পূর্ণতা পর্ব ৩২

পূর্ণতা পর্ব ৩২
নন্দিনী নীলা

পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে মায়ের রুমের সামনে। ভয়ে ও ঠকঠক করে কাঁপছে। গতকাল রাতেই বাবা এসেছেন। আব্বু আসার পর থেকে পূর্ণতা ভয়ে ভীত হয়ে আছে‌। ফোন ধরার সাহস করতে পারছে না। কিন্তু প্রভাতের সাথে কথা না বলেও থাকতে পারছে না।

এখন বিকেল আব্বু আম্মু দুজনেই ড্রয়িংরুম এ বসে আছে। পূর্ণতা এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেনি। তাই তো চোরের মতো মায়ের রুমে চলে এসেছে। পূর্ণতা ঢোক গিলে আড়চোখে চারপাশে চেয়ে চট করেই ভেতরে চলে গেল। মায়ের ফোন চার্জে লাগানো পূর্ণতা এগিয়ে এসে কাঁপা হাতে ফোন স্পর্শ করতেই দেখল ফোনে একটুও চার্জ নেই। ৫% চার্জ মাত্র, এদিকে চার্জে লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু লাইন নেই। আম্মু সুইচ অন করতেই হয়ত ভুলে গেছে। পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে ভাবল আব্বু বাসায় এসেছে। আম্মুর সব ধ্যান একজায়গায় জড়ো হয়ে গেছে। কোনদিকেই আর খেয়াল নেই। আব্বুর সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই তাই আম্মুর ফোনে চার্জ ও দরকার নেই। তাইতো এতো অবহেলা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পূর্ণতা তাড়াতাড়ি সুইচ অন করে চার্জে লাগিয়ে দ্রুত মুখস্থ নাম্বারে ডায়াল করে কানে ধরল।
বাই এনি চান্স যদি আব্বু এসে পড়ে। ভয়ে ওর হাত-পা থরথরিয়ে কাঁপছে। ও শুকনো ঢোক গিলে রিং হ‌ওয়া শুনছে। পূর্ণতা হার্টবিট বেড়ে গেছে ও বুকে হাত দিয়ে রেখেছে‌‌। কল রিসিভ হলো না পূর্ণতা বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয় বার কল দিতে যাবে পেছনে থেকে পূর্ণতার মা রোজিনা বেগম কথা বলে উঠল।
“ ওখানে কি করছিস?”

পূর্ণতার হাত থেকে ঠাস করে ফোনটা টেবিলে পরে গেল। ভয়ে ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। উত্তেজনায় কাঁপছে পূর্ণতা। মায়ের উপস্থিতিতে পূর্ণতা চোরের মতো ভয়ে আঁতকে উঠেছে।
রোজিনা বেগম কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসলেন। পূর্ণতা মায়ের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করতে লাগল।
রোজিনা বেগম ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ফোনে কি করছিলি?”
পূর্ণতা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল মায়ের দিকে‌।
রোজিনা বেগম কপাল কুঁচকে বলল,“ কেউ ফোন দিয়েছিল নাকি?”
পূর্ণতার চোখমুখ চিকচিক করে উঠল।

“ হ্যাঁ ফোনের আওয়াজ পেয়েই তো আমি আসলাম।”
বলে পূর্ণতা ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার দেখানোর সুযোগ নিয়ে তাড়াতাড়ি প্রভাতের নাম্বার কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শাহিন রুমে প্রবেশ করতেই পূর্ণতা মায়ের হাতে ফোন রেখে ছুটে চলে গেল।
রুমে এসে পূর্ণতা ভয়ে ভীত হয়ে বসে আছে। ‘একটুর জন্য বেঁচে গেছি। আম্মু যদি জানতে পারত আমি প্রভাত কে কল করেছি কি হতো?
কিন্তু একদিন তো আম্মুকে জানাতেই হবে তখন কি হবে? আম্মু কি খুব বকবে?’

‘ ধু্র কি সব যে ভাবছি আমি। আম্মু অবশ্যই প্রভাত কে মেনে নেবে। আর খুশি হবে অনেক। প্রভাত কে আম্মু অনেক পছন্দ করে। তাকে মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে পারবে না কেন? ছেলে হিসেবে প্রভাত পারফেক্ট ওকে অপছন্দ করার মানেই হয়না।’

পূর্ণতা খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল‌। প্রভাতের খবর কবে সবাইকে জানাতে পারবে? ইশ তারপর আর এমন লুকোচুরি করে কথা বলতে হবে না। সবার সামনেই কথা বলতে পারবে।
পূর্ণতা প্রভাতের সাথে ফোনে খুব বেশি কথা বলতে পারে না। যখনি কল লাগায় প্রভাত ওকে একটা ধমক দেয়, লুকোচুরি করে কল দেওয়ার জন্য। এতো ভয় পায় কেন প্রভাত?

কল দিলেই ধমকায় একটুও বুঝে না ওর তো কথা বলতে ইচ্ছে করে খুব। ফোনে ঘন্টার পথ ঘন্টা কথা বলতে ইচ্ছে করে। দেখাও তো বেশি করে না। এটা কোন প্রেম হলো? দেখা হয় না কথা হয় না কিচ্ছু হচ্ছে না। ওইদিন পার্কে মিরাকলি ভাবে দেখা হয়েছিল তারপর আর দেখা হয়নি। ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি।
পূর্ণতা নাক লাল করে বসে আছে।

বিড়বিড় করে বলল,“ বেশি ভালোবাসি তো তাই বেশি ভাব। একবার আমার সুযোগ আসুক আমিও দেখিয়ে দেব।”
রাতে পূর্ণতা খাওয়ার টাইমে চুপিচুপি মায়ের ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। সবাই খেতে নিচে চলে গিয়েছে। পূর্ণতার ও ডাক পড়ল পূর্ণতা চেঁচিয়ে বলল,“ আম্মু আমি একটু পর আসছি তোমরা খেতে শুরু করে দাও।”
এবার খুব দ্রুত প্রভাত কল রিসিভ করল।
প্রভাত কল‌ রিসিভ করেই বলল,“ পূর্ণতা তোমাকে এতো বার করে বারণ করার পর ও তুমি কল দেওয়া বন্ধ করতে পারছ না?”

পূর্ণতা রাগী কন্ঠে বলল,“ সত্যি করে বলো তুমি আমায় ভালোবাসো তো? সেইদিন তুমি আমায় মিথ্যা বলেছিলে তাই না? তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আমার সাথে নাটক করেছ তাই না?”
বলতে বলতে পূর্ণতা ফুঁপিয়ে উঠল।
“ কি বলছো? মাথাটা কি নষ্ট হয়ে গেছে?”

“ ঠিকি বলেছি।‌ ফোন দিলে কেমন ভাব দেখাও। অথচ এটা দেখো আমি কত কষ্ট করে তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য উন্মাদ হয়ে থাকি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ফোন হাতে নেয়। তোমাকে ফোন দিলে একটু সুন্দর করে কথা বলবে। প্রেম ভালোবাসার কথা বলবে, তা না সব সময় ধমক দিয়ে রাখো। জানো আজকে কত কষ্ট করে ফোনটা হাতে নিয়েছি। বিকেলেও তোমায় কল দিলাম তুমি রিসিভ করলে না। তুমি ইচ্ছে করে আমার কল রিসিভ করোনি আমি জানি। তোমার আমার কল দেখলেই বিরক্তি লাগে। সেদিন ভুল করে দেখা হওয়াতে তুমি বিরক্তি ছিলে কিন্তু মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করেছ। এখন বুঝতে পারছি। এইযে এক সপ্তাহ হয়ে গেল তুমি আমার সাথে দেখা করো না। ঠিকমতো কথা বলো না। এটা কোন রিলেশন হলো বলো তো। হঠাৎ দেখা হলে শুধু ভালোবাসা দেখাও এছাড়া তো আমাকে তুমি ভুলেই যাও।”

পূর্ণতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। প্রভাত থমকে চুপ করে গেছে। পূর্ণতা কান্নায় ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও পূর্ণতার সাথে কথা বলার রিস্ক নেয় না ভয়ে। যদি বাসার কেউ জানতে পারে এই ব্যাপার মানসম্মান সব শেষ হবে।
ওই বাসায় বিপদের সময় থেকেছে। এখন যদি তারা জানতে পারে পূর্ণতার সাথে ওর সম্পর্ক আছে। তখন তারা বলবে বিশ্বাসেল সুযোগ নিয়েছে।

প্রভাত চায় না ওর জন্য পরিবার অপমানিত হোক। এজন্য পূর্ণতার কল দেওয়াটা ও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনা। কারণ এই ফোনটা ওর নিজের নয়। এভাবে লুকিয়ে ফোন দিতে গিয়ে যদি ধরা পরে যায়? ভয়ে তটস্থ থাকে প্রভাত।
প্রভাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ পূর্ণতা প্লিজ শান্ত হ‌ও।”

পূর্ণতা নাক টানতে টানতে বলল,“ আমি শান্ত হবো না। তুমি যদি আমায় ভালো না বাসো তাহলেও তুমি আমার থেকে নিস্তার পাবে না। তোমায় আমাকেই ভালোবাসতে হবে বুঝেছ। তোমার পূর্ণতা ছাড়া আর কোন গতি নেই। হু।”
প্রভাত হাহাহা করে হেঁসে উঠল ওর কথা শুনে।
প্রভাত বলল,“ আচ্ছা ম্যাডাম। এবার রাখেন। কেউ দেখে ফেলবে আমি কাল কলেজে দেখা করতে আসব। ওকে।”
কাল প্রভাত কলেজে আসবে শুনে পূর্ণতা খুশি হয়ে গেল বলল,” তুমি না আসলে, আমিই চলে আসব।”

“ আমিই আসব।”
“ ওকে মনে থাকে যেনো।”
“ থাকবে। এবার রাখি ?”
পূর্ণতা লাজুক কন্ঠে বলল,“ না একটা জিনিস লাগবে..”
প্রভাত ওর লাজুক স্বর শুনে বলল,“ কি লাগবে? তাড়াতাড়ি বলো তোমার আম্মু চলে আসবে তো।”
“ আসতে পারতে না দরজা আটকে রেখেছি।”
“ বেশি সাহসী হয়ে গেছো। ফোন তোমার কাছে জানলে কি হবে ভাবতে পারছ?”
“ জানবে না তুমি তাড়াতাড়ি একটা কিস দাও না।”
“ হোয়াট?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রভাত।

পূর্ণতা জড়োসড়ো কন্ঠে বলল,“ কি হলো আমি এতো কষ্ট করে ফোন ম্যানেজ করে তোমায় কল দিলাম আর তুমি আমায় একটা সামান্য কিস দিতে পারবে না?”
“ দেব না কখন বললাম‌। তুমি আমার কাছে আসো একটা না আরো বেশি দেবো।”
“ এখানেই দাও।”
” এখানে কোনখানে দেব?”
“ ধুর ফোনের ওপাশ থেকে দাও না সবাই যেভাবে দেয়।”কপাল কুঁচকে এলো প্রভাতের।
“ সবাই মানে কে দেয়?”
” আরে আমাকে দেয় না। আমার বান্ধবীদের দেয়। ওরা বলেছে কল কাটার আগে সবার বয়ফ্রেন্ড কিস দেয়।”
“ আমি ফোনে কিস দেব না তোমায় দেব।”
“ ধু্র আন রোমান্টিক।”

বলেই পূর্ণতা একটা শব্দ করে কিস দিল। প্রভাত বলল,“ আমাকে সরাসরি দিতে হবে এভাবে দিলে হবে না।”
“ পারব না। নিজে তো সেটাও দিতে পারো না।”
“ আমি এতো অভিজ্ঞ না। আগে কোন গার্লফ্রেন্ড কে তো দেই নাই।”
“ ঢং আমি মনে হয় কত জনকে দিয়েছি।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল পূর্ণতা।
“ কথায় কথায় রাগ করো কেন? আমি সেটা কখন বললাম?”
“ তাড়াতাড়িই কিসি দিয়ে দাও।”
“ জেদি মেয়ে।”
“ হয়।”

পূর্ণতা তাড়াতাড়ি ফোন জায়গায় রেখে নিচে এসে দেখল খাওয়া অর্ধেক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খেতে বসতেই ওর বাবা ওকে ডেকে উঠলেন,“ পূর্ণতা।”
পূর্ণতা পিল চমকে উঠল। ও ভয়ার্ত চোখে তাকাল শাহিন আলম এর দিকে। প্রভাতের সাথে লুকিয়ে প্রেম করার পর থেকে পূর্ণতা ভয়ে ভীত হয়ে থাকে। কেউ ডাকলেই মনে হয় বকার জন্য ডাকছে। কি একটা অবস্থা নিজের বাসায় নিজেকেই চোরের মতো থাকতে হচ্ছে।
কাঁপা কন্ঠে পূর্ণতা বলল,” জি আব্বু।”

তিনি খেতে খেতে বললেন,“ পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়েছ দেখে ভালো লাগছে। কিন্তু ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে।”
রোজিনা বেগম ফোড়ন কেটে বললেন,” তোমার মেয়ে না খেয়ে থাকার না‌। রাগ জেদ তো কম না। তুমি বাসায় এসেছে তাই এতো ভদ্র হয়ে উঠেছে। নয়ত বাড়ি মাথায় তুলে রাখে।”
পূর্ণতা কটমট দৃষ্টিতে তাকাল মায়ের দিকে। একি মা নাকি শত্রু কেমন অভিযোগ করছে। মা জানে না ও বাবাকে কতটা ভয় পায় এসব বাবাকে বলার কি প্রয়োজন?
রোজিনা বেগম বললেন,“ বাপকে দেখে সুশীল হয়ে গেছে। সারাবছর থেকে দেখো এর বাড়াবাড়িতে তুমি অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।”

শাহিন আলম স্ত্রীর অভিযোগ শুনে হো হো করে হেঁসে উঠল। পূর্ণতা মাথা নিচু করে ভাত নাড়ছিল। ভেবেছিল মায়ের জন্য আজ বাবার কাছে ধমক খেতে হবে কিন্তু ওকে বিস্মিত করে দিয়ে শাহিন আলম কিছুই বললেন না। হাসতে হাসতে বাকি খাওয়াটা শেষ করে উঠে চলে গেলেন।
পূর্ণতা অবাক হয়ে বাবার যাওয়ায় দিকে চেয়ে বলল,’আব্বু আমায় বকলো না!’

পূর্ণতা পর্ব ৩১

পরদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতের অপেক্ষায়। প্রভাত বলেছিল আজ আসবে। কিন্তু আসছে না কেন? রাগে দুঃখে পূর্ণতার চোখ ছলছল করে উঠল। খুব অভিমান হলো। অভিমানে ওর চোখে জল চিকচিক করতে লাগল।

পূর্ণতা পর্ব ৩৩