকে। তামজিদকে শান্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তানহা তারিনের মাকে সামলাচ্ছে। রিহাব তামজিদকে চেয়ারে বসাতে বসাতে স্বান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“কাঁদিস না, ভাই। আমাদের বোনের কিছু হবে না। ও একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
রাফিও তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“ছোট বেলা থেকে বোনের অভাবে অভাবে বড় হয়েছি। কত আফসোস করেছি একটা বোন নেই বলে। এত বছর পর এসে আল্লাহ আমার বোনের অভাব পূরণ করেছিলো। উপরওয়ালা দিয়ে আবার নিশ্চয়ই কেড়ে নিবে না, বল? একদম চিন্তা করিস না। আমার বোন একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।”
বলেই রাফিও কেঁদে দিলো। সবার চোখের পানি। এভাবেই কেটে গেলো কিছু। সবাই অপেক্ষা ও ভীতিগ্রস্ত চেহারাপানে বসে আছে করিডোরে।
তারিনকে ও.টিতে নেওয়া হয়েছে মিনিট বিশ হবে। তামজিদ এখনো কাঁদছে। চোখের জলে সবকিছু ধোয়াশা হয়ে আসছে তবুও কাঁদছে। হঠাৎ করেই ও.টি রুম থেকে তামজিদের ডাক পড়লো। ইউসুব সাহেব তামজিদের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“তারিনের ডেলিভারি এক্ষুনি করাতে হবে নয়তো আমার মা, বাচ্চা কাউকেই বাঁচাতে পারবো না।”
তামজিদ শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। কিছু বলতে পারলো না। রাফি প্রশ্ন করলো,
“তারিনের এখন কি অবস্থা? আর বেবি ঠিক আছে তো?”
ইউসুব সাহেব তামজিদকে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“তুমি কাকে চাও?”
তামজিদ প্রশ্নোত্তর চোখে তাকালো। কাকে চাই মানে? তাহলে কি বাবা হওয়ার স্বপ্ন এখানেই শেষ করতে হবে? তামজিদ থেমে থেমে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
ডাক্তার জানালেন,
“মা বা বাচ্চা কাকে চাও?”
আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ৮
তামজিদ এক পা পিছিয়ে পড়লো। মাথার উপর আকাশটা যেনো ভেঙে পড়েছে৷ কী আশ্চর্য! এই ৮মাসের সব শখ, আহ্লাদ, আনন্দ, স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে? আর মেয়েটা যে এই সুখের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিলো! তার কি হবে? কিভাবে মনকে মানাবে? মা বাবা হওয়ার স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে গেলো। নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন?